ব্যালান্স – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

ব্যালান্স – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

ব্যালান্স        (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

— কিছু দেবেন বাবু?
প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। সিগন্যালিং এর কাজ হচ্ছে। গতকাল থেকে বন্ধ আছে ট্রেন চলাচল।
শীতের রোদ পিঠে নিয়ে প্লাটফর্মে বসেছিল রথীন। কয়েক শ মাইল দূরে থাকা নিজের পরিবার পরিজনদের ঘোরাফেরা মনের আঙ্গিনায়। অলস দুপুর। তন্দ্রা ঘন হয়ে এসেছে নিঃশব্দে। হঠাৎ করেই শোনে, ” কিছু দেবেন বাবু?”
তন্দ্রাচ্ছন্নতা কাটে। চোখ মেলে দেখে একটি ছেলে। কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে। বয়স আট কি দশ বছর হবে বলেই মনে হয়। রুক্ষ চেহারা। শতছিন্ন পোষাক। চোখে মুখে দারিদ্রতার বর্ণ সুস্পষ্ট।
একটা বেতের ঝাঁপি রয়েছে হাতে। সিঁদুর লেপা পট। কোন দেব বা দেবীর হবে। নিশ্চিত করে বোঝার উপায় নেই জীবন ধারনের জন্য কোন দেবতার উপর আস্থা রেখেছে। ছেলেটিকে আগে কখন এই চত্বরে দেখেনি রথীন।
ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যারা স্টেশনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে তাদের সবাইকে দেখেছে রথীন। কম বেশি মুখ চেনা।এই ছেলেটিকে আজ প্রথম দেখল।
বছর তিনেক তালঝারিতে রয়েছে রথীন। স্টেশন মাস্টার। লুপ লাইনের স্টেশন। সারাদিনে হাতে মাত্র কয়েকটি ট্রেনের যাওয়া আসা।
অফিসের পিয়ন রাম সিং বলে, ” এ্যায়সা নকরি কাঁহা মিলেগা সাব? ইধার রহে যাইয়ে।”
রাম সিংয়ের কথা শুনে চুপ থাকে রথীন। কথাটা ঠিক। তবে কর্ম না থাকা যে কত বড় যন্ত্রণার বিষয় সেটা দিনের প্রতি মুহূর্তে টের পায়।
সারাদিন অখণ্ড অবসর এখানে। স্বজন প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলা। কবিতা লেখা। স্মার্ট ফোনে সিনেমা দেখা। তারপরেও মনে হয় দিন রাত্রির বহর এখানে বড্ড বড়। অকৃতদার রাম সিংয়ের হাতের খানা। আর মাঝে মাঝে মোষের দুধের চা। ট্রেন এলে রাম সিং ম্যানেজ করে নেয়। কাজ আর কই! মাঝে মাঝেই কর্মহীনতায় হাঁপিয়ে ওঠে রথীন। বলে এবার এখন থেকে যেতে পারলে বাঁচি।

গতকাল ঠিক করেছিল প্ল্যাটফর্মের ভার রাম সিংয়ের হাতে দিয়ে ঘুরতে বের হবে। সাত সকালে জোনপুর থেকে খবর আসে উপর মহলের লোকজন আসবে। লাইনের কাজ দাঁড়িয়ে দেখবে সাহেব নিজে। রথীনকে থাকতেই হয়। সেই সকাল থেকে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। সাহেব সময় পায়নি এখনও।

— কিছু দেবেন বাবু? আবার ধেয়ে আসে কাতর অনুরোধ।
পরিষ্কার বাংলা শব্দগুচ্ছ নাড়িয়ে দেয় রথীনকে। জিজ্ঞাসা করে, কোথায় বাড়ি?
ভিক্ষার পরিবর্তে প্রশ্ন! এমনটা আশা করেনি ছেলেটি। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারপরেও।

