বড়োদিনে (ছোটোগল্প)
শুভংকর নিয়োগী
অনেকদিন পর চমকাইতলায় কাদড়া গ্রামে বেড়াতে গেল অভয়। কথায় বলে, ‘জননী জন্ম-ভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী।’ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও বড়ো। তাই জন্মভূমির টানে মাঝে মাঝে যেতেই হয় গ্রামে। যত অ্যাডভেঞ্চার, দুরন্ত ও রোমাঞ্চকর স্মৃতিগুলো সব যে ওখানেই! অতীত স্মৃতি কখনো কখনো হয় বড়ো সুমধুর আবার কখনো কখনো হয় বড়ো তিক্ত। স্মৃতি-রোমন্থনে মনের আয়নায় ভেসে আসে কত কী! এই সেই ঘোষালদের খামার। এই খামারে একেবারে ছোটবেলায় কত ফুটবল ম্যাচ খেলেছে। ঘোষাল পাড়া পেরিয়ে বাড়ুজ্জে পাড়া। ওইদিকের সেই বাড়ুজ্জে পাড়ার খামার। খামারের মাঝে এখনও সেই নিমগাছ, সেই তেঁতুলগাছ এখনও দাঁড়িয়ে। এই নিমগাছে উঠে কত গাছের ডাল ভেঙে নিম কাঠি দিয়ে দাঁত মেজেছে। তখন নিম কাঠিই ছিল দাঁত মাজার একমাত্র সম্বল অভয়ের। খামারের দক্ষিণদিকে ঘটক-পুকুর। ঘটক-পুকুরের পাড়ে বাঁশের গোঁজে বাঁধা গরু এখনও বাড়ুজ্জেদের। পুকুরের পাড়ে ইউক্যালিপটাস গাছে ভরা এখন।
দুই খামারের মাঝে জ্যাঠাইমার গোয়াল-বাড়ি। গোয়াল-বাড়ির ভিতর থেকে জ্যাঠাইমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল অভয়,
‘কেমন আছ জ্যাঠাইমা?’
‘কে?’
‘আমি অভয়।’
‘কতদিন পরে এলি বল তো! আমি তোর কথা মাঝে মাঝে ভাবি! তোর সেই মিষ্টি দুরন্তপনা আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর তেমন দেখতে পাই না! তারপর হ্যাঁ, এক রকম আছি বাবা। চোখে ভালো দেখতে পাই না! তা তুই কবে এলি? কেমন ছিলি? সব খবর ভালো তো?’
‘আমি গতকাল এসেছি। একরকম ভালোই আছি।’ তারপর একথা সেকথার পর জ্যাঠাইমা বলতে লাগল, ‘আমার শরীর আর তেমন চলছে না। গোটা শরীরে ব্যথা। কোমরের আর হাঁটুর ব্যথায় বড়ো কষ্ট পাচ্ছি। আমি আর বেশিদিন বাঁচব না; কিন্তু যাবার আগে তোর সেই বড়োদিনের রোমাঞ্চকর কাহিনিটি লিখে আমায় শুনিয়ে যাবি। খুব জানতে ইচ্ছে করে।’
অভয় চুপ করে আছে দেখে জ্যাঠাইমা বলল, ‘আমাদের সারকুঁড়ের গায়ে খেজুর গাছটিতে রাত্রিবেলা তুই রস খেতে উঠেছিলি। তারপর দেখলি এক প্রকাণ্ড খরিশ সাপ। আমি আর কাজল টর্চের আলো ফেলে দেখলাম যে তুই আর সেই খরিশ সাপ দু’জন–দু’জনের মুখোমুখি, মাঝে শুধু খেজুর রসের হাঁড়ি। আমরা গাছটির তলা থেকে তার জোরে জোরে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। ঐ ঘটনাটি দেখে আমি মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। কী করে যে তুই সাক্ষাৎ যমদূতের হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছিলি তা সবিস্তারে লিখে আমায় জানাস!’
