অপরাজিতা – দেবাশ্রিতা চৌধুরী

অপরাজিতা – দেবাশ্রিতা চৌধুরী

অপরাজিতা     (ছোটোগল্প)

দেবাশ্রিতা চৌধুরী

আজ “নীলসন্ধ্যায়” খুব আনন্দ। বাইরে থেকে বড় বড় লোকেরা সব আসবে, অনেক উপহার দেবে দু’হাত ভরে। সকাল থেকে সাজো সাজো রব। ড্রেনগুলো পরিস্কার করছে ছেলেমেয়েরা, তত্ত্বাবধানে মালতীদি। মালতীদি আজ খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। দু’একজনকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে চুল আঁচড়াস না কেন! ছেলেমেয়েগুলোর আজ খুব ভালো লাগছে। শুধু যাদের মাথায় হাত পড়েছে তারা সিঁটিয়ে আছে। এর আগের অভিজ্ঞতার রেশ এখনও আছে কিনা! তাই।
এখন এসে সবাই টিপেটুপে দেখবে, তারপর কয়েকজন চলে যাবে চিরদিনের মত আশ্রম থেকে। হয়তো খুব ভালো থাকবে নয়তো খুব খারাপ থাকবে। আর কেউ জানবে না।
এর মাঝেও একজনকে মালতী মাসি লুকিয়ে রাখবে, তাকে কখনোই কারো সামনে নেয় না।

তীব্র গরমের একটা ঝিমঝিমে নেশা আছে। চারদিক খা খা করছে। লোকজন সব খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোয় না।আলো, রোদ, খরখরে দিন। শীতের বিষন্নতা কেটে গেছে। গতকাল থেকে একটা চাতক পাখি সারাদিন-রাত-সকাল-দুপুর অক্লান্ত ভাবে ডেকে চলেছে। কাকে ডাকে ও ? সেই প্রেমিক পুরুষকে! যে চিরদিন অলক্ষ্যে, অধরা থেকে যায়? চাতকের ডাক আবার নেশা ধরায়, জানালার বাইরের টবে গন্ধরাজ ফুল ফুটেছে, ম ম করছে গন্ধে। সেও নেশা ধরায়। নেশা..নেশা..নেশা…জীবন একটা না একটা নেশা নিয়ে মুহূর্ত কাটাতে ভালোবাসে। যা নেই তা নিয়ে বিষন্ন হয়, আনন্দ হয়।
আশ্রমের দিনগুলো এভাবেই উপভোগ করে দিন কাটে। অথচ প্রেম শব্দটি আমার ঘৃণার উদ্রেক করে। ওয়াক..থুঃ
আমাকে তাই পাগল বলে সবাই। এভাবে ইচ্ছে করে পাগল হওয়ার ও নেশা আছে …তাই না?
আমি কে ? সে কথা আপাতত থাক। ধরে নাও ব্যর্থ এক মানব অথবা মানবী আমি। জন্মের পর মায়ের স্নেহ, বাবার আদর বঞ্চিত এক অবহেলিত মাংসপিণ্ড, যাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ডাস্টবিনে। কারো দয়ায় স্থান পেয়েছে অনাথ আশ্রমে। ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত একটা চাকরি ও পেয়ে গেলাম। মায়ের স্নেহে আমাকে মানুষ করেছেন যে মাসি তাকে নিয়ে সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখছি।
কিন্তু এক সন্ধ্যায় বসের জোর করে আমাকে ভোগ করার ফসল অক্ষত জমি আবাদ করে দিল। আশ্রম আর স্থান দিল না। শরীরে তার চিহ্ন প্রকট হয়ে উঠেছে। প্রাইভেট অফিস থেকেও বিদায় নিতে হলো। এখন পথই আমার ঘর। অপুষ্ট একটি সন্তান জন্মের পর মুক্তি দিয়ে গেল। এখন আমাকে পথে পথে যে ইচ্ছা যথেচ্ছ ভোগ করে। আমার কিছু হয় না। আমার দেহ নেই, দেহবোধ নেই, আমি নির্বিকার, একটা খাতায় সব লিখে রাখি। সব হিসাব হবে একদিন।
মনে করো আমি পাগল ? আসলে তা নয়।
আমি এ সমাজের কাছে একদিন খুনির তকমা পরে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখবো।
আমি অপরাজিতা। আশ্রমের মালতী মাসি সাধ করে নাম রেখেছিলেন। জয় করে যাব, হেরে যেতে এ পৃথিবীতে অন্যের অনিচ্ছায় আসিনি আমি।
আমি অপরাজিতা।
কিন্তু কী করে!! সেকথা বলে যেতে পারব তো!!
সব হিসাব হবে একদিন…