শঙ্খমালার ঝাড়বাতি – মৌ চক্রবর্তী

শঙ্খমালার ঝাড়বাতি – মৌ চক্রবর্তী

শঙ্খমালার ঝাড়বাতি      (ছোটোগল্প)

মৌ চক্রবর্তী

১.
— এই শাঁখের মতোটা কত রে ? নিত্য জানতে চায়। এটা ছোট হয় না ? পাত্তাও দেয় না ঝাড়বাতির দোকানের ছেলেটা।
— ইই, মুরোদ নেই, রোজ দাম জিজ্ঞেস করে। ছেলেটা নিত্যকে শুনিয়েই বলে। ক্রেতাদের সঙ্গে হাসেও। না, নিত্য এসব টিটকিরিতে মন ভারি করে না আর। ও জানে ওর সাধ্যের বাইরে এইসব ঝাড়বাতির দাম। জেনেও কেন জিজ্ঞেস করে ? কারণ ওর ঝাড়বাতির শখ। কিনতে চায়।
এই সাদায় হলদে উলটো শঙ্খের মতো, এটা ওর বেশি ভাল লেগেছে। ভেবেছে এর একটা ছোট সাইজ পেলে কিনে ফেলবে। এটা তো একেবারে সিনেমার মতন। এটা ওর ঘরে ঝোলালে, একেবারে চমকে যাবে বউ। ম্যাড়ম্যাড়ে দেওয়ালটাও। দিন দশ হবে ঝুলছে আলোটা। এতদিনের দেখা আলোগুলোর চেয়ে আলাদা। তাই ওর কৌতূহল। এটার দাম কত ? এর ছোট মাপ হলে কত ?
বছর পাঁচেক ধরে এই দোকানের উলটোদিকের স্ট্যান্ডে নিত্য গাড়ি লাগায়। আর সেই থেকে ছোটবেলার নেশাটা ওকে পেয়ে বসেছে। আলোগুলোর কত জমক দেখে নিত্য। কালো পরতে সাদা নিকেল করা। চিনেমাটির কাপের মতো দেখতে। ঘষা কাচে ঝাড়বাতির নল বাঁকান পদ্মের ডাঁট। উলটানো কুঁজো। লম্বা কাচের গ্লাস। বেঁকানো ঝিনুকের খোলস। আবার পাটের দড়ি থেকে ঝোলা বাল্ব। নীচের আলো ফেলা আলো। কত্ত রকমের। শেষে আকাশ-বাতাস এক করা ওই চেনা ঝাড়বাতির দাম। ইয়া শরীর তাদের। গোল। এখন ত্রিভুজ বা চৌকো কতরকমের হয়েছে ঝাড়বাতি। সবচেয়ে বেশি এগুলোই চলে। নিত্য ভাবে, আরে বাবা জ্যামিতি বই নাকি যে দেওয়ালে ছাদে এসব ঝোলাতে হবে। কিছু খদ্দের নেয় জ্যামিতি আলো। কিন্তু ওর শঙ্খের মতো দেখতে আলোগুলো একেবারে স্বর্গীয় যেন। ইন্দ্রের সভায় এরকম আলো ছিল হবে। তাই জিজ্ঞেস করে নিত্য।
— এই কত গো ?
আলোর দোকানের ছেলেটা পাত্তাও দেয় না। কাচ মুছতে মুছতে ওকে ছেড়ে কোণে চলে যায়। নিত্যর চোখে এই ঝাড়বাতির আলো ঝলকাচ্ছে। শুধু কি তাই? ওর কানে বাজছে হাজারো শাঁখ। সঙ্গে টুংটাং শব্দ হাওয়ার দুলুনি।
ছেলেটার হাতের আঙুল সব আলো ভরাট যেন। ওর হাতের ময়লা কাপড়ের ময়লা উধাও, শুধুই আলোর হাসি। হলুদ আলোর সামনে সাদা আলো। সাদা আলোর সামনে হালকা বেগুনি।
নিত্য ভাবে, যাহ্‌ তাল কেটে গেল। ততক্ষণে ভুলুর ভ্যানরিকশা এসে দাঁড়াল। ছেলেটা ইশারায় দেখাল মেঝেতে রাখা ঝাড়বাতি। ওটা হাতটানা ভ্যানের খড়বিচুলির বিছানাতে করে যাবে। ভুলু লোকালে কাচের জিনিস এভাবেই নিয়ে যায়। কটা ঝাড়বাতি যাবে ধীরে শুয়ে শুয়ে। আর কটা যাবে ওর হলুদগাড়িতে চড়ে বসে।
এখনও এই ট্রাম রাস্তায় বাস একটু কম। রোদ একটু এগিয়ে-পিছিয়ে যাচ্ছে অশ্বত্থ গাছের পাতায়। মানুষও। ভুজি-চা খাচ্ছে লোকে। আর চায়ের ভাঁড় হাতে এপার-ওপার করছে। চা-বিস্কুটের স্বাদের সঙ্গে নিত্য যেন আলোও খাচ্ছে। বা হাতেমুখে মাখছে। আলোর ছায়ায় টুংটাং মজলিস।
সেকি? এরই মধ্যে খদ্দেরের কাছে নিন্দেমন্দ করছে নাকি দোকানের ছেলেটা। নিত্য বেশি দর হাঁকে ? এটাই বলছে বুঝি? তাই হবে। সে যে গরিব ট্যাক্সিচালিয়ে। তাও হলুদ গাড়ির। ফ্যাকাশে উর্দি-পরা। একটু বকশিস না চাইলে চলে।
