
টানাপোড়েন
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য
“হাত কাটলো কি করে?” রতনকে দেখে চিৎকার করে ওঠে শান্তি।
দুপুর বেলায় বাড়ি ফিরেছে রতন। স্বামীর চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে শান্তি। রতনের ডান হাতের কব্জির ঠিক উপরে অনেকটা ক্ষত। রক্ত ঝরছে সেই ক্ষত থেকে। জামাতে লেগে রয়েছে তাজা রক্তের ছোপ। ডান পায়ের হাঁটুর কাছেও ক্ষত। স্বামীর এমন চেহারা দেখে ভয় পায় শান্তি। চিৎকার করে ওঠে দুয়ার থেকে। পড়িমরি করে নেমে আসে উঠানে।
রাগে আগুন হয়ে আছে রতন। রিকশাটা উঠানের এক পাশে ঠেলে দেয়। রান্নাচালার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে যায় সেটি। রিকশার চেনটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় ভীষণ রাগে। ততক্ষণে শান্তি এসে দাঁড়ায় রতনের পাশে। স্বামীর ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় ধরে জিজ্ঞাসা করে,”কি করে কি হলো ? হায় ভগবান আর বাঁচবো না আমি। দুপুর বেলায় একি বিপদ হলো গো!”
“তোর বাপের ছেরাদ্দ হয়েছে, সর মাগী চোখের সামনে থেকে। ঠাকুর ডেকে ঢং মারাচ্ছে এখন, অনেক হয়েছে। ভাগ আমার চোখের সামনে থেকে।” ঠেলে সরিয়ে দেয় শান্তিকে। নাছোড় শান্তি। রতনকে দুয়ারে বসাতে চায়। ততক্ষণে দুই থাপ্পড় পড়েছে শান্তির গালে। রতনের থাপ্পড় উপেক্ষা করে স্বামীকে টেনে নিয়ে এসে বসায় দুয়ারে। রতন শুরু করে খিস্তি খেউড়।
রতনের গালিগালাজ আর তেমন ভাবে গায়ে লাগে না শান্তির। এই কয় বছরে সে সব শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে। দুয়ারে বসে আকথা কুকথা বলেই চলে রতন।
গেলাসে জল আর এক টুকরো কাপড় নিয়ে এসে রতনের পাশে বসে শান্তি। ধুয়ে দেয় ক্ষতের রক্ত। কাপড়ের টুকরোটা বেঁধে দিতে যায় ক্ষতস্থানে।
“থাক, খুব করেছিস। আর ন্যাকামো মারাতে হবে না। শালা শেষ করে দিলি জীবনটা। ভাগ এখান থেকে। আজই বিদেয় হয়ে যা বাড়ি থেকে।” বলে রতন।
“বেশ, আগে কাপড়টা বেঁধে দিই তোমার হাতে। তারপর যা ইচ্ছে যায় করবে তুমি। চাইলে মেরে ফেলতে পারো আমাকে।” ধরে আসে শান্তির গলা। রতনের ক্ষতে কাপড়ের টুকরোটা বেঁধে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে উঠে যায় শান্তি।
রতন বলে চলে নানা কথা। “…আর শালা রিকশায় হাত দেবো না কোনোদিন। না খেয়ে মরবো সেও ভালো। তোর জন্যেই আমার এই হাল। কাল সকালেই গণেশের দোকানে বেচে দেবো রিকশা। যা দাম পাই …।”
রান্নাচালায় বসে থালায় ভাত বাড়ে শান্তি। এক গেলাস জল আর ভাতের থালাটা এনে নামিয়ে দেয় রতনের সামনে।
“খবরদার, কাল সকালে যদি দেখি ঢং করে রিকশার চাকায় জল ঢেলে পেন্নাম ঠুকছিস মেরে ফেলবো তোকে। একদম মেরে দেবো। শালা, এক পয়সা আনার মুরোদ নেই, ধূপ জ্বালানো হচ্ছে। ধূপের পয়সা তোর বাপ দেয়?” দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে রতন।
