বাইশে শ্রাবণ কিছু কথা
লোপামুদ্রা সিংহদেব
“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
কিন্তু “হায় তবু চলে যেতে দিতে হয় –
হায়, তবু চলে যেতে হয়। প্রিয়জনকে কাঁদিয়ে একদিন চলে যেতেই হয় – বাইশে শ্রাবণের বৃষ্টি ভেজা মধ্যাহ্নে সকলকে কাঁদিয়ে অস্তমিত হয়েছিলেন বাংলার তথা দেশের গর্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভালোবাসার পৃথিবী থেকে। তাই বাইশে শ্রাবণ আমাদের জীবনের এক বিষাদঘন দিন।
“জীবনেরে কে রাখিতে পারে।
আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে”।
এই ধ্রুব সত্যে বিশ্বাসী ছিলেন কবি। মৃত্যু তাঁর কাছে জীবনের অপর নাম। মহাকালের মহামিলন দূত―পরিণতির এক অসীম আনন্দলোক―এক পরম মুক্তি।
মৃত্যু তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে জীবনরথের সারথি হয়ে। তাঁকে কবি বরণ করতে চান সগৌরবে। তাই মরণের কাছে তাঁর প্রশ্ন —
“অত চুপি চুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ।”
কবির ভাবনায় চুরি করে নয়, মরণ আসবে তার বিজয় শঙ্খ বাজিয়ে।
“মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান” একথাই ছিল কবিগুরুর অন্তরের কথা। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন বন্ধুরূপে, দয়িত রূপে, একান্ত আপনজন রূপে। তাই মৃত্যুভয়কে জয় করেছিলেন অনায়াসে। বলতে পেরেছিলেন―
” যেতে যদি হয় হবে–
যাব, যাব, যাব তবে ॥
লেগেছিল কত ভালো এই-যে আঁধার আলো–
খেলা করে সাদা কালো উদার নভে।
গেল দিন ধরা-মাঝে কত ভাবে, কত কাজে,
সুখে দুখে কভু লাজে, কভু গরবে ॥
প্রাণপণে কত দিন শুধেছি কঠিন ঋণ,
কখনো বা উদাসীন ভুলেছি সবে।
কভু ক’রে গেনু খেলা, স্রোতে ভাসাইনু ভেলা,
আনমনে কত বেলা কাটানু ভবে ॥
জীবন হয় নি ফাঁকি, ফলে ফুলে ছিল ঢাকি,
যদি কিছু রহে বাকি কে তাহা লবে!
দেওয়া-নেওয়া যাবে চুকে, বোঝা-খসে-যাওয়া বুকে
যাব চলে হাসিমুখে– যাব নীরবে ॥”
মৃত্যুকে কবি বড় গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।
অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হয়েছিল জোড়াসাঁকোর বাড়িতে, তাঁর প্রিয় শান্তিনিকেতন ছেড়ে। ডাক্তারদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে ১৩৪৮সনের বাইশে শ্রাবণ তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন অমৃতলোকের পথে।
কবির স্নেহধন্য বুদ্ধদেব বসুর লেখনীতে অমর হয়ে আছে সেই দিনের কথা―
“খবরের কাগজের বিশেষ সংস্করণে সেই অমোঘ সত্যটাকে শিরোধার্য করে বেরিয়ে এসেছিলো―রবি অস্তমিত।
মূহূর্তে সব কাজ থেমে গেল। কোলকাতা শহর উপচে পড়লো রাস্তায়।….
স্কুল কলেজ শূন্য, রাজকার্য অর্থহীন হয়ে গেল। উকিলের শামলা, পাদ্রীর আলখাল্লা, হলুদ আর গেরুয়া রঙের উত্তরীয়, গোল টুপি, বাঁকা টুপি, পাগড়ি, কেউ চলছে, কেউ ছুটছে, কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। থেকে থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বৃষ্টি তাঁর যাবার পথটা ধুয়ে ধূলিহীন করে দিচ্ছে”।
রাস্তায় ঢেউয়ের পর ঢেউ, মানুষের ঢেউ।
“মহামান্য নেতা থেকে সামান্য মানুষে মানুষে গড়া জনতা মিলে মিশে একাকার। তারই মধ্যে শয়ান বনস্পতিকে বহন করে নিয়ে গেল একদল লোক”।
ফুলে ফুলে সাজানো কবির দেহ যেন ভেসে ভেসে চললেন অগণিত মানুষের মাথার ওপর দিয়ে।
“আস্তে আস্তে বাষ্প জমছে চোখের পাতায়। অঝোর বর্ষণ তখন আর বাইরের প্রকৃতিতে নেই। সেই জলধারা ঠাঁই নিয়েছে ঘরে ঘরে। পরিবেশ যখন স্নাত, স্নিগ্ধ, তখন বহ্নিমান চিতা জ্বলছিল গঙ্গার কোলে”।
(বুদ্ধদেব বসু)।
কবির প্রয়ানের খবর পেয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
” দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপথের কোলে
শ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলে
উদাস গগন-তলে
বিশ্বের রবি, ভারতের কবি,
শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে।”
কবি জড়িয়ে আছেন আমাদের মননে, চিন্তনে, সুখে-দু:খে। আমাদের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ সব কিছুতেই তাঁর উপস্থিতি।
আজ এতোদিন পরেও তিনি চলে গেছেন একথা মানতে মন চায় না। তিনি আছেন আমাদের অন্তরের অন্ত:স্থলে। বরেণ্য সেই কবিকে নিবেদন করি আমার শ্রদ্ধার্ঘ —
সমুদ্রের অতল গভীরতায় আমি তোমাকে অনুভব করি।
আকাশের ব্যাপ্তি আমাকে তোমার কথা মনে করায়।
জীবনের অণুতে অণুতে মিশে আছো তুমি।
আমরা বিষ্ময়ে চেয়ে থাকি তোমার সীমাহীন বিরাটত্বের দিকে-
আর অসীম ভালোবাসায় তোমার দেওয়া মণিমুক্তো দু-হাত দিয়ে আগলে রাখি।
বিশ্বকবি তোমার বিচ্ছেদে শ্রাবণও অঝোর ঝরে।
হে রবি কবি তোমায় প্রণাম।