ক্যান্সার এখন নিরাময়যোগ্য কি
সদানন্দ সিংহ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০২০ সালে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৬ মিলিয়ন লোক মারা গেছে ক্যান্সারে। তার মধ্যে স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্বজুড়ে ওই সময়কালের মধ্যে প্রায় ২.২৬ মিলিয়ন লোক স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ফুসফুস ক্যান্সারে ২.২১ মিলিয়ন এবং রেক্টাম ক্যান্সারে মারা গেছে ১.৯৩ মিলিয়ন লোক।
ক্যান্সার চিকিৎসার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বহুদিন যাবৎ চলে আসছিল। তেমন কোনো সাফল্য পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু সাময়িকভাবে কিছুটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছিল বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে। অবশ্য প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে অনেক ক্ষেত্রে নিরাময় হয়ে যাচ্ছিল বা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছিল।
তবে ইদানীং ক্যান্সার চিকিৎসার এখন দুটো আশাজনক খবর চারিদিকে প্রচারিত হচ্ছে যা ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটা যুগান্তকারীও বটে। ক্যান্সারের নানা গবেষণার মাঝে এই দুটো ফলাফল খুব উৎসাহজনক। প্রথম আশাজনক খবরটি হল, প্রথম ট্রায়ালেই নাকি ক্যান্সার একদম গায়েব। শুধু একজনের ক্ষেত্রেই নয়, যাদের ওপর ট্রায়াল হয়েছে সবার ক্ষেত্রেই নাকি একই ফল দেখিয়েছে। অর্থাৎ সবার ক্ষেত্রেই নাকি ক্যান্সার গায়েব।
১৮ জন রেক্টাল ক্যান্সার রোগীকে একই ওষুধ দেওয়া হয়েছিল ৬ মাস ধরে। মাস ছয়েক পর রেজাল্টে দেখা যায় যে, প্রত্যেকেই ক্যান্সারমুক্ত। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে যা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী ঘটনা। এই ঘটনা ক্যান্সার চিকিৎসায় এক আলোক দিশা দেখাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
Dostarlimab নামক এই ওষুধটি ল্যাবরেটরিতেই তৈরি। এই ওষুধে থাকা একটি মলিকিউল-ই মানবশরীরে অ্যান্টিবডির বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। যে ১৮ জন রোগীর উপর এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, তাঁদের আগে কেমোথেরাপিও করা হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল রেডিয়েশনও। কারও কারও অস্ত্রোপচারও হয়। কিন্তু তাতে আশানুরূপ সাফল্য মেলেনি। পেটের অথবা মূত্রনালীর সমস্যা দেখা যায় অনেকের। কেউ কেউ আবার যৌন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
এরপরই চিকিৎসার পরবর্তী ধাপ হিসেবে ৬ মাস তাঁদের Dostarlimab নামক ওষুধটি দেওয়া হয়। আর তাতেই মেলে চমকে দেওয়া রেজাল্ট। এরপর তাদের শারীরিক পরীক্ষা, এন্ডোস্কোপি, এমআরআই স্ক্যান, পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি, পরীক্ষা করা হয়েছিল। কিন্তু সবকটির মাধ্যমেই ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়নি। বরং মনে করা হচ্ছে তারা ক্যান্সারকে হারিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এই ফলাফলেই আশা জেগেছে বিশ্বে। ওই ১৮ জন রোগীর শরীরে আর নেই ক্যান্সার। তাঁদের আর কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
কীভাবে কাজ করে এই ওষুধ? রোগীদের ছয় মাসের জন্য প্রতি তিন সপ্তাহে ডস্টারলিমাব দেওয়া হয়েছিল। ওষুধটির লক্ষ্য ক্যান্সার কোষগুলিকে সনাক্ত করা যা শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে দেয়। এই ওষুধগুলি মূলত ‘চেকপয়েন্ট ইনহিবিটর’ এর কাজ করেছিল। এই ওষুধ প্রয়োগে কিছু প্রতিক্রিয়া শরীরে দেখা যায় তবে তা গুরুতর কিছু নয়৷ তবে একেবারে নেগেটিভ রিঅ্যাকশন কিছু হয়নি।
দ্বিতীয় খবরটিও আশাব্যঞ্জক। কয়েক বছর আগেও তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে জীবন ফিরিয়ে দিল এক ওষুধ। স্তন ক্যানসার থেকে বেঁচে ফিরলেন ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভুত ৫১ বছরের মহিলা জ্যাসমিন ডেভিড। চিকিৎসকরা কার্যত সময় দিয়েই দিয়েছিলেন, বলেছিলেন আর হয়ত কয়েক বছর বাঁচবেন জ্যাসমিন। কিন্তু তার মধ্যেই ক্যানসারের একটি বিশেষ ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয় ইংল্যান্ডে। সেটি গ্রহণ করার পরেই ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। সোমবার চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শরীরে আর ক্যানসারের চিহ্ন মাত্র নেই তাঁর।
তিনি ম্যানচেস্টার ফ্যালোফিল্ডের বাসিন্দা তিনি। সামনেই মহিলার ২৫ তম বিবাহবার্ষিকী। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ অ্যান্ড কেয়ার রিসার্চ ও ম্যানচেস্টার ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ফেসিলিটি-এর যৌথ উদ্যোগে খ্রিস্টি এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের একটি পরীক্ষামূলক ক্যানসারের ওষুধের প্রয়োগ চলছে। এই ওষুধটির নাম অ্যাটজলিজুম্যাব। তিন সপ্তাহ ধরে এই ওষুধ খেতে হয়েছিল। তার পর তিনি জানিয়েছেন, আমার প্রাথমিক ক্যান্সার চিকিৎসার পর আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ক্যান্সারের কথা, কিন্তু আমার শরীরে ১৫ মাস পরে ক্যান্সার ফিরে এসেছিল। তার পর আমাকে যখন চিকিৎসার কথা বলা হয়, আমি রাজি হয়ে যাই। আমি জানতাম না, এই ওষুধ কাজ করবে কি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, এটাই একমাত্র সুযোগ আমার প্রাণে বাঁচার, পাশাপাশি, হয়ত পরের প্রজন্মের জন্য আমার শরীরের উপর পরীক্ষা করায় নতুন কোনও দিক খুলে যাবে। গত বড়দিনের সময়ও আমার শরীরে খারাপ ছিল। তার পর ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হতে থাকি।
এর আগে এই ওষুধের ফলে সুস্থ হয়েছেন একজন মা ও তাঁর দুই সন্তান। বর্তমানে জ্যাসমিনের চিকিৎসক বলছেন, আমরা খুবই খুশি জ্যাসমিনের স্বাস্থ্য উদ্ধার হওয়ায়। আমরা খ্রিস্টিতে ক্রমাগত ক্যানসারের নতুন নতুন ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে চলেছি। আমাদের আশা ভবিষ্যতে এই গবেষণা অনেক মানুষের জীবনে আশার আলো নিয়ে আসবে।
তবে প্রশ্ন উঠছে যে এই চিকিৎসা কি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে? জানা গেছে এই চিকিৎসার খরচ কিছু মহার্ঘই। এই ট্রায়াল Dostarlimab ডোজের এক একটির মূল্য ১১ হাজার মার্কিন ডলার যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৮.৫৫ লক্ষ প্রতি ডোজ। সুতরাং প্রশ্ন থেকেই যায়।