রতনের কথায় কথা দেয় না শান্তি। যা ইচ্ছে যায় বলুক। মাথার ঠিক আছে কি মানুষটার। রিকশা ঠেলে দু মানুষের পেট চালাতে হিমসিম খায় রতন। দু মুঠো চাল জোগাড় করতে বুকের বাতাস ফুরিয়ে আসে। সে কষ্ট বোঝে শান্তি। সংসারের যা কিছু অমঙ্গল সে সবের দায় শান্তির উপর চাপিয়ে মানুষটা যদি চুপ করে মন্দ কি। এমনি এমনি তো আর বলছে না। মনের জ্বালায় এইসব বলছে। সব ওর মুখের কথা, মনের কথা তো আর নয়। দুয়ারে বসে চোখের জল মোছে শান্তি।
আগুনে চোখে বউকে তাকিয়ে দেখে রতন। বলে, “ওহ আবার কান্না হচ্ছে। শালা, ছেলে বিয়োতে পারে না বাঁজা…।”
রতনের সামনে থেকে উঠে যায় শান্তি। এ কথার ভার অসহনীয় লাগে।
সন্তান আসেনি শান্তির কোলে। বিয়ের পর বেশ কয় বছর সে কথা ভেবে অনেক কষ্ট পেয়েছে শান্তি। রতনও। দুই জনে ছুটেছে এদিক সেদিক। ডাক্তার, কবিরাজ, তাবিজ, মাদুলি, মানত করেছে সবই। কাজে আসেনি কোনো কিছুই।
সারাদিন রিকশা, প্যাসেঞ্জার, টাইমে গাড়ি ধরিয়ে দেওয়া এই আবর্তে পাক খেয়েছে রতনের রোজগেরে দিন। রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়েই ব্যস্ত থেকেছে রতন। হাড়ভাঙা পরিশ্রম রোজ, সকাল থেকে রাত। শেষট্রেনের প্যাসেঞ্জারকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরেছে নিজে পরিশ্রান্ত হয়ে। তারপর আবার একটা দিন কেটেছে ঠিক আগের দিনের মতো। তারপর আবারও একটা দিন। এইভাবে উপার্জনের ভাবনা নিয়েই পাক ধরেছে মাথার চুলে। সন্তান না থাকার দুঃখ ধুয়ে মুছে গেছে রতনের গায়ের ঘামের সঙ্গে কবেই।
এদিকে শান্তির সময় কেটেছে আর পাঁচটা নিঃসন্তান মহিলার মতো। সংসারের কাজ ফুরিয়ে এলে নির্জন অবসরে নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত করেছে শান্তি। সন্তান না পাওয়ার যন্ত্রণা আগলে রেখেছে মনের নিভৃতে। চোখের জল ফেলেছে হাজার দিন। সেদিনের নিদারুণ কষ্টের সময়ে পাশে থেকেছে রতন। রাতের বেলায় বাড়ি ফিরে শান্তির মনোকষ্টের আগুনে সহমর্মিতার বারি সিঞ্চন করেছে। দুঃখের অশ্রু মুছে স্বামীর বুকে মাথা রেখেছে শান্তি, ভালোবাসার পরশটুকু নিয়ে। যা নেই তার জন্য হাপিত্যেশ না করে যে আছে তাকে আঁকড়ে থেকে বাঁচার ভরসাটুকু পেয়েছে সেই দিন। রাতের আঁধারে রতনের কাছে সঁপে দিয়েছে নিজেকে, নিশ্চিন্তে।
ইদানীং বদলে গেছে দিন। অভাবের যন্ত্রণায় জর্জরিত রতন। পথে ঘাটে লোকে আর উঠতেই চায় না রিকশায়। দিনযাপনের কথা ভেবে দিশাহীন তাই। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে পিছিয়ে পড়েছে আজ, সে কথা বুঝেছে রতন। মুখের হাসি উধাও হয়েছে নিদারুণ দারিদ্রতার দাপটে। চরম অনটনের ঝাপটায় টালমাটাল মনের স্থিতি। এমন যন্ত্রণাময় জীবনের রুদ্ধদ্বার কক্ষ থেকে মুক্তি পেতে ছটপট করে রতন।
রিকশা স্ট্যান্ডে একলা বসে কত কথাই না ভাবে রতন। গণেশ বলে, “অনেক হলো রতন এইবার রিকশার মায়া ছাড়। একটা টোটো…।”
গণেশের কথায় উত্তর দেয় না রতন। টোটো কেনা কি ছেলে খেলা নাকি! টাকা দেবে কে?
