আত্মহত্যারও সময় পায় নি অসীমা (ছোটোগল্প)
বিজয়া দেব
১
দিয়া অসীমাকে দেখছে। মুখ ঘেমে লাল। আর অসীমা দেখছে নিজেকে। ক’দিন থেকে মনে হচ্ছে সে আর সে নয়, যেন আলাদা একটা মানুষ। তার দেহ থেকে তার চেতনা ছিন্ন হয়ে গেছে। সে দূর থেকে নিজেকে দেখছে। এই যে সারাদিন কাজের পর কাজ, বসের চোখ রাঙানি, কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে থেকে থেকে হুমকি, তা সে দেখে দূর থেকে। এই আজই বস ডেকে নিল তার চেম্বারে, বেশ কিছু ধমকচমক চলল। কারণ তিনটে ফাইলের কাজ এগোয়নি। অসীমা বসের মুখোমুখি চেয়ারে। আর দূর থেকে তারই চেতনা সবটাই দেখছে শুনছে, মৃদু হাসছে। ওর হাসি দেখে অসীমার রাগ হয়, ওটাকে বাগে আনার চেষ্টা করে।
বসের বয়েস তেমন বেশি নয়। একেবারে সুটেড বুটেড সারা দেহে ভুরভুরে সুগন্ধি। যখন তাকে ধমকচমক দেয়, চাকুরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়, তখন তার চেতনা হাসে, ওর হাসির জন্যেই হয়ত অসীমার মুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে না। এতে বসের আরও রাগ হয়। আরও ক্ষেপে ওঠে। এই করে করে তার আর কাজ করতেই ইচ্ছে হয় না। খুব ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে সে একটা ফাইলের কাজ সাঙ্গ করল প্রায় দিন সাতেক পর। তার পাশে বসে মেয়েটি, দিয়া, যে অসীমার খুব ভালো বন্ধু, তাকে বলল — তোকে বস গুলি করে মারবে, দেখিস। এই একটু আগে এদিক দিয়ে গেল, কীভাবে যে দেখল এদিকে কী বলব। ভাষায় বুঝাতে পারব না। অসীমা দেখল তার চেতনা তেমনই হাসছে, সুতরাং সে-ও হাসল।
— তুই হাসছিস? চাকরি গেলে কী করবি? বস খুব ভালো করে জানে তোর কথা। এইজন্যই এত ধমকানো। আজ তোর বাড়ি তোর ওপর নির্ভর না করত তখন অন্যভাবে কথা বলত। অসীমা দেখল তার চেতনা তাকে চোখ ঠেরে বলছে, কথা বাড়িও না। সে চুপচাপ কাজ করতে লাগল।
বিকেলের দিকে সে ফাইলটার কাজ একেবারে শেষ করে বসের চেম্বারে এল।
— আসব স্যার?
বস মাথা না তুলে বলে — আসুন।
সে ফাইলটা এগিয়ে দিল।
বস তার দিকে না তাকিয়েই কীসব লিখে চলেছে। ভীষণ ব্যস্ত। অসীমার ধৈর্য কমছে। ঘড়িতে সময় বলছে পনেরো মিনিট হয়ে গেল। বস একইভাবে লিখে চলেছে। কী লিখছে এত? তার ধৈর্য এমনিতেই কম। ডাক্তারের চেম্বারে গেলে এমনই অস্বস্তি হয় তার। বাধ্য হয়েই বসতে হয়। প্রায় আধঘন্টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই অসীমার চেতনা তাকে বলল — চলে যা। বলতেই সে উঠে দাঁড়াল, বলল — ফাইলটা রইল স্যার। দেখবেন। আমি নেক্সট এ যাই। বস কোনও উত্তর দিল না।
চেতনা বলল — অপমানিত বোধ করিস না, বেরিয়ে যা। যা হবার হবে।
সে উঠে বেরিয়ে এল। এখন কাজ করার ইচ্ছেটা আর নেই। বিকেল গড়াচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। কতদিন সূর্যাস্ত দেখা হয়নি। সে গুম হয়ে বসে রইল।
দিয়া তার পাশেই বসে। এগিয়ে এসে বলল — কি হয়েছে? কি বলল বস?