নিত্য ভাবে, ছেলেটা জানে নাকি একটা গাড়ি চালাতে কত লাগে ? তেলের দাম ? তার উপর ফ্যামিলি ? মানে পরিবার। এদিকে বউ পোয়াতি। তাই মা ঠেলে দিয়েছে ওর কাছে। ইস। কি দারুণ। নিত্য কাচ দেওয়ালে হাত ঠেকায়। আলো ধরতে চায়। অমনি রে রে করে দোকানি ছেলেটা। বলে,
— ক্যা দাদা, কালা হাত কিউ লাগাতে হো।
— আচ্ছা ভাই। দাম বল না রে। এটার।
— ইটাই লিয়ে যাও। ছেলেটা হাসে। ক্রেতা ওকে ফিরে দেখে। ছেলেটা ফের বলে,
— চালিশ হাজার। তরতর করে আলো যেন এগিয়ে গেল ক্রেতার দিকে। ক্রেতা বললেন, দাও আর কি!
নিত্যও হাসেন। মন খারাপের হাসি। এ কথা ঠিকই কিনতে পারে না সে। নিত্য ট্যাক্সিচালিয়ে। আটটা পেট চলে ওর রোজগারে। শুধু পেট, ছোট দুই ভাই আর বোনের পড়া। বাবার অসুখের খরচ। মায়ের রক্ত না থাকার ব্যামো। বন্যার জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে। সঙ্গে তিনমাসের পোয়াতি বউয়ের খরচ জুড়েছে গত বোশেখে। বউকে মা কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। পোয়াতির জন্যে ওকে একটা ঘর নিতে হয়েছে। আর রান্নার গ্যাস। আর বাতি। সাদা আলোর বাতিতে বসে খায় দুজনে। সকালে ছাতু খেয়েছে। এবারে ঘুরবে। যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজে আসে।
বউ আসার পর থেকে নিত্য একটু তাড়াতাড়ি ফিরত ঘরে। বউ বসে থাকে ওর অপেক্ষায়। বউয়ের এমন অবস্থায় খিদে পেলে বাচ্চার কষ্ট, বউয়ের কষ্ট। কিন্তু আজকাল যে কত খরচ, ওষুধ, খাবারের। ও তাই রাতভোর করে কলকাতাময় ঘোরে। ভোর হলে কত যাত্রীদের পৌঁছে দিয়ে ভাবে ডাবল ডিউটি করবে। চা খেয়ে ঘুম তাড়ায়। কিন্তু শরীর যেন শত্রুতা করে, চোখ বুজে আসে। তখন চা নিয়ে তাতিয়ে নেয় এই ঝিমিয়ে পড়া মেজাজ।
এখনও সক্কালেই চোখ বুজে আসছে। রাতভোর গাড়ি চালিয়ে একটুমাত্র ঘুম দাবি করে শরীরটা। ও গাড়ির সিটে বসে ঝিমোয়। এই গাড়িটাকে ভালোবেসে ফেলেছে নিত্য দশটা বছরে। মালিক সিংজির কাছে ওর একটা পোক্ত জায়গা। আর ওর মনে পোক্ত হচ্ছে আলোর দোকানে দাঁড়ানর ইচ্ছেটাও।
ও তাই এদিকওদিক না ঘুরে, হাওড়া থেকে সোজা এল এই আলোর দোকানের কাছে। রাস্তার কোণ জুড়ে আলোর দোকান। পুরনো। আলোগুলো নতুন সব। গোটা কলকাতার মধ্যে একটাই টান ওর। একটাই নেশা। তাই হ্যাঁ, ও শুধু একরকমের যাত্রীই বেশি তোলে। যাঁদের আলো কিনে দোকান থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। নিত্য আলোর দূত। কিন্তু ওর দৌঁড় ওই আলোর চৌহদ্দির ঠিক বাইরে পর্যন্তই।
দোকানে সব ইয়া বড় বড় ঝাড়বাতি। সাদা হলুদ আলো ঝলমল করে। কদিন হল বেগুনি, নীল, গোলাপি, সবুজ লাল আলো এসেছে। এসব পুজোর আলো। আলোর দোকানের ছেলেটা ঠেস দিয়ে বলেছে তাই, রোজ তো দেখ, ইটা নিয়ে যাও।
নিত্য হাসে। মনে মনে বলে, নেব, নেব। এখন টাকা নেই ওর। একটা সবুজ আলোর ঝাড়বাতি কিনল খরিদ্দার। ওকে বলেন,
— অ্যাঁই, চল। ডানকুনি। নিত্য চলে যেতে যেতে ঝাড়বাতিদের যেন বলে যায়। ঘুরে আসছি অপেক্ষা কর।

২.