রাতের বেলায় চোলাই পেটে নিয়ে বাড়ি ফেরে রতন। অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে। বেরোজগার দিন ভুলতে চেয়ে গালিগালাজ করে শান্তিকে। কথায় কথায় বউকে বলে বাঁজা। আঁধারে বসে কাঁদে শান্তি। সে কান্নার সুর এক অন্যরকম অনুভূতির আবেশ সৃষ্টি করে রতনের মনে। শরীরের শিথিল ধমনী জেগে ওঠে। হূ হূ করে ছুটে চলে রক্ত, ধাক্কা মারে মাথার তালুতে। সারাদিনের ভয়াবহ দারিদ্রতার সঙ্গে একপেশে লড়াইয়ে রতনের নির্মম পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায় রতন, রাতের বেলায়। শান্তিই যেনো মূর্তিমান দারিদ্র্য। শান্তিই রতনের একমাত্র প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে সেই মুহূর্তে। ধক ধক করে জ্বলে ওঠে রতনের প্রতিশোধ স্পৃহা। শান্তির চোখের জল বুঝি রতনের জয়ের তিলক। তাই বাইশ বছরের নিঃসন্তান দাম্পত্য জীবনের যে কষ্ট শান্তির মনের অতলে ঘুমিয়ে ছিল এতো বছর ধরে, তাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জাগিয়ে তুলে পরম সুখ পায় রতন। নিত্যদিন চলতে থাকা অসম যুদ্ধে জয়ী মনে হয় নিজেকে। চোলাই মদের নেশায় বুঁদ রতন শান্তির কান্নার তালে তালে প্রবল পরাক্রমী হয়ে ওঠে। ফণা তোলে তার জয়-লোলুপ দামাল আগ্রাসন। ছোবলে ছোবলে নীল হয়ে ওঠে শান্তি, চোখের জল ফেলে। বলে, “পায়ে পড়ি তোমার। চুপ করো এইবার। আমাকে মেরে ফেলো। ওই ভাবে খোঁটা দিও না। বড়ো যন্ত্রণা…।” এইবার তৃপ্ত হয় রতন। অভাবের সঙ্গে লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছে জয় এতক্ষণে। রতনের মনের আগুন নিভু নিভু হয়ে আসে তখন। অসাড় হয় মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলি। মুদে আসে দুই চোখ। ঘুমিয়ে পড়ে রতন। আর, আর দুঃসহ ব্যথা নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটে শান্তির। রোজ। রোজ। রোজ।
থালার ভাত শেষ করে রতন। ঘাম আর রক্ত মাখা গায়ের জামা ঝুলিয়ে দেয় বাঁশের খুঁটিতে। দুয়ারে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে তারপর। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর। ঢলে পড়ে গভীর ঘুমে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে শান্তি। খাবার ইচ্ছে নেই আর। চেয়ে থাকে রতনের দিকে।
রোজ দুপুরে এই সময় ভাত খেতে বাড়ি আসে রতন। কথা বলার সময় থাকে না তখন। রিকশাটা রান্নাচালার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখে। কোনো রকমে ভাত কয়টা মুখে গুঁজে রিকশা নিয়ে দৌড় দেয় আবার তেমাথার স্ট্যান্ডের দিকে। যদি কোনো প্যাসেঞ্জার পায়, সেই আশায়। সকালের একটা বাঁধা ভাড়া বাদ দিলে সারা দিন থেমেই থাকে রতনের রিকশার চাকা। ভাগ্য ভালো থাকলে কোনো দিন এক টিপ বা দু টিপ ভাড়া পায়। সে আর কয় দিন! তবুও দুপুরে বাড়িতে এলেই রতনের মনে প্যাসেঞ্জারের কথা হাজির হয়। আবার রিকশা নিয়ে দৌড় লাগায় স্ট্যান্ডের দিকে। তারপর আবার সেই কর্মহীন সময়ের তীব্র দহন। ঘরে বাইরে স্বস্তি নেই রতনের। এক অদ্ভুত টানা পোড়েন চলে দিনের পর দিন। রোজ। রোজ। রোজ।
