নিরাময়ের ছায়াজগৎ (ছোটোগল্প)
বিজয়া দেব
আজকাল শুলেই ঘুম পায় আবার রাতে ঘুম আসে না। ঘুমের সাথে পর্যাপ্ত লড়াই চালিয়ে অন্তত বার পাঁচেক বাথরুম গিয়ে ও জল খেয়ে অতঃপর মধ্যরজনীতে ঘুম আসে তা-ও ঘুমের মাঝে চলে আসে জীবন ছেড়ে চলে যাওয়া ছায়ামানুষেরা। তাঁরা হাসিখুশি নন। গম্ভীর, চিন্তাক্লিষ্ট। ঘুম ভাঙার পর মনটা আরও ভারী হয়ে থাকে।
নিরাময়ের বোন মাধুরীলতা। একটি মাত্র মেয়ে তার। আলোকলতা। নিরাময় বড্ড আদর করত। এক গভীররাতে সে হারিয়ে যায়। গিয়েছিল এক বন্ধুর দিদির বিয়েতে। সবাই ফিরে এল বাড়িতে। আলোকলতা ফেরেনি। অনেক থানাপুলিশ করেও কোনও খোঁজখবর মেলেনি। মেয়েটি হারিয়ে গেল। মাধুরী এরপর থেকে গুম হয়ে বসে থাকে। কত লোক কত কথা বলে। মাধুরীর কানে ঢোকে কিনা কে জানে।
পাড়ার কাকিমা বলে গেল – তুমি ওকে বড্ড ছাড় দিয়েছিলে মাধুরী। রাতবিরেতে বন্ধুর বাড়িতে বিয়েতে যাবে কেন? গার্জিয়ান আছে সঙ্গে? এরা আজকাল কি না করছে! মদ খাওয়া বেলেল্লাপনা করা কিছু কি আর বাকি আছে?
শুধু কাকিমা কেন অনেকেই দোষারোপ করছে মাধুরীকে। শাসন নেই আজকাল তাই জন্যেই এমন হচ্ছে।
মাধুরী পাথর। কোনও কথা তার কানে গেছে কিনা বোঝা যায় না।
আলোকলতার হদিস মেলেনি আজও। মেয়েটির কোনও ছেলের সঙ্গেও নাকি সম্পর্ক ছিল না। থাকলেও কেউ জানে না। তাহলে? তবে সে একটু উদাস থাকত। ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে। মারা গেছে মানে ধানক্ষেতে কেউ তাকে কুপিয়ে মেরেছিল। বাবাকে খুব ভালবাসত আলো।
আলোর বাবা আশুতোষ ধানক্ষেতে শেষ বিকেলে এক মুমূর্ষু যুবতীকে উদ্ধার করে পুলিশে খবর দিয়েছিল। যৌন অত্যাচারে সাংঘাতিক আহত মেয়েটি হাসপাতালে কয়েকঘন্টা পর মারা যায়। তবে মারা যাওয়ার আগে সে ধর্ষকের নাম বলতে পেরেছিল। যদিও পুলিশ কিছু চেষ্টাচরিত্র করে হাল ছেড়ে দেয়। এরপর আশুতোষ খুন হয়। কেন খুন হল? ঐ পূর্ববর্তী ঘটনার জের?
