স্বর্ণলতা – দেবাশ্রিতা চৌধুরী

স্বর্ণলতা – দেবাশ্রিতা চৌধুরী

স্বর্ণলতা         (ছোটোগল্প)

দেবাশ্রিতা চৌধুরী

পাবদা মাছের ঝোল মুখে দিয়েই আঁতকে উঠলেন সমীরবাবু। কিন্তু কিছু বললেন না। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে, মমতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

— কি হলো ? ঝাল বেশি না নুন বেশি ? কি তৈরি করে গেছে ছোটলোকের বেটি ?
তবুও নিশ্চুপ হয়ে খেয়ে উঠলেন সমীরবাবু।
মমতা ভাবতে লাগলো, ভাত যেন একটু বেশিই খেলেন আজ! ব্যাপারটা কী হলো!

চুড়ো করে একথালা ভাত নিয়ে চারপাশে শাক, ভাজা, তরকারি, মাছের ঝোলের বাটি নিয়ে খেতে বসলেন মমতা দেবী। প্রবল উত্তেজনায় প্রথমে মাছের ঝোলের বাটিতে আঙুল দিয়ে ঝোল পরখ করে দেখা হলো!
— কী হলো ? মন্দ তো হয়নি। ভদ্রলোক সজল চক্ষু হলেন কেন? স্বগত উচ্চারণে বলছিল।
একা একা কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করেনি পেছনে সমীরবাবু দাঁড়িয়ে আছেন।
— আমার মায়ের রান্না খেলাম যেন!
চমকে ওঠে মমতা। মাথা নিচু করে খেতে থাকে।

(২)
লতার বাচ্চা দোলনায় চিৎকার করে কাঁদছে। সমীর ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে দোল দিয়ে কান্না থামিয়ে বোতলে দুধ বানালেন। মমতা ওকে ধরবেন না, জানেন তিনি। দুধ খাইয়ে কোলে নিয়ে ফ্ল্যাটের বারান্দায় হাঁটছেন। মমতা বিছানায় শুয়ে দিবানিদ্রার চেষ্টা করছে।

এক বছর আগে ইভিনিং ওয়াক করে পুজোর ফুল মিষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরছেন সমীরবাবু। আকাশ জুড়ে মেঘ। হঠাৎ হাওয়া ছেড়েছে। ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস। বড় রাস্তায় না গিয়ে অন্ধকার গলি দিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসছেন সমীরবাবু। আচমকা একটা গাড়ি থেকে একটা মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে গাড়িটা দ্রুত চলে গেছে। গোঙানির আওয়াজ শুনে ছুটে গিয়ে দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় একটি মেয়ে পড়ে আছে।
এক মুহূর্ত চিন্তা করে, মেয়েটিকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। পরের সাতদিন হাসপাতালে কাটিয়ে ওঠার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয় কোথায় যাবে!
— ঠিকানা দাও পৌঁছে দেবো।
নিশ্চুপ মেয়ের চোখে জল। সাতদিনের মধ্যে একটি কথাও বলেনি।
সমীরবাবু আর কিছু না ভেবেই ওকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। পরিচিতি থাকায় পুলিশ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি ব্যাপারটা। ডাক্তারবাবুদের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন সমীরবাবু।

তারপর শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। মমতা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সমীরবাবুর এই কর্মকাণ্ড।
মেয়ে নিঃশব্দে একটু একটু করে এই সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। এ ব্যাপারে মমতার কোনো আপত্তি নেই। সহায়িকাকে বারণ করে দেয়, আর আসতে হবে না। মিনি মাগনা খাওয়াবে নাকি!!

একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেল লতা। ডাক্তার দেখে বলল, সে অন্তঃসত্ত্বা।
আবার বাজ পড়লো বাড়িতে। সমীরবাবু বুঝতে পারেন সে রাতের অত্যাচার ফল ধরিয়েছে। তিনি রুখে দাঁড়ালেন সমাজ, সংসার ও মমতার বিরুদ্ধে।

