আমি মতিলাল – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

আমি মতিলাল – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

আমি মতিলাল     (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

একটু শুনবেন, আমি মতিলাল বলছি। মতিলাল রায়।
এইমাত্র আমি একটা খুন করলাম জানেন। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। একটা ভীরু পরমুখাপেক্ষী পরাশ্রয়ী লোককে গুলি করে মেরে দিলাম। আমার দু’নলা বন্দুকটা, ওই যে পড়ে রয়েছে লাশটার পাশে, ওটা দিয়েই খতম করলাম। নিশানা নিখুঁত ছিলো আজও। শুধু বন্দুকের ট্রিগার চাপার সময় আমার ডান পা-টা কেঁপেছিলো সামান্য। কারণ আছে, সে কথা বলবো ঠিক সময়ে।
আজ সাত আট মাস আর সহ্য করতে পারছিলাম না আমি ওই লোকটাকে। মানে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। বিশ্বাস করুন লোকটার এই অবস্থা দেখে আমার করুণা তো হতোই না, বলতে পারেন ঘৃণা হতো। ভীষণ ঘৃণা। বেঁচে থাকায় আনন্দ যদি না থাকে তবে কি লাভ বলুন বেঁচে থেকে। তাই শেষ করে দিলাম। আর হ্যাঁ, জীবনে আজই প্রথম খুন করলাম আমি।

ভীতু লোকটাকে যে মেরে ফেলতে হবে সেটা আমি ভাবছিলাম বেশ কিছু দিন ধরেই। তবে আজই খুন করবো সেটা ভাবিনি আগে। মানে তিথি নক্ষত্র দেখে বোধ হয় খুন হয় না। গতকাল রাতে ঠিক করলাম আর নয়, অনেক হোলো। এইবার ওর মুক্তি পাওয়া উচিত।
গতকাল রাতের ঘটনাটা বলি। ছাদে পায়চারি করছিলো দিনু। মনটা খারাপ। আড়ালে থেকে আমি লক্ষ্য রাখছিলাম লোকটার উপর। বিছানায় শুয়ে লোকটা তাকিয়ে ছিলো জানালার ওপারের কালো আকাশের গায়ে। মনে মনে মৃত্যুর করুণ দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছিলো। নক্ষত্রের সঙ্গে নক্ষত্র অদৃশ্য রেখায় যোগ করে যে চিত্র আঁকছিলো তাতে মরণের সুস্পষ্ট ছবি আমিও দেখতে পাচ্ছিলাম। হ্যাঁ, সেই মরণের ছবি আমি স্পষ্টভাবেই দেখেছি গতকাল রাতে। লোকটা তন্ময় হয়ে ছিলো । যেনো বিস্ময়কর এক মৃত্যুচিত্র এঁকে তাক লাগিয়ে দেবে সবাইকে। আর ঠিক তখনই জানালার কার্ণিশে বসে থাকা রাতজাগা পাখিটা আচমকা ডেকে ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো। লোকটা ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিলো। তখনই আমি ঠিক করলাম মেরে ফেলবো লোকটাকে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।
রাতজাগা পাখি যে আগে কখনো লোকটার কানের পাশে আচমকা ডাকেনি এমন নয়। ডেকেছে। বিশ্বাস করুন সে পাখির ডাক শুনে লোকটা পৃথিবী কাঁপিয়ে এমন হাসতো যে নিঝুম নিশুতি চরাচরের সমস্ত রাতজাগা পাখি ভয়ে ডানা মেলতো আকাশে। লোকটা সারা জীবন ভয়কেই ভয় পাইয়ে এসেছে। এক বর্ণ মিথ্যে নেই আমার এ কথায়। আমি নিজে দেখেছি সেই সব ঘটনা। আর আজ সেই মানুষের এমন অবস্থা! মানে মরেই গেছে ও এটা বুঝে গেছি আমি। তাই…