এরপর থেকে একটু একা থাকার অভ্যেস ছিল আলোকলতার।
আলো হারিয়ে গেছে মাস তিনেক হল। সেই থেকে আলোর মা মাধুরী কথা বলে না আর নিরাময়ের ঘুম ছন্দছাড়া। নিরাময়ের নিজস্ব কোনও রোজগার নেই। ঐ মাধুরীর বর আশুতোষের ব্যবসাপত্র সামলায়। নিজের বাড়িতে থাকে না। থাকে মাধুরীর বাড়িতে। নিরাময় পড়াশুনো করেছে বেশ খানিকটা। তবে কলেজ ডিঙোনো হয় নি। এখানেই দোকান সামলাতে বসে গেল। একবার তার বিয়ের কথা হয়েছিল, পাত্রী নাকি বেঁকে বসেছিল নিজস্ব রোজগারপাতি নেই ছেলেকে বিয়ে করবে না বলে। কিন্তু বিয়ে করতে চেয়েছিল তখন নিরাময়। আজকাল আর সে ইচ্ছেটা হয় না। লজ্জা করে বিয়ে নিয়ে ভাবতে। সত্যিই তো এটা আশুতোষের দাঁড় করানো ব্যবসা। সে শুধু ওটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের কিছু নয়। আলোকলতা না হারিয়ে গেলে হয়ত একসময় মাধুরী কাজটা করত। আলোকলতার পড়াশোনার যাতে ব্যাঘাত না হয় সেজন্যে মাধুরী দোকানে বসতে চায়নি। বলেছিল – বাড়ি থেকে কী করবি, এখানে চলে আয়। বাড়িতে তো দাদা বৌদির অবহেলা, কথা শোনা। এখানে তোকে কেউ কিছু বলবে না।
এর আগে মাধুরীর ভাসুর ব্যবসা দেখত। এরপর উনিও মারা গেলেন। ওরা নিঃসন্তান। বড় জা আগেই গত হয়েছেন। সুতরাং…
নিরাময়ের বাবা মা গত হয়েছেন বেশ কিছুকাল। একেবারে একা সে। বাইরের জগতে নিরাময়ের সম্মান নেই, দাম নেই সে এটা বোঝে। লাঙল টানা বলদের মত যেন সে। তবু বাঁচতে হবে ভেবে সে তো বাঁচছিল এভাবেই। বড্ড মায়া জন্মেওছিল আলোকলতার জন্যে। একটা টান ছিল বাড়ি ফেরার। যদিও আলো সব কথা তাকে বলত না, তবু তার কাছে এসে বলত – ছোটমামা তোমার ছোটবেলার গল্প বলো।
তার আর ছোটবেলা কী! বাবা চাষবাস করত। গরীবের সন্তানের শৈশবকালে প্রকৃতি খুব অকৃপণ থাকে। মাঠঘাট, গাছপালা, পুকুরনদী, আকাশ তারা ঐসব। ঐ নিয়েই সাদামাটা গল্প। তবু খুব প্রিয় ছিল আলোর কাছে।
যাইহোক, আপাতত একটু নিরুপদ্রব ঘুম চায় নিরাময়। ঘুম… কিছু সময়ের জন্যে এই দিনকালের কাছ থেকে ছুটি। সময়ের চলমানতা থেকে হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেখানেই বিপত্তি।
সারাটা দিন যেমন তেমন করে কেটে যায়। বিক্রিবাটা কিছু কিছু হয় রোজ নিয়মমাফিক। মাধুরী যন্ত্রের মতো রান্না করে, দুপুরে খাবার নিয়ে আসে ভবেশ। তার দোকানের কর্মচারী। সবকিছু আজকাল ভবেশই দেখে। নিরাময় তদ্বির করে। রাতে হিসেব করে টাকাপয়সা ক্যাশবাক্সে তুলে দোকান বন্ধ করে।
ঝিম ধরা দুপুরে কাস্টমার কমে যায়। তখন ভবেশের সাথে দু চারটে আটপৌরে কথার বিনিময়, এইটুকুই।
এই ক’দিন থেকে বাড়ি ফেরার পথে নিরাময়ের মনে হয় ছায়ার মত কেউ তার পিছু পিছু হাঁটছে। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় কেউ নেই। ভবেশ কিছুটা পথ তার সঙ্গে আসে, তারপর গলিপথে ঢুকে যায়, ওখানেই ভবেশের বাড়ি। তারপর একটা মসৃণ পায়ের আওয়াজ। কে হতে পারে? কোনও শত্রু? নতুন জন্মানো? নাহলে শত্রু হবার মত কোনও ঘটনা এরমধ্যে ঘটেছে বলে তো মনে হচ্ছে না। তাহলে কি অলৌকিক কিছু? পেছন ফিরে তাকালে কেউ নেই। আর ব্যাপারটা ঘটছে ভবেশ তার বাড়ির গলিপথে ঢুকে যাওয়ার পর। তাহলে কি আলোকলতা? আলো কি বেঁচে নেই? সে কি এখন অশরীরী?
