পাকা দেখা (ছোটোগল্প)
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য
আজ শ্যামার পাকা দেখা। সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত কমলা। হবু বেয়াই আর বেয়ান আসবে মেয়েকে দেখতে, বিয়ের পাকা কথা বলতে।
হবু জামাই আগে দেখে গেছে শ্যামাকে। সঙ্গে দুজন বন্ধুকে এনেছিল। পাত্রী পছন্দ হয়েছে, সে কথা গোপন রাখেনি। মেয়ের বিয়ের ফুল ফুটলো বলে। মনে মনে খুব খুশি কমলা। তবে চিন্তাও রয়েছে বই-কি। মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
আজ রায়পুর থেকে শ্যামার মামা আর মামীমাও আসবে। সবদিক একা হাতে সামলাতে পারবে না কমলা, তাই। অতিথি আপ্যায়নের কোনো রকম ত্রুটি যেন না হয়, সে কথা ভেবে সাত সকালে বাজারে পাঠিয়েছে কার্তিককে। “সব কিছু দেখে শুনে নিয়ে আসবে। ভুল হয় না যেনো। আর ভালো দই নিও, শুভ কাজ।” স্বামীকে বলে কমলা।
বিয়ে নিয়ে নিজের কোনো মতামত নেই শ্যামার। রোজ দিনের মত উদাসী মনে আজও মেশিনে বসে শালপাতা সেলাই করছিল। পাতার গায়ে পাতা বসিয়ে এক সুতোয় গেঁথে রাখছে। দুলাল বাড়ি বয়ে এসে নিয়ে যাবে সেলাই করা পাতা, মেশিনের ডাইসে সেলাই করা পাতা ফেলে শালপাতার থালা বানাবে।
রান্নাঘর থেকে কমলা বলে, ” আজকে ওই সব না করে আমার সঙ্গে কাজে হাত লাগালে তো উপকার হয়! লোকজন আসবে। আজও কি ওই কাজ না করলে চলছে না! বাপের আস্কারা পেয়ে পেয়ে ধিঙ্গি মেয়ে মাথায় উঠেছে।” মায়ের কথা গায়ে মাখে না শ্যামা। এতে আরও রেগে ওঠে কমলা। রান্নাচালা থেকে উঠানে নেমে আসে বলে, ” রাতদিন তার চিন্তাতেই বিভোর তুই। হায় ভগবান কোন কুক্ষণে যে তোকে রায়পুরে পাঠিয়েছিলাম…।”
কমলার মুখে ‘তার’ শুনে ভুবন আসে শ্যামার মনে। থমকে দাঁড়ায় শ্যামার হাতের কাজ। ‘সর্বনাশ’ এর দিনগুলি ভেসে ওঠে শ্যামার দুচোখের পাতায়। রায়পুর, মামাবাড়ি, খোলা আকাশ, শালবন, সুধা, মামী, মামার নজর চুরি করে উঁকি দিয়ে ভুবনকে দেখা, আর আর ভুবন, মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে সে সব দিনের কথা। আজ প্রায় সাত মাস হলো মামাবাড়ি থেকে ফিরে এসেছে শ্যামা তার নিজের গ্রামে। তারপরেও সারাদিন কোনো না কোনো ভাবে ভুবন আসে শ্যামার মনে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় সদ্য-অতীত হওয়া দিনগুলিতে। রায়পুর থেকে সুধা ফোন করে মাঝে মধ্যেই। বলে, “কেমন আছিস শ্যামা? জানিস সেইদিন ঘোষ পুকুরের পাড়ে ভুবনদা…।” ফোনের ওই প্রান্ত থেকে বলে চলে সুধা। এই প্রান্ত থেকে শ্যামা বলে, “কি হবে সুধা এ সব কথা শুনে? চোখের সামনে থেকেও …।” মাঝে মধ্যে মামী ফোন করে শ্যামাকে। বলে, “তোকে নিষেধ করেছিলাম পোড়ামুখি। আমার কথা আর শুনলি কই! এইবার বোঝ ভালোবাসার জ্বালা।”
মেয়ের সর্বক্ষণের নীরবতা দেখে মেজাজ হারায় কমলা, “হায় ভগবান! কেনো যে মেয়েকে আমার বাপের ঘরে রেখেছিলাম! এইবার আমার …।” শ্যামার সামনে নিজের অদৃষ্টকে গাল মন্দ করে কমলা। মায়ের কথার খুঁট ধরে কত কথা শ্যামার মনে এসে ভিড় করে। মেয়ের এমনতর অবস্থা দেখে আড়ালে কাঁদে কার্তিক। অষ্টাদশী শ্যামা, ভালোবেসেছে অজান্তে। ঠিক ভুল যাই করুক, পাপ তো করেনি যে এমন ভাবে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে! কমলাকে বোঝায় কার্তিক। কে শোনে কার কথা!