লোকটা এমন ছিলো না জানেন। ভীষণ সাহসী। ভয়ডর হীন পাথরকঠিন একটা মানুষ। তাকে নিয়ে আমার গর্ব আর অহংকার দুইই ছিলো। অমন একটা বাঘের মতো মানুষ যে এমন হয়ে যাবে ভয়ে, আমি মানতেই পারিনি। তাই পুলিশ, জেল এই সবের পরোয়া না করে খতম করে দিলাম। এই বয়সে জেল পুলিশের ভয় আর পাই না। তাছাড়া পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া কি এমন কঠিন কাজ বলুন। ওদের চোখে ধুলো দেওয়া বাহাদুরি নয় মোটেই। সারা দুনিয়াতে কতো খুনিই তো ঘুরে বেড়ায় পুলিশের সামনে। আমিও না হয়…
আমার কথা থাক। সেটা শেষেই বলবো। আগে ওই ভীতু লোকটার কথা বলি। মানে লোকটা ভীরু হয়ে উঠলো কীভাবে।

রোগে ধরলো জানেন। বেশ কঠিন রোগ। সে সাত আট মাস আগের কথা। দু চার সপ্তাহ কম বেশিও হতে পারে। একদিন সকালে ওর বমি হোলো। সেটা নতুন কিছু নয়। বমি আগেও হয়েছে। রাত জেগে মদ্যপান করলে এমন বমি হয়। তবে এবারের সমস্যা অন্য রকম। রক্ত বমি। সঙ্গে প্রচন্ড যন্ত্রণা পেটে বুকে পিঠে, বলতে পারেন সর্বাঙ্গে। প্রথমে ভেবেছিলো দু এক দিনের মামলা। ঠিক হয়ে যাবে এমনিতে। ভাবাই সার। দিন কতক বিছানা নিতে হলো লোকটাকে। এবারই প্রথম। আগে রোগে এমন কাবু হয়নি কোনোদিন। দিনু বললো, চলো ডাক্তারের কাছে যাবে। শরীরে জমিদারি রক্ত, মেজাজও তেমনই। দিনু বললেই মানবে কেনো লোকটা। তবুও রাজি করালো দিনু। বহু দিনের পুরনো সঙ্গী তো। তাই লোকটা দিনুর কথা ফেলতে পারেনি। দিন কতক কলকাতার আস্তানায় থেকে চিকিৎসা করালো। টেস্ট হোলো নানা রকম। শেষে ডাক্তার শোনালো অন্য কথা। লিভারের রাজ রোগ। তার বিষ ছড়িয়েছে সারা শরীর। নিরাময়ের আশা নেই আর। ব্যস। লোকটা যে বাঁচবে না এই কথাটাই না বাঁচার কারণ হলো । ভিতরে ভিতরে লোকটা মরতে শুরু করলো সে দিন থেকেই। অমন পাষাণ কঠিন মনের জোর তরল হয়ে উবে যেতে লাগলো দিনে দিনে। আর একটু একটু করে নিজেকে মৃত্যুর কোলে সঁপে দিলো লোকটা। শুরু করলো দিন গোনা। রোজ রাতে আকাশের গায়ে মৃত্যুর করুণ ছবি ফুটিয়ে তুলতো। দিনু বোঝালো খুব। চলো ভিন রাজ্যের ডাক্তার দেখিয়ে আনবো। রাজি হলো না। হয়তো মৃত্যুর নিশ্চিত পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলো। দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলো শেষ দিনের ভয়ানক পরিণতি। একটু একটু করে সিঁদ কেটে লোকটার মনে জায়গা নিলো ভয়। ধীরে ধীরে পল্লবিত হোলো তার ঘন ছায়া। আর লোকটা নিজেকে পরাশ্রয়ী ভাবতে লাগলো। হয়ে উঠলো পরমুখাপেক্ষী ভীতু মানুষ। রাতে ঘুম থেকে উঠলেও দিনুকে ডাকতো।
লোকটাকে আমি ভীষণ ভালবাসতাম আগে। মানে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় তেমন আর কি। কিন্তু এ লোকটা যেনো আমার সেই ভালোবাসার লোকটার কঙ্কাল। আমার অসহ্য হয়ে উঠলো। তাই…
দিনুও তো ভীষণ ভালোবাসত লোকটাকে। আজ প্রায় চল্লিশ বছর ওর সঙ্গে রয়েছে দিনু। ওর মৃত্যুর কথা ভেবে আড়ালে কাঁদত দিনু। খুব কাঁদত। আমি নিজে দেখেছি জানেন। তবে শেষ চেষ্টা করেছিলো দিনু । কোথা থেকে খবর পেয়েছিলো দুমকায় কে একজন কবিরাজ আছে। ধন্বন্তরি। তার জরিবুটি নাকি এই সব রোগে কথা বলে। দিনু এনেছিল সেই কবিরাজি ওষুধ। খাওয়াতে লাগলো লোকটাকে নিয়ম মতো। তবে মদ্যপান না ছাড়লে কাজ দেবে না ওষুধ। দিনু বললো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, অনেক হোলো এবার অন্তত ছাড়ো। ছাড়ো বললেই কি ছাড়া যায়। মদিরা তো শুধু নেশা ছিল না লোকটার। মদিরার মৌতাতে ভেসে যেতো তার অতীতে। না জানি কি ছিলো সেই ফেলে আসা সময়ের গর্ভে। শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা তাও মদিরা চাইই। কারন…

