উপন্যাস ও গল্প লেখার গল্প
সুদীপ ঘোষাল
লিখে কী হয়, একথা অনেকেই জিজ্ঞেস করেন। আমি বলি, আনন্দ পাই, অফুরন্ত আনন্দ। আর এই আনন্দের খোঁজে আমরা সকলেই ব্যস্ত। কেউ আনন্দ পান সংগীতে কেউ পড়ে আবার কেউ বা অপরের সমালোচনা করে।লক্ষ্য কিন্তু একটাই। আনন্দের খোঁজে মনকে একটু হাল্কা করা। তারপর মিশে যাব গোধূলির আলোয় অজানা এক মহানন্দময় ঘুমের দেশে কিংবা অন্ধকার এক শূন্য মায়ায়। তার আগে যদি একটু আনন্দে থাকা যায় তাই এই লেখার ইচ্ছে হয় বারেবারে।
গল্পে সবকিছু বলে দিলে গল্প হয় না। পাঠককে চিন্তা করার অবকাশ দিতে হয়।
আমাকে একজন বয়স্ক সম্পাদক বলেছিলেন, উপন্যাস লিখতে গেলে, কয়েকটি রসের উপস্থিতির কথা জানতে হবে। তিনি বললেন, প্রেমরস, খলনায়কের উপস্থিতি, বাৎসল্য রস, খুনসুটি প্রেম, চরিত্রের বিশ্লেষণ ও সাহিত্যরস।
আমি বললাম,আমি যদি নতুন কোনো নিয়মে লিখি, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে।
তিনি বললেন, হবে, তবে পরিষ্কার রাস্তায় দেখানো রাস্তায় হাঁটলে গন্তব্যে পৌঁছোবে তাড়াতাড়ি। আর আঁচট পথে হাঁটলে পা কাঁটায় আক্রান্ত হবে। পথ নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে।
তিনি আরও বললেন মোদ্দাকথা হচ্ছে পড়াশোনার সঙ্গে বিশ্লেষণী ক্ষমতা আর প্রতিভা থাকতে হবে। আর শুধু পড়লে হবে না। প্রতিভা না থাকলে সব পড়াশোনা করা ছাত্ররা ঔপন্যাসিক হয়ে বসবে। প্রতিভা তো রাস্তাঘাটে, দোকানে কেনা যায় না, বাবা।
আমি এবার আসি, গদ্যে লেখা দীর্ঘাবয়ব বর্ণনাত্মক কথাসাহিত্যের কথায়। আমার মনে হয়েছে, কবিতা ও ছোটগল্পের ন্যায় উপন্যাস সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা। আধুনিক সাহিত্যে এটি তুলনামূলকভাবে নতুন আঙ্গিক। যিনি উপন্যাস রচনা করেন তিনি ঔপন্যাসিক। উপন্যাস লেখার নির্দিষ্ট নিয়ম বা কাঠামো নেই। তবে সচরাচর এগুলো ছোটগল্পের তুলনায় বৃহদাকার হয়ে থাকে। অধিকন্তু উপন্যাসের আখ্যানভাগ ও চরিত্রের, বিস্তার লক্ষিত হয়। হ্রস্ব দৈর্ঘ্যের উপন্যাসকে অনু-উপন্যাস বলা হয়ে থাকে। উপন্যাসে পরিবেশ, বর্ণনা, রূপরেখা, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদি যখন মানুষের জীবনের কাহিনিকে সুন্দর ও স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলে তার মধ্যে জীবনের কোনো অর্থ বা ভাষ্য প্রকাশ করা হয়। জীবনের এই রূপায়ণ উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠকের কাছে বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। বস্তুত, উপন্যাসের রূপ অত্যন্ত নমনীয় ও মিশ্র। তাই এর নানা রূপভেদ চোখে পড়ে। উপন্যাসের প্রধান উপাদান পাঁচটি। ঘটনা, চরিত্র,সংলাপ, ভাষা ঔপন্যাসিকের জীবনদর্শন। জীবনদর্শন, এটা একটা প্রয়োজনীয় বিষয় উপন্যাসে।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে উপন্যাস সর্বাধুনিক এবং সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শাখা। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে প্রথম আধুনিক উপন্যাস রচিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিভাগে বাংলায় প্রথম উপন্যাসের প্রবর্তন হয়। ইংরেজি ভাষায় ড্যানিয়েল ডিফো বাংলা ভাষায় উপন্যাস ধারার প্রথম সার্থক রূপকার। তারপর থেকেই বিভিন্ন দেশে এই ধারার বিচিত্র ও বহুমুখী বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।
উপন্যাস আধুনিক কালের একটি বিশিষ্ট শিল্পরূপ। উপন্যাসের আক্ষরিক অর্থ হলো উপযুক্ত রূপে কাহিনির উপস্থাপন। অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে কাহিনি রূপে, একটি উপাদানকে বিবৃত করার বিশেষ কৌশল, পদ্ধতি বা রীতি। ‘উপন্যাস’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ novel-এর আভিধানিক অর্থ হলো a fictitious prose narrative or tale presenting picture of real life of the men and women portrayed. অর্থাৎ উপন্যাস হচ্ছে গদ্যে লিখিত এমন এক বিবরণ বা কাহিনি যার ভেতর দিয়ে মানব-মানবীর জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
ব্যুৎপত্তিগত এবং আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায়, মানব-মানবীর জীবন যাপনের বাস্তবতা অবলম্বনে যে কল্পিত উপাখ্যান পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য বিশেষ বিন্যাসসহ গদ্যে লিপিবদ্ধ হয় তাই উপন্যাস। যেহেতু উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য মানুষের জীবন, তাই উপন্যাসের কাহিনি হয় বিশ্লেষণাত্মক, দীর্ঘ ও সমগ্রতা সম্পূর্ণ।