রিকশার চেনটা পড়ে রয়েছে দুয়ারের সামনে। দেখে শান্তি। চেনটা ছিঁড়লো কি ভাবে? প্রশ্ন আসে শান্তির মনে। না, না, কিছুতেই না। আর ভাববে না এমন কথা। তুলে রাখবে চেনটা? না, থাক। পড়েই থাক। কি হবে ওই কাটা চেন দিয়ে? কোন কাজে লাগবে? তারচেয়ে বেচে দিক রিকশা। এক পয়সা আয় নেই। শুধু শুধু মরা ছেলের মত রিকশাটাকে আগলে রেখেছে রতন।
সারা শহর জুড়ে এখন শুধু টোটো আর টোটো। অলিতে গলিতে টহল দিচ্ছে সর্বদাই। পথে লোক দেখলেই হলো। কোথায় যাবেন? উঠে বসুন টোটোতে। মানুষ জনেরও সুবিধা হয়েছে। ভাড়া কম লাগে। আবার গন্তব্যস্থানে পৌঁছানো যায় তাড়াতাড়ি। তাই লোকে আর রিকশায় পা রাখে না। রোজগার নেই রতনের। সংসারে অনটনের ছায়া লম্বা হয়েছে তাই।
তেমাথার স্ট্যান্ডে আগে গোটা দশেক রিকশা ছিলো। এখন রিকশা বলতে শুধু রতনের একার। বাকিরা ধার দেনা করে পুরানো রিকশাতেই ব্যাটারি মোটর বসিয়ে নিয়েছে। নয়তো টোটো কিনেছে। রতনও ভেবেছে বহুদিন রিকশায় ব্যাটারি মোটর বসিয়ে নেবে। সাহসে কুলায়নি। সারা দিন স্ট্যান্ডে প্যাসেঞ্জার পিপাসু চাতক হয়ে বসে থাকে রতন। আর রাতে বাড়ি ফিরে শান্তির সঙ্গে অশান্তি করা, এই এখন রতনের কাজ। রাগটা যে ঠিক কার উপর সে কথা নিজেও জানে না রতন। তবে সারাদিনের উপার্জনহীনতার সমস্ত দোষ এসে পড়ে শান্তির উপর। একদিন আধ দিন নয়, রোজ। রোজ। রোজ।
গতকাল রাতে রোজ দিনের মতোই পেটে চোলাই ঢেলে বাড়ি এসেছিলো রতন। বমি করেছে খানিক আগেই। ভাত খাবার ইচ্ছে ছিলো না। দুয়ারে বসে বিড়ি টানতে টানতে ভাবছিল ভুবন বিশ্বাসের কথা। শালা এক নম্বর হারামি লোক ভুবন বিশ্বাস। আর ঠিক সেই সময় ভাত খাবার কথা বলে শান্তি। বউয়ের কথা শুনে ফুঁসে ওঠে রতন। ভুবন বিশ্বাসের রাগ গিয়ে পড়ে শান্তির উপর। বলে, “সারা দিন কাজ নেই তোর, শুধু বাড়িতে বসে গেলা আর গেলা। নে তুই নিজে খা।” হাতের সামনে জলের গেলাস ছিলো। সেটা ছুঁড়ে মারে শান্তির দিকে। আঘাত পায় শান্তি। কপালের ডান দিকটা এখনো ফুলে আছে।
গতকাল মেজাজ হারিয়ে ছিলো রতনের। রোজ সকালে সুজাপুরের ভুবন বিশ্বাসের ছেলেকে রিকশা করে শহরের স্কুলে পৌঁছে দেয় রতন। আবার দুপুরে স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসে। মাস শেষে ভুবন চারশ টাকা দেয়। গতকাল রতন বলেছিলো একশ টাকা বাড়িয়ে দিতে। ভুবন বিশ্বাস বলে, না পোষালে ছেড়ে দাও। তিনশ টাকায় টোটো পেয়ে যাবো। কথাটা সত্যি হলেও গায়ে জ্বলন ধরায় রতনের। জিনিস পত্রের দাম লাগাম ছাড়া। একশ টাকা ভাড়া বাড়াবে না! আজ তিন বছর ধরে সেই একই ভাড়ায় খাটছে রতন। সেই নিয়েই মাথা গরম ছিলো। শান্তি খাবার কথা বলতেই গেলাস ছুঁড়ে মারে। শুতে যাবার আগে শান্তিকে বলেছিলো রতন, “ফের যদি দেখি রিকশার সামনে পেন্নাম…।”
