কটন
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য
“কটন হবে?”
প্রশ্নটা কানে এলো।
মেজর ফ্র্যাকচার, অপারেশন থিয়েটার থেকে কেবিনে দিয়ে গেছে আমাকে। শুয়ে আছি বেডে। যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচাতে ওষুধ দিয়েছে। শরীরের সমস্ত স্নায়ু নিস্তেজ প্রায়। তদ্রাচ্ছন্ন দৃষ্টি কেবিনের সিলিংয়ে হেঁটে চলেছে, অনাগত দিনের দুর্ভাবনা তার সঙ্গী। শুনলাম, “কটন হবে?” আমি ছাড়া কেবিনে আর কেউ ছিলো না। স্ট্রেচার থেকে ডান পাশের বেডটা দেখেছিলাম, খালি ছিল। প্রশ্নটা সেদিক থেকেই এসেছে। হতে পারে সে সময় টয়লেট বা অন্য কোথাও গিয়েছিল রোগী। এখন ফিরে এসেছে বেডে। বা আমার দেখার ভুল, আসলে রোগী বেডেই ছিল। হতেই পারে। তবে যেটাই হোক প্রশ্নকর্তাকে দেখার উপায় নেই আর। ঘাড় ঘোরানো অসম্ভব আমার পক্ষে। যন্ত্রণা লিপ্ত কণ্ঠে জানতে চাইলাম, “আমাকে বলছেন?”
“আপনি, আমি ছাড়া আর কেউ নেই এখানে। কটন আছে ?”
বিরক্ত হলাম। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো বৃদ্ধ। নিস্তেজ স্বরে পরামর্শ দিলাম, “সিস্টার কে বলুন।”
মনে হয় না শুনেছেন আমার কথা। এইবার নিজেই বলে চলেছেন উনি, শেষ আট দশ দিনের সমস্ত ঘটনা। আর্টারি ব্লকেজ। অপারেশন হয়েছে। ছেলে কাছে নেই। চিন্তা হচ্ছে নানা রকম। তবে এই মুহূর্তে ওনার অস্বস্তির কারণ অন্য। নাকের ভিতরে ব্লিডিং। সেটা ক্রনিক প্রবলেম। ন্যসাল সেপট্রম ডেভিয়েশন, মাঝে মধ্যেই ব্লিডিং হয়।
ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, “আমার বাবারও ছিলো।”
“ছিলো মানে, এখন কিওরড?”
“বাবা আর নেই।” সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার।
ছেদ পড়েছে ওনার কথায়। এসির ঝিঁ ঝিঁ শব্দ কেবিনের মৌনতায় বিদ্রোহ জানিয়ে চলেছে অবিরত। দুচোখ বন্ধ করেছি। ছেলের মুখটা ভেসে এলো। এমন হয়তো সবারই হয়। জীবনমরণের দৃশ্যমান সীমানায় দাঁড়িয়ে সন্তানের কথা মনে পড়ে সবার।
“অতনু।”
বিকাশ এসেছে। আমার বন্ধু। চেষ্টা করলাম দুচোখ খোলার। ঘোলাটে অস্পষ্ট দৃষ্টি। আমার স্ত্রীও রয়েছে দাঁড়িয়ে। স্ত্রীকে দেখে আবার ফুটে ওঠে আমার একমাত্র ছেলের মুখটা। তুমুল অসহায়তার কবলে আমি।
“বাইপাস সার্জারির পর শেষ কয়দিন এই কেবিনেই রেখেছিল কাকুকে।” আমার স্ত্রীকে বলছে বিকাশ। এইসব কথা জানি না আমি। বাবার মৃত্যুর সময় এ দেশে ছিলাম না। বিকাশ ছিলো আমার বাবার পাশে।
“ডোন্ট ওরি। রেস্ট নে, কাল আসবো।”
চলে যাচ্ছে ওরা। অনেক কষ্টে বলতে পারলাম, “পাশের বেডের ভদ্রলোকের তুলো লাগবে, ব্যবস্থা কর।”
“পাশের বেড? খালি তো!” বললো বিকাশ।
— খালি! তাহলে…!