— অত আলোর রকম থাকতে এই সবুজটা ? মানে হয় কোন। জোয়ান ছেলে, কাউকে বলছেন। বাড়ির লোকই হবে। মা হতে পারে।
— দাম মানে। এইখানে এসে কিনে পোষাবে ? বললাম অনলাইনে নিয়ে নাও। না, তোমাকে তোমার ঠাকুরদার চেনা দোকান থেকেই নিতে হবে। ঐতিহ্য। কি বলছেন উলটো পিঠে শুনতে পেল না নিত্য। কিন্তু ছেলেটা বলছে, হয়েছে হয়েছে, আর না হয় দাম নিচ্ছেই। এতগুলোর মধ্যে ওই সবুজ? এত রকমের নতুন আলো বেরিয়েছে। আগেরগুলো একঘেয়ে ছিল শুধুই হলুদ। উনি ধোঁয়াকাঠি জ্বালান। তারপর উলটে বলেন,
— জেনে কি করবে মা ? শোন, তোমার পছন্দ। নিলাম তো। এবারে গোটা বাড়ি পৌঁছুলে হয়। ব্যস। নিত্য অপেক্ষায় ছিল। দোকানের ছেলেটা ইশারা করতেই নিত্য কাঁধের গামছা ঝেড়ে বলে, আসুন।
ছেলেটা একটু মেজাজে বলে,
— আসুন মানে ? এসব কে তুলবে ?
দোকানের ছেলেটা তার সমাধান করল নিমেষে। বলে,
— স্যার, ওটা আমাদের কাজ।
পরে অবশ্য নিত্যকে সিগারেটও দিচ্ছিল। ও নেয়নি। তবে ছেলেটার হাতখোলা। নামিয়ে অমনি দিয়ে দিল দুশো টাকা। ব্যস্ত শহরে এটা রোজগার করতে ঝরা ঘামও শুকিয়ে যায়। নিত্য তখনই বউয়ের জন্যে নখপলিস কিনেছিল হাতিবাগানের ফুটপাথের বাজার থেকে। তারপর আর ফিরতে পারেনি ঝাড়বাতির দোকানের কাছে। সব যাত্রী ছিল হাওড়ার। ঘরে ফেরার। দুজন যাত্রী অনেক বাজার করেছেন। শেষে আলো কিনতে দাঁড়াল। নিত্য ভাবল একবার বলে। তারপর চেপে গেল। গড়িয়া থেকে শেয়ালদা যাওয়া যাত্রী কেন এদিকে আসবেন। তবে, ওর আলোর ছররা ছিল সুন্দর প্রদীপওলা।
দিনের শেষ ভাড়া নিত্য পেয়ে যায় ঝাড়বাতির দোকানের পাড়ার। খুব দ্রুত চালিয়ে আসতেও বাইপাস ছেড়ে ঢুকে মৌলালিতে আটকে খায়। এই প্রথম যাত্রীর চেয়ে চালকের তাড়া বেশি। জানবাজারে নামিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে আসতেও সময় —
কেউ হেসে কত গল্পও রেখে যান। যেমন, সেদিনেই তো। ভদ্রলোক মাঝবয়েসি যাত্রী। গোলগাল চেহারা। সাবেকি আমলের দুটো ঝাড়বাতি কিনলেন। ভ্যানরিকশার দিকে ফিরেও দেখলেন না। উলটো ফুটপাথে নিত্যকেই ইশারায় ডাকলেন। তারপর উঠেই কত গল্প। ভদ্রলোক বলতে পারেন বটে গল্প। ওনাদের বাড়ির গল্প। বাপ রে বাপ রে বাপ। সেই তো কিনেছিলাম বাবার সঙ্গে।
হলদে ঝাড়বাতি ছিল বাহারে। আর সাদা দেওয়ালে ঠিকরে পড়ত আলো। পুজোর দালানে সাদা চুন রং করান হত পুজোর আগে। লাল মেঝেতে আলপনা। সাদা আলপনা তাতে ঘট। দু পাশ ঢাকিদের। আর ওই দালানের চার কোণে চারটে ঝাড়বাতি। তখন সত্যিই এত রঙের আলো ছিল না। আর আলোর ঝাড় দুলত শুধু ওই ধনীদের ঘরে। এখন তো সস্তায় দিচ্ছে ঘরে ঘরে আলোর বাহার। সেইদিন কই ? তখন রাস্তা থেকেই লোকে পুজো দেখতে দাঁড়িয়ে থাকত। কত লোকে আলোর দিকে দেখত শুধু।
— তখন এত আলোর দোকান ছিল ? নিত্য প্রশ্ন করে। যাত্রী ভদ্রলোকের যেন সম্বিত ফেরে। উত্তর দেন,
— না, ছিল না। এখন লক্ষটা দোকান। সস্তার মাল। তখন বাবা কিনেছিলেন পাঁচ দিয়ে। এখন ত্রিশ হাজার। তাও নকল কাচ। আলোয় যেন সেই মায়া নেই। সেই ভার নেই। কেমন যেন …। এটা যে নিলাম মনেহয় নকল কাচের ঝাড়লন্ঠন।
নিত্যর সেদিন এসব শুনতে মোটেই ভালো লাগছিল না। ও তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে দেখে। আহা, অপূর্ব আলো। ফাঁকাফাঁকা কাটাকাটা এদিকওদিক দিয়ে বেরিয়ে আসে। ছিটকে পড়ে না, ছুঁয়ে দেয় শুধু। ও কখনও কখনও এক কাপ চা হাতে এগিয়ে যায়। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকে। সব আলোর মধ্যে সব আলো মিলতে চায়। মিশে মিশে থাকে, কোনও ঝগড়া নেই ওদের। শুধু মিলে মিলে থাকা। আলোর দোকানের ছেলেটা মিটিমিটি হাসে। নিত্য দেখে আলোরাও হাসছে।
নিত্য ভাবে, আহা, বললেই হল, কাচের নকলে আলো কম পড়ে নাকি ? ওই যে দুগগা পুজোয়, অত বড় ঝাড়বাতি দোলে। সব নকল নাকি ? হয় নাকি ?