— কোনও কথাই বলেনি। কীসব লিখছে একটানা। আমি যে একটা মানুষ গেলাম, মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করলাম, কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।
এরপর বললাম — স্যার আসি। বাকিগুলো শেষ করি গিয়ে, তাতেও কোনও উত্তর দিল না। বড্ড অপমানিত লাগছে জানিস। কী যে লিখছে, আমার বরখাস্তের নোটিশ হতে পারে।
— ধুর, অত দূর ভাবছিস কেন? তেমন কিছু নয় হয়তো। আসলে একটা ফাইল নিয়ে গেছিস তো। তিনটের মধ্যে মাত্র একটা ক্লিয়ার করেছিস।
অসীমা গুম হয়ে আছে। হঠাৎ উঠে পড়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।
দিয়া বলে — এ্যাই, কোথায় চলেছিস? পাগলামি করিস না। বসে পড়। নেক্সট ফাইলে হাত লাগা।
অসীমা অনুভব করল তার থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়া তার চেতনাকে সে আর দেখতে পাচ্ছে না। কী ভেবে শেষ পর্যন্ত বসে পড়ল।
দিয়া বলল — ফাইলটা খোল।
সে পুতুলের মত ফাইল খুলে কাজ করতে শুরু করল।
২
বাড়ি ফেরার পর অসীমা দেখল বাবার প্রেসারটা বেড়েছে।
— প্রেসারের ওষুধ খেয়েছিলে বাবা?
— হ্যাঁ সে তো সময়মতই খেয়েছি।
মা বলল,
— ডাক্তার দেখাতে হবে রে। তুই তো ক্লান্ত, আমিই নিয়ে যাই।
মা-ই নিয়ে গেল, ডাক্তারের ফী নাকি বেড়েছে। হাজার থেকে বারো’শ হয়েছে। অসীমা কিছু টাকা আলমারির এক গোপন কোণে লুকিয়ে রাখে। ব্যাগটা খুলে দেখল দু’হাজারের মত রয়েছে। তা থেকে বারোশো টাকা মা’র হাতে তুলে দিল।
ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ার পর লক্ষ করল কোথাও তার বিশ্লিষ্ট চেতনার অস্তিত্ব নেই। তার মানেটা কী! এই বস অন্য কারও সাথে এমন খারাপ আচরণ করে না। অথচ তার সাথে কী অপমানজনক আচরণ করে। ঠিক কেন করে, হয়তো তার কাজ কিছুটা ধীরগতিতে চলে, তাই। তাই কি? না কি তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে। কে জানে! এমনটাই হয় সচরাচর। দুর্বলের ওপর অত্যাচার কথাটা তো আপ্তবাক্য।
মা বাবাকে নিয়ে ফিরে এল। ভাইটা এখনও ফেরেনি। ডাক্তার একগাদা টেস্ট দিয়েছে। প্রেসারের ওষুধ দুটো করে খেতে হবে। কোলেস্টেরলের ওষুধটার বদল হয়েছে। এদিকে গত পরশু সে একপাতা কোলেস্টেরল এর ওষুধ এনেছিল। সেটা থেকে দুটো খাওয়া হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখালে এই এক সমস্যা। সে লক্ষ করল তার চেতনা আবার তার থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে গেছে। সেই চেতনা তাকে নির্দেশ করছে দুর্ভাবনায় জড়িয়ে না পড়ার জন্যে।
ভাইটা রাতে ফিরল না। এমন প্রায়ই হচ্ছে আজকাল। সামনে লোকসভা ভোট, ভাইটা কোনও এক পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। দিনরাত ওকে নিয়ে বাবা মা-র দুর্ভাবনা। কী ভালবাসত অসীমা ভাইটাকে। চাকরিবাকরি হল না। তখন বাবার চাকরি ছিল। দুজনকে বাবা পড়িয়েছেন খুব কষ্টে। বড় চাকরি নয়, ছোট একটা চাকরি করেছেন বেসরকারি সংস্থায়। পেন্সন নেই। এককালীন যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে এই ছোট্ট বাড়িটা তৈরি করেছেন।
রাতে ফিরল না ভাইটা।
বাবা একটু আওয়াজ পেলেই উঠে গিয়ে দেখছে ছেলে ফিরল কিনা। ভাই ফিরল না সারারাত। দুচোখের পাতা এক করা গেল না। খুব সকাল বেলায় অসীমা বেরিয়ে পড়ল। সে একটা ব্যাপার অনুভব করছে, যখন তার চেতনা তাকে দূর থেকে দেখে তখন সে খুব ভালো থাকে। দুর্ভাবনা তাকে একটুও স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু কখনও কখনও সে তাকে দেখতে পায় না। এই মুহূর্ত সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কাজেই দুর্ভাবনা বাড়ছে ক্রমশ, ক্রমশই। এই ভাইকে সে ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে। কত খেলাধুলো…মা তো বলত, ঠিক যেন অপু আর দুর্গা। বড় হলো, অনেক কষ্ট করে বাবা দু’ভাইবোনকে পড়িয়েছে। যাক, এই জীবনটা তো এদেশের গতানুগতিক ছবি। কোথায় খোঁজ করবে, ফোনে গতকাল রাত থেকেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। যতবার ফোন করা যায় ততবারই ব্যস্ত দেখাচ্ছে।
— মিনু, কোথায় যাচ্ছ?
