
স্বপ্ননদীর অপর পাড়ে (ছোটোগল্প)
প্রসেনজিৎ রায়
শনিবার থাকায় স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি। বাড়িতে তিনটার আগেই চলে এসেছে দেবা। বাড়িতে আসার পর থেকেই মুখটা বাংলার পাঁচ করে রেখেছে। নির্মলের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে স্কুলে কিছু একটা হয়েছে, তবু জিজ্ঞেস না করে খেতে ডাকল — আয় দেবা, খাইয়া লা ভাত।
— না খাইতাম না আমি ভাত। কাঁদোকাঁদো স্বরে দেবার উত্তর।
— কেনে বেটা, কেউ কিচু কইচে নি ইস্কুল ও।
— বাবা, তুমি আমারে থুবাইয়া আনচো নি।
— কে কইচে তরে অতা ? হুদ্দা মাত।
— তে সবের মা আচে আমার নাই কেনে।
— তর মা আচলো রে, ঠাকুর এ নিচইন গি।
— অত মানুষ থাকতে আমার মারে কেনে নিলা ?
আর প্রশ্নের উত্তর দেয় না নির্মল। দুহাতে জড়িয়ে ধরে দেবাকে বুকের মাঝে। বাবা হওয়ার মাঝে যে প্রশান্তি, যে স্বস্তি তা দেবাকে না পেলে কোনোদিন বুঝতেই পারতো না নির্মল। নির্মলের বাড়ি ধর্মনগরের রাঘনা সীমান্তের পাশাপাশি। আর্থিক অবস্থা বড় করুণ। মা বাবা অনেক আগেই গত হয়েছেন। ছোটো সাত বোন ছিল। তাদের বড় করে সংসারী করার দায়িত্ব পালন করতে করতেই নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়টুকু পায়নি নির্মল। যখন সময় পেয়েছে সব দায়িত্ব সামলে নিজের দিকে তাকানোর ততদিনে বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে অনেক। তাই বাকি জীবনটা একাই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্মল তার বাড়ির পাশের জুরি নদীর কলতানের গানকে সঙ্গী করে। ছোটোবেলা থেকেই নদী তার একমাত্র সাথী। দুঃখ, অভিমান, ক্ষোভ যখনই মনে দানা বেঁধেছে নদীর গান তাকে শান্তি দিয়েছে। ছোটোবেলা হাজার স্বপ্ন এঁকেছে মনে মনে এই নদীর বালুচরে বসে। স্বপ্নে কখনো উত্তম কুমার কখনো বা কিশোর কুমার, আর জুরি সঙ্গ দিত সুচিত্রা, লতা হয়ে। আবার ধীরে ধীরে যখন বড়ো হয়েছে, সংসারের দায়িত্ব বুঝতে শিখেছে একটা একটা করে স্বপ্ন গচ্ছিত রেখেছে জুরির বুকে লুকিয়ে, যা ক্রমশ হারিয়ে গেছে জুরির প্রবল স্রোতধারায়। দায়িত্ব পালন ছাড়া কোনো কিছু আশা করার সময়টুকুও পায়নি কারো কাছ থেকে। একা দিন ভালোই কাঁটছিল। হঠাৎ একদিন ধর্মনগর সাপ্তাহিক বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে লোকজনের ভিড় দেখে সামনে এগিয়ে দেখেছিল আধুনিক যুগের তথাকথিত সভ্য মানুষের অসভ্য ভালোবাসার ফল এক অবুঝ শিশু পড়ে আছে রাস্তায়। শহরের সব শিক্ষিত বাবু আর দিদিমণিরা দামি ফোনে ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিলেন, অশিক্ষিত নির্মল বরং বাচ্চাকেই কোলে তুলে নিয়েছিল। নাম রেখেছিল দেবদূত, তার বাঁচার একমাত্র সম্বল দেবা।
নির্মলের অমলিন হৃদয়ের স্পর্শে শান্ত হলো দেবা। বাপ-ছেলে খেয়েদেয়ে রওনা দিল জুরির দিকে। বিকেলে ফুরফুরে বাতাস, নির্জন জুরির তীরে নদীর স্রোতের পাগল করা বাউল সুর বাবা ছেলে দুজনেরই খুব প্রিয়।
নির্মল দেবাকে সেই বালুচরেই বসে বলল — জানোস বাবা, মাইনষের কথাত কুনুদিন কান দিচ না।
— কেনে বাবা ?