“বলছি থম মেরে বসে না থেকে বেগুনগুলোকে পিস পিস করে দিলেও তো আমার উপকার হয়।” বলে কমলা। সেই সময় বাজার থেকে ফিরে আসে কার্তিক। ভীষণ ব্যস্ত যেনো। কমলাকে বলে, “এই নাও ধরো তোমার বাজার। দীনুকে সঙ্গে নিয়ে আমি বাইরে যাবো। খুব প্রয়োজন, ফিরতে বিকেল হবে।”
“মানে?”, আকাশ থেকে পড়ে কমলা।
“মানে কিছু নেই। আজকেই যেতে হবে। নয়তো সব ভেস্তে যাবে। দীনুকে বলে আসি।” বলে কার্তিক।
“আজ শ্যামাকে দেখতে আসবে, পাকা দেখা। তুমি মেয়ের বাপ, বাড়িতে থাকবে না! কেমন লোক তুমি?” কার্তিকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় অবাক হয় কমলা। উঠানে দাঁড়িয়ে ভীষণ রাগে বাপ বাপান্ত করতে থাকে কমলা।
“কপাল করে স্বামী জুটেছে…।”
কমলার কথা হওয়ায় ভাসে, কার্তিক যায় দীনুর বাড়ি। আজ বাড়িতে শুভ কাজ, চান করে মঙ্গল ঘটে জল ভরবে কমলা। তারপর পুজো দিয়ে আসবে দাসেদের দুর্গাতলায়। তার আগে বাড়ির লোক মুখে কিছু না দিয়ে বাইরে যাবে! সংসারের অমঙ্গল হবে না? কাঠের উনুনে দু মুঠ চাল ফুটিয়ে দিতে হবে।
“উনুনে হাঁড়ি বসিয়েছি। খেয়াল রাখিস।” পুকুর ঘাটে যায় কমলা। মায়ের কথা নীরব থেকে কানে নেয় শ্যামা। খানিক পর দুলাল আসে সেলাই করা পাতা নিতে। আর তখন স্নান করে ফিরে আসে কমলা। দেখে দুলাল কথা বলছে শ্যামার সঙ্গে। ওদিকে ভাতের ফ্যান পড়ে চুলো নিভে যাবার উপক্রম। মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে কমলার। “কোন রাজ কাজ করা হচ্ছে শুনি? উনুনের দিকে খেয়াল নেই!” কমলার গলায় ভীষণ ঝাঁজ। দুলালের সামনে বিব্রত বোধ করে শ্যামা। পরিস্থিতির ভার বুঝে চলে যায় দুলাল।
“কি গল্প হচ্ছিলো শুনি?”
“গল্প কোথায় দেখলে তুমি মা!”
“আমার সাত কথায় একটারও উত্তর নেই। আর দুলাল এলেই কথার খই ফোটে মুখে।”
এরপর কমলার কথায় কথা দিলে সেই চেনা খাতে বইবে মায়ের মুখের তোড়। তাই চুপ থাকে শ্যামা। দুলাল তো আর এমনি এমনি আসে না। প্রয়োজনে আসে। বাড়ি বাড়ি শালপাতা পৌঁছে দেয় দুলাল। পাতা সেলাই হলে আবার সংগ্রহ করে নেয়। মেসিনে শালপাতার থালা, ডিস বানায়, শ্যামার মতো অনেকেই দুলালের কারবারের সঙ্গে যুক্ত।
শ্যামা বড় হয়েছে রায়পুরে, মামাবাড়িতে। মামাদের শালপাতার থালা বাটি বানানোর কারবার কাছ থেকে দেখেছে। সে কাজের সব কিছুই জানে। তারপর সেখানের দিন ফুরালে বাড়ি ফিরে এসে রাতদিন থম মেরে বসে থাকতো মেয়ে। কমলার বাক্যবাণ বিদ্ধ করতে শ্যামাকে। তাই পাতা সেলাইয়ের মেশিন কিনে দিয়েছে কার্তিক। কাজের মধ্যে ডুব দিয়ে ভালো থাকবে শ্যামা, সেই কথা ভেবে। “পই পই করে বলি বাইরের লোকের সঙ্গে বেশি কথা বলিস নে। কখন কোন কথার সঙ্গে কি বলে ফেলবি আর পাড়া ঘরে জানাজানি হবে।” বলে কমলা। কমলার এই এক ভয়। এই বুঝি পাড়া ঘরে সবাই জেনে যাবে শ্যামার কাণ্ড। আর মেয়ের বিয়ে ভেস্তে যায়। মায়ের কথা শুনে অবাক হয় শ্যামা। ভাবে, কি পাপ করেছি আমি? ভুবনকে ভালোবেসে যদি পাপ করেই থাকি তার প্রায়শ্চিত্তও তো নিজেই