নাপিতের দোকানে – আন্তন চেকভ

নাপিতের দোকানে – আন্তন চেকভ

নাপিতের দোকানে       (ছোটোগল্প)

আন্তন চেকভ

(রাশিয়ান গল্প, “At the Barber’s” ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ বিজয়া দেব)

সকালবেলা, এখনও সকাল সাতটা বাজেনি, মাকার কুজমিচ ব্ল্যোস্তকেন এর দোকান ইতিমধ্যেই খোলা হয়েছে। নাপিতটি তেইশ-চব্বিশ বছরের এক যুবক। ভীষণ অগোছালো, কাপড়চোপড় তেলচিটে। কিন্তু সে ফ্যাশানে খুব আকৃষ্ট, সে দোকান পরিষ্কার করছে। যদিও পরিষ্কার করার মতো তেমন কিছু নেই, তবুও সে ঘাম ঝরিয়ে খাটছে। এক জায়গায় সে একটা কাপড় দিয়ে ঘষছে, আরেক জায়গায় আঙুল দিয়ে খোঁচাচ্ছে, অথবা দেয়াল থেকে একটা পোকা ধরে ফেলে দিচ্ছে। নাপিতের দোকানটি ছোট, সংকীর্ণ আর অপরিষ্কার। গাছের গুঁড়ির দেয়ালগুলো এমন কাগজ দিয়ে মোড়ানো, যা দেখে মনে হয় যেন কোনো ঘোড়ার গাড়ির কোচওয়ানের ম্লান হয়ে যাওয়া জামা। ঘোলাটে ঝরঝরে দুটি জানালার মাঝখানে একটি সরু দরজা, এর ওপরে শ্যাওলা ছোপ ধরা দেয়ালে একটি বেল ঝোলানো, যেটি এমনি এমনিই বাজে, কেউ না বাজালেও বেজে চলে, শব্দেরও বিলকুল জোর নেই, মনে হয় সে-ও এই ঘরটির মতই ভারি দুর্বল। দেয়ালে যে আয়নাটা ঝোলানো রয়েছে তা এমনভাবে পারদচটা হয়েছে যে, মানুষের মুখ যে কোনও দিকে তাকালেই অদ্ভুত লাগে, এমনই বিকৃতি এসে গেছে আয়নাটায়। এই আয়নার সামনেই দাড়ি কাটা, চুল কাটা চলে।
সামনের ছোট টেবিলটায় অপরিচ্ছন্ন মাকার কুজমিচের মতোই রাখা আছে চিরুনি কাঁচি রেজর, গোঁফের জন্যে আধ পয়সার মোম, আধ পয়সার খুব পাতলা করা ওডিকোলন ইত্যাদি। সত্যি বলতে কি পুরো নাপিতের দোকানের মূল্য পনেরো কোপেকের বেশি নয়।
মরচে ধরা বেলটাতে একটা চিঁচিঁ আওয়াজ হলো, এক বৃদ্ধ প্রবেশ করল। তার গায়ের চামড়া ভেড়ার চামড়ার মতো কুঁচকানো, পায়ে ওভারবুট, মাথা ও ঘাড় মেয়েদের শাল দিয়ে জড়ানো। লোকটি মাকারের ধর্মপিতা, এরাস্ত ইভানিচ ইয়াগোদভ। একসময় সে চার্চের বিচারালয়ে প্রহরীর কাজ করতো, এখন সে রেড পন্ড এলাকায় বাস করে ও তালাচাবি তৈরির কাজ করে।
— মাকারুস্কা, মাই ডিয়ার, গুড ডে। কথাটা সে বলল মাকার কুজভিচকে যে দোকান পরিষ্কার করতে এখনও ব্যস্ত। অত:পর উভয় উভয়কে চুম্বন করল। ইয়াগোদভ মাথা থেকে চাদর সরিয়ে চেয়ারে বসে গলা খাঁকারি দিয়ে কন্ঠস্বরকে সাফ করল, একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল — কত লম্বা রাস্তা উফফ। সেই রেড পন্ড থেকে এই কালুগা গেট পর্যন্ত আসা, বাপরে, এটা কি চাট্টিখানি কথা!
— কেমন আছ তুমি ? মাকারুস্কা জিজ্ঞেস করে।
— খুব ভালো নয়। আমার জ্বর হয়েছিল।
— জ্বর ? তুমি তো বলোনি!
— হ্যাঁ। প্রায় একমাস বিছানায় ছিলাম। ভেবেছিলাম বুঝি মরেই যাবো। অবস্থা একেবারে ভয়াবহ ছিল। এখন আমার চুল পড়ছে। ডাক্তার বলল, মাথা কামিয়ে নাও। তখন ভাবলাম – মাকারের কাছে যাবো। আত্মীয়ের কাছে যাওয়া অন্য কারো কাছে যাওয়া থেকে অনেক ভালো। আমি জানি তুমি এটা খুব ভালোভাবে করবে আর বিনিময়ে কিছুই নেবে না। রাস্তাটা একটু বেশি এটা ঠিক, কিন্তু এইটুকু পথ তো হাঁটাই যায়, কি বলো?
