পালাবার পথ নাই – সুদীপ ঘোষাল

পালাবার পথ নাই – সুদীপ ঘোষাল

পালাবার পথ নাই   (ছোটোগল্প)

সুদীপ ঘোষাল

গাঁয়ের পাগলাদা। মাঝে মাঝেই চিৎকার করে বলে, পালাবার পথ নাই যম আছে পিছে। কুঁড়েঘর একদিক কাত হয়ে আছে। ভোটার লিষ্টে নাম আছে পাগলা হাজরা। লেখাপড়া অল্পবিস্তর জানা আছে। জীবনের পাঠশালায় এখনও পড়ে। রান্না করে না। বাড়ি বাড়ি যায়, কেউ না কেউ খেতে দেয় ঠিক। মানুষের সঙ্গে মেশে। চালাঘরে তার সঙ্গী একটা বাঁকা লাঠি, ঠিক ফালি কুমড়োর মত। চাঁদ উঠলে চাঁদের আলো ভাঙা দেওয়ালের ফোকল গলে টুকি দেয়। হ্যারিকেন বা লন্ঠন কিছু নেই। রাতে ঘুম হয় না। দিনে পুষিয়ে নেয়। রাতে কত কি দেখে। প্যাঁচা, শিয়াল আর চোর। পাগলা চেঁচিয়ে বলে, পালাবার পথ নাই। চোর ভয় করে পাগলাকে। তার ঘরের পেছন দিয়ে তাদের যাতায়াত। পাগলা ছয় ফিট লম্বা, শরীর ভেঙে পড়েছে। ধুতিটা মালকোঁচা মেরে পরা আছে। বনে প্রাতঃকৃত্য সারে। পুকুরে চান করে মুখ ধোয়। সারাদিনে এটুকুই তার কাজ। দুপুরে কোনো বাড়িতে খাবার জুটলে খায় তা না হলে উপোস।

এই কদিন হল একজন মানুষ পাগলার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। সকলে যাওয়া আসার পথে দেখে পাগলদা একা নয়, আর এক জন আছে তার। সাতকুলে পাগলার কেউ নাই কিন্তু জুটে গেছে কপালজোড়ে। পাগলা কিছু ভাবে না, সে কি খাবে, নবাগত কি খাবে কোথায় শোবে কিচ্ছু জানে না। মৌন বাবাজি হাসে আর তাকায় জুলজুল করে। তার তাকানোর মধ্যে জীবনের প্রতি তাচ্ছিল্য ধরা পড়ে। সকালে একবার বেড়িয়ে যায় আবার মৃদু হাস্যমুখে দিব্বি পাগলার পাশে বসে। পাগলা কিছু বলে না। তোমার জায়গা, তোমার বাড়ি ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো এই ঘরের মালিক নই। পাগলার গানের গলাটা চমৎকার। মৌন বাবাজি পাগলাকে তাকিয়ে দেখে আর ব্যাগ থেকে বের করে কয়েকটা খুচরো টাকা পয়সা। হাত বাড়িয়ে পাগলাকে দেয়। পাগলা মাটিতে রাখে পয়সা। পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একটা ল্যাংটা ছেলে। পাগলা তাকে ডেকে বলে, এই পয়সাগুলো দিয়ে মুড়ি, চিড়ে আর গুড় নিয়ে আয়, তোকেও দোবো। ছেলেটি ছুটতে ছুটতে যায় আর খাবার নিয়ে আসে। চিড়ে গুড় খায় তিনজনে। পাগলা বলে, তোর বাড়ি কোথায়? ছেলেটা বলে জানি না। তোর বাবা, মা। জানিনা। বেশ বস এখানে। এখানেই থাকবি আজ থেকে।
বেশ একটা সাজানো গোছানো সংসার হয়েছে পাগলার। পাগলা দেখেছিল বাড়ির সামনে লোকটা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পাগলা দেখেছে অনেক আগেই। খোঁচা দাড়ি আর ছিপছিপে লম্বা লোকটা একটা সিগার ফুঁকছে। পাগলার ইচ্ছে হলো লোকটার সঙ্গে একটু পরিচয় করার। কিন্তু লোকটা যদি বিরক্ত হয়। একটা দোটানা মনোভাব নিয়ে পাগলা লোকটার কাছে গিয়ে বললো, কিছু খুঁজছেন নাকি?
লোকটা বেশ বিজ্ঞের মত উত্তর দিলো, আমরা সবাই তো খুঁজে বেড়াই। কি খুঁজে মরি জানি না। তবু খুঁজি।
লোকটার কথা শুনে তার ভালো লাগলো। সে বললো, আসুন চা হোক এক কাপ।
লোকটা বললো, কেন, আপনি খাওয়াবেন? আমার পয়সা নেই।
পাগলা বললো, আসুন আমার সঙ্গে। আমি আছি তো। একটু আড্ডা মারা যাবে। অন্য কেউ হলে হয়ত ভাবত অপরিচিত লোক। চোর, গুণ্ডা হতে পারে? এড়িয়ে যায় অনেকে।