— আচ্ছা, ঝাড়লন্ঠন বলে কেন? নিত্য জানতে চায়।
প্রশ্ন করলেও উত্তর কেউই দেয় না। ভিড়ের মধ্যে ভিড়ে চোখেও পড়ে না, কে প্রশ্ন করছে। পুজো শুরু। মাইকে গান আলো আমার আলো …। নিত্য গলা মেলায়। ওর বউ কিন্তু আলোর সমঝদার। আলো দেখাতে তাকেও নিয়ে বেরিয়েছিল নিত্য। সেদিন ওর বউ বোঝাতে চায় লন্ঠন ব্যাপারটা। লন্ঠন একটা ছোট ব্যাপার। কেউ ভুল করে বলে হয়ত, জান। লন্ঠন তো আর ঝাড়বাতি নয়। সেই আনন্দেই হবে বউকে নিত্য এদিকওদিক ঘুরে দেখায় শহরের।
— কি মায়া বল ? বউ প্রশ্ন করে না। বুঝতে চায় নিত্যর ভাব। নিত্য দেখায় বউকে,
— ওই দেখ পরী। ওই দেখ মনুমেন্ট। ওই দেখ ময়দান। কত আলোর খেলা বল তো শহর জুড়ে। পুজো মানে শহরে তো আলোর জোয়ার।
ওর বউ অবাক। এসব গ্রামে দেখেইনি। গ্রাম মানে তো এতটুক। এপাশে বটতলা, ভুজঙ্গপুরের মোড় অনেকটা ঢেকেছে। থেকে বাঁদিকে নয়নপুর। ওপাশে ডুমুর, নিম, কাঠবাদামের সঙ্গে আরও কত গাছেরা। মিলেমিশে গেছে তারই এক দেওয়ালে ছয়ছোট্ট মন্দির। তাতে একটা ঝাড়লন্ঠন ঝুলত। সেই স্কুলবেলা থেকে দেখে আসছে নিত্যরা। আর তার অদ্ভুত বাঁকে বাঁকে কত না কালচে কাজলের মতন। কে যেন বলত, এ ব্রিটিশযুগের বাবা। এখানে ঝুলছে। কোনও কেউই প্রতিবাদ করেন না ওদের নয়নপুর গ্রামে। এটা বড় গুণ। সব্বাই ভাবে, হবে বা।
কেউই বলেনি কখনও এই তো দেশ স্বাধীন হলে পর, জলায় আসতে আসতে বসতঘর হল। চালাঘর। ঘরের পায়ের চার খুঁটিতে জল। যেন হ্রদের মধ্যে থাকা। তবে সেখানে মন্দির তো ছিল না। এই একটা রাস্তা ওদিক থেকে মেন রোড ধরে নেয়। বাঁশবাগান পেরলেই। ওদিকে তো তারপর রায়বাবুদের বাড়িটা দেখা গেল সেবার জঙ্গল কেটে ফেলতে।
রায়বাড়ির আটচালায় দুলত। হাওয়া দিলে টুংটাং শব্দ হত ঝাড়লন্ঠনের। আর তার পাশে ছিল মাটি-ঘাসের রাস্তা। সেটা দিয়ে ওদের সেই অঞ্জলি দিতে যাওয়া। তখনই ওর বউয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা। নিত্য পরপর তিনদিন গেছিল। সুগন্ধ চালের ভোগপ্রসাদ খেয়েছিল পাশাপাশি বসে। আহা, জিভে ঢেঁকুরে থেকে যেত বিকেল পর্যন্ত। আর সন্ধ্যায় জ্বলত ওই আলো। হলুদ মায়ার আলোয় ওর বউকে দেখা। আর ঠিক করে ফেলা, এই মেয়েকেই বিয়ে করবে। লক্ষ্মীপুজোয় বিয়ে হল। সেদিন সব ঘরের দুয়ারে প্রদীপ জ্বলছিল। ওদেরও ঘরে আলোর ছররা দুলছিল। নিত্য জানত ওর বউও আলো পছন্দ করে। তাই বিয়েতে এক লতানে আলো দিয়েছিল। বউয়ের মুখখানা আলতো আলোয় আরও সেজে উঠেছিল।
