ফানুস (ছোটোগল্প)
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য
সময় এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে মনের উৎফুল্লতা মলিন হয়ে আসে অবনীর। উঁকি দেয় অনিশ্চয়তার মেঘ। আজ কি আর আসবে তুতু? কে জানে। ভাবনায় অধীর হয় অবনী।
– বারান্দায় উঠে এসো এইবার, হিম পড়ছে। ঠাণ্ডা লাগবে। বলে সুধা।
স্ত্রীর কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অবনী। ঠিকই বলেছে সুধা। হেমন্তের মাঝামাঝি। সন্ধ্যার হাত ধরে শিশির নামে এই সময়। তাছাড়া ঋতু পরিবর্তনের দিনে ঠাণ্ডা কাবু করে সহজেই। বয়স তো থেমে নেই, এগিয়ে চলেছে সামনে। দিনে দিনে হাজার রোগ ব্যাধি হয়েছে সঙ্গী। তার উপর ঘাড়ের ব্যথাও বেগ দিচ্ছে খুব। সারা জীবন ছাত্র পড়ানোর হিসাব এইবার বুঝে নিতে চাইছে শরীর অবনীর কাছ থেকে।
সেই বিকাল থেকে অবনী চেয়ে থেকেছে নাতি আসবার পথ চেয়ে। তমাল আর বৌমাও আসবে। ওবেলায় ফোন করেছিল তমাল। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাবো বাবা, চিন্তা করো না। মনক্ষুন্ন হয়েছিলো অবনী ছেলের কথা শুনে। গতকাল রাতেও বলেছিলো আজ সকালে আসবে। আর আজ বলে…
সুধা বলেছিলো, কার্তিক মাসের বেলা। বিকালের গায়ে গায়ে সন্ধ্যা উঁকি দেয়। এই তো কয়েক ঘন্টা, সবুর করো না বাপু। সে কথা ঠিকই, হেমন্তের অপরাহ্ন সংক্ষিপ্ত বড়ো। তবুও সুধা বললেই কি তর সয় অবনীর! দুপুর পার হতে না হতেই সদর দরজায় দাঁড়িয়ে, চেয়ে থেকেছে রাস্তার দিকে। তুতু আসবে। নাতির কথা ভেবে মনের অস্থিরতা সময়ের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে সারাদিন। আজ মাস ছয়েক পর আসবে তুতু। ছয় মাস নয়তো, যেনো ছয় বছর! এতো দিন একমাত্র নাতিকে ছেড়ে থাকবার যন্ত্রণার উপসম পেতে অধীর হয়েছে মন। সেই কবে এসেছিলো তুতু এখানে। তাও মাত্র একদিনের জন্য। এবারে এসে নাকি থাকবে তিন চারটে দিন ।
এখন তো তুতুর নতুন স্কুল। শুরু থেকে পড়াশোনা না করলে গুছিয়ে নিতে পারবে না নিজেকে। পিছিয়ে পড়বে সবার চেয়ে। তাই সময় নষ্ট করলে চলবে না কেনো ভাবেই। গতবার এসে বলেছিলো অবনীর বৌমা। সত্যিই হয়তো তাই। ঠিকই বলছে বৌমা। ছোটদের পড়াশোনার চাপ তো এখন পাহাড় প্রমাণ।
সুধা বলেছিলো রাখো তো ওই সব কথা। এখানে না আসবার অজুহাত। ছেলে যেনো আমরা মানুষ করিনি। এখানে বাচ্ছারা স্কুলে পড়ছে না! তমাল উচ্চ মাধ্যমিকে জেলায় সেকেন্ড হয়েছিলো এই ব্যান্ডেলের স্কুলে পড়েই। আর এতো বছর মাস্টারি করে তোমার বিচার বুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে? যা বোঝাবে তাই বুঝতে হবে! কানে নিও না ওসব কথা।