বিতান পেছন থেকে ডাকছে। বিতানের তার প্রতি কিছু বাড়তি আগ্রহ আছে। পাড়ারই ছেলে। তাকে কি পছন্দ করে? কে জানে! ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না অসীমা। কারণ প্রেম ভালবাসা যেমন আনন্দ দেয়, তেমনই দু:খও কম দেয় না। এত কষ্টের মাঝে এই বাড়তি আবেগিক কষ্ট বড় যন্ত্রণার। অসীমাকে এইসব ভোগ করতে হয়েছে। অফিসের কলিগ অরিন্দমের সাথে কিছুদিন ভালবাসার খেলায় মেতে উঠেছিল সে। তার কাছে যদিও সেটা মোটেও খেলা ছিল না। অরিন্দম ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল মুম্বাই। তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। এখন সে বিয়েও করেছে। বছর ঘুরতে চলল সে বাবাও হয়েছে। অসীমা ওসব নিয়ে আর ভাবতে চায় না। জড়াতেও চায় না। প্রেম ভালবাসা এক সমস্যা বটে। বিশেষ করে যাদের ওপর সংসারের গুরুভার রয়েছে।
বিতান পিছুপিছু হাঁটে।
বলে — মিনু, সুখেনকে বোঝাও। বড়বেশি জড়িয়ে পড়ছে এসবে। গতকাল বাড়ি ফেরেনি, তাই না? খুঁজতে বেরিয়েছ?
অসীমা চমকে উঠে বলে — কি করে জানলে? ওকে দেখেছ?
— না দেখিনি? মেসোমশাই ফোন করেছিলেন।
— কখন?
— বেশ রাতে। রাত ধরে নাও একটা হবে। না মানে জিজ্ঞেস করছিলেন, সুখেনকে দেখেছি কিনা। তুমি আবার মেশোমশাইকে জিজ্ঞেস করতে যেও না। উনি বারবার করে বলে দিয়েছেন তোমাকে না বলতে। তোমার অফিস নেই?
— আছে।
— তো কোথায় খুঁজবে? তুমি বাড়ি যাও। আমরা দেখছি। তুমি অফিস যাও, চিন্তা করো না।
অসীমা বাড়ি ফিরে আসে। আজ দেরি হয়ে গেছে। ছুটিও হাতে নেই। মা অসুস্থ হয়েছিল। তখন ক’দিন ছুটি নিয়েছিল। বিতান কোনও কাজকর্ম করে না। ওই ভাইয়ের মতই কোনও রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। তবে সুখেনের পার্টি নয়। সুখেনের বিরোধী দল। তবে এক পাড়ার লোক, তাই সৌহার্দ্য বজায় রেখেই চলে সবাই। এই পাড়াটা এরকমই। শিষ্টতা আছে। একসাথে আবার রবীন্দ্র জয়ন্তী নজরুল সন্ধ্যা, নাটক ইত্যাদি হয়।
এদিকে বাবা মা তাকে ফিরে আসতে দেখে প্রায় ছুটে এল।
— কি রে কোনও খবর পেলি?
— নাহ, আমাকে অফিস যেতে হবে মা। আমি কোথাও যাই নি আর। বিতান বলেছে ও দেখছে খোঁজ করে।
— এই অবস্থায় তুই আজ অফিস যাবি?
— তুমি তো জানো মা, বেসরকারি সংস্থার কাজের অবস্থা, প্রচুর কাজ, না করলে দূর হটো। এরমধ্যে কাজ জমে গেছে, বসের চূড়ান্ত খারাপ ব্যবহার। এখন ভাইয়ের জন্যে ছোটাছুটি করতে গিয়ে যদি চাকরি হারাই। তাহলে পরিণামটা কি হবে?