— মাইনষের কাম মাইনষরে হুদ্দা কস্টো দেওয়া, ইতা কইরা মজা পায়। গতবার তুপানে যে আমরার বাড়ি ভাঙ্গছিল মনে আচে নি, কেউ থাকার জাগা দিচে না। মানুষ বেতালা স্বার্থপর রে বাবা। তারা তর কোনো কামে আইতো না, তুই বালা চললে তরে নস্টো করাত লাগবো উল্টাপাল্টা মাত মাতিয়া।
দেবা কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনে।
দেবা ছোটোবেলা থেকেই নির্মলের বুকের পরশ ছাড়া ঘুমোতে পারে না। দেবা শুয়ে শুয়ে বাবাকে বলল — কালকে তো জগন্নাথ ঠাকুরর রত্, আমারে লইয়া যাইবায় নি রত্ দেখাত।
নির্মল — অয়, যাইমু রে বাবা, এখন ঘুমা।
দেবা — বাবা আমরা এত গরিব কেনে ? সবের কত্ত সুন্দর ডেস, আমার নাই। রাজুর বাবা তো বর্ডারর ঐ দিকে কিতাকিতি জিনিস চালান করিয়া বহুত টাকা পাইন। তুমি করো না কেনে?
নির্মল — না রে বাবা, বর্ডারের ওইদিকে যারা জিনিস পাচার করে তারা দেশদ্রোহী। এমন টাকা পাপর টাকা, আমরার লাগে না ঔ টাকা। কোনোদিন ইতা কাম করিস না কেউ কইলেও। আমি কিন্তু খমা করতে পারতাম না।
দেবার যে উত্তরটা পছন্দ হলো না বেশ ভালো বুঝতে পারলো নির্মল — ডেস দিয়া মাইনষর দাম বারে না রে, আমরার সন্মান আসল। তুমরার যে মাস্টর প্রকাশ স্যার কত টাকা তাইনর, কিন্তু পুলায় চুরি করে মারামারি করে, তে তারে কেউ বালা কইবনি। তরে আমি কিচ্ছু কিনিয়া দিতাম পারি না। এখন তুই যদি কষ্টো করিয়া পড়িয়া বালা কিচ্ছু হইতে পারস, সবে কইবো দেবদূত বাবু অনেক কষ্টো করিয়া বরো হইচইন, তে কে বালা তুই না তাইনর পুলা ?
ফোঁকলা দাঁতে হাসি মাখিয়ে দেবা বলে — আমি….
রাত গাঢ়তর হয়। ঝিঁঝিঁ পোকার গান, নদীর কলতানের সুর নির্জন রাতে আছড়ে পড়ে নির্মলের ভাঙা ঘরে।
পরের দিন রবিবার, স্কুল বন্ধ। তার উপর বিকেলে রথ দেখতে যাবে বাবার সাথে। ছোট্ট দেবার আনন্দ আর ধরে না। কখন দুপুর হবে আর বাবা কাজ থেকে আসবে — এ প্রতীক্ষা বাঁধা না মানা।
বিকেলে রথে যায় বাবার সাথে ধর্মনগর। প্রচণ্ড ভিড়, দেবা কিছু দেখতে পাচ্ছে না বুঝে নিজের কাঁধে তুলে নেয় নির্মল।
— বাবা, ঠাকুর কর আমরা পুজা করি কেনে ?
— ঠাকুর আমরারে খাওন দেয়, আমরারে ডেস দেয়, খুশি দেয়। ঠাকুর ছাড়া আমরা কিচ্ছু করতে পারতাম না।
— বাবা, ঠাকুরের গাত পা লাগলে পাপ হয় নি ?
— অয় তো।
— আমারে নামাই দেও বাবা।
— কেনে দেকতে নানি ঠাকুর ?