রোজ ভোর হলে ঘুম থেকে উঠে বাসি কাপড় ছাড়ে শান্তি। ঘটিতে জল নিয়ে রিকশার তিন চাকায় জল দেয়। ধূপ দেখিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে রিকশার সামনের চাকায়। আর তারপরই চোখে মুখে জল দিয়ে রিকশা নিয়ে হাঁটা দেয় রতন। শান্তির বিয়ের পর থেকে এ নিয়মের অনিয়ম হয়নি কোনো দিন। এই কয় বছরে শান্তির এ কাজ নিয়ে হাজার বার চোখ রাঙিয়েছে রতন। তার রিকশার প্যাসেঞ্জার না পাওয়ার একটা যুতসই কারণ শান্তির সাত সকালের এই কর্মটি। এমনটা মনে হয় রতনের। মাথায় রাগ উঠলে রোজ হুঁশিয়ারি দেওয়া শান্তিকে, “ফের যদি দেখি সকাল বেলায়…।”
সকাল হলেই কে যেনো হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসে শান্তিকে রতনের রিকশার কাছে। বাধ্য করে ধূপ দেখিয়ে প্রণাম করতে। চেষ্টা করেও এই অভ্যাসের কবল থেকে মুক্তি নেই শান্তির। গতকাল রাতে গেলাসের আঘাত খেয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে শুয়ে ছিলো শান্তি, আর নয়। অনেক হয়েছে। কিছুতেই আর রিকশার দিকে ফিরে তাকাবে না। তারপরেও সাত সকালের সেই কাজে ছেদ টানতে পারেনি । রতনও পারেনি বাড়িতে বসে থাকতে। এ যেনো দু তরফের এক অবাধ্য অভ্যাস হয়ে উঠেছে।
চোত মাস। আগুন ঝরছে আকাশ থেকে। আজ দুপুরে ভুবন বিশ্বাসের ছেলেকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে সেই মাত্র স্ট্যান্ডে ফিরেছে রতন। মাথার ঘিলু শুকিয়ে গেছে রোদের তাপে। রিকশাটা দাঁড় করিয়ে খানিক বিশ্রাম নেবে ভেবেছিল রতন। আর ঠিক তখনই একটা বাস আসে ইলামবাজারের দিক থেকে। দুজন লোক নামে। হাবভাব দেখে রতন বোঝে ট্রেন ধরার তাড়া আছে লোক দুজনের। স্ট্যান্ডে কোনো টোটো নেই সেই সময়। বাধ্য হয়েই লোক দুজন ডাকে রতনকে। স্ট্যান্ড থেকে বোলপুর স্টেশন কম বেশি তিন কিলোমিটার। তিরিশ টাকা ভাড়া চায় রতন। “এইটুকু পথ তিরিশ টাকা!” অবাক হয় যাত্রী দুজন।
“এই রোদে কষ্ট নেই দাদা।” বলে রতন। তবে দিনকাল বদলেছে। ভাড়া নিয়ে আর দরদাম করা চলে না। কোথা থেকে টোটো এসে প্যাসেঞ্জার তুলে নিয়ে চম্পট দেবে। যা পায় তাই ভালো। কুড়ি টাকাতেই স্টেশন যেতে রাজি হয় রতন। রিকশায় উঠে বসে যাত্রী দুজন। প্যাডেলে চাপ দেয় রতন। ঘট ঘট শব্দ তুলে চেনটা পড়ে যায়। বিরক্ত হয় প্যাসেঞ্জার দুজন। বলে, “হায় কপাল! এই জন্য লোক ওঠে না রিকশায়।”
রিকশার চেনটা বেশ ঢিলে হয়েছে অনেক দিন ধরেই। গণেশের দোকানে গিয়ে কাটাবে কাটাবে করে আর কাটানো হয়নি। সামনের গিয়ারের দাঁতে চেনটা লাগায় রতন। বলে, “এক মিনিট। হয়ে যাবে এখুনি দাদা।”