অনেক বছর কেটে গেছে। লিখবে লিখবে করে লেখা আর হয়ে ওঠেনি অভয়ের। অভয়ের ছোটোবেলায় বড়োদিনগুলো কাটত চুপিসারে! সাধারণত ১০ই ডিসেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত! তারপর পরীক্ষা শেষের দিনে নোটিশ আসত যে, আগামী ২৪শে ডিসেম্বর রেজাল্ট-আউট হবে। ওই দিনে সকল ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিত থাকতে বলা হচ্ছে। ২৪শে ডিসেম্বর রবিবার বা কোনও কারণে ছুটি থাকলে রেজাল্ট-আউট হত ২৩শে ডিসেম্বর।
এই সময়টায় চাষের কাজের শেষ থাকত না। এখনও থাকে না। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। পড়াশোনা আপাতত বন্ধ। তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাত:কাজ ও প্রাতরাশ সেরে কাস্তে নিয়ে খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমন ধান কাটতে যেত। তখনকার দিনে এখনকার মতো এত উচ্চ-ফলনশীল ধানের চাষ হত না। মানে প্রচলনই ছিল না। আট থেকে দশ গোছ কাটলে তবে এক হালা ভর্তি হত। এরকম দু’হালাতে হত এক আঁটি। দুপুর পর্যন্ত চলত ধান কাটার পর্ব। সন্ধেবেলা শিশির পড়ার পর সেই কাটা ধানকে এটোতে হত। মনে পড়ে একদিন অন্ধকারে ধান এটোবার সময় একটি জ্যান্ত চন্দ্রবড়া সাপের মাথাকে আটির মধ্যে এটোনা হয়ে গিয়েছিল। পরের দিন সকালবেলা এটোনা ধানগুলিকে জাঙ্গি দেবার সময় ধানআটির মাথা নড়ছে দেখে বোঝা গিয়েছিল যে সেটি ছিল চন্দ্রবড়া সাপ। ভাগ্যিস চন্দ্রবড়া সাপের মাথাটি ধানআটির মধ্যে গোঁজা ছিল তাই রক্ষে, নইলে জীবন সংশয় ছিল নিশ্চয়। কথায় বলে রাখে হরি তো মারে কে! যাইহোক সেই এটোনা ধানকে দিতে হত জাঙ্গি। পরের দিন গোরুর গাড়িতে করে সেই ধান খামারে নিয়ে এসে দিতে হত পালুই। এ-সব কাজ যে অভয় একা করত তা নয়, সঙ্গে আরো লোকজন থাকত।
এরই মাঝখানে আলু ও শীতের সবজি চাষের জন্যে শুরু হত বিশাল কর্মযজ্ঞ। কালামাটিতে আট থেকে দশটি লাঙল ও মই দেবার পর মাটি একেবারে ঝুরঝুরে শুকনো হয়ে যেত। শেষ চাষ দেবার আগে গাছেদের প্রধান খাবার পটাশ, ফসফেট ও ইউরিয়া ঠিক অনুপাতে মিশিয়ে মাটিতে দিতে হত ছড়িয়ে। তখন এত মিনি ছিল না। এই কনকনে ঠাণ্ডায় এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে সিমলি দিয়ে জল সেচ করতে হত সবজি চাষে দেবার জন্যে। তার কিছু পরে ব্যবহার হল ডোঙা। আলুর সঙ্গে সঙ্গে চাষ হত সর্ষে, কলাই, বেগুন, কপি, পেঁয়াজ টম্যাটো ইত্যাদি। তবে এখন অবশ্য বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চাষের ধরন অনেক পালটেছে। উচ্চ ফলনশীল বীজ, ট্র্যাক্টর দিয়ে চাষ, পাম্প মেশিন দিয়ে জল সেচ করার ফলে পরিশ্রম তুলনামূলক ভাবে কম হয়, সময় কম লাগে, ফলনও বাড়ে।