— খুব ভালো করেছ। তোমার চুল কেটে দেবো, এটা তো আমার জন্যে আনন্দের ব্যাপার। তুমি চেয়ারে ঠিক হয়ে বসো। মাকার তার পা অল্প ঘষে চুল কাটার চেয়ারে বসার জন্যে ইঙ্গিত করলো। ইয়াগোদভ চেয়ারে বসে সামনের আয়নায় নিজেকে দেখল এবং প্রাথমিকভাবে খুশি হলো। আয়নায় তার মুখটা অন্যরকম লাগছিল। একটু ঝাপসা, কেমন যেন আঁকাবাঁকা, তেরছা মতোন, তার কালমুক মোটা ঠোঁট, চওড়া মোটা নাক, চোখ…মাকার তার গ্রাহকের কাঁধ ও বুক একটি হলুদ ছোপ ধরা সাদা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দিল। এবার কাঁচি দিয়ে চুল কাটতে শুরু করল।
— তোমার চুল এমনভাবে সাফ করে দেব যে চকচকে ত্বক দেখা যাবে।
— নিশ্চয়ই। তখন আমার মুখশ্রী দেখাবে তাতারদের মতো, কিম্বা বোমার মতো। তারপর যখন চুল গজাবে তা আরও মোটা ও ঘন হবে।
— আন্টি কেমন আছে?
— মোটামুটি। কিছুদিন আগে সে মেজরের স্ত্রী-র মিডওয়াইফের কাজ করেছে। ওরা তাকে কাজের বিনিময়ে এক রুবল দিয়েছিল।
— ও তাই ? এক রুবল ? কান একটু ধরে রাখো তো!
— ধরেই তো রেখেছি। তুমি সাবধানে! কেটে দিও না আবার! উফ লাগছে তো। তুমি আমার চুল ধরে টানছ!
— এটা আমাদের কাজ, কিছু করার নেই। আচ্ছা এনা ইরাসতোভনা কেমন আছে ?
— আমার মেয়ে ? খুব ভালো। সে এখন দারুণ সময় কাটাচ্ছে। গত সপ্তাহের বুধবার ওর সেইকিন এর সাথে এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।
কাঁচিটা হঠাৎ থেমে গেল। মাকার কুঝমিচ চুল কাটা থামিয়ে হাত নীচে নামিয়ে ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল — কার এনগেজমেন্ট হয়েছে ?
— এনা।
— এটা কি বলছ! কার সাথে বললে ?
— সেইকিন! প্রকফি পেত্রভিচ। জ্লাতউস্তেনস্কিতে তার মাসির বাড়ি দেখাশোনা করতো। ওই যাকে বলে হাউসকীপার। মহিলা খুব ভালো। আমরা আগামী সপ্তাহে তার বিয়ে দিচ্ছি সেইকিনের সাথে। তুমিও এসো। আমন্ত্রণ রইল। খুব আনন্দ হবে, চলে এসো।
— কিন্তু কি করে এটা সম্ভব ? জিজ্ঞেস করল মাকার। তাকে ফ্যাকাসে, হতচকিত দেখাচ্ছিল। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল — এটা একেবারেই অসম্ভব, হতেই পারে না। এনা ইরাস্তোভনা…. আমি… আমি কেন তার জন্যে.. এনার জন্যে আমার অন্তরে অনেক অনুভূতি জমিয়ে রেখেছি, তাকে লালন করেছি। এটা অসম্ভব, হতেই পারে না।
— কেন হতে পারে না ? তার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। আর সেইকিন ? লোকটা ভালো।
মাকারের মুখমণ্ডলে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। সে কাঁচি টেবিলে নামিয়ে রেখে হাতের মুঠোয় নাকে জমে ওঠা ঘাম মুছতে লাগল।
— আমার প্রত্যাশা আছে, ছিল। এটা হতেই পারে না মি: ইয়াগোদভ, আমি এনাকে ভালবাসি এবং আমি তাকে অন্তর থেকে এই ভালবাসার কথা তাকে বলেছি… এবং আন্টি আমাকে কথা দিয়েছিল। আমি তোমাকে সবসময় শ্রদ্ধা করেছি যেন তুমি আমার বাবা…আমি সবসময় তোমার চুল কেটে দিয়েছি বিনিময়ে কিছু নিইনি। যখন আমার বাবা মারা গেল তুমি আমাদের সোফা নিয়েছিলে আর দশ রুবল ক্যাশে নিয়েছিলে, আজ অবদি তা তুমি ফেরত দাওনি। মনে পড়ে?
