আজও রবীন্দ্রনাথ কতটা প্রাসঙ্গিক (প্রবন্ধ)
সুদীপ ঘোষাল
জনৈক যুবক, তাঁকে অশ্লীলভাবে আক্রমণ করে জনপ্রিয় হতে চান, এটা বড় বিস্ময়কর ঘটনা। আজও রবীন্দ্রনাথের দেশজ প্রয়োজন, রাজনৈতিক প্রয়োজন, সমসাময়িক প্রয়োজন আছে। তবে তারও উপরে যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো রবীন্দ্রনাথকে আরও ভালো করে জানা, তাঁকে অন্তরে ঠাঁই দেওয়া, রবীন্দ্র দর্শনে নিজেদের উজ্জীবিত করা৷ আজো রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
বর্তমান সময়ে ভারতে যখন অতি-জাতীয়তাবাদের জিগির ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তথাকথিত উদারপন্থীদের প্রায় আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে রবীন্রনাথের জীবনদর্শনের কথা আরও একবার মনে করা আশু প্রয়োজন বইকি। আর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলও বেরিয়ে গেছে। আগামী দিনের ভারত কোন পথে এগোবে ? যদি জাতীয়তাবাদী জিগির আরও উগ্র হয়ে ওঠে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার উপরে নেমে আসে তরবারির আঘাত, তবে ভবিষ্যতের দিনগুলি যে খুব অস্বস্তিজনক হবে না, তা বুঝতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না। এই কথা সহজেই অনুমেয় এবং বিবেচ্য কারণ তাঁকে বাদ নিয়ে কেউ সম্পূর্ণ রূপে বাঙালি হয়ে উঠতে পারে না। আমাদের প্রকৃত বাঙালি হয়ে উঠতে গেলে ক্রমশ রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করতে হবে; কোথায় নেই তিনি বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের জাদুকরি হাতের স্পর্শ পড়েনি শুধুমাত্র মহাকাব্য ছাড়া। হয়তো অনেকে আমার সঙ্গে একমত পোষণ করবেন না কিন্তু সত্য হলো এটাই বাঙালি হয়ে বাঙালিত্ব গ্রহণ করতে হলে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় গ্রহণ করতেই হবে। জন্ম থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে জন্ম, বিরহ থেকে আনন্দ, বিষাদ থেকে আত্মপ্রকাশ সব কিছুর ভেতরেই আমাদের শ্রেষ্ঠতম আশ্রয় হলেন তিনি; এমনকি বাঙালির আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভাবনা এবং এই উপমহাদেশে প্রথম সমবায় তথা কৃষি ব্যাংকের ভাবনা এবং ক্ষুদ্র ঋণের কথা তিনিই প্রথম ভেবেছেন। তিনি জমিদারি থেকে দূরে গিয়ে দরিদ্র কৃষকের দ্বারে পদচারণা করেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভাবনা এবং তাদের মুক্তির কথা; কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া শুধু শিল্প আর সাহিত্য দিয়ে কখন মানবজাতির মঙ্গল সম্ভব নয়; আর এখানেই তিনি অনন্য এক মহীরুহে পরিণত হন। তিনি জীবনব্যাপী সাধনার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের যে নতুন মাত্রা দান করেছেন, তা তুলনাহীন। তাকে ঘিরেই বাংলা সাহিত্যে, শিল্প ও সংস্কৃতির ভুবনে আধুনিকতার সূচনা হয়েছে। পরবর্তী কালে এই ধারার ধারাবাহিকতায় বাংলা সাহিত্য বিষয় বৈচিত্র্যে, জীবন জিজ্ঞাসায় ও মানবিকতায় বিশ্বস্ত হয়ে উঠে। তার কাছে আমাদের অনেক ঋণ। তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্যের সকল শাখা আজ সমৃদ্ধ। শুধু সাহিত্যে নয় সংগীতে এবং পরিণত বয়সে চিত্রকলায় বঙ্গীয় চিত্রধারার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে তিনি যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, পরবর্তীতে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আমাদের দেশে রবীন্দ্রচর্চার ইতিহাস আজকের মতো এত সহজ ও সুন্দর ছিল না; তিনি ছিলেন দেশ কাল জাতি বর্ণ নির্বিশেষে এক মহাবৃক্ষের মতো আশ্রয়দাতা। আজকের তরুণ প্রজন্ম যতটা সামাজিক মাধ্যমে সাবলীল বোধ করে, ততটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে করে না। ওল্টালে বুঝতে পারত, মৃত্যুর এত বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। এই প্রাসঙ্গিকতা যে নবীন প্রজন্মকে সে ভাবে নাড়া দিচ্ছে না, সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বর্তমান প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং তাতেই আকৃষ্ট। তাই রবীন্দ্রনাথকে তাদের সামনে তুলে ধরার জন্য সেই পথ অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই।