নিত্য এখন আর যায় না গ্রামের পুজোয়। এদিকে প্যাসেঞ্জার অনেক পুজোর কদিনে। ওই কদিন সারাক্ষণের বুকিং মেলে। অনেক কামাই। তাই গ্রামের আলোর কথা ভাববার সময় নেই। বরং ওর পণ এখন বউকে বাচ্চাকে নিয়ে ওই হলদে ঝাড়বাতির আলোর নীচে ঘুমানোর। হাতে বেশি সময়ও নেই যে। পুজোর মাসেই ওর বউয়ের বাচ্চা হবে। মাত্র আর কটা দিন।
হিসেব করে দেখেছে নিত্য। মালিককে দিয়ে তিনশো থাকল। আর তিনশোর থেকে রান্না খাওয়া সিগারেট চা মিলে দেড়শো টাকা। আর দেড়শো রইল। সেটা বেশিকিছু তো নয় ? ঘরভাড়া দিতে হয়। বাড়তি খরচ কত। আর বউয়ের জন্যে চপ, ভাজি, ক্লিপ, চুড়ি এসবও নিতে হয়। বউ খুশি হয়। হাসপাতাল থেকে বলেছে, এইসময় মাকে খুশি রাখবে, তাহলে বাচ্চাও খুশি হবে। নিত্যর প্রতিজ্ঞা। বউয়ের আবদার রাখবেই। সে এমনই ঝাড়বাতি চেয়েছে।
ও বলেছে, দেবে। বাচ্চা হওয়ার আগেই দেবে। তাই ঘরের ছাদে গত রোববারে সিলিং থেকে ফুটিয়ে একটা ইলেকট্রিক তারের কানেকশনও করে ফেলেছে। এবারে শুধু ঝাড়বাতি ঝোলানর অপেক্ষা।

৩.
মহালয়া থেকেই ভিড়। গাড়ির এদিকওদিক যাওয়ায় নিষেধ। বাঁশের বেড়া রাস্তার পেট দেয় ছোট করে। শহরে আজকে কি যে হল? একটাও ভাড়া হল না নিত্যর। আলোর দোকানে একটা আলো দেখাতে গিয়ে সব লাইন গেছে উড়ে। তাই নিয়ে দমকল এল। আলো জ্বলেনি দোকানে। নিত্যর তাই মন খারাপ খুব। এদিকে পুজোর মাত্র পাঁচদিন আর। ওর বউয়ের বাচ্চা হওয়ার সময়ও এগিয়ে আসছে। নিত্য টাকা জোগাড় করতেও পারেনি। দোকানের সবচেয়ে কমদামি ঝাড়বাতি পনের হাজার। ওই যে উলটো শাঁখের মতো ওটা চল্লিশ। ওর পক্ষে যে অসম্ভব। এরকম একটা ছোট কিনে দেবে বউকে। কলকাতায় ওর বউয়ের প্রথম পুজো। নিত্য দিনে গাড়ি চালিয়েছে বেশি। আর রাতে কোথাও গিয়ে দাঁড়াচ্ছিল। সামনের সিটে বউ ঘোমটা চুড়ি সাজ করা। পেছনে দুজন হলেই ও নিচ্ছিল।
— বড় পরিবার বাদ আজকে, বলেছিল বউকে।
বউও মুগ্ধ। দেখছিল কতশত আলোর ঢল। নিত্যর কথা শুনতে শুনতে একেকটা প্যান্ডেল পেরিয়ে যায়। নিত্যর বউ আলোর দেবতাকে প্রণাম করে। একটু আলো যদি পেটের ভেতরে দিয়ে দেয়া যেত ? বাচ্চাটা আলো দেখতে পেত। বউয়ের ইচ্ছে নিত্য শোনে। মনে মনে বলে, আলো তোদের কিনে দেবই।
পুজোর শুরুতেই বউ বায়না করে, বিরিয়ানি। কোনওদিন সে খায়নি। নিত্য বলে, চল। দোকান দেখে ওর বউ অস্ফুটে বলে ফেলে, কিন্তু দাম?