— কি নাম তোর?
ঘাবড়ে গিয়েছে ছেলেটি। পিছিয়ে যায় কয়েক পা। ভীত চাউনি ছুঁয়ে থাকে রথীনকে।
শেষ কবে এই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় কাউকে কথা বলতে শুনেছে মনে করতে পারে না রথীন। তাছাড়া একটা বাচ্চাটা ভিক্ষা করছে, বিষয়টা রথীনের মনে আবারও প্রশ্নের জন্ম দেয়।
— কোথায় বাড়ি?
ভয় পায় ছেলেটি। কিছু পাবার আশা ছেড়ে হাঁটা দেয় দ্রুত।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রথীন। ছেলেটির পায়ে পা ফেলে এগিয়ে আসে প্ল্যাটফর্মের শেষ দিকে। দেখে মাটিতে বসে রয়েছে একটি লোক। জরাজীর্ণ চেহারা।
— কোথায় বাড়ি আপনাদের?
রথীনের প্রশ্ন শুনে মুখ তোলে লোকটি। চমকে ওঠে রথীন। ডান চোখে দগদগে ঘা। কালচে রক্তধারা নেমে আসে গাল বেয়ে। শরীরে কম্পন। ডান পা শীর্ণ কাঠি যেন। লোকটি বেশ কিছুক্ষণ দেখে রথীনকে। তারপর ডাকে ক্ষীণ স্বরে, “রথীন।”

ভীষণ অবাক হয় রথীন। তাকে চেনে। ভালো করে দেখে লোকটিকে। হ্যাঁ, চিনতে পেরেছে এইবার। রথীনের ছেলেবেলার বন্ধু সতু। সময় যেন ভাবীকাল থেকে কয়েক দশক পিছিয়ে এসে বার্ধক্যের রং বুলিয়ে দিয়েছে সতুর শরীরে।
রথীনের বুক ফুঁড়ে স্বতস্ফূর্ত ভাবে বের হয়ে আছে, ” সতু তুই?”
মাথা নামায় সতু। বিস্ময় বিপন্ন করে তোলে রথীনকে। টান পড়ে স্মৃতির রশিতে। দুর্নিবার সেই টান। হই হই করে ধেয়ে আসে গ্রাম্য শৈশব। সেই সতু। রায়দের বাগানে কতবেল গাছের মগডালে উঠেছে। নিচে দাঁড়িয়ে রথীন। তুই কি করে পারিস সতু? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করত রথীন।
ব্যালেন্স। ব্যালেন্স। মনে মনে হনুমানজীকে ডাকবি তুইও পারবি। বলে, এক ডাল থেকে অন্য ডালে চালান করে দিত নিজেকে।
গ্রামের রথের মেলায় সাইকেল নিয়ে ব্যালেন্সের খেলা দেখাচ্ছে সতু। হাততালি দিচ্ছে সকলে। সেই দৃশ্য ভেসে আসে মনতটে নিমেষে।
আরও কত কত কথা ধেয়ে আসে মনে। শেষ বার সতুকে দেখেছিল চন্দনপুরে। সার্কাসের দলে খেলা দেখাত সতু। রথীন গিয়েছিল দিদির বাড়ি। পথে দেখা। সতুই জোর করে নিয়ে গিয়েছিল নিজের শো দেখাতে। মনে আছে শো শেষ হতে সতুর হাতে ধরে বলেছিল রথীন, সতু এ বড় ভয়ংকর খেলা। ছেড়ে দে। হেসে ছিল সতু। ব্যালেন্স, ভয় পেলে চলবে কেন বল।
তোর এমন হল কি করে সতু? জিজ্ঞাসা করে রথীন।