লোকটি বললো, আমাকে সবাই তো চুপ করতে বলে। কথা বললেই খেপে যায়। আপনি আমাকে কিছু বলতে বলছেন।
— হুম, বলছি। বলুন
— আচ্ছা আপনি আঁতেল দেখেছেন। বেশ বড় বড় কথা। আর কাজের সময় অষ্টরম্ভা।
— ঠিক, ঠিক।
— নিজের পুরনো জামার মায়া ছাড়তে পারে না। কোনোদিন একটা না খেতে পাওয়া লোককে খাওয়াতে পারে না। কোনো সামাজিক অবদান থাকে না। শুধু পয়সা কামাবার ধান্দা। প্রচুর পয়সার মালিক হয়ে, আদিরসে হাবুডুবু খেয়ে সবশেষে লাইনে দাঁড়ানো। ব্যস শেষ। আগুন, আগুন শালা মাটি চিনলো না অথচ মাটিতেই জন্ম।
পাগলা ভাবছে, বাবা তুমিই বা কি এমন কাজ করেছো যে এত ফাটাচ্ছ।
লোকটি বললো, আমি এখন ভবঘুরে। বাবা, মা মরে যাওয়ার পর গাংপুরের তিরিশ বিঘে জমি অনাথ আশ্রমের নামে লিখে দিলাম। তারপর মনে করলাম, একটা পেট তো, ঠিক চলে যাবে। আমার দুটো রুটিতেই দিন কেটে যায়। পড়ে থাকি এদিকে ওদিকে। কোনো নিয়মে আটকা থাকতে পছন্দ করি না। কি হলো ভাট বকছি না তো। আপনি কিছু বলছেন না তো।
— না, মানে আমি বলছিলাম আমাদের গাঁয়ের পাশে একটি সংস্থা আছে। তারা স্টেশনে ফুটপাথে অনাথ লোকদের জন্য মাঝেমাঝেই খাওয়ার ব্যবস্থা করে। আপনার মত লোক তাদের প্রয়োজন। যদি সময় দেন তো ভালো হয়।
— কিন্তু মশাই, আমার এক জায়গায় বেশিদিন ভালো লাগে না।
— যতদিন পারবেন, থাকবেন।
— না আপনার কাছেই বসি। এবার লোকটির থাকার ব্যবস্থা হলো পাগলার ভাঙা ঘরে। খায় দায় গান গায়। মাঝে মাঝে কাজ করে। কিন্তু লোকটার চোখ মুখে পরিতৃপ্তির ছাপ নেই। একদিন ওর ঘরে মারলো উঁকি। দেখলো লোকটা উবু হয়ে বসে দাগ কাটছে আঁকিবুকি। কৌতূহল হলো পাগলার। সোজা ঘরে ঢুকে বললো, কি করছেন কই দেখি। লোকটা কিছুতেই দেবে না। শেষে পাগলা কোনোরকমে বুঝিয়ে হাতে কাগজটা নিলো। দেখলো সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকা। আর ছবির তলায় দু লাইনের ছড়া। সে বললো, আপনি তো ছুপা রুস্তম। শিল্পী লোক। আপনার এলেম আছে বাপু। লোকটি বললো, যখন ভালো লাগে, একটু আঁকতে বসি। আর কিছু নয়।