— অত টাকা দেখিস না রে। নিত্য বলে।
বিরিয়ানির দোকানের গায়ে মেঝেতে সাদা হলদে আলো। আলোর স্রোতে মানুষের ঢল, নাগাল পেতে ওরা লাইন দিয়েছে। এপাশে নিউ মার্কেটের লাল দেওয়াল। ওদের মাথার উপরে জ্বলছে লম্বা আলোর ফিতে। নিত্য বউকে বলে,
— তিনটে বাজে রাত মনেই হচ্ছে না, দেখ।
বউ মাথা নাড়ে, বলে,
— হ্যাঁ, আরেকটু পর ভোর।
— আরেকটু পর মায়া আলোগুলো সব নিভে যাবে। নিত্য বলে। সায় দেয় বউ।
ওরা এভাবেই কত সব আলোর রং নিয়ে আলোচনা করে। একটা আলোর প্রজাপতি দেখে নিত্যর বউ বায়না করে।
— আলোর পরজাপতি, কি সুন্দর। গ্রামে নিয়ে যাব এটা ? নিত্য সায় দেয় বউয়ের কথায়।
নিত্য জানে, আলোর ব্যাপারটা সে বেশ বোঝে এই পাঁচ বছরে। সে অভিজ্ঞ। তাই আলো কিনে ওঠা প্যাসেঞ্জারকেও বলেছে,
দোকানে হরেক আলোর মধ্যে কি আর চোখে পড়বে ? সেই মায়া তো চোখে দেখার একার মায়া।
— মায়া ? তা হবে। মায়াই বটে। অচেনা মানুষ মায়ায় উত্তর দিয়েছিল। দেখেছেন কীভাবে সেই আলোর মায়া স্তম্ভে স্তম্ভে ঝুলিয়ে দিয়েছে, সাদানীল গোলাপি-বেগুনিতে।
— খাপছাড়া। ছাড়া ছাড়া। নিত্য বলে।
নিত্য জানে মায়া কাকে বলে। সেই মায়ার স্বপ্নে রাত জাগে নিত্য।
বউ বলে, মায়া তো মানুষের হয়। আলোর হয় নাকি ?
নিত্য বলে,
— হ্যাঁ, হয়। মায়া মানে মন পড়ে যাওয়া। এই যেমন তোকে দেখে আমার মন পড়েছিল। আর তোর আমাকে দেখে নয়। বউ হাসে। হাসিতে মায়া লাগে। নিত্য বলে,
— গায়ের রং কালো আমার, তাই তুই না বলেছিলি।
বউ হাসে। বলে, মিত্যে।
— পাক্কা।
— হু।
নিত্য আজ খুশি। খুশিতে ঘুম আসে না নিত্যর। বউ হাসিমুখে ঘুমে।
নিত্য বউকে দেখে মনে মনে বলে, তোকে এমন একটা ঝাড়বাতি দেব কিনে। যার বাহারি আলো। যার আলতো আলো তোকে লেপটে থাকবে। নিত্য হাসে।
তবে দামের ব্যাপারটাও মাথায় ঘোরে। দিন নেই হাতে আর। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে নিত্যর ঘুম আসে না। কীভাবে টাকাটা জোগাড় হবে। ভেবেছিল হয়েই যাবে। পুজোতে কামাই ভালোই হয়। এবারে মন্দ হল ঝড়-বৃষ্টিতে।
বিড়ি ধরিয়ে বাইরেটা দেখে নিত্য। নাহ, এই তিনটে দিন খাটতেই হবে। শহর তো জেগেই রয়েছে। নিত্য ভেবে নেয় বেরিয়ে পড়বে এখনই। ঘুম না হয় তিনদিন পরই ঘুমাবে।
ওর গাড়িটা রাখা পাশের রাস্তায়। আলোর বাহারে রাতও দিন দেখাচ্ছে। গ্যারেজের শেষে ওর গাড়ি। গাড়ি সাফা করে স্টার্ট দেয়। গাড়ি নড়ে না। নিত্য জানে সব কলকব্জা। খানিক পর গাড়ি নড়ে উঠল। শুরুতেই পুজোয় বেড়াতে যাওয়ার যাত্রী পেল। হাওড়া। ঘরে ফেরার যাত্রী পেল শ্যামবাজার। ঘুরতে ঘুরতে কিছুতেই আলোর দোকানের দিকে আসতে পারল না নিত্য। রাতে গ্যারেজ করল বারোটা পেরিয়ে। তারপর একটা বিড়ি ধরায়। ধোঁয়া শেষ হয় এই সিগন্যালে। চারপেয়ে থেকে দুপায়ে বাড়ি ফেরে। বউটা ঘুমে। ঘরের মেঝে ডুবেছে জলে। এ তল্লাটে অবস্থা এরকমই হয়, তাই ভাড়া কম। গান বাজছে এসব উপেক্ষা করেই। নিত্য ভাবে একটু জিরিয়ে নেবে।
