অট্টহাস সতীপীঠ — সুদীপ ঘোষাল

অট্টহাস সতীপীঠ

সুদীপ ঘোষাল

ধর্মতলা থেকে নিরোলের সরকারি বাস (SBSTC) পাবেন। তবে বাসে সময়টা একটু বেশিই লাগে। বাস ছাড়ার সময় হল বিকেলে তিনটে। ওই বাসটি নিরোল পৌঁছায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। নিরোলে নেমেই টোটো রিক্সা করে পৌঁছে যান অট্টহাস সতীপীঠে। আপনি চাইলে মন্দিরে আগে থেকে ফোন করেও আসতে পারেন। তাতে আপনারই সুবিধা। অতিথিদের থাকার জন্য জায়গা আছে। ভক্তদের থাকা, খাওয়া মন্দির থেকেই পরিচালিত হয়।

এছাড়াও কাটোয়ার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মস্থান। যেমন, চৈতন্য চরিতামৃতের লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজের বাড়ি ঝামতপুর নামের এক গ্রামে। বাংলায় মহাভারতের রচয়িতা কাশীরাম দাসের বাড়ি কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে। ফলে অট্টহাসে এলে আপনি এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্মস্থানেও আসতে পারবেন ঘুরতে। অন্যদিকে কাটোয়া থেকে ১০ কিলোমিটার দূরেই জগদানন্দপুর গ্রাম। সেখানেই রয়েছে রাধাগোবিন্দ জিউয়ের মন্দির। যদি আপনার পুরাতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ থাকে, তাহলে এই মন্দিরের গঠনশৈলী আপনাকে অবাক করবেই। মন্দিরের পূর্বপাশে সাধক ভোলাবাবার মন্দির। পঞ্চমুণ্ডীর আসন। রটন্তী কালিকা মন্দির। এই কালীর কাছে ডাকাতরা পুজো করত৷ আগে অট্টহাসে পূজার পর শিবাভোগের (শিয়ালকে খাওয়ানো) ব্যবস্থা ছিল। ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় শৃগালকূল ধ্বংস হওয়ায়। এখন ওই প্রথা উঠে গেছে। শাক্তদেবী হলেও এখানে বাৎসরিক পুজো হয় বৈষ্ণবীয় উৎসবের সময় দোল বা ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। এখানে ধূমধাম সহকারে ওই উৎসবের প্রচলন করেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ বা কাটোয়ার বিখ্যাত দুলাল সাধু।

যদিও বীরভূমেও অট্টহাস সতীপীঠ আছে। যা লাভপুরের কাছে। সেখানেও গিয়েছি। আগে বলেছি সেই সাধনপীঠ তথা সতীপীঠের কাহিনী ।

এই সতীপীঠে দেবীর পাথরের প্রতিমা উপর মহিষমর্দ্দিনীর পাথর মূর্তি রেখে নিত্যসেবা করা হয়। মহাভোগ যোগে কালীমন্ত্রে দেবী পূজিতা হন। এখানে মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী দন্তরা চামুন্ডা। ভূগর্ভের কয়েক হাত নিচে রয়েছে সতীর মূল শিলা বা পাথর।হাজারেরও বেশি বছর আগের একটা নথি পাওয়া গেছে একটা স্কেচ তাতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। “অট্টহাসে চ চামুন্ডা তন্ত্রে শ্রী গৌতমেশ্বরী”। তাই, অনেকে বলেন এখানে প্রাচীন বৌদ্ধ দেবীর হিন্দুআয়ন হয়েছে। তাই মনে হয় হিন্দু ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক, বজ্রযানী ও সিদ্ধাচার্যগণ এখানে সাধনা করেছেন।

মায়ের কাছেই ছোট মন্দিরে বিল্লেশ থাকলেও মূল বিল্লেশ মন্দির বিল্লেশ্বর গ্রামে। সেখানে শিবলিঙ্গ মাটিতে বসা। কষ্ঠি পাথরের শিববাহন ষাঁড়ের মূর্তি। মহাপীঠ নিরূপম গ্রন্থে এই পীঠের কথা বলা হয়েছে। এই পীঠে একসময় ভয়ানক রঘু ডাকাত পুজো করে ডাকাতি করতে যেত। সে নরবলি দিত বলে জনশ্রুতি আছে। আবার যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত “বাংলার ডাকাত” বইয়ে বলেছেন এখানে বেহারী বাগদী নামে এক ডাকাত পুজো করে নরবলি দিত। ত্রিশ একর জঙ্গলে ঘেরা এই মন্দিরে আজও গা ছমছমে পরিবেশ।

মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ঈশানী নদী। কাছেই রয়েছে শ্মশান। এই এলাকাটি আগে এত বেশি জঙ্গলে ভরা ছিল যে, দিনের বেলায়ও যেতে সাহস পেতেন না অনেকে। তবে এখন খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে মন্দিরটিকে। রাতে ঘুমানোর সময় কানে আসবে শিয়ালের ও প‍্যাঁচার ডাক, সকালে উঠবেন পাখির ডাকে। শান্ত পরিবেশে ভক্তি ভরে পুজো দিতে পারবেন আপনি। কথিত আছে একমনে মাকে ডাকলে সতীমায়ের উপস্থিতি অনুভব করা যায় আজও।

সত্য যুগে দক্ষযজ্ঞে সতী শিবনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত‍্যাগ করেন। এর পর মহাদেব বীরভদ্রকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে। সতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য। ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন। এই অংশগুলো যেখানে পড়েছে সেখানে শক্তিপীঠ স্থাপিত হয়েছে। এগুলোকে সতীপীঠ বলে। এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে। এখানে দেবীর অধর বা নিচের ঠোঁট পতিত হয়।

এরপর অনেক বছর কেটে যায়। এই স্থান জঙ্গল হয়ে ওঠে। তখন এ স্থানের নাম ছিল খুলারামপুর বা তুলারামপুর। পরবর্তীতে এই গ্রামের নাম দক্ষিণডিহি হয়। এই গ্রামে কিছু কৃষক বাস করত। তারা মাঠে চাষবাদ করত। ঈশানি নদীর ধারে অবস্থিত এ স্থান ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দিনের বেলাতেও ওখানে কেউ যেত না। একদিন কৃষকরা চাষ করতে গিয়ে এক সাধুবাবাকে জঙ্গলে ধ‍্যানমগ্ন দেখতে পায়। তারা কৌতূহলী হয়ে দলবদ্ধভাবে তার কাছে যায় ও তাকে প্রণাম করেন। সাধুবাবা এখানে যজ্ঞ করেন। যজ্ঞ শেষে তিনি যজ্ঞস্থানে একটি ত্রিশূল পুঁতে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। চলে যাবার আগে বলেন, এটি একটি সতীপীঠ।

এখানে দেবী ফুল্লরা ও ভৈরব বিশ্বেশর । এখানে দেবীর দন্তুরা চামুণ্ডা মূর্তি। এখানে দেবীকে অধরেশ্বরী নামে পূজা করা হয়। এখানে আছে এক প্রাচীন শিলামূর্তি। মন্দিরের অষ্টধাতুর মূর্তিটি চুরি হয়ে গেছে।

সারা বছর এখানে ভক্তরা আসে। তবে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস এ পাঁচ মাস এখানে বহু ভক্তের সমাগম হয়। বহু ভক্তের ইচ্ছাপূরণ হয়েছে এখানে পূজা দিয়ে। দোলের সময় এখানে বিশাল মেলা বসে। এখানে থাকার জন্য অতিথি নিবাস আছে। মন্দির থেকে ভক্তদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।