পরিতৃপ্তি – সদানন্দ সিংহ

পরিতৃপ্তি – সদানন্দ সিংহ

পরিতৃপ্তি        (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

ঠিকে ঝি’র কাজে কমলা বেরিয়ে গেছে সাতসকালে। বিমলা আজকাল অত সকালে উঠতে পারে না। ছোটোখাটো একটা স্ট্রোক হবার তার শরীরটা বেশ দুর্বল লাগে। দিন বিশেক আগে হঠাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। ভাগ্যিস ঘরের বাইরে সে পড়ে গেছিল। বস্তির ছেলে মাছ বিক্রেতা মতি তখন বাজারে যাচ্ছিল। বিমলাকে তাদের একচালা ঘরের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে বস্তির কয়েকজনকে ডেকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। কমলা তখন ওখানে ছিল না, যথারীতি সেদিনও সে সাতসকালে বেরিয়ে গেছিল ঠিকে ঝি’র কাজে। তারপর পাঁচদিন হাসপাতালে ছিল বিমলা। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার সময় হাসপাতালের ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন সব সময় খেয়ে যাবার জন্যে। তার শরীরে নাকি সুগার-প্রেশারও আছে।
ষাট বছর বয়সী বিমলা কোনোদিন আগে সুগার-প্রেশার এর জন্যে ডাক্তারের ত্রিসীমানায় যায়নি। শুধু জ্বর বা পেট খারাপ হলে ওষুধের দোকান থেকে বড়ি কিনে খেয়েছে। সেই হাসপাতালের লিখে দেওয়া ওষুধ এখনো চলছে। সে জানে না কমলার আয়ে আর কতদিন ওষুধ চালিয়ে যেতে পারবে। অসুস্থ হবার পর বিমলার কাজকর্ম সম্পূর্ণ বন্ধ। শরীর বেশ দুর্বল। তার আগে সেও ছোটখাট ঠিকে ঝি’র কাজ করত, কিছু আয়ও হত।
বিমলা জানে তাদের বংশধরদের সবই মেয়ে। বিমলার মেয়ের নাম কমলা। রমলার মেয়ের নাম বিমলা। আর সরলার মেয়ে রমলা। বাবার চেহেরা বিমলার ঠিক মনে নেই। সে ছোট থাকতেই বিমলার বাবা অন্য এক মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেভাবেই বিমলার স্বামীও বস্তির এক বৌ-কে নিয়ে পালিয়ে গেছে অনেকদিন আগে যখন কমলার বয়েস পাঁচ বছর। তবে কমলার এখনো বিয়ে হয়নি।

খালের আশেপাশের সরকারি জমিতে বিমলাদের মতো অনেক লোক অনেকদিন আগে থেকে একচালা দু’চালা ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেছিল। তখন এখানে ছিল চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা একটা বারোয়ারি কাঁচা পায়খানা। এখন সরকার বস্তির লোকদের জন্যে সুলভ পাকা পায়খানা বানিয়ে দিয়েছে।
সেই সুলভ পায়খানায় দিনের ক্রিয়াকর্ম সেরে বিমলা তার টিনের ছাউনি দেয়া একচালা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটা কাককে লক্ষ করছে। ইদানীং আগের মত আর কাক দেখা যায় না, কোথায় জানি সব চলে গেছে। মাঝে মাঝে দু-একটা কাক হঠাৎ হঠাৎ ওড়ে আসে। বিমলা এদের আর তাড়িয়ে দেয় না।

কাকটা বিমলাদের ঘরের চালের বরাক বাঁশের কোটর থেকে কি এক জিনিস বের করার চেষ্টা করছে। বিমলা দেখে, কাকটা একটা কিছু বের করে ওড়ে চলে গেছে। হয়তো কোন খাবার যা আগে পাখিটি সঞ্চয় করে লুকিয়ে রেখেছিল।
এইসময় বিমলা দেখে একটা বাইক এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। বাইক চালক তার মাথার হেলমেট খুলতেই বিমলা তাকে চিনতে পারে, বরেণবাবুর ছেলে। বছর খানেক আগে এই বরেণবাবুর বাড়িতে সে একসময় ঠিকে ঝি’র কাজ করতো।
বরেণবাবুর ছেলে বলে, বাবা পাঠিয়েছে। দিদির বিয়ে। মাসী, তুমি কি আমাদের বাড়িতে তিন-চারদিন থেকে বিয়ের কাজে সাহায্য করতে পারবে ? এই ক’দিনের জন্য বাবা বলেছে দু’হাজার টাকা দেবে।
এই মুহূর্তে দু’হাজার টাকা বিমলার কাছে অনেক। তার টাকার দরকার। তাই সে নিজের শরীরের কথা চিন্তা করে বলে, বাবা, আমি ত অখন ভারী জিনিস আর উঠাইতে পারি না। শুধু হালকা কাজই আমি করতে পারমু।
— তোমাকে কোনো ভারী জিনিস উঠাতে হবে না। সেজন্য বলরামকে রাখা হয়েছে। তুমি আগামীকালই চলে এস।
— আইছা ঠিক আছে। আমার মেয়ের সঙ্গে আগে কথা কইয়া নিই, তারপর আমি কাইল যামু।