আলোর দোকানের ফোনে নিত্যর ঘুম ভাঙে। দেরি হয়েছে বলে নিজেই নিজেকে ছ্যাছ্যা করে। আলোর দোকান খুলে গেছে সেই কখন। আলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মন চাঙ্গা ওর। আলোর আবর্তে ওর বেশ লাগছে। দু দিনে অনেকগুলো আলো পালটে গেছে। পুজো বলে কথা, লোকে কিনছে আলো। ওর একটা প্রিয় আলো ছিল। সেটা নেই। নিশ্চিত বিক্রি হয়ে গেছে। ছেলেটা বলে,
— ঠিক ডুবালে। নিত্য কিছু বলতে চেয়েও দমে যায়। ঠিকই তো, পুজোয় গাড়ি বায়না করে রেখেছিল। আগে টাকাও দিয়েছিল। খরিদ্দারের সঙ্গে কথায় নিত্য জেনেছে, সবচেয়ে ছোট ঝাড়বাতির দামও অনেক। পনের, কুড়ি হাজার। মুখের কথা তো নয়। দুপুর পড়েছে তবুও ভাড়া মেলেনি।
একজন কালো রঙের কাচঘেরা মরচে মরচে কীসব নলের মতো আলো দেখছেন। বোদ্ধা মতন দেখতে খরিদ্দার। পয়সাওলা ভদ্রলোক। উনি একেকটা আলো বেছে বেছে জ্বালাতে বলছেন। অনেকক্ষণ চলছে। তবে আলোর রুচিবোধ রয়েছে।
বাহ্‌, অস্ফুটে বলে নিত্য। আর কিই বা বলবে। ভদ্রলোক তাকায়। গাড়ি এগিয়ে আনতে বলেন। ট্রাম লাইন ছেড়ে গলিগলি ধরে নিত্য। দক্ষিণ কলকাতার শেষপ্রান্ত। ঢাকের শব্দে গাড়ি জানলা ভর্তি। ঢকঢক খসখস কি বিচিত্র সব শব্দ হচ্ছে।
নিত্য ভাবে, ভদ্রলোক আলোর ব্যবসায়ী ? গাড়ির সিট, ডিকি ভরে গেছে বিভিন্ন ঝাড়বাতির অলস শরীরে। দরদাম হল।
নিত্য তিন হাজারে রাজি হয়েছে। ভদ্রলোক বলেই দিয়েছেন, বেলা পড়ছে দিনে দিনে পৌঁছুতে হবে। নইলে আবার সন্ধ্যার দিকে আলো চলে যায়। একটু দূর জন্নতপুর। ২৪ পরগণা শেষ বলে ও জানত। কিন্তু এটা আটচল্লিশ হবে বা। তাতে ওর কি? শুধু হয়ত সারাদিনে আর ভাড়া নিয়ে ফিরে আসা হবে না ওর। নিত্য দ্রুত চালাতে চেষ্টা করে। বাইপাস ফাঁকা।
নিত্য ভেবে নিয়েছে, অতদূর গেলে কোনও একটা হাসপাতালে দাঁড়াতে হবে ফেরার সময় ভাড়া ধরতে। যেখান থেকে মরমর রোগী নিয়ে কলকাতা ফিরে আসা যায়। টাকা রোজগারের জন্যে খাটনি দিলেই হবে না, মাথাও খাটাতে হয় ওকে। হাজার পেরচ্ছে না কতদিন হল।
এই রোজগারের সঙ্গে ওকে একটু কুবুদ্ধিও খাটাতে হবে। সিংজিকে এই রোজগারের কথা চেপে গেলে, কেমন হয়। হিসেবে দেখাতে হবে হাজার হয়েছে খালি। কিন্তু ঠিক হবে তো ? বাকি দুহাজার একেবারে আলোর থলেতে ? আরে, একটু ট্রেনের গণ্ডগোল না লাগলে, তেমন ঝড়-বৃষ্টি না হলে লোকে হলুদ গাড়িতে চড়ে না। ভাবতে ভাবতে একটা ঠোক্কর খেল।
চলে এসেছে কোনও একটা গ্রামের দিকেই হবে। ওই মাঠে সূর্যের বিছানায় ধানগাছ খেলছে। গাড়ি থামতেই কজন এল। আলো নামিয়ে নিচ্ছে বড় দালানে। রায়বাড়ির চেয়েও বড় দালানবাড়ি। শরবত দিল। আর পেট পুরে খাওয়াও। এবাড়ির বৃদ্ধা মা ওকে খাবার আর দুহাজার টাকা আরও। পুজো বলে কথা, তাই সব্বাই খুশি থাক।
নিত্য খুব খুশি। এ টাকা ওর যে স্বপ্নপূরণের সম্বল। টাকার থলেতে চালান করে দিল দু হাজারের এই নোটটাও। মোট কত হল গোনার জন্যে উশখুশ করছে নিত্য। বেলা শেষ হচ্ছে। গুনবে এখন নাকি এগিয়ে যাবে শহরের দিকে। শেষে গুনেই ফেলল। দশ হাজার চারশো নব্বই টাকা। আজকের টাকাগুলো সিংজিকে লুকিয়ে ধরলে তবেই হচ্ছে। তাই করবে নিত্য? বলবে না। একটু মিথ্যে থাক না বউ-বাচ্চার জন্যে। লোকে যে কত চুরি করছে। এটুক না করলে ওর ঘরে ঝাড়বাতি দুলবে না। ওর বাচ্চা আলোর নীচে খেলবে না। এখন ওর মনে হচ্ছে কতক্ষণে শহরে পৌঁছুবে। ভরা পেটের আলসেমি টাকা গোনা — সব মিলে দেরি হয়ে গেছে।