নিঝুম রাতে বহুদূর থেকে সম্ভবত কোনো না দেখা নক্ষত্র থেকে নূপুর নিক্কন ভেসে আসতো। শুনতে পেতো লোকটা। ধীরে ধীরে সেই শিঞ্জন তার শিরা, ধমনী হয়ে হৃদপিণ্ডে আসর বসাতো। যতো গভীর রাত ততো স্বচ্ছ সেই নূপুর ধ্বনি। ততো উৎকণ্ঠা লোকটার। তারপর তারপর একটা বিকট চিৎকার শুনতে পেতো। ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় বা অসহনীয় কোনো দৃশ্য দেখলে কোনো মহিলা যেভাবে চিৎকার করে ওঠে ঠিক সেই রকম একটা ভীষণ চিৎকার থামিয়ে দিতো নূপুরের শব্দ। আর টুকরো টুকরো হয়ে যেত সেই জমাট আসরের আমেজ। তারপর ক্ষণিক গাঢ় বিরতি। নিটুট নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যেতো আনন্দের স্ফুলিঙ্গগুলি। একটা পুরুষ কণ্ঠ জেগে উঠতো তারপর, রাতের নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে। দাপিয়ে বেড়াতো বেশ কিছুক্ষণ। যেনো শাসন করছে কাউকে বা নির্যাতন। তারপর আবার নূপুর বাজতো আর আবহে চলতো বিরামহীন ক্রন্দন। আকুল করে তুলতো লোকটাকে সেই হৃদয় ভাঙা কান্না। যতো আকুলতা ততো মদিরা। যতো মদিরা ততো মৌতাত। একটা সময় ঘুমিয়ে পড়তো লোকটা। ঘুম ভাঙলে মাঝে মধ্যে বমি হতো। এই রকম বহুবারই হয়েছে। এই সবই জানতাম আমি। দুশ্চিন্তা করিনি কোনো দিন। ওই মহিলার কান্নার সুর নিশি ডাকার মতো ডাকতো লোকটাকে। যেন সেই কান্না তার আপনজনের। যাকে তার স্পষ্ট মনে পড়ে না। তন্দ্রাচ্ছন্নতায় ক্ষণিকের স্বপ্ন দেখার মতো অস্পষ্ট। কিংবা আকাশের বিদ্যুৎ বিকাশের মতই ক্ষণস্থায়ী।