ছেলেবেলা থেকেই ব্যালেন্সের খেলা দেখানোর নেশা পেয়ে বসেছিল সতুকে। সুযোগ পেলেই ছুটে যেত এদিক সেদিক খেলা দেখাতে। গুরু খুঁজে নিয়েছিল আরামবাগের দিকে। সে লোক নাকি মাটির থেকে অনেক উপরে তারের উপর সাইকেল চালায়। গুরুর সঙ্গে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াত সতু। একদিন আলাপ হয় গুলাবীর সঙ্গে। যোগ দেয় সার্কাসে।
গুলাবীর সঙ্গে জুটি বাঁধে সতু। মাটির থেকে অনেক উপরে টান টান তারের উপর এক চাকার সাইকেলে চেপে সতু। আর সামনের ঝুলন্ত পাটাতনে দাঁড়িয়ে গুলাবী। টান টান উত্তেজনা তাঁবুর মধ্যে। হাজার বর্ণের আলোয় ঝলমল গ্যালারি। হাজার জোড়া চোখের সামনে চলছে ব্যালেন্সের খেলা। সতুকে লক্ষ্য করে একটার পর একটা ধারালো ছুরি ছোঁড়ে গুলাবী। শরীর দুমড়ে মুচড়ে নিজেকে রক্ষা করে চলে সতু। জীবন মরণের সীমানায় দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে বিস্ময় বিলিয়ে চলেছে হাজার হাজার লোকের মনে। এইভাবেই এগিয়ে চলে বছর। তারপর একদিন হঠাৎ করেই সব শেষ।
ছুরির ফলা বেঁধে সতুর চোখে। উপর থেকে পড়ে যায় সতু।
ভাঙ্গা পা। এক চোখ। হারিয়েছে ব্যালেন্স। সার্কাসে অচল। জায়গা হয়নি আর। সতু ভিক্ষা করে এখন।

কথাগুলো বলে নিজেই লজ্জা পায়। নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চায় রথীনের সামনে থেকে। বাম হাতটা ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সতু। কষ্ট করে উঠে দাঁড়ায়। লাঠি এখন অবলম্বন। কোন রকমে এগিয়ে চলে সতু।
— সতু শোন, ডাকে রথীন। দাঁড়ায় না সতু।
— কোথায় যাবি? আমার এখানে থাক। সুস্থ হয়ে ফিরে যাবি না হয়। রথীনের ডাক স্পর্শ করে না সতুকে।
— বাচ্চাটা তোর? জিজ্ঞাসা করে রথীন।
— না।
–তবে?
— গুলাবীর। স্পষ্ট উত্তর সতুর।
— আর গুলাবী ?
— সে অন্য এক বিহারী ছেলের সঙ্গে সার্কাসেই আছে বলে শুনেছি।
ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সতু।
রথীন ডেকেই চলে, সতু…সতু।
দিগন্তে তখন ধ্যানমগ্ন সূর্য্য। সতু বিলিয়ে দিতে চায় নিজেকে অপসৃয়মান সূর্যের বুকে।

জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যার বর্ণময়তা অফুরান ভাবনায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রথীন বোধ হয় তেমনই এক সময়ের প্রবাহে ভেসে চলে। সতুর জীবন বড় অদ্ভুত। ব্যালেন্স ভালোবেসে জীবনের ভারসাম্য বিপন্ন আজ।

বাচ্চা ছেলেটির পাশে পাশে হেঁটে চলে সতু। রথীন নিশ্চল হয়ে চেয়ে দেখে। কি করুণ পরিণীতি সতুর! জল আসে দুই চোখে।

— সাব।
রথীনকে একলা এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্ল্যাটফর্মের ধারে এসেছে রাম সিং।
— আকেলা কেয়া দিকতা সাব?
নীরব রথীন। কে জানে কি দেখছিল। অপলকে তাকিয়ে থাকে অপসৃয়মান সূর্যর দিকে। সতু আর গুলাবীর ছেলে মিলিয়ে গেছে দিনান্তের দিবাকরের বুকে।
— জোনপুর সে ও সাহাব আগ্যয়ে। আপ চলিয়ে।
চলে যায় রাম সিং।
অলস পায়ে অফিস ঘরের দিকে হাঁটা দেয় রথীন। সতুর জন্য কেমন একটা হাহাকার মাথা তোলে মনে।