করছি। নির্মম দহনে দগ্ধ হয়ে চলেছে শ্যামা নীরবে। নির্জনে বসে মামীর কথা ভাবে। আজ বোঝে সত্যি কথা বলত মামী। “শ্যামা, ভালোবাসার আরো এক সুর শোনা যায় ভালোবাসার গানটি থামার পর। মনের টানে ভেসে চলার আনন্দ — সময়ে অধরা থাকে প্রেমের অন্য এক অনুভূতি। অগাধ আনন্দে প্লাবিত মনের অবসর কোথায় ভালোবাসা-ছাড়া দিনের কথা ভাবার? ভালোবাসার নদীটি যখন গতি হারায়, দিশাহীন হয়ে অন্ধ আবর্তে ঘুরপাক খায়, সেই নিস্তরঙ্গ জলাশয়েই প্রেমের অন্য রূপের প্রকাশ। নির্মল উচ্ছ্বাসের দিনগুলি তখন দুর্দিনের মাঝে ভিড় করে মনে। গুনগুন করে পুরানো কথা শুনিয়ে যায়। তখন এক পাহাড়ে বসে বহু দূরের অন্য এক অজানা পাহাড়ের দিকে ঝাপসা চোখে চেয়ে থাকা শুধু। কোনটা ঠিক, বেঠিক কোনটা সে হিসাব চায় না মন। শুধু বিভোর থাকে অবশ ভাবনায়। সে যন্ত্রণা ভয়ংকর বড়। শ্যামা, ভালোবাসার অনেক কথা বোঝা যায় ভালোবাসা হারিয়ে যাবার পর। সে যে না ফুরিয়েই ফুরিয়ে গেছে সেই কথা মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি মুহূর্তে। তার বেদনা বড্ড করুণ হয়ে বাজে বুকে।” ঠিক ঠিক ঠিক। একদম ঠিক কথা বলতো ছোটমামী। এখন বোঝে শ্যামা। ভুবনের মনে মন দিয়ে সেদিন এসব কথা ভাবার সময় ছিল না শ্যামার। সোনালি আলোয় উড়ে বেড়াত, প্রজাপতি যেনো।
“বলি তুই প্রশ্রয় না দিলে দুলাল কথা বলার সাহস পায় কিভাবে ? এখন বুঝি নিজের মেয়ে ঠিক না থাকলে অপরকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।” কথাগুলো বলে কাজে ব্যস্ত হয় কমলা। কমলার মুখের ‘অপরকে’ কাঁপিয়ে দেয় শ্যামার বুক। ভাবে, সে কি সত্যিই প্রশ্রয় দিয়েছিল ভুবনকে? হয়তো তাই। হয়তো কেনো। নিশ্চয় তাই। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা এই দুই অনুভূতির মাঝে প্রশ্রয় তো আসেই। অনিবার্য ভাবেই আসে। ভুবনকে রোজ দেখত শ্যামা। ছোটো মামার কাছে কাজ শিখতে আসতো ভুবন। কি যে মায়া ছিলো দুটো চোখে! মামাবাড়ির বাইরের ঘরে কাজ করতো ভুবন। একমনে মেশিনের ডাইস বদলে কখনো থালা কখনো শালপাতার ডিস বানাত। প্রথম প্রথম নানান অছিলায় বাইরের ঘরে যেত শ্যামা। দেখত ভুবনকে। দৃষ্টি মেলাত ভুবনও। সামান্য হাসি আর পলকের চোখ মেলানো, এতেই যেনো কথার পাহাড় পৌঁছে দিত একে ওপরের মনে। সে সবুজ পাহাড় ছায়া ফেলত শ্যামার সমগ্র ভুবনে। নিবিড় ছায়ার স্নিগ্ধতায় বিভোর হয়ে যেত শ্যামা। ভুবনকে দেখতে চাওয়া কেমন যেন অভ্যাস হয়ে উঠেছিল। সেই অবাধ্য অভ্যাসের খবর ছিল মামীর কাছে। “শ্যামা, পুড়ে মরতে হয় রে। ভালোবাসা কি তা ভালোবাসা হারিয়ে গেলে বুঝবি। ভগবান যেনো বিরূপ না হন তোর প্রতি”, বলে শ্যামাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদত মামী। সে কান্নার অর্থ এখন বোঝে শ্যামা।
