শ্যামাপোকার সন্ধানে – বিজয়া দেব

শ্যামাপোকার সন্ধানে – বিজয়া দেব

শ্যামাপোকার সন্ধানে    (ছোটোগল্প)

বিজয়া দেব

লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে চলেছে। যেন কিছু একটা খুঁজছে। কালীপুজোর পরের দিনের ভিড়, একটা পুজো প্যান্ডেলের সামনে লোকটা দাঁড়িয়ে রইল। প্যান্ডেলের চারপাশ দেখছে। ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছে কালু। তার মহা ব্যস্ততার মধ্যে লোকটার দিকে নজর পড়ল। কি খুঁজছে তখন থেকে? কিছু কি হারিয়েছে? বিক্রিবাটায় ব্যস্ত কালু থেকে থেকে লোকটার দিকে তাকায়। কাজ করতে করতে ভাবে — লোকটা কে হতে পারে? বেশ ভদ্র গোছের চেহারা, মোটেই পাগল বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু সেই থেকে খোঁজার পালা তো শেষই হচ্ছে না। কালুর দু’ হাত কাজে ব্যস্ত। কিন্তু মাঝেমাঝেই চোখটা চলে যাচ্ছে লোকটার দিকে। একটু রাতের দিকে বিক্রিবাটা যখন বন্ধ হলো, যখন সে দোকান গোটাতে ব্যস্ত তখন অবাক হয়ে দেখল লোকটা দেবীপ্রতিমার মুখে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। এইবার আর থাকতে না পেরে কালু চলে এলো লোকটার সামনে।
বলল — স্যার, তখন থেকে দেখছি আপনি কী যেন খুঁজে চলেছেন। কি খুঁজছেন স্যার?
— শ্যামাপোকা।
— শ্যামাপোকা? হ্যাঁ এই সময়টা শ্যামাপোকাদেরই সময় বটে। পেলেন স্যার? আমি তো এখনও একটিও দেখতে পাইনি।
— শ্যামাপোকার ইংরেজি নাম কি বলো তো?
— সে আমি কি বলি স্যার? লেখাপড়া তো তেমন শিখিনি!
— শেখোনি তো এখন শিখে নাও। ওর নাম গ্রিন লিফহপার। কোথায় গেল শ্যামাপোকা বলো তো? একটাও চোখে পড়ল না।
— স্যার যদ্দুর জানি শ্যামাপোকা ধানগাছকে নষ্ট করে দেয়। তাই কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশক দিয়ে শ্যামাপোকাকে ধ্বংস করছে। ওদেরই বা কী দোষ।
লোকটা গুনগুন করে গায় — “দোষ কারো নয় গো মা, আমি স্বখাতসলিলে ডুবে মরি শ্যামা।”
কালু লোকটার পাশে বসে থাকে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হয় না তার। বাড়ির মালিকটা বড্ড উৎপাত করছে। দু’মাসের ভাড়া বাকি আছে। কিছুতেই খরচা কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। ঘরমালিক তো সেটা বুঝবে না। তার দু’দিনের ভেতর ভাড়া দাও, নাহলে পথ দেখো। এই শ্যামাপোকা খুঁজে বেড়ানো লোকটার মতো যদি সে হতো তাহলে বেশ হতো।
সে ভাবছে লোকটাকে আরও একটু জানতে হয়।
— আমাকে জানতে চাইছ, তাই তো?
কালু অবাক হয়ে বলে — কি করে জানলেন স্যার ?
— কোনও সমস্যায় আছো, ভাবছো এই পাগলটার সাথে দু’মিনিট কথা বলে যদি শান্তি পাই। তাই না?
— না সেরকম কিছু নয়, আসলে আপনি যে বললেন শ্যামাপোকা দেখছেন না, সেটা নিয়ে আমিও ভাবছিলাম।
— তাই ? এত ব্যস্ততার মধ্যে এটাও ভাবো, মানে ভাবতে পারো?
— কেন পারব না স্যার? আমরাও তো মানুষ।
— না না সেকথা নয়, যারা শারীরিক পরিশ্রম করে তারা কতদূর ভাবতে পারে তা নিয়ে বলছি। মানে হলো শরীর ও মন দুটো নিয়েই তো মানুষ। এখন যে মনকে নিয়েই থাকে সে কিন্তু শারীরিক পরিশ্রমের দিকে দক্ষ নয়, সে একটা রাজমিস্ত্রির কাজ করতে পারে কি? পারবে না।
— কিন্তু বাবু, সত্যিই তো শ্যামাপোকা নেই হয়ে গেল, কেন?
— সেটাই। তুমি যেটা বললে, সেটা হতে পারে। কীটনাশক থেকে হয়তো মরে গেছে, আর নতুন করে জন্ম হয়নি।
— তবে স্যার বড্ড জ্বালাত। খাবারে পড়ে যেত। আলো যেখানে ওরাও সেখানে। আর গায়ে বসলে তো শান্তি নেই, পায়ে কাঁটামতো কীসব আছে, মনে হয় কামড়ে দিল। ওদের জ্বালায় খাবারের দোকান চালানো মুশকিল হয়ে পড়ত। সেদিক দিয়ে এবার একটু শান্তিতেই ব্যবসা করছি। স্যার আপনি শ্যামাপোকা কেন খুঁজছেন?
— কেন খুঁজছি? সেটাই তো, কেন খুঁজছি?
— ওগুলো বড্ড বিরক্তিকর স্যার, ধানগাছের কত ক্ষতি করে জানেন। কৃষকদের একেবারে মাথায় হাত পড়ে।
লোকটি মাথা নাড়ে। সম্মতিসূচক।
কিন্তু কালুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে যেন দেখতে পেল দেবী কালীমাতারও মনটা ভালো নেই, শ্যামাপোকাকে না দেখে। মানুষের কাণ্ডকারখানা তাঁর মোটেই ভালো লাগছে না।
— আচ্ছা স্যার ঐ পোকাগুলোর নাম শ্যামাপোকা কেন?
— আমিও ঠিক জানি না। তবে শ্যামাপূজার সময় আসে বলেই হয়তো নাম শ্যামাপোকা।
— হ্যাঁ স্যার, ঐসময়ে ওরা আগুনের সামনে আসে, পুড়েও মরে। নিজেকেই নিজেরা মেরে ফেলে।
— হ্যাঁ আত্মহত্যা বলতে পারো।
— না না স্যার, আত্মহত্যা নয়। মায়ের কাছে নিজেদের নিবেদন করে। না ওদের এভাবে মেরে ফেলা ঠিক হয়নি।
লোকটি মৃদু হাসল।
— স্যার, আমি এখন যাই। আমার ঘরের মালিক আমাকে দু’দিন সময় দিয়েছে ঘর ছেড়ে দিতে। সত্যিই আমার মনটা বড় চিন্তায় আছে। তাই আপনার কাছে বসে দু’দণ্ড কথা বললাম। আগামীকাল ঘুম থেকে উঠেই আবার তাগাদা দিতে আসবে লোকটা।

লোকটা ভারি ঠেলাটাকে টেনে বের করে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে।
পরিবেশবিদ সৌভিক চন্দ্র তাকিয়ে রইল তার চলার পথের দিকে। মনে হলো কত কত অন্ধকার জমাট বেঁধে হাজার হাজার প্রশ্নপত্রের সরল সমাধান করতে চাইছে আর উত্তরপত্রটি দেখাচ্ছে হিজিবিজির ম্যাজিক বিশ্বের মতো, পরীক্ষক হাতে লালকালির কলম নিয়েছে ডানহাতে, আর বাঁ হাতে মুছছে মাথার ঘাম।