চিন্তার ব্যাপার বৈকি। ভবেশকে সেদিন কথাটা বলল নিরাময়। ভবেশ শুনে গোটা ছয়েক ভূতের গল্প শুনিয়ে দিয়ে বলল – ভূত আছে। আপনারা বিশ্বাস করুন কিংবা না-ই করুন। আপনি ভূতের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছেন। ওরা তো অন্ধকারের ছায়া। আঁধারের ছায়া কি আর দেখা যায়?
এরপর একটি অদ্ভুত কথা বলল ভবেশ। বলল – আপনি বিয়ে করেন নি তো তাই ভূত আপনাকেই পছন্দ করেছে।
নিরাময় আশ্চর্য হয়ে বলে – কেন?
ভবেশ হেসে হেসে বলে – দেরি করবেন না, বিয়ে করে নিন।
– ধুর ঠাট্টা করো না। আচ্ছা তোমার কী মনে হয় ভবেশ, আলো বেঁচে আছে?
ভবেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে থাকে। কাজেই প্রসঙ্গের সুরাহা হয় না, ছায়ার মতই মিলিয়ে যায়।
সেদিন দুপুরে বেরিয়েছিল এক কাজে। হেঁটে ফিরছিল। মাঝদুপুর তখন। মনে হল কেউ তার পেছন পেছন হাঁটছে। নিঃশব্দে। তার পিছু পিছু। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ব্যস চুপচাপ। আবার হাঁটছে তো আবার পিছু নিল। আবার সে দাঁড়াল। একটি দীর্ঘ ছায়া। অসমান এবড়োখেবড়ো। নাহ এটা তার ছায়া হতে পারে না। একটা অদ্ভুত আতঙ্কে সে দৌড় লাগাল।
ব্যাপারটা অতঃপর বাড়ছিল। বেড়েই যাচ্ছিল। নিরাময় এখন আর কাউকে বলে না কিছু। কাজ করতে করতে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। ভবেশ ব্যাপারটা দেখছে। মাধুরী দিদির মত হয়ে যাবে লোকটা? বিয়ে থা করল না। সবসময় গুটিয়ে থাকে। ওরকম ভালো নয়। আজকাল তাকেও আর কিছু বলে না।
সেদিন ঘন রাতে অন্য কেউ নয়, নিরাময় আলোকলতাকে দেখল। সমস্ত মুখ বিক্ষত, হাতদুটো রক্তমাখা… যদিও সে ছায়াশরীরে ছিল। তাকে বলল – মামুন, আমাকে দ্যাখো। আমি এই হয়েছিলাম।
আদর করে আলো তাকে মামুন বলত।
নিরাময় জানে সে একটি ঝাপসা মানুষ। মানুষের কাছে সে মানুষ হিসেবে প্রকট নয়। পারদচটা আয়নায় যেভাবে মানুষ নিজেদের মুখটা দেখতে পায় না, তেমনি তাকেও স্পষ্ট করে কেউ দেখে না। দেখতে পায় না। কিন্তু এটি তার জন্যে সুবিধে। কেননা এই অস্পষ্ট অবয়বে সে খুঁজবে, খুঁজতে সুবিধে হবে আলোর রক্তাক্ত ছায়াশরীরের পেছনের হন্তারক অবয়বটিকে। খুঁজে পাবে কিনা সে জানে না, তবে অন্বেষণ জারি থাকবে।