— আমারে ত তুমি ভাত দেও, ডেস দেও, আমার ঠাকুর ত তুমি। তুমার গাত আমার পা লাগের।
এ কথায় নির্মলের চোখে জল চলে আসে। অশ্রুসিক্ত চোখেই দেবাকে বুকে আঁকড়ে ধরে। কপালে চুম্বনচিহ্ন এঁকে দেয় ভালোবাসার স্বীকৃতি হিসেবে।
একবার দেবা বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু দেবা নির্মলের বুক ছাড়া ঘুমাতে পারে না জেনে আলাদা ঘুমানোর ব্যবস্থা করতে মন মানেনি বৃদ্ধ নির্মলের।
— বাবা, হুনচি ইতা রোগ ছুইলে অই যায়। তুমি আলাদা গুমাও গিয়া।
— তুই আমারে ছাড়িয়া গুমাইতে পারস না আর তুই অসুস্থ দেকিয়া আলাদা জাইতাম গিয়া নি, হইলে অইচে। তবু তর লগে গুমাইমু।
— যদি তুমার অয়, আমার খারাপ লাগের। আমার কতা ভাবিও না, আলাদা গুমাও বাবা।
— আমার তুই ছারা কে আচে ? তর অসুকে আমিই ত তরে দেকমু। আমার যকন বয়স অইবো তুইও ত আমার লগে থাকবে। আমি বুড়া দেকিয়া অসুস্থ অইলে রাকিয়া জাইবে গিয়া নি ?
দেবার দুচাখ বেয়ে জল গড়িয়ে নামে।
কিছুদিন থেকেই নির্মলের কাশিটা বেড়েছে। বয়স বেশি হওয়ায় নেতিয়ে পড়েছে পুরো। অভাবের সংসার। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে দেবা। ডাক্তার বলেছে দুরারোগ্য ব্যাধি। অনেক খরচ। দেবার মাথা খারাপ, এতো টাকা কোথায় পাবে ? সাতকুলে কেউ নেই সাহায্য করার মতো। অবস্থার অবনতি হচ্ছে ক্রমশ নির্মলের। হঠাৎ একদিন ব্যাগ ভর্তি ওষুধ আর ফলমূল নিয়ে এসে দেবা বলল ধর্মনগর একটা দোকানে কাজ পেয়েছে সে। ছোট্ট দেবা কবে এতটা বড়ো হয়ে গেছে হঠাৎ বুঝতেও পারেনি নির্মল। এই তো চার-পাঁচ বছর আগে রথের দিনের কথা আজও মনে পড়ে নির্মলের।
এখন খানিকটা সুস্থ নির্মল। একদিন দেবা কাজে গেলে একটা ছেলে এসে দেবার খোঁজ করে।
— দেবা তো বারিত নাই।
— তার একটা মোবাইলও নাই? ইশ কিতা যে করতাম, আমি আবার শিলচর জাইতাম অখন।
— কুনো দরকার নি দেবার লগে।
— দেবা আইলে এইটা দিয়া দিবেন, কইবেন সুমনদা আইচলো।
এ কথা বলে একটা চিঠি নির্মলের হাতে তুলে দেয় লোকটি।
আজ রবিবার। দেবার দোকান বন্ধ। খাবার একটা টিফিন বক্স এ নিয়ে নির্মল ছেলেকে বলে — মনে আচে নি তোরে আগে লইয়া নদীর কিনারে নদী দেকাইয়া খাওয়াইতাম। আজকে চল আগের মতো আবার।
দেবা রাজি হলো।
আগের মতো খাইয়ে দিচ্ছে নদীকে সাক্ষী করে পিতা তার পুত্রকে। বদলায়নি কিছুই এত বছরে।
হঠাৎ চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দেবা। রক্ত গড়াতে থাকে মুখ দিয়ে।
— বাবা তুমি আমারে কিতা খাওয়াইছো ?
অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর উত্তর — বিষ।
দেখতে দেখতে বৃদ্ধ নির্মলের চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তার একমাত্র সম্বল।
নির্জনতা গ্রাস করে চারদিক। হঠাৎ নির্মল বলে — জানোস নদী, আমার পুলা ড্রাগস পাচার করে বর্ডার দিয়া। আমারে পাপের টাকায় বাচাইছে। আমার পুলা তার কাজ করছে, কিন্তু আমি পুলা অইয়া আমার ভারত মার লগে বেইমানি করতে পারলাম না, মারি লাইচি দেশদ্রোহীটারে। বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে চিঠিটা বের করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ভাসিয়ে দেয় নদীর কূল ভাঙা স্রোতে।
আমার তুই ছারা কেউ নাই, আমি আজকে খুনি অই গেলাম। আমারে শাস্তি তুই দে রে জুরি, তুই দে। বলে বৃদ্ধ টলমল পায়ে এগিয়ে গেল নদীর অভিমুখে।