দেখতে দেখতে ২৪শে ডিসেম্বর এসে যেত। বুকের মধ্যে শুরু হত ধুকপুকানি। অভয় কাকে হারাতে পারবে বা আদৌ হারাতে পারবে কিনা; অভয়কে কেউ হারাতে পারবে কিনা; এই দোটানায় মন একরকম অন্তরের অন্তস্তলের এক কোণে গুম হয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকত। বস্তুত অভয় চাইত না যে সে কাউকে হারায় অথবা অন্য কেউ তাকে হারায়। কারণ অপরকে হারিয়ে আগে এলে তার নিজের আনন্দ হবে ঠিকই কিন্তু যাকে হারাবে তার মনের কষ্টটি উপলব্ধি করে নিজে কষ্ট পাবে বেশি। বস্তুত সে চাইত না তার জন্যে তার কোনো বন্ধু কষ্ট পাক; আবার অন্য কোনো বন্ধু তাকে হারিয়ে তার চতুর্থ স্থানের জায়গাটি দখল করুক এটিও সে চাইত না। এটি তার চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো গুণ।
রেজাল্ট আউটের আগে কানাঘুষো কিছু কিছু কথা শোনা যেত। এই শুনেছিস, সুশান্ত প্রথম, তপন দ্বিতীয়, নব তৃতীয় ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারী ছাত্রদের মধ্যে জায়গা প্রায়ই অদল-বদল হতো; আবার পঞ্চম থেকে দশম স্থানাধিকারী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও জায়গা অদল-বদল ঘটতোই! বাকিদের মধ্যে তো হতোই! কিন্তু কী করে যে চতুর্থ স্থানটি অভয়ের পাকা হয়ে গিয়েছিল তা আজও ভেবে কূলকিনারা পায় নি!
প্রতিবারই রেজাল্ট আউটের সময় অভয় চতুর্থ হতো শুনে তার মেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, তুমি প্রতিবারই চতুর্থ হতে কী করে?’
অভয় মজা করে উত্তর দিল, ‘কারণ পঞ্চম ছাত্র ছিল না বলে!’
‘অ্যাঁ,’ বলে হাঁ করে রয়ে গেল তার মেয়ে!
তারপর ব্যাপারটি অনুধাবন করে দু’জনেই হো হো করে হাসতে লাগল।
বাড়িতে স্বভাবতই একটি খুশির হাওয়া বইত।
এটুকু সাফল্যে এত বড়ো আনন্দ উপভোগ করার মতো মন অভয়ের নয়। সে চাইত নতুন কিছু করতে, নতুন কিছু করে দেখাতে কিন্তু উপকরণ কোথায়!
এই সেই বড়োদিন। মনের মধ্যে একটি চাপা কৌতূহল ঘোরাফেরা করছে। মাঠের মাঝে তালপুকুরের জলটি যেমন কালো তেমনি ঠাণ্ডা। সহজভাবে জলে নেমে সাঁতার কাটা যাবে না। তাই ঠিক করল, দূর থেকে ছুটে এসে শেষের শানবাঁধানো চাতালের কিনারে জোড় পা দিয়ে লাফিয়ে ভল্ট খেয়ে জলে ডুব দেবে। একবার জলে ডুব দিয়ে দিলে আর ততটা শীত লাগে না। তারপর সাঁতারে গিয়ে একটি শালুক ডাঁটা তুলে নেবে। চিন্তা-মতো চান সেরে শালুক ডাঁটাটিকে সযত্নে নিয়ে এসে বাড়িতে রেখে দিল।
বিকেলবেলা বাড়ুজ্যেদের খামারে বল খেলতে গেল অভয়। কাজলদা এক সময় অভয়কে ডেকে বলল, ‘আমাদের সারকুঁড়ের ধারে খেজুর-গাছটির রস খেতে যাবি না, কারণ একটি বড়ো খরিশ সাপ রোজ রাত সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে রস খেতে গাছে ওঠে। আমরা সাপটিকে মারার অনেক রকম চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই পারছি না। সাপটি যেমন লম্বা ও মোটা আর তেমনি তার গতিবেগ!’