কারোর কথাই কানে নেয়নি অবনী। সবাই ঠিক বলে। সংসার বড়ো বিচিত্র জায়গা। এখানে কেউ নাকি ভুল বলে না। আশ্চর্য! সবাই নির্ভুল বলেই হয়তো এতো ভুলের মাসুল গুনতে হয় সকলকে।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো, এখনো আসবার নাম নেই তমালদের। ফোনে খবরও দেয়নি কিছু। তাই চিন্তা নিয়ে বসে ছিলো বারান্দার সামনে। দু দুবার ফোন করেছে তমালের ফোনে। বৌমার ফোনেও চেষ্টা করেছে অবনী। সাড়া পায়নি ওপ্রান্ত থেকে। তাই মনের অস্থিরতা বেড়েছে আরো।
– অতো ব্যস্ত হচ্ছো কেনো? আসবে বলেছে যখন ঠিক আসবে। ওদেরও তো কাজ কর্ম থাকে। তাছাড়া সবে এই কয় মাস হলো ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। সেখানেও আজ পুজো। পাঁচ জনের কাজে পাশ কাটিয়ে চলে আসা যায় না মনে করলেই। সুযোগ সুবিধা করে আসবে ঠিকই। আর না এলে তুমি কি পারবে জোর করে আনতে? বাদ দাও। যার যা মন চাইবে করুক। ভাবতে ভালো লাগে না আর। তুমি বারান্দায় এসে বসো। বলে সুধা।
সে তো ঠিকই। না আসতে চাইলে জোর করে কি নিয়ে আসা যায় কাউকে। কতো দিন ধরেই তো অবনী বলছে তমালকে, তুতু কে নিয়ে আয় না একদিন। কই, আসেনি তো। কখনো আঁকা, কোনোদিন আবৃত্তি কোনোদিন বা ক্যারাটে ক্লাসের কথা শুনিয়েছে তমাল। অতো টুকু বাচ্ছা, অবসর কখন তাহলে! ভেবে শিউরে উঠেছে অবনী। বাচ্ছাদের পড়াশোনা আর সন্তানকে ঘিরে বাবা মায়ের স্বপ্ন এখন যেনো পাল্লা দিয়ে ছোটে!
আট নয় মাস হলো হিন্দ মোটরে ফ্ল্যাট কিনেছে তমাল। রোজ রোজ অফিস যাতায়াতের ধকল আর নিতে পারছে না শরীর। অসুবিধা হচ্ছিলো তমালের স্ত্রীরও। সেই ছুটতে ছুটতে গিয়ে ট্রেন ধরা। সকাল থেকেই তাড়াহুড়ো। বাচ্ছার দিকে নজর দেবার সময় নেই। তাছাড়া কলকাতার দিকে পড়াশোনার সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। এদিকে তেমন স্কুল আর কোথায়! এইসব ভেবেই নাকি তমালের হিন্দ মোটরে থাকা।
সুধা বলে অন্য কথা। তাই যদি হতো এতো দিন পরে বুঝলো সেকথা! চাকরি কি আগে করেনি ওরা এখানে থেকে। এই আট বছরে ব্যান্ডেল থেকে কি হিন্দ মোটরের দূরত্ব বেড়ে গেছে? তা তো নয়। অসুবিধা ঠিক এখনই শুরু হলো! আর বাচ্ছা কি অপরিচিত কারোর কাছে ছিলো সারাদিন! আসলে…