“তুই কবে ভালোবাসায় ডুব দিলি শ্যামা?” জানতে চেয়েছিল সুধা। উত্তরে শুধুই হেসে ছিল শ্যামা। কবে প্রেমে পড়লো? তিথি নক্ষত্র দেখে কি প্রেম হয়! সে কথা নির্দিষ্ট করে কেই বা বলতে পারে? ভুবনের জন্য শ্যামার প্রেম যেনো জন্মান্তরের। শুধু হৃদয়ে ধ্বনিত হয়েছে অনেক অনেক পরে। এ বুঝি বহু আলোকবর্ষ দূরের কোনো নক্ষত্র। কোন সে আদিকাল থেকে তার বিকীর্ণ আলো প্রবাহমান পৃথিবীর দিকে। কোন এক ক্ষণে পৃথিবীর বুকে চুম্বন এঁকে সে আলো জানান দেয় তার উপস্থিতি। শ্যামার মনের প্রেমও তেমনই এক নক্ষত্রের আলো। কিভাবে যে শেষ হল সব! ভাবলেই মরুঝড় ওঠে শ্যামার মনে। মামা যেদিন জানলো, ভিতর বাড়িতে এসে ভীষণ মারধর করে শ্যামাকে। তারপর, তারপরের কথা শুনেছে মামীর মুখে। ভুবনকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল ছোটোমামা।” নির্লজ্জ, কখনো পা রাখবি না আর। কোনো ভাবেই শ্যামার সঙ্গে…।” তারপর এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে এসেছে শ্যামা। এদিকে শ্যামাকে নিয়ে সর্বক্ষণ তটস্থ থেকেছে কমলা। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হিম হয়ে এসেছে মায়ের বুক। আর কার্তিক কষ্ট পেয়েছে মেয়ের কষ্ট বুঝে।
“ওদের সামনে হাসি মুখে থাকবি। যা যা জিজ্ঞাসা করবে মিষ্টি হেসে জবাব দিবি।” শ্যামাকে আগেই বলেছিল কমলা।
পাত্রের বাবা-মায়ের সামনে শ্যামা ছিলো শ্যামার মতো। খুব খুশি না হলেও বিরক্ত হয়নি কমলা মেয়ের ভাব দেখে। শ্যামার বিয়ে এক রকম পাকা। আড়ালে শ্যামাকে ডেকে নিয়ে মামী বলে, “কি করবি শ্যামা, পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া ভালোবাসাকেই ভালোবাসতে হয় রে! মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস…।”
পাত্রের বাবা-মা বাড়ি পৌঁছে তাদের পছন্দের কথা জানিয়েছে। ভীষণ খুশী কমলা, দাসপাড়ার দুর্গাতলায় ধূপবাতি জ্বালিয়ে প্রণাম করতে গেছে। ঘরে বসে শ্যামা। অস্তাচলগামী সূর্য রাঙিয়ে তুলেছে আকাশ। কর্মহীন পথভোলা মেঘের দল লালচে আলোর স্রোতে ভেসে চলেছে কোন সে অচিন দেশে। শাড়ির আঁচলে চোখ মোছে শ্যামা। ফোনটা বেজে ওঠে। “কেমন আছিস শ্যামা? তুই একবার ফোন কর ভুবনকে। জানিস আজ কি হয়েছে? তোর বাবা…” কিছু বলতে চেয়ে ব্যাগ্র সুধা। সুধার কথা শুনতে ইচ্ছে যায় না শ্যামার। অন্য দিন হলে হয়তো বা আগ্রহ দেখাতো, আজ সে ইচ্ছে নেই। ফোনের লাইন কেটে দেয়। ভুবনকে সে ফোন করবে না কিছুতেই। যা শেষ হয়েছে তাকে আবার নতুন করে বাঁচিয়ে তোলা অর্থহীন। থাক। ভুবনকে ছাড়াই বাঁচতে পারবে শ্যামা। হ্যাঁ, পারবে পারবে পারবে। বালিশে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কাঁদে শ্যামা। কমলা বলে, “তোর কপাল ভালো এমন একটা পাত্র…।” বেলা শেষের আলো রয়েছে তখনও আকাশে। কার্তিক বাড়ি আসে। স্বামীকে সুসংবাদ দেয় কমলা। তারপর বলে, “তোমার মেয়ে বিয়েটাকে ভালো মনে মেনে নিলে বাঁচি।” কার্তিক রেগে ওঠে বলে, “শ্যামার ভালো মন্দ ওর উপরেই ছেড়ে দাও। আমি এই সবের মধ্যে নেই। যেখানে ইচ্ছে যায় বিয়ে দাও তুমি।”
বাবার কথা শুনে ভীষণ অবাক হয় শ্যামা। যন্ত্রণার দিনগুলিতে বাবার ভালোবাসা বাঁচিয়ে রেখেছে শ্যামাকে। আজ কি হলো!