— হ্যাঁ মনে আছে। নিশ্চয়ই আমি নিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার পাশে এনাকে কি মানায় মাকার? তোমার টাকাও নেই, সামাজিক সম্মানও নেই। তুমি কি করছ? একটা তুচ্ছ কাজ!
— সেইকিন বুঝি খুব ধনী ?
— সেইকিন একটা ইউনিয়ন এর সদস্য। সে বন্ধকী ব্যবসাও করে। তাছাড়া সেইকিনের সাথে এনার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে, ওটা আর বদলানো যায় না মাকারুস্কা, তুমি অন্য জীবনসঙ্গী দেখে নাও। আরে, দুনিয়াটা এত ছোট নয় হে! বেশ, এখন তুমি তোমার কাজ সেরে নাও। চুল কাটা বন্ধ করেছ কেন?
মাকার নীরব, স্থির দাঁড়িয়ে। সে পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁদতে লাগল।
— আরে এসো, এসব কি হচ্ছে কি? উফফ থামো, দ্যাখো তো মেয়েদের মতো কাঁদছে।
মাকার কাঁচি হাতে নিল, শূন্যচোখে চারপাশটা একবার দেখল, তারপর কাঁচিটা আবার টেবিলে রেখে দিল। তার হাত কাঁপছে।
— আমি পারব না। আমি এই মুহূর্তে পারছি না। আমি হাতে জোর পাচ্ছি না। আমি একটা দুর্ভাগা মানুষ এবং এনাও তাই। আমরা দুজনে দুজনকে ভালবাসি। আমারা দুজনেই দুজনের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম, এবং কিছু নির্দয় লোকের সমবেদনার অভাব আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিল। তুমি চলে যাও ইভানিচ, আমি তোমার উপস্থিতি সহ্য করতে পারছি না।
— ঠিক আছে, তাহলে আমি আগামীকাল আসছি, মাকারুস্কা। তুমি আমার চুল কাটা আগামীকাল সম্পন্ন করে দিও।
— ঠিক আছে।
— তুমি ততক্ষণ নিজেকে শান্ত করো। আমি আগামীকাল একেবারে সকালের দিকে আসব।
ইভানোভিচের মাথার অর্দ্ধেকটা অংশ কামানো, মাথার ত্বক দেখা যাচ্ছে, বাকি অর্দ্ধেক অংশে চুল রয়েছে, তাকে দেখতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া জেলের অপরাধীর মতো লাগছিল। এরকম অবস্থায় রাস্তায় লোকজনের সামনে বের হওয়া খুবই অস্বস্তিকর। কিন্তু কী আর করা, কোনও উপায়ান্তর নেই। সে সেই মেয়েদের শালটা মাথায় জড়িয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। একা বসে মাকার কুঝভিচ নি:শব্দে কাঁদতে লাগল।

পরদিন সকালে ইভানোভিচ আবার এসে হাজির।
— কি চাই ?  শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মাকার।
— আমার চুল কাটা শেষ করো মাকারুস্কা। অর্দ্ধেক মাথা বাকি রয়ে গেছে যে!
— আমাকে এডভান্স করো। ফর নাথিং আমি চুল কাটব না।
কিছু না বলে ইভানোভিচ বেরিয়ে গেল এবং বাকি অর্দ্ধেক মাথার চুল কাটার জন্যে পয়সা খরচ করা বাজে খরচ হবে বলে সে অপেক্ষা করতে লাগলো বাকি অর্দ্ধেক মাথার চুল বড় হবার জন্যে। এখন তার মাথার অর্দ্ধেক চুল লম্বা, অর্দ্ধেক চুল কামানো।
মেয়ের বিয়েতে সে এই অবস্থাতেই নাচের পার্টিতে নাচলো।

(কালমুক = তাতারদের মতো)