আসলে যে কি সে হিসাব মেলাতে পারেনি অবনী। সংসারে সবার হিসাবের নিক্তি এক তো নয়। সবার তৌল এক নিয়মে চলে না। বৌমার হিসাবের কৌশল সুধার চেয়ে পৃথক। সুধার যোগ বিয়োগের নিয়ম অন্য রকম। তমালের হিসাব কি সহজ বোধ্য? কে জানে, কোন সূত্র মেনে হিসাব করে তমাল। হয়তো তমালও ঠিক ওর নিজের বিচারে। শুধু এইটুকু বুঝেছে অবনী, সবাই সবার অঙ্কে ঠিক। আর সবার সঠিক ভাবনা তার সুখের পৃথিবীটাকে দিয়েছে দু টুকরো করে। মাঝে মাঝে মনে হয় অবনীর, জগতের সমুদয় আনন্দ নিয়ে গেছে কেউ ছিনিয়ে। চেনা মানুষগুলো মধ্যে মধ্যে হয়েছে অচেনা। পৃথিবী বুঝি ঊষর মরুময়। এই আট-নয় মাসে মনের শান্তি তলানি ছুঁয়েছে। এক পৃথিবীতে বসে অন্য পৃথিবীর চিন্তায় বুঁদ হয়ে থেকেছে অবনী। কতদিন রাতে বিছানায় শুয়ে এপাশওপাশ করেছে। না ঘুমানো রাত হয়েছে ভোর। কোথা থেকে কি হলো বুঝতে পারে না। শেষে হাল ছেড়েছে। সত্তর বছর বয়সে এসে নতুন করে আর সংসারের হিসাব শিখতে সায় দেয় না মন। তবে এইটুকু বোঝে সহজেই, তুতুকে আর কাছে পাবে না কোনো দিন। এরপর কখনো কখনো হয়তো তুতু আসবে এখানে। দেখে যাবে অবনীকে। দিনে দিনে ভাটা পড়বে সে আসা যাওয়ায়। তারপর তারপর অবনীও অভ্যস্ত হয়ে উঠবে তার নিজের পৃথিবীতে। নাতির জন্য মনের মধ্যে তোলপাড় করা ব্যাকুলতা স্তিমিত হবে একদিন। সুধারও সমস্ত অভিমান যাবে থিতিয়ে। জীবনে চাওয়া পাওয়ার হিসাব নিতে চাইবে না মন।
বারান্দায় উঠে এসে বসে অবনী। গলা থেকে কলারটা খোলে। ধীরে ধীরে শরীরটা এলিয়ে দেয় সোফায়। ক্ষণিক আরাম আচ্ছন্ন করে রাখে। বুজে আসে দু চোখের পাতা। অন্য দিন দুপুরে বিশ্রাম নেয় কিছুক্ষণ। আজ আর ইচ্ছে হয়নি। নাতি আসবে। আনন্দে শরীর যেনো নিজের থেকেই বিশ্রামে অনিচ্ছার কথা শুনিয়েছিলো। সময়ের সঙ্গে এখন সে আনন্দে ঘাটতি এসেছে বুঝি, তাই এই অসময়ে…
– কি হোলো? এখন হঠাৎ কলার খুললে কেনো? শরীর খারাপ লাগছে? জিজ্ঞাসা করে সুধা।
– না এমনিই, বলে অবনী।
গলায় কলার অবনীর চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী। শোয়া আর স্নান ছাড়া সব সময় গলায় কলার পড়ে থাকতে হয়। ডাক্তার বাবুর নির্দেশ তেমনই। নিয়মের নড়চড় হতে দেয় না সুধা। স্বাভাবিক। অবনীর কিছু হলে সুধাকেই সামলাতে হয় সমস্ত ঝক্কি। এইতো মাস দুয়েক আগের কথা। পোস্ট অফিস যেতে গিয়ে পথেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো অবনী। দুশ্চিন্তায় স্নান খাওয়া ভুলে ছিলো সুধা। না জানি কোন বিপদ এলো। পরে সুধাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে, স্পণ্ডালাইটিস। তারপর থেকেই অবনীর টিউশন পড়ানোর পাঠ তুলে দিয়েছে সুধা। আর এতে যেনো সময় থমকে দাঁড়িয়েছে অবনীর। তবু সকাল বিকেল কয়েক ঘন্টা সময় কাটতো ইংরেজি গ্রামার, সিন আনসিন প্যাসেজ পড়িয়ে। কিছুটা সময় তুতুর ছায়া ঝাপসা হতো মনে। এখন সকাল, দুপুর, বিকাল অবনীর কর্মহীন মন নাতির জন্যই ব্যাকুল হয়ে থাকে। জীবন বুঝি নিস্তরঙ্গ জলাশয়। সহস্র শৈবাল