(৩)
মোহনপুর থেকেও আরও অনেক ভেতরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন দিনমজুরের বাড়িতে সেদিন কান্নার রোল।
পরেশ যখন যা কাজ পায় তা-ই করে। একটি মাত্র মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ওর সংসার। মেয়েকে মানুষ করার চেষ্টায় সব কষ্ট সহ্য করে নিয়েছে হাসিমুখে। সুখী সুখী সংসারে অর্থের অভাব ছাড়া আর কোনো কষ্ট ছিল না। ডাল-ভাতে সুখী পরিবার। মেয়ের যখন আঠারো বছর বয়স, হঠাৎ করেই বজ্রপাতের মতো সর্বনাশ ঘনিয়ে এলো। দৌড়ে এসে কয়েকজন খবর দেয় পরেশকে সাপে কামড় দিয়েছে। হাসপাতালে যেতে যেতে সব শেষ। অকূল সাগরে ডুবে যায় মন্টি মেয়েকে নিয়ে। মা মেয়ে বাইরের পৃথিবীটা এতো দিন দূর থেকে দেখেছে। বাস্তব সামনে এলে আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। তবুও সাঁতার কেটে পারে যাওয়ার চেষ্টা তো করতে হবেই। দরিদ্র গ্ৰামে কাজই বা কোথায়! মোহনপুরে চলে আসতে বাধ্য হয় ওরা। গ্ৰামের একজন কাজ ঠিক করে দিলো এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে। ওদের কথা শুনে মায়ায় পড়ে ছোট একটা ঘরে থাকতে দিয়েছে বাড়ির মালিক। মা কাজ করে, মেয়েও এটা সেটা কাজ করে টুকটাক। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি।

সুন্দরী মেয়েদের অনেক জ্বালা। বিশেষ করে গরিবের অল্পবয়সী মেয়েদের। বহু নজর থেকে বাঁচতে, নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত লতা একদিন হারিয়ে গেল। আক্ষরিক অর্থেই হারিয়ে গেছে। অন্ধকারে কারা মুখে কাপড় বেঁধে গাড়িতে তুলে ওকে নিয়ে তোলে আগরতলা শহরের অচেনা বাড়িতে। কয়েক দিন অমানবিক নির্যাতনের পর ফেলে দিয়ে যায় রাস্তায়।
সেখান থেকেই নিঃসন্তান সমীরবাবু ওকে নিয়ে এলেন।

মমতা কেন যে ওকে সহ্য করতে পারে না সমীরবাবু ভেবে পান না। তিনি ওকে ভর্তি করে দিয়েছেন আই টি আই-এ, কিছু হাতের কাজ শিখুক, জীবন চালিয়ে নিতে পারবে। সকাল থেকে সব কাজ গুছিয়ে ও ছেলেকে রেখে যায় কাজ শিখতে। সমীরবাবুর জীবনে এতো সুখের দিন আগে আসেনি কখনও। একটা শিশু তার হাসি কান্নায় আশেপাশের জীবনকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ দেয়। আমরা অনেক সময় ভাবি ছেলেমেয়েদের জন্য এই করেছি, সেই করেছি কিন্তু ভুলে যাই আমাদের যে দু’হাত ভরে জীবন দেয় শিশুটি, তার বেলা!!

রবিবার লতার ছুটির দিন। বাচ্চাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করছিল। সমীরবাবু একটু বেরিয়েছেন। সপ্তাহে এই একদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যান।
এই সময় হঠাৎ মমতার চিৎকারে লতা ছুটে এসে দেখে বাথরুমে পিছলে পড়ে আর উঠতে পারছে না মমতা। বহু কষ্টে তুলে এনে সমীরবাবুকে ফোন করলো। তারপর হাসপাতাল। পায়ে ভারী ব্যাণ্ডেজ। মমতার এই দুঃসময়ে লতা এক মুহূর্ত কাছ ছাড়া হয়নি। বিয়াল্লিশ দিনের বিশ্রামে সব কিছু ভুলে মমতার সেবা চালিয়ে যাচ্ছে।

একদিন ছেলের সব কাজ গুছিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে মমতা কাঁদছে।
— কী হলো তোমার? ব্যথা করছে?
— আয় আমার কাছে আয়।
দু’হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছে। লতার চোখে জল, মুখে হাসি। এই দিনটার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছে সে। জড়িয়ে ধরে দুজনে একসাথে কাঁদছে। সমীরবাবু লাড্ডুকে নিয়ে ঘরে ঢুকে চোখের জলে ভাসছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল একদিন এই সময় আসবে। মমতা পারবে না মুখ ফিরিয়ে থাকতে।

— আমার কাছে লাড্ডুকে দেবে না!
লতাকে জড়িয়ে লাড্ডুকে বুকের উপর তুলে নিলো।
— মা বলে ডাকতে পারিস আমাকে লতা? আমার সংসার সম্পূর্ণ করতে পারিস না!

তবে কি গভীর গোপনে এটাই চাইছিল মমতা? নিজেকে চেনা এতোই সহজ!..