আদর্শ ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার প্রতিফলন তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর সুবিশাল সৃষ্টিতে। আজকের অস্থির সমাজের কাছে সেই সৃষ্টি অতি অল্পসময়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া বিকল্প পথ নেই। এই বিষয়ে কিছু কিছু কাজ অবশ্যই হয়েছে। ইন্টারনেটের সহায়তায় এখন চাইলেই যে কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায়। ই-বুকে রবীন্দ্ররচনাবলি সংযোজিত হয়েছে। এখন আর কাগজ নয়, রবীন্দ্রনাথ তরুণ প্রজন্মের পছন্দের ডিজিটাল ফর্মেই। কিন্তু তবু সংশয় থেকেই যায়।
শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বা গল্প-কবিতা পড়েই কি রবীন্দ্রনাথকে জানা সম্ভব! সেটাই-বা ক’জন করছেন! আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল রবীন্দ্রনাথ নিয়ে খুব আগ্রহী। নেপালি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বেশ কিছু রবীন্দ্ররচনা। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে জানতে অনেকেই শিখে নিচ্ছেন বাংলা ভাষা। আর আমরা বাঙালিরা! আমরা রবীন্দ্রনাথ বলতে কার্যত পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে সীমাবদ্ধ! নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কি ঠিকঠাক পালন করতে পারছি আমরা?
এই বিষয়ে যুক্তিতর্ক চলতেই থাকবে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারের নানাবিধ আয়োজন আজও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দু:খ, বিরহ-মিলন, প্রাত্যহিক কাজকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। যুক্তিতর্ক বাদ দিয়ে আমাদের উচিত রবীন্দ্রনাথের বিশাল সম্ভারকে মানবতার উৎকর্ষ বৃদ্ধির কাজে লাগানো। রবীন্দ্রনাথ দেশকালের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নন। তিনি চিরকালের। তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটি লিখেছিলেন আজকের শতকের জন্যই। তিনিও নিশ্চিত ছিলেন যে, এই শতকেও তাঁর রচনার সমান গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। নতুন প্রজন্মের জন্য কবিতায় দেওয়া তাঁর বার্তাই সেই কথার সাক্ষ্য বহন করে।
উনিশ শতকে নারী স্বাধীনতা বা অধিকার যখন এক কথায় অকল্পনীয়, তখন কবি নারীকে তুলে এনেছেন তাঁর রচনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী হিসেবে, যা আজও একই রকম ভাবে প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে যে বিষয়টি পরিবেশবিদ তথা সমগ্র মানবজাতির অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়, তা হল বৃক্ষচ্ছেদন ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই এটি উপলব্ধি করেছিলেন এবং সেই প্রকৃতিবাদী দর্শনচিন্তার প্রতিফলনও রেখে গিয়েছেন কাব্যে, গানে, সাহিত্যে, যার প্রাসঙ্গিকতা কখনওই অস্বীকার করা যায় না। আর তাই ষাটের দশকে যখন তাঁর চর্চার প্রয়াস পূর্ণতা লাভ করছিল ঠিক তখনই নেমে আসে তৎকালীন সামরিক সরকারের বিরোধিতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি এক নতুন অভিযাত্রার সন্ধান পায় এবং রাবীন্দ্রিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে সৃজন করেন বাঙালির জীবনে এক নতুন অধ্যায়। পরবর্তীতে রবীন্দ্র সংস্কৃতির চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েই এই অঞ্চলের বাঙালি সব আনন্দ বেদনায়, সংকটে ও স্বপ্নে তাঁকে অবলম্বন করেছে, এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর গান সৃষ্টি করেছিল এক মহান উৎস, যা প্রেরণাসঞ্চারী হয়ে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন,”আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছো বসে আমার কবিতাখানি”।