পাগলা ভাবে, লোকটি এক কথায় তিরিশ বিঘে জমির মায়া ছাড়তে পারে, যখন, তখন সকলের মায়া কাটিয়ে ভবঘুরে হয়ে না খেয়ে জীবন কাটাতে পারে। পাগলা ভাবে এইসব লোক সত্যিকার গুণী লোক। অথচ এদের সঠিক কাজে লাগাবার লোক নেই। কি করে একটা লোক এরকম হতে পারে তার জানা নেই। লোকটা পাগলাকে বসিয়ে জীবনের কতকথা শোনায়। সে বলে, স্থূল পদার্থ নিয়ে পরমাণু বিজ্ঞানীরা অপেক্ষায় থাকেন না। অণু পরমাণু নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত। তা না হলে হিমালয়ের চূড়া কিংবা জমি জায়গা নিয়েই তারা টানাটানি করতেন বেশি।
আকাশকে আমরা পৃথিবীর মানুষ, স্বার্থপরের মত খণ্ড খণ্ড করেছি। এটা কাটোয়ার আকাশ, ওটা দিল্লীর, ওটা রাশিয়ার আকাশ। অখণ্ডতার বাণী আমরা ভুলে যাই। আকাশ চিরদিন অখণ্ডই থাকে। তাকে খণ্ডিত করার অকারণ অপচেষ্টা না করাই ভালো। তবু কাঁটাতার হয়, সীমানা ভাগ হয়। অদ্ভূত মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে আছে প্রাণীকুল। আলোর অন্তরে বাদ্য বাজে, ‘অনন্ত নাদ’ এর ভেরী। সূক্ষ্ম তরঙ্গে মিশে যায় তার অস্তিত্ব, ভুলে যায় তার অবস্থান। এ অনুভূতি ঝর্ণার মত, কবিতার মত, ভালোবাসার মত, নদীর প্রবাহের মত। জোর করে সে গতি পাল্টায় না। সৃষ্টির সবাই ভয়ে কাজ করি। অস্তিত্ব বিনাশের ভয়ে। পৃথিবী ঘোরে ভয়ে, তা না হলে সে ধ্বংস হবে। সূর্য তাপ দেয় ভয়ে, তা না হলে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
সৃষ্টি মানুষের প্রশ্বাস, স্থিতি মানুষের ক্ষণিক ধারণ, প্রলয় মানুষের নিশ্বাস। আলোর অনুসন্ধানীর ভয় নেই, তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই নেই। লোভ নেই, তাই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নেই। অকাল বার্ধক্য নেই।
আছে শুধু আনন্দ, ছেলেমানুষি, বোকামি, সরলতা, সোজা পথে হাঁটার সোজা রাস্তা…বন্ধু, জাতপাত নির্বিশেষে অখণ্ডতার অসীম ভালোলাগায় মনসায়রে আপনি ডুব দিতেই পারেন। মনোজ জানত, অভিনবকে সবাই নার্ভলেস বয় বলেই ডাকে। ছোটো থেকেই সে প্রচণ্ড সাহসী। নদীতে সাঁতার কাটা কিংবা উঁচু গাছ থেকে লাফিয়ে পুকুরের জলে ঝাঁপ দেওয়া তার কাছে জলভাতের মত সহজ। তার বন্ধু সুমন বলছে বন্ধুদের আড্ডায়। এর একটু পরেই চলে এল নার্ভলেস বয় অভিনব। সে এসেই বসল বন্ধুদের মাঝে। বন্ধুদের বড় প্রিয় এই নার্ভলেস। সে এলেই বন্ধুদের আড্ডায় চারটে চাঁদ নেমে আসে। আলোচনা আরও জমে ওঠে। নার্ভলেস শুরু করে তার পাহাড়ে ওঠার গল্প। একবার মটর সাইকেলে ভারত ভ্রমণে বেড়িয়েছিল নার্ভলেস বয়। উত্তর ভারত ঘুরতে তার সময় লেগেছিল একমাস। সব জায়গা ঘোরা না হলেও বেশির ভাগ স্থান ঘোরা হয়েছিল। স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পড়েছিলেন কবিতা। মনে পড়তো ফুলশয্যা, আদর। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। পাগলা লোকটার কথা কিছু বোঝে আর কিছুটা ধোঁয়াশা থেকে যায়। পাগলা জেনে গেছে এ লোক সত্যিকারের সাধু। তার কাছে কতকিছু শেখার আছে। পাগলা ভাবে, এ ভবঘুরে আমার কাছেই কেন এলো আরও তো অনেক জায়গা আছে। যারা তার বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত করে তারা বলে, কি গো পাগলদা, বেশ সংসার গুছিয়ে বসেছো তো শেষ বয়সে।
এখন ছুপা রুস্তম শুকনো ডালপালা জড়ো করে ইঁটের উনুনে সেদ্ধ ভাত করে। ছোটছেলেটা তার নেওটা হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি থেকে সে দোকানে যায়, ডালপাল জোগাড় করে। পাগলা বসে ভাবে এত সুখ ভালো লয়, তার মানে এবার কপালে কি অপেক্ষা করে আছে কে জানে। লোকটার ব্যাগে কত টাকা পয়সা, ছবি আর চিঠি আছে। পাগলা লোকটার দর্শন বুঝতে পারে না। সে কি চায়,তার জীবনের উদ্দেশ্য কি, তাকে জিজ্ঞেস করেও উত্তর পায় না। লোকটা বলে, কি হবে অতকিছু জেনে। সময়টা পার করলেই তো চিরশান্তির খোঁজ পাওয়া যাবে।
পাগলা খুশিতে গান ধরে। তার মনের মত একটা লোকের দেখা পেয়ে সে আনন্দিত হয়।

তারপর একদিন সকালে উঠে পাগলা দেখে সেই লোকটা আর ছেলেটা আর এখানে নাই। পাগলার মনের কুঠুরি কেমন শূন্য শূন্য হয়ে যায়।
পাগলা চেঁচিয়ে গান ধরে,”পালাবার পথ নাই যম আছে পিছে’।