কমলাকে বুঝিয়ে হালকা কাজের কথা বলে বিমলা পরদিন বরেণবাবুর বাড়িতে গেল। বিয়ের বাড়ি বলে কথা, চারিদিকে চেঁচামেচি হৈচৈ, অনেক আচার-অনুষ্ঠান। চারদিন পরেই বিয়ে। সিঁড়ির কোঠাতে বিমলার থাকার জায়গা হল।
কেন জানি না, বিয়ে বাড়িতে কাজ করতে এসে বিমলার শরীরে যেন এক বল এসে যায়। চারিদিকে ছুটে কাজ করতে থাকে। বাসন মাজা, চা করা, মসলা বাটা, পুজোর ফুলের মালা তৈরি, রোদে জিনিস শুকানো ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বরেনবাবুর বাড়ির লোকেরাও বিমলার কাজে খুশি।
রাতে বরেণবাবুর স্ত্রী বিমলার কাছে আসে। বাসন মাজার পর বিমলা তখন রান্নাঘরে বাসন গুছিয়ে রাখছে। বরেণবাবুর স্ত্রী বলে, মাসী, শুনেছি তোমার শরীর ভাল নেই। আর তুমি দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করে যাচ্ছ সারাদিন। কাজের মধ্যে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি, তাই এখন এলাম একটা কথা বলতে। ভাত বাদে সারাদিন তুমি কিছুই খাওনি। শোনো, রান্নাঘরের ফ্রিজের মধ্যে অনেক মিষ্টি রাখা আছে। তুমি যে কোনো সময় যতগুলি ইচ্ছে ততগুলি মিষ্টি খেয়ো। আমি যাচ্ছি। বরেণবাবুর স্ত্রী চলে গেল।

রাত বারোটার দিকে এগোচ্ছে। বাড়ির অন্যরাও শোবার আয়োজন করছে। সবসময় মিষ্টি খাওয়ার শখ বিমলার প্রবল, দু-একটা আগে হাতের কাছে যখন পেত তখন সে টপাটপ খেয়ে নিতো। এখন রান্নাঘর ফাঁকা, বিমলা বাদে কেউ নেই। বিমলা কৌতূহলবশত ফ্রিজের দরজা খোলে আর অবাক হয়ে যায়। সে দেখে ফ্রিজের ভেতর থরে থরে সাজানো প্রচুর রসগোল্লা, সন্দেশ, কালোজাম, রাজভোগ, চমচম ইত্যাদি অনেক মিষ্টি। তবে বরাবর রসগোল্লা এবং কালোজামই তার পছন্দের। বরেনবাবুর স্ত্রীর কথা “যতগুলি ইচ্ছে ততগুলি মিষ্টি…” তার কানে বাজতে থাকে। লোভ সংবরণ করতে পারে না আর। এতগুলি মিষ্টি তার সামনে তার খাবারের জন্য তৈরি হয়ে থাকবে জীবনে কল্পনাও করেনি। জীবনে কোনোদিন একসঙ্গে দুটোর বেশি রসগোল্লা খেতে পারেনি। কাছে রাখা এক বড় প্লেট এনে সে পনেরটা রসগোল্লা আর দশটা কালোজাম প্লেটে রাখে। হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বলেছিলেন মিষ্টি আর চর্বি জাতীয় খাবার একদম চলবে না। সেই উপদেশ আর গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না বিমলা। ভাবে, আগে সারাজীবনের মতো পরিতৃপ্তির সাথে পেট ভরে আজ রসগোল্লা আর কালোজাম খেয়ে নিই, তারপর যা হবার হবে।