কোথায় পাবো তাঁরে – বিজয়া দেব

কোথায় পাবো তাঁরে – বিজয়া দেব

কোথায় পাবো তাঁরে

বিজয়া দেব

পুরনো এলবামে ছবিগুলো দেখছি। সেই ছোটবেলা, দুরন্ত সময়, অফুরান প্রকৃতি, মা বাবা ভাইবোনদের নিয়ে সাদাকালো ছবি। স্মৃতি জাগানিয়া ছবিগুলো অত:পর বন্ধ করে আলমারিতে সযত্নে ঢুকিয়ে রাখলাম। বাইরে সন্ধ্যা নামছে। এদিকে ওদিকে ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে একদল কিশোর ও যুবকের দল। অজস্র ঘুড়ি উড়ছে। আগামীকাল বিশ্বকর্মা পুজো। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ নানা আকৃতির মেঘ, পাখিরা নীড়ে ফিরছে। আমার ছাদবাগানে ফুল ফুটেছে বেশ। বিশেষ করে গুচ্ছ গুচ্ছ রঙ্গন ফুলের সমারোহ। সবকিছু মন ভালো করে দেওয়া। প্রকৃতি মানুষকে ঢেলে দিচ্ছে সৌন্দর্য, তবু মানুষ ভালো নেই। কেউ ভালো নেই। এতো চমৎকার প্রাকৃতিক সমারোহে সমৃদ্ধ পৃথিবীকে দেখার চোখ সব মানুষের কি থাকে না?
অতি সম্প্রতি কলকাতা আর জি কর হাসপাতালে এক তরুণী চিকিৎসকের কর্তব্যরত অবস্থায় নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা এই মহানগরীর ভিত অব্দি নাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ চমকিত, ভীত, সন্ত্রস্ত। সবাই একধরনের মানসিক বিক্রিয়ায় কিম্বা বলতে পারি ট্রমায় ভুগছেন। কি আমাদের ভবিষ্যৎ? কি ভবিষ্যৎ এই যান্ত্রিক সভ্যতার? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছি কীভাবে, কবে “মানবিকতা” শব্দটি পুরোপুরি ব্রাত্য হয়ে গেল? ব্রাত্য হয়ে গেল “ভালবাসা” শব্দটি? কবে থেকে আমরা নিক্তির ওজনে পাল্লা দিয়ে হিসেবনিকেশ শিখে গেলাম? কবে থেকে “প্রতিহিংসা “হয়ে গেল “ভালবাসা”র স্থান দখলকারী শব্দ?
ঘুড়ি ওড়ানোর ছবি দেখে যে মানসিক স্থৈর্য এসেছিল, পরদিনই কাগজে পেলাম একটি খবর, এক নির্মীয়মান ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল দুই কিশোর, কথা কাটাকাটি হতে হতে একটি কিশোর অপর কিশোরকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে নীচে, ছেলেটি গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
আমি সবকিছু ভুলতে চাইছি। এই নির্মম বাস্তব থেকে চাইছি পরিত্রাণ। হয়তো তা পলায়নপরতা, হয়তো সমাজব্যবস্থায় মলম লাগানোর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা প্রয়োজন কিন্তু কেন মনে হচ্ছে চারপাশে যা দেখছি তার পেছনে এক অন্তহীন অন্ধকারের রহস্যময় খেলা নিয়ত বিদ্যমান যার কূল নেই, কিনারাও নেই। সেই অজস্র গিঁটের বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছে মানুষ, হাতেপায়ে পড়েছে শিকল, আপাতস্বাধীনতার ভেতরে তৈরি হচ্ছে অন্তহীন পরাধীনতার শৃঙ্খল। অর্গল খোলার চাবি আজ ছায়ামানুষদের হাতে।
এই শৃঙ্খল দীর্ঘযুগ থেকে মেয়েদের পায়ে পরানো হয়েছিল। যৌন শৃঙ্খল পরিয়েছিল পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্র। আমাদের পরম সৌভাগ্য আমরা মানে গোটা নারীসমাজ দুইজন