বুকে নিয়ে চেয়ে থাকে আকাশের পানে। গুমরে মরে মনে মনে। অস্বাভাবিক তো নয়, বার্ধক্যে মন নাতিনাতনিদের সঙ্গে থেকেই তৃপ্তি খুঁজে পায়। মনের স্থাণু দুর্ভাবনাগুলি হালকা হয়ে আসে শিশু মনের পরশে। আসলে বার্ধক্যে শৈশব আবার হাজির হয় মনে। সেই পরিণত শৈশব শিশুর খেয়ালি শৈশবের সঙ্গে হাঁটতে চায় টলমল পায়ে। সে প্রাপ্তির সুখ অনাবিল। ভারী হয় অবনীর বুক হারিয়ে যাওয়া সুখের কথা ভেবে।
– এই নাও, তোমার চা। কলারটা পড়ে নিও আবার। আমি একবার ওই দিকে দেখে আসি।
অবনীকে চা-বিস্কুট দিয়ে সুধা যায় বোসবাড়ি। আজ কালীপুজো। বছরের এই দিনটায় নির্জলা উপবাসী থাকে সুধা। মা কালীর চরণে অঞ্জলি দিয়ে ভঙ্গ করে তার উপবাস। পরিবারের মঙ্গল কামনায় তার এই ব্রতে ছেদ পড়েনি কোনোদিন। তমালের জন্মের পর থেকে এই কাজে একনিষ্ঠ সুধা। ভেবে অবাক হয় অবনী। তমালকে নিয়ে বৌমাকে নিয়ে সুধার অভিযোগ কম নয় কিছু । কথায় কথায় ঠিকরে বাইরে আসে মনের ক্ষোভ। তবুও তাদের মঙ্গল কামনায় উপবাসী থাকে সুধা নানান পুজোয়, বার ব্রতেও। সত্যি, সংসার বিচিত্র বড়ো। জটিল, ভীষণ জটিল হিসাবের নিয়ম। ভালো লাগা, মন্দ লাগার প্রকাশও সরল নয় মোটেই।
সুধা চলে যায়। কিছুটা আনমনা হয়েই চায়ে চুমুক দেয় অবনী। অন্য দিন সন্ধ্যার এই চা-পর্ব দুজনের নানা কথায় এগিয়ে চলে বেশ কিছুটা সময়। অবশ্যই তুতুর কথা আসে। রোজই এই সময় নাতিকে একবার ফোন করে অবনী। তমালের অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরী হয়। অবশ্য বৌমা ফিরে যায় স্কুল থেকে। তাই বৌমার ফোনেই ফোন করে অবনী। কথা বলে নাতির সঙ্গে। পাঁচ মিনিটের কথা শেষে পঁচিশ মিনিট ধরে সে কথাগুলি চর্বণ করে সুধা আর অবনী। গতকালও এই সময়েই ফোন করেছিলো। নয়তো খানিক পরেই তুতুর টিচার আসে বাড়িতে। তখন আবার ফোনে করলে পড়ার ক্ষতি হয়। বাচ্ছা ছেলে। মন চলে যায় অন্য দিকে। সে কথা ভেবেই সন্ধ্যার আগে আগেই ফোন করে অবনী, রোজ। গতকাল তুতু বলেছিলো দাদু ফানুস কিনে রাখবে। পাঁচটা। হেসে বাঁচেনা অবনী! বলে কিনা পাঁচটা ফানুস লাগবে। তারপর বলে, সুধাকে বলবে যেনো রোদে রেখে দেয় ফানুস। নয়তো উড়বে না। আমি সকাল সকাল পৌঁছে যাবো। বাব্বা! বাচ্ছা ছেলের কথা একেবারে গোছানো। ঠিক জানে কাকে কোন কাজটার কথা বলতে হয়। সেই নিয়েই হাসাহাসি চলে কিছুক্ষণ। রোজই তুতুর কোনো না কোনো কথা নিয়ে অবনী আর সুধার আনন্দ বাঁধ ভাঙা হয়। বেশ কিছুক্ষণ চলে সেই আনন্দ ধারা। তারপর কথায় কথায় কখন যে সিঁদ কাটে অন্য প্রসঙ্গ, বুঝে পায় না অবনী। সুধাও। উচ্ছ্বল মুহূর্তগুলি অজানা কার নির্দেশে হয়ে ওঠে নিশ্চুপ। ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসে অবনী আর সুধার কথা। বিবর্ণ হয়ে আসে মনের মুহূর্ত সুখ। সময়ের পল অনুপল এগিয়ে যায় বাকহীন হয়ে। দুজনের মনের মধ্যে বলতে না চাওয়া কথাগুলি ঠেলাঠেলি করে একে অপরকে। এক বোধ্য আড়ষ্টতা সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মনের চৌকাঠে। টের পায় দুজনেই। ভারী হয়ে ওঠে ঘরের বাতাস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে যায় সুধা। রান্না ঘরে কাজের অছিলায় আড়ালে চোখের জল ফেলে। আর অবশ মনে বসে থাকে অবনী। একলা। এক খণ্ড মুহূর্ত ঘুর ঘুর করে অবনীর চারপাশে। মনে করিয়ে দিয়ে যায় আলো ঝলমলে সে রাতের এক ছোট দৃশ্য। কাঁদছে তুতু। ফানুস লাগবে তার। ছোটো ছেলের বায়না। সুধা ব্যস্ত নাতিকে ভোলাতে। ওদিকে তমাল আর বৌমা…
হাজার বাতির আলো মুছে আঁধার ঘনিয়ে এসেছিলো বাড়িতে সেই রাতে। তারপর কতো কথা। কতো কথা। তমাল, সুধা, বৌমা। ক্ষোভ, বিক্ষোভ, রাগ, অভিযোগ, অভিমান সহস্র শব্দে আছড়ে পড়ে বারান্দায়। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো অবনী। অপ্রত্যাশিত বিহ্বলতা জাপটে ধরে ছিলো। ওদের কথার তোড়ে ভেসে গিয়েছিল তুতুর কান্না। হতচকিত সে। এমন দৃশ্য অপরিচিত তার কাছে। শেষে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে আবার। তুতুকে কোলে নিতে যায় সুধা। ছিনিয়ে নেয় বৌমা। শুরু হয় আর একপ্রস্থ কথা চালাচালি। অবনীর বুক শীতল হয়ে এসেছিলো সে রাতে। তার পর পরই তো বদলে যেতে লাগলো পৃথিবী। সবুজের সতেজ প্রলেপ ফিকে হতে হতে আজ ধূসর, রুক্ষ সবই। তারপর…
এক বছর আগের কথা। তারপর থেকে এ বাড়ির সবার পা ফেলা হিসাব করে। সুধা, বৌমা, তমাল সবাই সাবধানী হয় পা ফেলেছে। অবনীও। রোজ, রোজ সে রাতের কথা ভাবে অবনী। সত্যি, সংসার বড়ো বিচিত্র। দূর্বোধ্য তার ভাব গতিক। কোন ছোট্ট মুহূর্ত কখন কিভাবে এসে স্থায়ী দাগ রেখে যায় কে বলতে পারে! একটা শ্বাস দীর্ঘ হয়ে বাইরে আসে অবনীর। মনের অতলে জ্বলতে থাকা যন্ত্রণার আগুনে বাতাস বুঝি।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে টি টেবিলে কাপ নামিয়ে রাখে অবনী। চোখ যায় দেওয়াল ঘড়ির দিকে। ছয়টা দশ বাজে। তমালরা পথে আছে হয়তো। মনে মনে একটা রাগ ঘনিয়ে আসে। ফোনও তো করতে পারে তমাল। কতো দূরে আছে বললেই মিটে যায়। এতক্ষণে একবারও কি মনে পড়েনি যে চিন্তা করবে অবনী। মনের অধীরতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝিমিয়ে আসে কিছুটা। বিষণ্ণতা ছায়া ফেলে মনে। দানা বাঁধে সংশয়, হয়তো নাও আসতে পারে ওরা।
