পুনুবুড়ির কিস্যা (ছোটোগল্প)
বিজয়া দেব
নাম তাঁর প্রণতি। তরুণী বন্ধু দোলার কাছে তিনি পুনুবুড়ি। বয়েস উনআশি। ঘরে ঘরে যেসব অত্যাধুনিক গল্প তৈরি হচ্ছে নিয়ত, পুনুবুড়ির সেই একই গল্প, ছেলে বিদেশে আর তিনি একা বাড়ি আগলে থাকেন। তাঁকে অনেক বলেও বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে পারেনি বিদেশের ছেলে। তিনি তাঁর এই পুরোনো বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। ঘরের ভেতর এক বুদ্ধ মূর্তি টাঙানো, একে মুছে সাফ করেন রোজ রোজ। কী এক অজানা আকর্ষণ এই মূর্তিতে তিনি জানেন না। দ্বিতীয় আকর্ষণ তার পাগল তরুণী বন্ধুটি, নাম তার দোলা। বিকেলের দিকে আসে, তিনি শুয়ে থাকলে শিয়রে দাঁড়িয়ে বলে — হেই পুনুবুড়ি, এলাম।
তিনি একগাল হেসে বিছানায় উঠে বসেন। দোলার জন্যে কিচেনে মুড়ির মোয়া নারকোল নাড়ু ইত্যাদি তৈরি হয়। এতেও তাঁর ভারি আনন্দ। তারপর শুরু হয় গল্প ও গান। এখনও পুনুবুড়ি গাইতে পারেন। আর দোলাও সাথে সাথে গলা মেলায়।
এই দোলা ও পুনুবুড়ির গল্প কিন্তু আর গল্পে থাকে না। সব বদলে যায়। পুনুবুড়ির বুদ্ধ তেমনি নির্বিকার হয়ে থাকেন, তাঁর গায়ে ধুলো জমে। দরজা জানালা খোলা হয় না কতদিন। কিচেনটা মুড়ির মোয়ার গন্ধে উতলা হয় না আর। মাকড়সা তার ঊর্ণাজাল ক্রমশই বিস্তার করে চলে। একবছর পর ছেলে রৌনক তার পরিবার নিয়ে আসে।
পুনুবুড়ির বাৎসরিক শ্রাদ্ধশান্তি হবে ধুমধাম করে। মায়ের মৃত্যুর পর পর ছেলে আসতে পারেনি কাজের চাপে। পুনুবুড়ির পুত্র রৌনক ও পুত্রবধূ সায়নী বিদেশ থেকে এসেছে পুত্রকন্যা নিয়ে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবে ঘর গমগম করে। মাকড়সার ঊর্ণাজাল ছিন্নভিন্ন হয়। বুদ্ধদেব আবার ঝকমকে হন। ঋতিকা নামে এক তরুণী এসে সবার সাথে কথা বলে, পরিচয় দেয়। বলে — সে ছিল দোলার বন্ধু। সে এখন পুনুবুড়িকে নিয়ে গবেষণা করতে চায়।
পুনুবুড়িকে নিয়ে গবেষণা? আশ্চর্যের ব্যাপার নয়? এক বাঙালি বৃদ্ধা, একসময় ছিলেন গৃহবধূ, পুত্র স্বামীর সেবা করে ঘরটাকে গুছিয়ে গাছিয়ে সংসার করে বৃদ্ধ হয়েছেন, স্বামীর মৃত্যুর পর একা থেকেছেন। তাকে নিয়ে গবেষণা করতে চায় এই ঝকঝকে তরুণীটি।
রৌনক ও সায়নী গম্ভীর হয়ে যায়। ঋতিকাকে বারবার এ বাড়িতে আসতে দেখে তাদের দেহের ভাষা আর আগের মত থাকে না। ঋতিকা বোঝে। বলে — দোলা ছিল পুনুবুড়ির শেষ মানসিক আশ্রয়। আর এই বুদ্ধমূর্তি। সুন্দর সব চলছিল। পুনুবুড়ির বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ধর্ষকরা দোলাকে টেনে নিয়ে যায়। দোলার মৃতদেহ উদ্ধার হয় কংসাবতী নদীর তীরে এক ঝোপের আড়ালে। এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে পুনুবুড়ি ঘুমের ওষুধের ভেতর তলিয়ে যান।