বাবা মা দুজনেরই মুখে কোনও কথা নেই। কেমন বোবা শূন্য চোখ। চোখ চেয়ে দেখা যায় না।
৩
অফিসে আজ বেশ দেরি হয়ে গেল। দিয়া বলে — কি করেছিস অসীমা। বস রেগে কাঁই। কত কথা বলে গেল তোর নামে, সবার সামনে। অসীমা এই প্রথম ভয় পেল। বড় বেশি অনিরাপদ চারপাশ। তার চেতনাকে সে আর নিজের থেকে বিশ্লিষ্ট অবস্থায় দেখতে পেল না। মনে হল, তাকে হয়তো সারাজীবন এই বসের কাছে চরম অপমান সহ্য করতে করতে চলতে হবে। এই প্রথম একটি গাঢ় মৃত্যু ইচ্ছে এল। আত্মহত্যা। এটা সে করতেই পারে। এটা করা তেমন কঠিন হবে বলে মনে হয় না। তারপর কোথায় কী হচ্ছে আর তাকে দেখতে হবে না। দুনম্বর ফাইলটাতে হাত দিতে দিতে সে ভাবল। সে জানে এখন বস তাকে ডাকতে পারে। অথবা লোকটা চেয়ার ছেড়ে চলে আসতে পারে এবং সবার সামনে যাচ্ছেতাই অপমান করতে পারে। সে সমস্ত মনোযোগ লাগিয়ে কাজ করতে শুরু করল। এতটাই মনোযোগ দিল যে একবার বসের ডাক এলে সে সাফ বলে দিল — হাতের কাজ শেষ করে যাব। বলে দিও স্যারকে। দিয়া কি যেন বলল, সে কানে তুলল না। মনে মনে সে স্থির করে নিয়েছে যাবার পথে সে মা-র ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে যাবার জন্যে যে প্রেসক্রিপশনটা নিয়েছে তা কিছু বাড়িয়ে নেবে। আজ রাতেই যা করার করতে হবে। আরও দু’বার বসের ডাক এল। কিন্তু সে একই কথা বলল। আজ তার আর ভয় নেই। এই দিনটাই আজ তার শেষ দিন। সে মন লাগিয়ে কাজ করছে, আর কোনও দিকে না তাকিয়েই।
দিয়া ফিসফিস করে বলে — কাজটা ভালো করছিস না। বস এখানে এসে তোকে অপমান করবে, সবার সামনেই। সেটা কি ভালো হবে?
অসীমা কথা না বলে কাজ করছে। কথাটা শুনল কিনা বোঝা গেল না।
একটু পরই বস চলে এল। দিয়া দেখল স্টাইলিশ লোকটার মুখ রাগে গনগন করছে। কিন্তু অসীমা মুখ তুলে তাকাচ্ছে না মোটেই। সে একমনে তার কাজ করে যাচ্ছে। বস এগিয়ে গিয়ে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে অসীমার কাজ দেখল, নিবিষ্টতা দেখল। দেখে যেন আরও রেগে গেল। এরকম উপেক্ষা হয়তো কেউ তাকে কখনও করেনি। চিবিয়ে চিবিয়ে বস বলল — ডিড য়ু নো দ্যাট ইওর জব ক্যান বি গন অ্যাট এনি টাইম? অসীমা?
— আই নো স্যার। দ্যাটস ইওরস চয়েজ স্যার। কুড আই নাউ কম্পলিট মাই পেন্ডিং ফাইলস স্মুথলি? মুখ একটুও না তুলে কাজ করতে করতে অবলীলায় সে বলল।
চমকে উঠল সবাই। দিয়া ভাবছে এই মুহূর্তে একটা বিস্ফোরণ হল বলে। আশ্চর্য! লোকটা কথা না বলে নিজের চেম্বারের দিকে চলে গেল।
মুখ তুলেও দেখল না অসীমা। ফোনটাকে সাইলেন্ট মুডে রেখেছে সে। বাড়ি থেকে ফোন আসতে পারে, বিতান ফোন করতে পারে। কোনও খারাপ খবর আসারও সম্ভাবনা আছে। দিয়া আর কথা বলেনি। শুধু দেখছিল কাজের ফাঁকে ফাঁকে। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে কাজ করে যাচ্ছে সে। দিয়া এবং আরও কয়েকজন ডাকাডাকি করল। শেষে দিয়া জোর করে ওর মুখে কিছু খাবার গুঁজে দিল।
যখন কাজ শেষ হল সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। মাথাটা একটু টলে গেলেও একটু দম নিয়ে পদত্যাগ পত্রটি লিখল সে। অফিস প্রায় ফাঁকা। দিয়া বলেছিল — আমি কি তোর জন্যে অপেক্ষা করব? সে বলেছে — না, তুই যা। দিয়া বলেছিল — বস…। অসীমা হেসে বলেছিল — আরে ভাবিস না। কারণ আমার ভয় ব্যাপারটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
কাজ শেষ করে বসের চেম্বার এর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সন্ধ্যে উতরে গিয়ে রাত নেমেছে। ভাই ফিরল কিনা কে জানে! ফোন তো সাইলেন্ট মুডে রাখা। আজ কি একটি বিশেষ দিন তার জন্যে?