কাল বাড়ি যাবো দাদু, বলেছিলো তুতু। তারপর থেকেই অবনীর মন তুতুর আসবার মুহূর্তটাকেই মনে করে সুখে থেকেছে। এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতির মৌতাতে আচ্ছন্ন ছিলো সারা দিন। বুঝিয়েছে নিজেকে আর তো কয়েকটা ঘণ্টা। এ ভাবেই কাল সন্ধ্যা থেকে হিসাব রেখে পার করেছে রাত্রি, সকাল, দুপুর।
এই সময় রোজ একটা ওষুধ থাকে অবনীর । ঘড়ি দেখে। সাড়ে ছয়টা বাজে। বয়স এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধই মনে করিয়ে দেয় সময়ের হিসাব। বার্ধক্যের এ আর এক যন্ত্রণা।
সুধা আসবে নিশ্চয়ই। নয়তো মনে করিয়ে দিয়ে যেতো অবনীর ওষুধের কথা। ফ্রিজের পাশের টেবিলে রাখা রয়েছে ফানুসের প্যাকেট। চেয়ে থাকে অবনী। লাল, নীল, হলুদ নানা রং মিলিয়ে পাঁচটা ফানুস আজ সকালে কিনে এনেছে অবনী। সারা দুপুর সে গুলিকে রোদে রেখেছিলো সুধা। গতকাল বৃষ্টি হয়ে গেছে। রোদে না দিলে নেতিয়ে থাকবে ফানুস।
আজ সারাদিন মাঝে মধ্যেই ফানুসগুলোর দিকে চেয়ে থেকেছে অবনী। কল্পনায় উড়তে দেখেছে আঁধার আকাশে। মনের খুশি অধীর হয়ে পাক খেয়েছে ফানুসের চারপাশে, রঙিন প্রজাপতি যেনো। বিকেল বেলায় ফানুসে হাত দিয়ে দেখেছে নিজে ভেজা ভাব আছে কিনা তাতে। সুধা বলে অতক্ষণ রোদে রাখার পর ভেজা ভাব থাকে কি করে! তুমি বাপু আচ্ছা মানুষ। সুধা যতই বলুক, নিজে হাত দিয়ে দেখে তবেই নিশ্চিন্ত হয়েছিলো অবনী, না ভিজে ভাব নেই ফানুসগুলোয়। গত বছর কালী পুজোর আগের দিন বৃষ্টি হয়েছিলো বেশ কয়েক পশলা। স্যাঁত স্যাঁতে বাতাসে নেতিয়ে ছিলো ফানুস। কিছুতেই জ্বলে না। শেষে ছিঁড়েই গেলো। আর তুতুর সে কি কান্না। আবার ফানুস আনতে হবে। অবনী, সুধা দুজনেই ব্যস্ত নাতিকে বোঝাতে। কাল আবার তোমার জন্য ফানুস কিনে নিয়ে আসবে দাদু, বলে সুধা। তুতু মানবে না কিছুতেই। শেষে বাধ্য হয়ে সুধা বলে তমালকে। যা না একবার বাজারে। নিয়ে আয় ফানুস। তোরা বাচ্ছা ছেলের কান্না দেখতেও পারিস। সে কথা শুনে ফুঁসে ওঠে তমালের স্ত্রী। হয়তো সবার অলক্ষ্যে মনের মধ্যে তুষের আগুন জ্বলেই ছিলো অনেক দিন ধরে। সুধার কথায় বাতাস পেয়ে বাইরে আসে বৌমার মনের আগুন। মুহূর্তে বদলে যায় পরিস্থিতি। সেই ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই ওরা চলে গেলো হিন্দ মোটর, ফ্ল্যাটে। তারপর থেকে একবারই এসেছে সবাই মিলে এখানে।