মানবতার পূজারীকে পেয়েছিলাম, তাঁরা কথায় নয়, ছিলেন কাজে বিশ্বাসী, পেয়েছিলাম রামমোহন ও বিদ্যাসাগরকে। এঁরা আমাদের অর্গলমুক্ত করেছেন। আমরা আজ ঘরে বাইরে কাজ করছি। তবে চর্যাপদের সেই বিখ্যাত প্রবাদ আমাদের গায়ে আজও সেঁটে আছে- “অপনা মাংসে হরিণা বৈরী “।
তবে আরেকটি ব্যাপারও আমাদের ভাবাচ্ছে। ছেলেরাও কিন্তু বিপদমুক্ত নন এই আবহে। আমাদের চোখে দেখার লেন্সটাকে যদি আরেকটু উচ্চশক্তির করে নিই, তাহলে দেখতে পাবো, সমাজের অন্তরালের অন্ধকারে অনেককিছু ঘটে চলে, কেউ যদি তা দেখে ফেলে কিম্বা প্রতিবাদ করে, সুপারি লাগিয়ে জাস্ট মেরে ফেলা সেই অন্ধকারের জগতের ছায়ামানুষের জগতে কোনও ব্যাপারই নয়। এক্ষেত্রে যদি পুরুষ হন তাহলে হবে খুন, আর যদি নারী হন তাহলে হবে খুন ও ধর্ষণ। যেহেতু উপভোগ করার মতো তাদের যৌনাঙ্গ রয়েছে।
অন্যদিকে মেয়েদের আরও ঝুঁকির মুখে চলতে হয়, কর্মক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন তারা, যেহেতু তাদের দেহটি নারীর।
প্রশ্ন আসে কেন এমনটা হলো, বিশেষ করে এই বাংলায় যত মনীষীরা জন্মেছেন, যাঁরা প্রাণ দিয়ে স্বাধীনতা এনেছেন সেই রাজ্যে কিম্বা সেই দেশে নিজেদের কাছে নিজেদের মধ্যে একে অপরের পায়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল পরিয়ে দেওয়া হলো কেন? কেন শান্তি ও স্বস্তির আনন্দময় পরিবেশটাকে বিষিয়ে তুলল নিজেরাই। কেন “মানবিকতা ” শব্দটি দ্রুত মুছে গেল সমাজজীবন থেকে। আপাতত এই কলমচির কাছে কোনও উত্তর নেই।
” যাঁহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো / তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?” রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন সেই অদেখা ঈশ্বরের কাছে। তখন দেশ ছিল পরাধীন।
আজও আমরা সেই প্রশ্নই করছি অদেখা ঈশ্বরের কাছে এই স্বাধীন(!) দেশে দাঁড়িয়ে? সেই বাউল গানের কথাগুলো মনে পড়ে, আর খুঁজে বেড়াই তাকে, যে সবার মনের মানুষ, খুঁজে খুঁজে বেড়াই। সেই বিখ্যাত বাউল গান, গগন হরকরার লেখা, তার শেষের ক’টি পংক্তি নিয়ে ভাবতে থাকি, ভাবিই শুধু-

” কুল-মান সব গেলো রে! তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে, তাইতে মরি দেয়না দেখা সে রে;
ও তার বসত কোথায় না জেনে তাই গগন ভেবে মরে-
ও সে মানুষের দিশ
যদি জানিস,
কৃপা করে বলে দে রে, আমার সুহৃদ হয়ে বলে দে রে,
কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে…..
হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে দেশবিদেশে
আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে…..”

বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের “ইছামতী “উপন্যাসে মিথ্যে সাক্ষী না দেওয়ার জন্যে নীলকুঠির সাহেব ধুলোবালি মেশানো বস্তায় ঢুকিয়ে চাবুক মারতে মারতে ফেলে রেখেছিল সহজ সরল সৎ রামকানাই চক্রবর্তীকে। যদিও দেশ তখন পরাধীন ছিল। তবে যে চাবুক লাগিয়ছিল সে ছিল এদেশেরই লোক। সাহেবের জো হুজুর নফর।