কাজলদা কোনোদিন মিথ্যে কথা বলেছে বলে মনে পড়েনি অভয়ের। আবার একটি বড়ো খরিশ সাপ প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ ফুট উঁচু গাছে ওঠে রস পান করে সেটিই বা মানে কী করে! যেটি সে কোনোদিন দেখেনি এবং শোনেওনি!
অভয়ের মনে জেদ চেপে গেল। সে যাতে তাদের খেজুর গাছের রস পান না করতে পারে সেজন্যে অভয়কে এরকম গল্প ফেঁদে বলা হয়েছে, তার এরকমই ধারণা হল!
গ্রামের পঁচিশে ডিসেম্বর মানে শুধু খাতায়-কলমে। চুপচাপ। উৎসবের লেশমাত্র নেই। শুধু চাষের কাজ আর চাষের কাজ! শুধুমাত্র রাত্রিবেলা বড়োদিনকে জাগিয়ে রাখে একমাত্র ঝিঁঝি পোকা। একটানা অনর্গল ডেকেই চলে। তাদের কোন ইন্টারভেল নেই। যেন কে কতখানি একটানা ডেকে যেতে পারে তারই চলে প্রতিযোগিতা! প্রতিবছরের মতো এবছরও ঘন অন্ধকারে তারাদের মিট মিট করা আলোয় প্রাকৃতিক কালো সামিয়ানা টাঙিয়ে খোলা আকাশের নিচে গাছে গাছে ঝিঁঝি পোকাদের যেন জলসা বসেছে। মাঝে মাঝে দু-একটি বদমাশ পাখি এই জলসাকে ভাঙবার জন্যে গাছগাছালির ঝাড়বন থেকে এমন চিৎকার ও পাখার ঝাপটা মারার আওয়াজ করে যে সেই শব্দ জলসার শব্দকেও অতিক্রম করে যায়; কিন্তু তাতে ঝিঁঝি পোকাদের জলসার কোনো বিঘ্নই ঘটে না। দূরে একটি শেয়াল হুক্কা-হুয়া, হুক্কা-হুয়া বলে ডেকে চলে। বস্তুত এ-জলসা চলে সারা শীতকাল ধরে।
হাড়কাঁপানি শীতে এই ডিসেম্বরে গ্রামে রাত্রি সাড়ে সাতটা মানে প্রায় নিশুতি। বাইরে কনকনে হাড়কাঁপানি ঠাণ্ডা। যেন প্রকৃতিদেবী ঠাণ্ডা-ভরা সূচ নিয়ে সারা শরীরে বিঁধতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে হালকা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস চোখে মুখে ঝাপটা মেরে চলে যায়; যেন প্রকৃতিদেবী তাঁর দু’হাতে মুঠো মুঠো খুশির বরফ নিয়ে অভয়ের দু’গালে ঘষে দিয়ে চলে যান দৌড়ে। এমন সময় অভয় চাদরটিকে সারা শরীরে ভালো করে জড়িয়ে শালুক ডাঁটাটির গোড়ার ও ডোগার কিছুটা অংশ বাদ দিয়ে মাঝের অংশটি নিয়ে চলে খেজুর রস পান করতে। বলা বাহুল্য শালুক ডাঁটাটি কাজ করে ছাঁকনির।
ঘন অন্ধকার। গ্রামের সব পথই প্রায় সর্পিল। পথ প্রায় দেখা যায় না বললেই হয়। অথচ এই কনকনে ঠাণ্ডায় খেজুর রস পান করার নেশাটিই আলাদা। যেমন মিষ্টি তেমনি তার স্বাদ। প্রথম জিরন-কাঠের রস, তার সুস্বাদই আলাদা! যারা তা পান করেনি তাদেরকে বোঝাই কী করে! অন্ধকারে গা ছমছম করে কারণ সামনেই সেই বেলগাছ; যে বেলগাছের তলা দিয়ে যাবার সময় একবার এক ভূত তাকে ধরেছিল। আকাশের দিকে তাকায়। লক্ষ কোটি তারা অভয়ের দিকে তাকিয়ে লণ্ঠনের মতো মিটমিট করে আলো দেখিয়ে যেন বলে, ‘ভয় কী আমরা আছি!’
