গোবেচারার বৃন্দাবন ভ্রমণ
সদানন্দ সিংহ
গিন্নি আগে অনেকবারই বলেছে বৃন্দাবনে বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে, আমিই গা লাগাই নি। কারণ আমার স্বর্গমর্ত্য-পাপপুণ্য-ধর্মকর্ম জাতীয় কোনো কিছুতেই কোনোদিন বিশ্বাস ছিলনা, এখনও নেই। অন্যদিকে আমার গিন্নি একটু আস্তিক ধরনের। তাই এবার বেশ জোর করেই যখন আমাকে ধরল, এই এপ্রিল-মে মাসে তীব্র গরমের মাঝে বৃন্দাবনে যাবেই তখন না করার আর সাধ্য ছিলনা। যেহেতু গিন্নির কাছে প্রায় সব স্বামীই গোবেচারা। তাই ভাবলাম, বৃন্দাবনে যেতে কীসের আপত্তি, কতো মসজিদ-চার্চে বেড়াতে গেছি, বৃন্দাবনে কেনো বেড়াতে যাবো না? তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে।
যাঁরা শ্রীকৃষ্ণভক্ত তাঁদের কাছে বৃন্দাবন হয়তো তীর্থভূমি, কিন্তু যাঁরা আস্তিক নন এবং হিন্দু নন তাঁদের কাছে বৃন্দাবন-মথুরা কেনো এক ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে ধরা হবে না? বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমি। শ্রীকৃষ্ণ এক ঐতিহাসিক চরিত্র, এক অসাধারণ চরিত্র। আমার মনে হয় এজন্যে নাস্তিকসুদ্ধ সবারই শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বর্তমান। তিনি আমাদের মতোই একসময় মানুষ ছিলেন। যিনি একসময় রাখাল বালক থেকে দ্বারকার অধীশ্বর হয়েছিলেন। খৃষ্টপূর্ব তিনহাজার বছর থেকে কালে কালে শ্রীকৃষ্ণের জনপ্রিয়তা এবং ভক্তের সংখ্যা ভীষণভাবে বেড়ে গেছিল। এই ভক্তগণই শ্রীকৃষ্ণের ওপর অলৌকিকি ও দেবত্ব আরোপিত করতে করতে একসময় শ্রীকৃষ্ণকে হিন্দুদের সুপ্রিম গড হিসেবে সবাই মেনে নিয়েছিলেন। সেই সময় অন্য কোনো ধর্মের অস্তিত্ব ভারতে ছিলনা। অবশ্য লৌকিক দেব-দেবীরা তখনো ছিলেন, এখনো আছেন।
বৃন্দাবনে বেড়াতে এসে শিখদের আমি বেশ কিছু মন্দিরে ঢুকতে দেখেছি। আর বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরে তো এক মুসলমান পরিবারকেও ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। অবশ্য গোকুলে আবার অন্যরকম। এখানে হিন্দুরা ছাড়া কেউ ঢুকতে পারেন না। আবার হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা মেথর, মুচি অর্থাৎ দলিত শ্রেণির তাঁদের জন্যেও দরজা বন্ধ। এই ধরনের নিয়মকানুন শ্রীকৃষ্ণ কখনোই করেন নি। এসব নিয়মকানুন করেছিলেন শাসক রাজামহারাজগণ, সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে ছিলেন পাণ্ডা অর্থাৎ ব্রাহ্মণগণ। কালে কালে এঁরাই বিভিন্ন আচারব্যবহার, পাপপুণ্যের ব্যাপার ঢুকিয়ে প্রজাগণকে বিভ্রান্ত করে গেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। দক্ষিণ ভারতের এক মন্দিরে তো এক নোটিশ টাঙানো দেখেছিলাম যেখানে লেখা ছিল ‘CHAMARS NOT ALLOWED’। সত্যি কথা বলতে কী, এইসব জাত-বর্ণ-ধর্ম ধুয়ে আমরা যে কী খাচ্ছি নিজেরাই ঠিক টের পাচ্ছি না।