রৌনক বিরক্তমুখে বলে — মা ভালই কাটিয়েছে সারাজীবন। বৃদ্ধাশ্রমে গেলে মা আজও বেঁচে থাকত। একা থাকার কোনও দরকার ছিল না। সেদিন ঋতিকা চুপিসারে ড্রয়ার খুলে দেখে একটি ডাইরি ও কলম। উপরের পৃষ্ঠায় লেখা — পুনুবুড়ি, এটাতে তোমার নারী জীবনের কথা লিখে রাখো। — দোলা।
ঋতিকা ডাইরিটা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা হাত ডাইরির দিকে এগিয়ে এল। চমকে উঠে ঋতিকা দেখে একটা শাদা হাত। ডাইরিটা ছুঁল। তারপর আর কিছু নেই। কিছু কি ছিল? না কি স্রেফ মনের ভুল? নিশ্চয়ই মনের ভুল।
রৌনক এসে দেখল তার হাতে ডাইরি। একটু হেসে বলল — মা-র ডাইরি? খুব ভালো। শ্রাদ্ধের দিন শ্রদ্ধাঞ্জলিতে রাখা যাবে। আমরা অনেক কিছুই রাখছি। মা-র স্মৃতিচিহ্ন।
ঋতিকা বলে — এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি।
রৌনক তেমনি হেসে বলে — কী বলছ! মায়ের ডাইরি তো শ্রদ্ধাঞ্জলিতে নিবেদিত হবে। ওটা আমাদের কাছেই থাকবে। আচ্ছা, তুমি কি আর গবেষণার বিষয় খুঁজে পাচ্ছ না ঋতিকা? একজন সফল মহিলার জীবন, একজন মায়ের জীবন যিনি তাঁর সন্তানকে সফলভাবে সার্থকভাবে মানুষ করেছেন। সন্তানের সাফল্যেই মা-র উজ্জীবন। আর কি চাই?
ঋতিকা এসবের উত্তর না দিয়ে শক্ত করে ডাইরিটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে প্রচণ্ড বাধার সামনে পড়ে। সায়নী দাঁড়িয়ে দরজায়। চোখ লাল করে বলে — ও ডাইরি তোমাকে দেওয়া যাবে না, তোমার তো সাহস কম নয়। বাইরে থেকে এসে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে ড্রয়ার খুলছ, ডাইরি তুলে নিয়ে যাচ্ছ। এসবের অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?
ঋতিকা মৃদু হেসে বলে — এই ডাইরিটা দোলার দেওয়া। দোলাকে সম্মান জানাতে আমাকে এটা নিতেই হবে।
— কে দোলা? আমরা তো তাকে চিনি না।
— পুনুবুড়ি চিনত। পুনুবুড়ির বন্ধু ছিল শেষবেলায়।
— এ্যাই পুনুবুড়ি পুনুবুড়ি করো না তো! সুন্দর করে কথা বলতেও তো শেখোনি। উনি প্রণতি দেবী। ডাইরিটা ভালোয় ভালোয় দাও, নাহলে ওটা তোমার হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হবে।
রৌনক সায়ন্তীকে চোখ দিয়ে কী একটা ইশারা করল। সায়ন্তী হাত চেপে ধরল ঋতিকার। এই সময়ে ঘরের ভেতর প্রচণ্ড এক শব্দ। মনে হল কিছু একটা ভেঙে পড়েছে। সায়ন্তীর মেয়ে চিৎকার করে উঠল। সায়ন্তী ঋতিকার হাত ছেড়ে ছুটে ভেতরে গেল। ঋতিকা উঁকি মেরে দেখে বুদ্ধের মূর্তি ভেঙে চুরমার। আকাশ কালো করে ঝড় উঠেছে। সায়ন্তী ও রৌনক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। স্থাণু। ঋতিকা ডাইরি হাতে চুপিসারে বেরিয়ে এল।
