
চোরাবালির চর ছোটোগল্প
নিধির রায়
একটা ভয়ংকর ব্ল্যাকহোলের ভেতর পড়ে গেছে সুহাস। সে কিছুতেই তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা সেই ব্ল্যাকহোলের রাস্তা ধরে চলে যায় দূরে একটা কানা গলির মধ্যে। গলির এক নিভৃত কোণে থাকে তার কাঙ্ক্ষিত নায়িকা, বাসবী, তার অফিসের হার্টথ্রব – সকল পুরুষের শ্বাসরোধ করা ক্রাস। নিজের প্রবৃত্তির কাছে সে একেবারেই অসহায়। সে জানে তাকে এই পিচ্ছিল দলদল থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কঠোর মানসিক শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে বারবার নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করে। কিন্তু কী একটা নিঠুর আর ভয়ানক সুন্দর সাপের কোমল কুণ্ডলীর প্যাঁচ তার সত্তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। সে সাপের বিষে নেশা জাগে, বিবেক মনুষ্যত্ব বিলোপ হয়ে যায়। অবশ হয় সমস্ত জাগতিক বোধ। সে সহজেই তার স্ত্রী কন্যার কাছে অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে তখন, বাসবীর জন্য, আশ্চর্য!
বাসবী তাকে মিথ্যে বলাতে পারে এমন! একটা প্রবৃত্তি, একটা ভয়ানক প্রবৃত্তি তাকে সেই দলদলের পথে টেনে নিয়ে যায় প্রতিদিন!সে যায়, রোজ যায়। ভুলে যায় সব, সন্তানের কোমল বাৎসল্য, স্ত্রীর আহ্লাদী রভস।
— রোজ রোজ কোথায় যাও? জয়ন্তী জিজ্ঞেস করে।
জয়ন্তী সুহাসের স্ত্রী। সুহাসের বাবা শখ করে গ্রামের সুন্দরী মেয়েকে ছেলের বৌ করে এনেছে ঘরে। ঘর আলো করে আছে। তুতুন তার মেয়ে। বিয়ের একবছরের মাথায় তুতুন এসেছিল তাদের জীবনে। তুতুন এখন চারে পড়েছে।
জয়ন্তীর প্রশ্নটা কানেই যায় না যেন সুহাসের।
জয়ন্তী আবার জিজ্ঞাসা করে, কোথায় যাও এ্যা, দিন দিন কী চেহারা হচ্ছে, ছিঃ, চোর-লুচ্ছার মতো হচ্ছো দেখতে তোমাকে। তুমি তো এমন ছিলে না!
চোর-লোচ্চার মতো হয়ে যাচ্ছে তার চেহারা! সদা সুশীলা জয়ন্তীর মুখে এমন অভিধা শুনে মাথায় আগুন চড়ে সুহাসের। ইচ্ছে হয় একটা চড় মেরে সব দাঁত ফেলে দেয়। কিন্তু পারে না। সেই রকম জোর পায় না সুহাস। সে হঠাৎ আবিষ্কার করে তার সেই পুরুষালি বিক্রম কোথায় গেল? কোথায় গেল সেই দৃঢ়তা? অবলা স্ত্রীকে পর্যন্ত শাসন করতে পারছে না সে? কে যেন তার সমস্ত পৌরুষ শুষে খেয়ে নিয়েছে এত দিনে।
সে তাড়াহুড়ো করে কটা ভাত নাকে মুখে গুঁজে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় অফিসে। সন্তানকে আদর করার কথাও মনে থাকে না।
জয়ন্তী পেছন থেকে ডেকে শ্বশুরের জন্য ওষুধ আনতে মনে করিয়ে দেয়,
— আজ কিন্তু আনতেই হবে বাবার প্রেসারের ওষুধ, কতদিন ধরে ভুলে যাচ্ছ।
সুহাস ঘাড় কাত করে, ভাবেসাবে ভেসে ওঠে অনিশ্চয়তার ছায়া।
নিরাশ হয় জয়ন্তী। অদৃষ্টকে দোষ দেয় সে।
ইদানীং বেশ রাত করেই বাড়ি আসে সুহাস। শরীরে একটা মিষ্টি গন্ধ লেগে থাকে। তার ছোট্ট মেয়েটাও বুঝতে পারে এই গন্ধ তার বাবার শরীরের গন্ধ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সে নাক কুঁচকে বলে, এই গন্ধ তোমার নয় বাবা, কোথা থেকে মেখে আসো? জয়ন্তী কটমট করে তাকায় সুহাসের দিকে। সুহাস জড়িয়ে ধরতে ধরে আদর করতে চায় মেয়েকে, মেয়ে দৌড়ে পালায়। বলে যায়, আমার শরীরে ঐ গন্ধ লেগে যাবে, ছি গন্ধ, আমার ভালো লাগে না। আমার শুধু তোমার আর মায়ের শরীরের গন্ধই ভালো লাগে।
জয়ন্তী ভেতরে ভেতরে মরছে একটু একটু করে। সুহাস নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট মানুষ। ভ্রষ্ট মানুষ। তাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজানো যায় না আর। একটা কিছু করতেই হবে। তার দেহাতি মেরুদণ্ডটা হঠাৎ খুব শক্ত হয়ে ওঠে।
রাত বেড়ে গেছে। পাশের উঁচু বাড়িটার জানালার আলো নিঃশব্দে নিভে গেছে একে একে। কৃষ্ণা অষ্টমীর আধখানা চাঁদ লুকিয়ে পড়েছে পশ্চিম আকাশের একরাশ ধূসর মেঘের ভেতর। জয়ন্তী যেন দেখতে পাচ্ছে সেই মড়া চাঁদের আলোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটা আস্ত সাপ। সাপটা একটা বিশাল ফণা তুলে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সাপের মাথায় বসে আছে একটা বিবস্ত্র নারী, সাপটা মহাকাশের শূন্যতা মুহূর্তের মধ্যেই অতিক্রম করে তার জানালার বাইরে এসে কাচের উপর ফুঁসফাঁস ছোবল বসাতে লাগলো এলোপাতাড়ি। নারী মূর্তিটা উল্লাসে হি হি করে ভয়ংকর হাসছে। জয়ন্তী চিৎকার করে সরে এলো জানালার কাছ থেকে। জয়ন্তীর চিৎকার শুনে তার শ্বশুরমশাই ওঠে এলো ,’কী হল বৌমা।’
— কিছু না বাবা।
— সুহাস আসেনি?
— না।
— এত রাত হলো, এলো না এখনো? ফোন করেছিলে?
— স্যুইস অফ।
— কী যে করে বুঝি না। একটা কিছু বিহিত করতেই হবে।
তুতুন এখন আর বাবার জন্য অপেক্ষা করে না। খাইয়ে দিলে মায়ের সাথে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ে।