কার্তিকের মেজাজ হারানোর কারণ আছে। আজ সকালে দীনুকে সঙ্গে নিয়ে রায়পুর গিয়েছিল কার্তিক, ভুবনকে দেখতে। ভুবনের বাবা মায়ের সঙ্গে কথাও বলেছে কার্তিক। মেয়ের বিয়ে ভুবনের সঙ্গেই দিতে চায় সে কথা শুনিয়েছে আজ। তবে বাদ সেধেছে ভুবন নিজে। এই বিয়েতে তার নাকি মত নেই। ভীষণ আশাহত হয়ে বাড়ি ফিরেছে কার্তিক। “যার যা ইচ্ছে যায় করুন। কপালে যা আছে তাই হবে। আমার চাওয়ায় কি আসে যায়।” বলে উঠে যায়।
কার্তিকের মুখে সব কথা শুনে কমলা বলে, “আমি আগেই বুঝেছিলাম ভুবন ছেলে হিসাবে সুবিধের নয় মোটেই। শ্যামাকে বোকা পেয়ে…।”
রাত্রি নেমেছে এবার। ঘরে বসে শ্যামা। বাবার মুখে শুনেছে ভুবনের কথা। বিশ্বাস হয়না এমনটা যে হতে পারে। হয়তো জমাট অভিমান থেকেই এমন কথা বলেছে ভুবন। তবুও ভুবন পারলো এমন কথা মুখে আনতে! মনের গচ্ছিত সমস্ত ভালোবাসা আজ পুড়িয়ে দেবে শ্যামা। তার আগে ভুবনকে ফোন করবে নিজে, বলবে সব কিছুর শেষ হলো আজ এই মুহূর্তে। ফোন হতে নিয়ে কেঁপে ওঠে শ্যামার বুক, পারবে তো বলতে? হ্যাঁ নিশ্চয় পারবে। হঠাৎ করেই বেজে ওঠে শ্যামার ফোন। মামীমা ফোন করেছে রায়পুর থেকে। কথা বলে শ্যামা মামীমার সঙ্গে। হায় ভগবান! শ্যামার দুই চোখের পাতা ভিজে যায় অবিরাম বর্ষণে। আজ বিকালে গ্রামে ফিরে গিয়ে কার্তিকের রায়পুর আসবার ঘটনা শুনেছে শ্যামার মামা আর মামী। বুঝেছে কার্তিকের মানসিক যন্ত্রণার কারণ। এতদিন বাদে ভাগ্নিকে দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে শ্যামার মামাও। দগ্ধ হয়েছে অনুতাপে। সেদিন রাগের তোড়ে অত বাড়াবাড়ি না করলেও চলতো, মনে হয়েছে আজ। রাতের বেলায় নিজে গেছে ভুবনের বাড়ি। ভুল হয়েছিল সেদিন, বলেছে নিজের মুখে। শ্যামার মামার আজকের ব্যবহারে অভিমানের বরফ গলেছে ভুবনের। শ্যামার মামীও ছিল সঙ্গে। শ্যামা আর ভুবনের বিয়ের কথাটা পাকা করতে ভোলেনি শ্যামার মামী। সেই খবরটাই দিয়েছে শ্যামাকে। কমলাকে খবরটা দিয়েছে শ্যামার মামা। খুব খুশি কার্তিক। এমনটাই চেয়ে এসেছে এতদিন ধরে।
সারারাত ঘুম নেই কমলার দু চোখে। রাত শেষে একরাশ চিন্তা নিয়ে কমলা বলে, “হ্যাঁগো মেয়েটা সুখী হবে তো?”
কার্তিক বলে, “ভগবান আছেন। নিশ্চয় সুখী হবে শ্যামা।”
পাশের ঘরে রয়েছে শ্যামা। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখে বাইরের পৃথিবী। ভোরের পাখি জেগে উঠেছে। পুব আকাশের মোম নরম লালিমা শ্যামার রাত জাগা চোখের পাতায় আলতো চুম্বন রাখে। নতুন দিনের আনন্দ সংকেত ফুটে ওঠে আকাশে। ভুবনকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করে শ্যামার।