বাড়ি ফিরে ডাইরিটা খুলল ঋতিকা।
পুনুবুড়ির ভারি সুন্দর হস্তাক্ষর — “এত ভাল কখনও থাকিনি। দোলা আমার বন্ধু, মনের সাথী, এই পড়ন্ত বেলায় সূর্যের লালিমা। ভোরের দিকের নাকি শেষ বিকেলের লালিমা তা বলতে পারব না। রৌনক-সায়ন্তী এক বৃদ্ধাশ্রমের ব্যবস্থাই করে ফেলল। আমাকে চাপ দিতে লাগল ওখানে চলে যাও। একা পড়ে থাকবে মরে।
মৃত্যু আসলে ব্যক্তিগত অপছন্দের সাথে জড়িয়ে থাকে। সে মনে হয় অপেক্ষায় থাকে বিমর্ষ মানুষদের তুলে আনার জন্যে। এই প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধার ভেতর এক নতুন প্রাণ জেগে উঠছে, কেউ বললে বিশ্বাস করবে আমার কথা? কী অদ্ভুত অনুভূতি, একপাশে নির্বিকার বুদ্ধ, আরেকপাশে উচ্ছল দোলা।”
পুনুবুড়ি লিখছেন অতীতের কথা আবার পাশাপাশি লিখছেন উৎফুল্ল নব্য জীবনের কথা। লিখছেন, “বার্ধক্য তার সামাজিক অবস্থান থেকে নেতিবাচক ভাবনার জন্ম দেয়, নিজেকে ভারগ্রস্ত, পারিবারিক বোঝা মনে করার জন্যে এই মানসিকতাই দায়ি।”
কোথাও লিখছেন — “দোলা কোথা থেকে এল? এমন উৎফুল্ল অনুভব আমার সদ্য যৌবনেও হয়নি। কারণ বিয়ের পর সংসারের সবাই এর মন যোগাতে যোগাতে তারপর স্বামী সন্তানের পরিচর্যায় কেটে গেল অনেকটা সময়। আমার ছায়াকে দেখতাম নিরন্তর, নিজেকে সেভাবে আয়নাতে দেখতাম না। সাজগোজ করতাম বাইরে বেরোবার সময় আয়নায় দাঁড়িয়ে, পেছনের ছায়াকে দেখতাম না।”
কত গান লেখা হয়েছে। নিচে কোথাও লেখা গীতিকার — দোলা। কোথাও লেখা গীতিকার — পুনুবুড়ি। কোথাও আলপনা আঁকা, তিনটে প্রতিকৃতি — একটি নির্বিকার ধ্যানী বুদ্ধ, একটি পুনুবুড়ি, একটি দোলা। কিন্তু কোথাও রৌনক কিংবা সায়ন্তীর ওপর কোনও রাগ কিংবা ক্ষোভের কথা লেখা নেই। তাহলে ওরা এই ডাইরি নিয়ে এমন কাড়াকাড়ি করছিল কেন? বুদ্ধ কি তার হাতে ডাইরিটি তুলে দিলেন?
শেষ পাতায় লেখা — দোলাকে চলে যেতে হল। আমার কাছ থেকে বেরিয়ে সে আর বাড়ি ফিরতে পারল না। আমার দেহ জুড়ে নিদারুণ ক্লান্তি। মনে হচ্ছে এইবার আমার বয়েসের ভারে নুয়ে পড়ার সময় এসেছে।
এই গোলার্দ্ধে কেন এত বিপরীত হাওয়ার ঝাপট? আমি বুদ্ধের কাছে গেলাম। বুদ্ধ সত্যের প্রতীক। যেন সেই সংকেত পেলাম। কি সেই সংকেত? তা আর লিখছি না। কিছু না বলা কথা থাক। দোলা বলেছিল — সব লিখে রাখো, আমার এক বন্ধু তোমাকে আশ্রয় করে তাঁর গবেষণাপত্র তৈরি করবে। তাহলে সেই তরুণীটিই নাহয় সেই সংকেতের রহস্যের উদঘাটন করুক। আপাতত মৃত্যুর কোল চাইছি।”
ঋতিকা দেখে এক মৃদু আলোর রশ্মি ভেঙে খানখান হয়ে পড়ছে। জেগে উঠছে বুদ্ধের নির্বিকল্প রূপ। গোটা একটা জীবন তৈরি করে মানুষ। তার অধিকাংশই গোলকধাঁধার পথ নির্মাণের জন্যে অযথা কালক্ষেপ। কি চায় মানুষ?