দিনু বলতো পুরনো কথায় কাজ কি আর। যার সঙ্গ পাওনি কোনোদিন তার দুঃখে চোখের জলই বা কেনো। দিনু বললেই কি বন্ধ হয় সেই নূপুর ধ্বনির আবহে করুণ কান্নার সুর শোনার নেশা। তাই পরদিন আবার সেই নূপুর ধ্বনি, সেই পুরুষ গলায় শাসন আর সেই আকুল করা কান্না। আবারও পরদিন একই ঘটনা। এই ভাবেই ভেসে যাওয়া লোকটার। নিঝুম রাতের কান্নায় নিজেও কখনো সুর মিলিয়েছে। সজল চোখে গায়ে হাত বুলিয়েছে দিনু। অনেক কষ্ট করে ঘুম পাড়িয়েছে লোকটাকে। সকালে আবার বাঘের মত গর্জন করেছে লোকটা। সেই মানুষের এমন পরিণতি! ঘৃণা ছাড়া আর কিই বা করার ছিলো আমার?
আজ দুপুরে আমার বন্দুকটা নিলাম জানেন। বড্ড ভারী মনে হলো বন্দুকটা। হতে পারে অনেক দিন হাতে নিইনি তাই। তবুও নিজেই নিলাম। দিনু কে বললাম চল দেখি আমার নিশানা আগের মতই আছে কিনা। দিনু খুব খুশি আমার কথা শুনে। ভীরু লোকটাও আমার সঙ্গ নিলো। আমিও সেটাই চেয়েছিলাম। বিলের মাঠে পৌঁছে ঠিক করলাম এইবার…
কিন্তু সমস্যা হলো দিনু। দিনু থাকলে আমি কিছুতেই খুন করতে পারবনা লোকটাকে। তাই বললাম, যা তো দিনু জমির ওই কাকতারুয়াটা সোজা করে দে। দিনু মহানন্দে ছুটে গেলো জমির দিকে। আর আমি…
খবরটা শিমূল তুলোর মতো ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। লোকজন এসেছে। সবাই অবাক। বলছে মতিলাল করলো এমন কাজ! শুনে হাসি পায় আমার জানেন। কেনো? কাউকে খুন করা কি আমার মানা ছিলো? প্রয়োজনে তো মানুষ নিজেকেও শেষ করে। করে না? বলুন?
সুযোগ বুঝে আমি সরে পড়েছি। বন্দুকটাও আর সঙ্গে নিইনি। প্রয়োজন ফুরিয়েছে সেটার। লাশটার পাশেই পড়ে রয়েছে বন্দুকটা, ওই দেখুন। পায়ে ট্রিগার চেপে আমি ফায়ার করতে পাড়বো এটা ভাবতেই পারেনি দিনু।
কৌতূহলী জনতার বলয় ঘিরে রেখেছে লাশ, বন্দুক আর দিনুকে। প্রিয়জনের এইভাবে চলে যাওয়ায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে দিনু। ওরও তো বয়স হয়েছে। একলা হয়ে গেলো এইবার। আজ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় দিনু ওই লোকটার সঙ্গী ছিলো। ভীষণ খারাপ লাগছে জানেন দিনুর জন্য। ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু আর কিই বা করতে পড়তাম আমি? এইভাবে ভীরু পরজীবী হয়ে কি বেঁচে থাকা যায়, নাকি সেটা ওই লোকটার নিজের জন্য গৌরবের হতো বলুন।
দেখুন, আর কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ আসবে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে দিনুকে। তারপর সামান্য তল্লাশি চালিয়ে লাশটার জামার বুক পকেটে এক টুকরো কাগজ পাবে, লেখা আছে ‘আমার স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। অসম্ভব যন্ত্রণার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে নিজেই নিজেকে মুক্তি দিয়েছি আমি, ইতি মতিলাল রায়।’