গাড়ি বড় রাস্তায় উঠতে না উঠতেই বৃষ্টি শুরু। এখনও দূর অনেকটা। বেলা শেষ প্রায়। উঁচু টাওয়ারের মাথায় সূর্যের শেষ লাল টুপির মতো। তার নীচে ম্যাড়ম্যাড়ে ঘরগুলো আরও ঝাপসা আর মনখারাপের মতো দেখাচ্ছে। আলো বলতে একমাত্র সূর্য্যি ভরসা এখানে। এদিকটায় দেখে কে বুঝবে পুজো ? নিত্য ভাবে। বউয়ের ফোন লাগছে না। সে বেচারা চিন্তা করবে যে।
নিত্য দেখে ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। ক্রমে বৃষ্টি বেড়েছে। আগে জানলে সে কিছুতেই আসত না এদিকে। তবে নগদ চার হাজার টাকা, কম তো নয়। গাড়ির ভেতর নিত্য কাচ তুলে বৃষ্টি ধরার অপেক্ষা করে। আশপাশে কোন বাড়ি, ঘর, দোকান নেই। এমনকি একটা চালাঘরও। গাড়িটাই যা দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে। গাড়ির ভেতরে জল ঢুকছে ও বোঝে। অন্ধকারও জলে খেলছে ছলছল। কিন্তু জল বের করার উপায় নেই এমন বৃষ্টিতে। গাড়ি স্টার্ট দিতে হেডলাইট জ্বলে। একটু এগিয়ে যায় বড় গাছ ছেড়ে একটা মোড়ে। নাহ, জলের তোড়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না। চারদিক পুকুর। নিত্যকে অপেক্ষা করতেই হবে।
টিনের চাল থেকে আরও কি কি যে উড়ে আসছে, নিত্য চোখ বুজে ফেলে মধ্যে-মধ্যেই। ও ভেবে নিয়েছে। বউয়ের জন্যে চুলের বাহারি ক্লিপ নেবে। নখপালিশ। টিপ, ফলস চুলের গোছা। সব নেবে নিউ মার্কেট থেকে। চেনা কত দোকানদার ওকে ডাকে। এসব পেলে বউ কত খুশি হবে যে। আর তাহলে ঝাড়বাতি পেলে ? না, এখন কিছু বলবে না তো বউকে। চমকে দেবে আগামীকাল, ষষ্ঠীর দিন। সবটা টাকা আজকে কলকাতা পৌঁছেই দিয়ে দেবে আলোর দোকানে। আর বলবে দেখাও তো কোনটা হয়। আজকেই যাবে আলোর দোকানের ছেলেটার সামনে। টাকা দেখে ছেলেটা অবাক হবে খুব। আলো কিনিয়েদের সব্বাইকে সেলাম ঠোকে ছেলেটা। ওকেও ঠুকবে ? বৃষ্টি শেষ হতে একটু জিরিয়ে নিলে মন্দ নয়। ওর চোখ বুজে আসে আবেশে। হয়তো বা স্বপ্নে শঙ্খমালার ঝাড়বাতির নীচেই ঘুমায়।

— জ্ঞান ফেরেনি দু’দিন হল। মধ্যে একবার তাকিয়েছিল। কিছু যেন বলতে চায় এই পেশেন্ট, বলেন সেবিকা। ওই সাদা আলোর দিকে দেখাচ্ছিল আঙুল দিয়ে। তারপর আর চোখ মেলেনি এখনও।
— চারপাশে জল। জলের মধ্যে গাড়ি ভেসে গেছে। কিন্তু কী করে ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়ল, মাথায় আসছে না। বলেন আলো কিনতে আসা ভদ্রলোক। তিনি ওকে ভর্তি করেছেন। আরও বলেন, ওর গাড়িতে কোনও কাগজ, ঠিকানা, নাম্বার মেলেনি। সব ভেসে গেছে জলস্রোতে।
সেবিকা উত্তর দেয়,
— যা জল হচ্ছে। পুজো মাটি এবারে।
— আলোর দোকানেও ফোন করে যোগাযোগ হল না। এদিকে পুল ডুবে গেছে।
জ্ঞানহারা নিত্য চোখ মেলেছে সাতদিন পর। সন্ধ্যা তখন। হাসপাতালের জানলা দিয়ে ভেসে আসছে পুজোর আলো। সেটা দেখেই বুঝি নিত্য বলে,
— বউ, ওই দেখ শঙ্খমালার আলো।
আরও কিছু বুঝি বলতে চাইল নিত্য। বুঝল না কেউই। দেখল শুধু আঙুল দিয়ে কিছু দেখাচ্ছে জানলার দিকে। ওই আলোর দিকেই বোধহয় নিত্য যেতে চাইছে।