ভাবনায় ছেদ পড়ে অবনীর। সুধা আসে। একটু পরেই পুজো শুরু হবে বোসেদের বাড়ি। অবনীর ওষুধের কথা মনে করেই এখন বাড়ি এসেছে সুধা। তুমি ওষুধ খেয়ে ঘরে গিয়ে বসো। তেমন তেমন বুঝলে বারান্দার গেটে চাবি দিয়ে দাও। ওরা মনে হয় আর আসবে না, এলে চলে আসতো এতক্ষণে। বলে সুধা। অবনী বোঝে সুধার শেষের কথাগুলো মনের তীব্র অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। চলে যায় সুধা। একলা বারান্দায় বসে থাকে অবনী।
বোসদের বাড়িতে ঢাকের শব্দ লম্বা হয়ে বেজে ওঠে। বাড়ি থেকে শুনতে পায় অবনী। পুজো শুরু হলো এইবার। অঞ্জলি দিয়ে বাড়ি আসতে প্রায় দশটা বাজবে সুধার। বারান্দার সামনে আলো আঁধার। গ্রীলের নক্সা পার করে অবনীর দৃষ্টি হেঁটে চলে উঠানে। পথ হারায় উঠানের আলো ছায়ায়। বহু বছর পর আজ কালীপুজোর রাতে গোটা বাড়িটাকে গ্রাস করেছে আঁধার। তমাল থাকলে ঠিক জ্বেলে দিতো আলোর ঝাড়। গেলো বারও দোতলা থেকে নানা রঙের আলোর মালা ঝুলিয়ে সাজিয়েছিলো গোটা বাড়ি। পুজোর খুশি উপচে পড়েছিলো। তাই দেখে তুতু বলেছিলো বাবার সঙ্গে গিয়ে সেই নাকি কিনে এনেছে সমস্ত আলো। পাকা বুড়ো। হঠাৎ করেই বুকটা কেমন ডুকরে ওঠে অবনীর। সদ্যজাত কান্নার বুদবুদ হয়তো।
কতদিন আসেনি তুতু। তমাল সময় করে এসেছে মাঝে মাঝে। খবর নিয়েছে বাবা মায়ের। সুধা একদিন বলেছিলো তমালকে, ছেলেটাকে আর বৌমাকে তো আনতে পারিস একবার। তোমার বৌমা কি ছেলে মানুষ? নাকি আমি এখানে আসতে বারণ করি? তমালের কথা শুনে যা বোঝার সবই বুঝেছিল সুধা। অবনীও ছিলো পাশে। আর তুতুর নাকি রবিবারই আঁকা, আবৃত্তি আর ক্যারাটে ক্লাস থাকে। তোমরাও তো যেতে পারো। আমাদেরও ভালো লাগে তাহলে। যাবো, বলেছিলো অবনী। সুধার সময় হয়নি তারপর থেকে। কোনো না কোনো অজুহাতে পাশ কাটিয়ে গেছে ঠিক। শেষে একদিন বলে কই বৌমাতো বলেনা কোনো দিন। ফোন করে বলেছে কখনো নতুন ফ্ল্যাটে আসতে ? সেটা অবশ্য অবনী খেয়াল করেছে। বৌমা সুধার সঙ্গে কথা বলেনা। ব্যাপারটা তুমিই তো মিটিয়ে নিতে পারো। অবনীর কথা শুনে সুধা বলেছিলো বৌমাও তো পারে একবার আসতে। দরজা কি বন্ধ থাকে? নাকি আমি…
গলা ধরে এসেছিলো সুধার। কে পারে, কে পারে না এই প্রশ্নের মীমাংসা আজও অধরা অবনীর।
হঠাৎ করেই সদর দরজা খোলার শব্দ কানে আসে। চকিতে সেই দিকে চোখ ফেরায় অবনী। আকাশের বিদ্যুৎ বিকাশের মতো আশার ঝিলিক মন ধাঁধিয়ে দিয়ে যায়। তুতু এলো হয়তো। অশেষ আশায় স্নাত দৃষ্টি দৌড়ে যেতে চায় সদর দরজার দিকে। বারান্দার পিলারে বাধা পায় অবনীর তৃষিত দৃষ্টি। সোফা থেকে উঠে আসে দু পা। চেয়ে থাকে সদর দরজার দিকে। আশাহত হয় অবনীর অধীর মন। না, তমালরা আসেনি। সুধা এসেছে আবার। মনের আশার সুর সঙ্গতহীন হয়ে বেসুরে বাজে। সোফায় এসে বসে আবার। বুজে আসে দু চোখ। অবসন্ন মন। উঠান পেরিয়ে বারান্দায় পা রাখে সুধা। বলছি, আমি সদরে চাবি দিয়ে যাচ্ছি। তুমি এবার ঘরে গিয়ে বসো। সুধা চলে যায়। ফোন হাতে নেয় অবনী। তমালকে ফোন করে। একটানা রিং হয়ে চলে। ওহ! বিরক্ত হয়ে ঘরে আসে অবনী। এবার বেজে ওঠে অবনীর হাতের ফোন। তমাল ফোন করেছে। কথা বলে অবনী। নিঃশেষ হয়েছে আশা। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে বিছানার উপর। বিধ্বস্ত অবনীর মন। তুতু আসবেনা। সারা দিন উপবাসী থেকে পুজোর জন্য ভোগ রান্না করেছে তমালের স্ত্রী। মাইগ্রেনের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে ভীষণ।
কষ্ট তো অবনীও পাচ্ছে। সে কথা বলবে কাকে। গতকাল থেকে নাতিকে কাছে পাবার আশায় এক অন্য জগতে বাস করেছে অবনী। তমালের কথা শুনে শেষ হয়েছে মনের সমস্ত আশা। বিছানা থেকে চেয়ে থাকে ফানুসগুলোর দিকে। নানা রঙের পাঁচটা ফানুস। এক ভাবনাহীন চাউনি আঁকড়ে ধরে ফানুসের প্যাকেটটাকে। সারাদিন উড়তে থাকা রঙিন প্রজাপতিগুলো আর নেই এখন। সময় এগিয়ে যায় নিঃশব্দে। চুপটি করে বসে থাকে অবনী। ফোন বেজে ওঠে আবার। ওপ্রান্তে তুতু। হ্যালো দাদু –
বুকের মধ্যে ছুটে চলা উদভ্রান্ত কান্নাগুলি ভিড় করে অবনীর গলায়। বিদ্রোহী তারা, বাইরে আসবে এখনি। বহু কষ্টে শব্দ আসে অবনীর মুখে। বলে, বলো দাদুভাই –
– মায়ের শরীর ভালো নেই, তাই…
অবনী বধির যেনো। তুতুর কোনো কথা কানে আসছে না। এক অবশ ভাবনা ছেয়ে আসে মনে।
– হ্যালো, তুমি লাইনে আছো দাদু? জিজ্ঞাসা করে তুতু।
– হ্যাঁ, শুনছি তো…
শেষ করতে পারে না অবনী তার বলতে চাওয়া কথা। মিলিয়ে যায় বাতাসে।
– হ্যালো দাদু, জানো ফ্ল্যাটের ছাদে এসে আমরা সবাই ফানুস…
ফানুস জ্বেলে আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে তুতু। ভীষণ আনন্দ তার মনে। জিজ্ঞাসা করে অবনীকে, তুমি দেখতে পাচ্ছো দাদু আমার ফানুসটা? ভালো করে দেখো উড়ে যাচ্ছে, ওই যে লাল রঙের ফানুস।
ফ্রিজের পাশের টেবিলে রাখা ফানুসগুলোর দিয়ে চেয়ে থাকে অবনী। বলে, একটা তো নয় দাদুভাই। পাঁচটা ফানুস…
– ধ্যাত, কোথায় পাঁচটা! ভালো করে দেখো ওই দূরে চলে যাচ্ছে লাল রঙের…
কথা নেই অবনীর মুখে। বিদ্রোহী কান্নাগুলি বাইরে আসে একযোগে। ফোনটা ধরে থাকে কানের পাশে। ও প্রান্তে তুতু বলে চলে কিভাবে তরতর করে আকাশে উড়েছে তার ফানুস। ভীষণ খুশি তুতু আজ। ফানুস উড়েছে আকাশে।
টেবিলের ফানুস গুলোর দিকে চেয়ে থাকে অবনী। নিথর হয়েছে দৃষ্টি। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে চশমার কাঁচ। অবনীর পৃথিবীতে চলে নীরবে ধারাপাত। ওই পৃথিবীতে আকাশে পাড়ি দিয়েছে তুতুর ফানুস। উড়ে চলে দূরে, আরো আরো দূরে।