বসের ঘরে আলো জ্বলছে। বাইরে টুলে বসে থাকা রঘুনাথ সিং বা কোথায় গেল? ফাইল ও পদত্যাগ পত্রটি তো জমা দিতে হবে।
এইসময় বস বাইরে এল। তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল।
— স্যার। একটু দাঁড়ান। নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই অচেনা ঠেকল তার।
লোকটা দাঁড়িয়ে গেল আচমকা। মানে তাঁর কণ্ঠ বসকে দাঁড় করাতে বাধ্য করল যেন।
— ফাইলগুলো হয়ে গেছে। এগুলো আপনার টেবিলে রাখতে হবে। একটিবার ভেতরে আসবেন স্যার? তাছাড়া একটা চিঠি আছে।
বস একটু ভেবে নিয়ে ভেতরে ঢুকল।
একটু চুপ। অসীমা ফাইলদুটো জমা করল। তারপর পদত্যাগ পত্রটি দিল।
বস কথা না বলে খামটা খুলে পড়ল।
অসীমা তার প্রতিক্রিয়া জানার আগেই কিছু না বলেই বেরিয়ে এলো। ফোনটা খুলে দেখল তিরিশটা মিসড কল রয়েছে। মার, বাবার ও বিতানের। ভাইএর কোনও ফোন নেই। যাক গে, অত ভেবে আর কী হবে। রাতে খাওয়ার পর অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিশ্চিন্ত লম্বা ঘুম। আহা কী মুক্তি।
এখন ওষুধের দোকান। মায়ের ঘুমের ওষুধ। একটু অবাক হয়ে ভাবল, তার থেকে বিশ্লিষ্ট তারই চেতনা আর দেখতে পাচ্ছে না কেন সে? নিজেকে সে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে না, চিনতেও পারছে না, এটা তো নিজের জন্যে বেশ খানিকটা অসুবিধেজনক।
দোকানে প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারের প্রেস্ক্রাইব করা ঘুমের ওষুধের বাড়তি ওষুধ দিতে রাজি হল না দোকানি। অসীমা আরেকটি দোকানের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল, আরও দুটো দোকান ঘুরলে ঠিক পেয়ে যাবে। এই সময়ে পেছন থেকে ডাক শুনল — মিনু!
বিতান। সেরেছে। কী খবর দেবে কে জানে!
— কি ব্যাপার বলোত? সারাদিন ফোন তুললে না যে?
ভালো লাগছে না। এই পৃথিবীর মানুষ আলো হাওয়া পরিবার পরিজন চাকরিক্ষেত্র এসব তার জন্যে নয়, ছিল না কখনও।
— কি ব্যাপার মিনু, এত দেরি করছ আজ? সুখেন লক আপে। ওকে জামিনে ছাড়াতে হবে। আমি ব্যবস্থা করেছি। মেশো ছিলেন সাথে। মেশোর শরীরটা বিশেষ ঠিক নেই। তাই বাড়িতে রেখে এসেছি। তোমার অপেক্ষায় আছি। তাড়াতাড়ি চলো আমার সাথে।
ঘুমের ওষুধ কেনা হল না আর।
অনেক রাতে সুখেনকে নিয়ে বাড়ি ফিরল অসীমা।
পরদিন সকালেই বসের ফোন — সময়মত অফিস এসো। তোমার রেজিগনেসন লেটার এক্সেপ্টেড হয়নি।
৪
অসীমা একইভাবে অফিস যায় আসে। বস তাকে কিছু বললে আজকাল সে ঘুরে দাঁড়ায়। অসীমা আর পৃথিবীটাকে ছেড়ে যাবার সময়ই পেল না।
বাড়তির মধ্যে শুধু একদিন সন্ধ্যার পর বিতান তাকে ফিসফিস করে বলেছে — আমি তোমায় ভালবাসি অসীমা। অনেক দিন থেকেই। বলতে পারছিলাম না শুধু।
অসীমা তার সেই চেতনাকে নিজের থেকে আলাদা করে নিয়েছে এই পৃথিবীর বুকে পথ চলার জন্যে। তার জন্যে এবার অনেক কসরত করতে হয়েছে তাকে।
মাঝেমধ্যে শুধু ভাবে আত্মহত্যার ইচ্ছেটাকেও এই পরিস্থিতি গলা টিপে মেরে ফেলল কীভাবে সেটা ঠিক বোঝা গেল না।