বাড়ুজ্জেদের সারকুঁড়ের ধারে খেজুর গাছটির তলায় চুপি চুপি গিয়ে হাজির হল অভয়। চাদরটিকে ভালো করে পেঁচিয়ে ঘাড়ে ও কোমরে শক্ত করে বাঁধল। তারপর শালুক ডাঁটাটি নিয়ে তরতর করে খেজুর গাছে উঠতে লাগল। এমন সময় কাজলদা নিচ থেকে টর্চের আলো জ্বেলে বলল, ‘তোকে যে বললাম, সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে একটি বড়ো খরিশ সাপ রস খেতে গাছে ওঠে!’ অভয় নির্বিকার; যেন কোনো কথা শুনতে পাইনি; কাজলদা আবার বলল, ‘ঠিক আছে, তুই রস খেয়ে আয়, আমরা নিচে পাহারা দিচ্ছি।’
হঠাৎ অভয় গাছের ওপর থেকে শুনতে পেল, কাজলদা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, ‘ঐ যে আসছে! মার! মার!’ সটাশ সটাশ করে লাঠির আওয়াজ শুনতে পেল অভয়! বাঁশের লাঠি দিয়ে মাটিতে মারলে যে রকম আওয়াজ হয় ঠিক সেই রকম আওয়াজ। অভয় তখনও ভাবছে, এ বোধ হয় তাকে খেজুর রস না পান করতে দেবার আরও একটি কৌশল মাত্র! জ্যাঠাইমা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘সাপটিকে খেজুর গাছে উঠতে দিস না কিছুতেই!’
জ্যাঠাইমার কথা কানে আসতেই অভয় বুঝল যে তাহলে কাজলদা মিথ্যে বলেনি! কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই তার। সে বুঝতে পারল যে নিচে দু-তিন জন আছে! তাহলে সত্যিই খরিশ সাপ রস পান করতে গাছে উঠছে! কাজলদা হাঁপাতে হাঁপাতে একরকম জোর করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘না রোখা গেল না, সাপটি গাছে উঠছে। অভয় তুই সারকুঁড়ে ঝাঁপ মার, অন্তত প্রাণে বেঁচে যাবি!’
কে কার কথা শোনে! তার পায়ের ওপর দিয়ে সড়-সড় করে কী একটা চলে গেল বুঝতে পারল অভয়। খেজুর গাছটাকে বাঁ’হাত দিয়ে ঠিক করে ধরে ডান হাত দিয়ে শালুক ডাঁটাটিকে রসের হাঁড়ির মধ্যে গলাতে যাবে এমন সময় ফোঁস ফোঁস করে আওয়াজ আসতে লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল খেজুর রসের হাঁড়ির ওপারে স্বয়ং যমদূত। নির্ভীক বিশ্বাসে পলকহীন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কাজলদা ও জ্যাঠাইমা নিচ থেকে টর্চের আলো ফেলে তাদেরকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। অভয় তার সরল বিশ্বাসে মনে মনে বার্তা পাঠাতে লাগল, ‘আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি! করবও না, তুমিও রস পান করতে এসেছ, আমিও রস পান করতে এসেছি, তুমিই আগে পান করো! একই বার্তা মনে মনে আবার পাঠাল অভয়। একটু পরে লক্ষ করল আগের মতো জোরে জোরে ফোঁস ফোঁস শব্দ আর নেই। অনেক শান্ত হয়ে গেছে। তবে যমরাজ তখনও অভয়ের চোখ থেকে চোখ সরায়নি। অভয় দেখল যে তার দু’টি হাত অঞ্জলি দেবার মতো একত্র করলে যে আকার হয় সেরকম তার ফণা। গায়ে, মাথায় চাকা চাকা দাগ। তারপর ফণীধর যখন বুঝতে পারল যে সে সত্যিই তার দ্বারা কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হবে না, তখন আস্তে আস্তে পুরো মাথাটি রসের হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে রস পান করতে লাগল। অভয় তার গায়ে হাত বোলাতে লাগল! এত মোটা সাপ যে এক হাতের মুঠোর মধ্যে আসে না! সাপুড়েরা যে সাপ নিয়ে খেলা দেখাতে আসে তার মধ্যে এরকম সাপ দু-একটি মাত্র দেখা যায়।