রিকশা থেকে একজন প্যাসেঞ্জার বলে, “তোমার যখন হবে ওদিকে ট্রেন ততক্ষণে বর্ধমান পৌঁছে যাবে।”
এই কয় বছরে হাজার বার এমন কথা শুনেছে রতন। তবুও এই কথা শুনে মাথায় রক্ত ওঠে আজ। জেদ চাপে মনে। সময়ের আগেই লোক দুজনকে পৌঁছে দেবে স্টেশনে। রিকশার সিটে বসে শরীরটা সামনে ঝুঁকিয়ে প্রচণ্ড জোরে প্যাডেলে চাপ দেয় রতন। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। চেনটা ছিঁড়ে যায়। বেসামাল হয়ে রাস্তায় পড়ে যায় রতন। ভীষণ আঘাত পায় হাঁটুতে। ডান হাতের কবজির উপরের অংশ কেটে যায় বেশ গভীর হয়ে। তারপর বাড়ি ফিরে…।
সন্ধ্যার দিকে ঘুম থেকে একবার উঠেছিল রতন। বলে, “মাথায় আর গায়ে ব্যথা। রাতে খাবো না কিছু। ডাকবি না আমায়। কাল সকালেও বেরোবে না। খবরদার বলছি…।”
রাতে আর রান্না চড়ায়নি শান্তি। মাদুর বিছিয়ে শুয়েছিলো দুয়ারে। রোজ দিনের মতোই নিরালকে হাজার কথার উঁকি শান্তির মনে। মানুষটা বদলে গেছে কেমন। আগে দিনশেষে বাড়ি ফিরে শান্তিকে সারাদিনের সমস্ত ঘটনা বলতো রতন। স্ট্যান্ডে কাকে কি বলেছে। তাই নিয়ে কি মজা হয়েছে। শান্তির ঘরে বাচ্চা নেই বলে দোকানের গণেশ কি কি পরামর্শ দিয়েছে। সব, সব বলতো। সে দিনের সব কথা হারিয়েছে রাতের আঁধারে। এখন কথা বলতে শুধুই খিস্তি খেউড়।
আকাশের গায়ে চোখ এলিয়ে কতক্ষণ জেগেছিল মনে নেই শান্তির। চোখ মেলে দেখে পুব আকাশে আলো ফুটেছে। মাদুর ছেড়ে উঠে শান্তি। বাসি কাপড় ছাড়ে। ঘটিতে জল নিয়ে ধুয়ে দেয় রিকশার তিন চাকা। ধূপের সুবাসে ভরে ওঠে বাড়ি। গড় হয়ে প্রণাম করে রিকশাটাকে। কাটা চেনটা দুয়ারের সামনে থেকে তুলে এনে ঝুলিয়ে দেয় রিকশার হ্যান্ডেলের উপর।
ঘুম ভেঙেছে রতনের। মুখে চোখে জল দেয়। রক্তের ছোপ লাগা জামাটা চড়ায় গায়ে। এক ঝলক তাকিয়ে দেখে শান্তিকে। তারপর রিকশা টেনে হাঁটা লাগায় স্ট্যান্ডের দিকে। আগে গণেশের দোকানে সারাই করাবে চেনটা। তারপর ভুবন বিশ্বাসের ছেলেকে পৌঁছে দিতে হবে স্কুলে। উপার্জনের আশায় পা টেনে টেনে এগিয়ে চলে রতন।
সদর দরজা থেকে চেয়ে থাকে শান্তি। রিকশা টেনে এগিয়ে যাচ্ছে রতন। হাঁটুতে ব্যথা। খুঁড়িয়ে হাঁটে তাই। রতনকে দেখতে থাকে শান্তি। আজ মনটা কেমন করে মানুষটার জন্য। অফুরান শূন্যতা বেদনার সকরুণ হাহাকার তোলে শান্তির মনে।
দু চোখের জল কাপড়ের খুঁটে মুছে নেয় শান্তি। দমকা কান্না বুক ফুঁড়ে বাইরে আসে। দুই হাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদতে থাকে শান্তি। ধীরে ধীরে পথের বাঁকে মিলিয়ে যায় রতন। কাল রাতেও বলেছিল রিকশা নিয়ে পথে নামবে না আর। পারলো কই? ঘরে বাইরে কোথাও শান্তি নেই রতনের। কোথাও নেই। কোথাও নেই। কোথাও…।