ফণীধর পেট ভর্তি করে খেজুর-রস পান করে একেবারে সটান রসের হাঁড়ির ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে ফণা তুলে শান্ত হয়ে বসল। ফণীধরের ফণা থেকে অভয়ের নাকের দূরত্ব মাত্র আধ হাত। অভয় আবার পলকহীন চোখে তার চোখের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে রইল। একেবারে অবাধ্য, শান্ত, নিরীহ, গোবেচারার মতো চুপচাপ বসে অভয়কে দেখতে লাগল। দু’জন দু’জনের মধ্যে অসীম করুণা ও মমতায় তৈরি হল অটুট বিশ্বাস। তারপর একসময় ফণীধর অভয়ের নাকে তার মুখটা টুক করে ঠুকে দিয়ে অটুট বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে যেমন এসেছিল তেমনি ফিরতে লাগল। যেন কোনও দেবী পরম স্নেহে তার চিবুকে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করে চলে গেলেন। অভয় হতচকিত হয়ে কিছু বুঝবার আগেই সে সড় সড় করে নামতে লাগল।
নীচ থেকে টর্চের আলোয় কাজলদা, জ্যাঠাইমা ও আরো একজন দেখেছে যে ফণীধর অভয়ের নাকে ছোবল মেরেছে! আর তা দেখেই জ্যাঠাইমা হা-হুতাশ করে বলতে লাগল, ‘ওরে ওর বাড়িতে খবর দে রে! ওঝা ডাক রে! হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর রে!’ বলেই সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল!
ফণীধর চলে যাবার পর অভয় শালুক ডাঁটাটিকে রসের হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে চোঁ-চোঁ করে পান করতে লাগল খেজুর রস। তারপর গাছ থেকে নেমে এলে কাজলদা টর্চের আলো জ্বালিয়ে সারা মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘সাপটা ছোবল মারেনি?’
অভয় বলল, ‘না।’
পুরো ঘটনাটি লিখে কলকাতা থেকে গ্রামে গিয়ে জ্যাঠাইমার বাড়িতে গেল অভয়। এত বছরেও তাদের বাড়ীর কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই টিনের চালের মাটির দোতলা বাড়ি। ডাকল অভয়, ‘জ্যাঠাইমা…..।’
দোতলা থেকে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে অভয়কে দেখে নিয়ে কাজলদা নিচে নেমে এল। বলল, ‘কী রে অভয় এতদিন পরে এলি!’
— আর বোলো না কাজলদা! নানা ঝঞ্ঝাট-ঝামেলায় আসব আসব করে আসা আর হয়ে ওঠেনি। তা তোমাদের সব ভালো তো? জ্যাঠাইমা কোথায়?
— তুই বড্ড দেরী করে এলি! তারপর একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু পরে জল ভরা চোখ নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
অভয়ের আর বুঝতে বাকী রইল না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্যাঠাইমাকে মনে মনে স্মরণ করে তার পায়ে প্রণাম নিবেদন করে শতবার, আর তার আত্মার শান্তি কামনা করে বলল, ‘জ্যাঠাইমা, তোমার নিজের চোখে দেখা বড় দিনের সেই রোমাঞ্চকর কাহিনিটি লিখেছি; তুমি শুনবে না!’