বৃন্দাবনে যাওয়ার জন্যে সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্ট হচ্ছে আগ্রা, তবে কোলকাতা থেকে সরাসরি ফ্লাইট নেই। দিল্লিতে ফ্লাইটে এসে সেখান থেকে ট্রেন বা বাসে যাওয়া যায়। কোলকাতা থেকে ট্রেনে গেলে তুফান মেইল মথুরাতে থামে, এই টেনটা সাত ঘন্টার মত দেরিতে মথুরায় পৌঁছোয়। এছাড়া আগ্রা, টুন্ডলা বা ভরতপুরে ট্রেনে এসে তারপর বাস বা কারে করে বৃন্দাবন আসা যায়।
বৃন্দাবনে থাকার জায়গা প্রচুর। হোটেল প্রচুর। আশ্রমও প্রচুর। দেখলাম বেশির ভাগ হোটেল-আশ্রমের থাকার ঘরগুলি এখন খালি। অনেকখানে AC room available নোটিস টাঙানো। আশ্রমে থাকার জন্যে একটা আইডেন্টিটি কার্ড থাকলেই হল।
আমরা যখন মথুরা রেলস্টেশনে পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় বারোটা। ওখানে কোলকাতার মত ওলা-উবের ট্যাক্সি নেই। মথুরা থেকে বৃন্দাবনের দূরত্ব পনের কিলোমিটারের ওপর। রেলস্টেশনের সামনে একটা অটোরিক্সা পেলাম। সে বৃন্দাবন যেতে রাজি দু’শো পঞ্চাশ টাকায়। সঙ্গে সঙ্গেই আমিও রাজি। অটো ছুটে চলল। আমি গুগুল ম্যাপ খুলে রেখেছিলাম মোবাইলে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখলাম অটো বৃন্দাবনের দিকে না গিয়ে একদম উল্টো পথ ধরে পঞ্চাশ-ষাট কিমি স্পীডে ছুটছে। আমি আবার গুগুল ম্যাপ দেখলাম। ঠিকই উল্টো দিকে যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে দু-একটা গাড়ি ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি অটোওয়ালাকে বললাম, কোন্দিকে যাচ্ছ? এটা তো বৃন্দাবনের রাস্তা না। অটোওয়ালা অটো দাঁড় করালো রাস্তার একপাশে, তারপর আমার দিকে তাকাল। দেখলাম অটোওয়ালার বুকের ছাতি নরেন্দ্র মোদিজীর থেকেও বেশি। অটোওয়ালা আমাকে বলল, আমি একজন সৎ মানুষ। ঘাবড়াবেন না। আমার অটোর গ্যাস কমে গেছে তাই গ্যাস ফিলিং করার জন্যে অন্য রাস্তা ধরে যাচ্ছি। এখানে একটিই গ্যাস ফিলিং স্টেশন, শহরের একটু বাইরে। আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমার। হোটেলে ঢুকিয়েই আমি আপনার কাছ থেকে ভাড়া নেব। বলেই অটোওয়ালা আবার অটো স্টার্ট করল। কী আর করা যায়। পথেঘাটে অন্য কোনো অটোও দেখছিনা। তাই বসে থাকলাম। শেষে দেখলাম, অটোওয়ালা সত্যিই একজন সৎ মানুষ। আমাদেরকে হোটেলে ঢুকিয়েই সে তার ভাড়া নিল। সময়টা একটু বেশি লাগল বটে।
আগেই হোটেল বুক করে রেখেছিলাম দু’দিনের জন্য, যদিও থাকবো আরো বেশি দিন। অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে হোটেল বুক করার পর হোটেলগুলি একটা বদমাইশি করার চেষ্টা করে। দীঘার এক হোটেলে এসি রুম বুক করে যাওয়ার পরও প্রথমদিন এসি রুম পাইনি, টাকাও ফেরত দেয়নি যেহেতু ওটা মেকমাইট্রিপ থেকে বুক করিয়েছিলাম। বৃন্দাবনের হোটেল ম্যানেজারকে বললাম, রুম ভালো এবং পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন হলে এখানেই আরো কয়েকটা দিন থাকবো, নইলে অন্য হোটেলে চলে যাবো। এতে হোটেল ম্যানেজার আমাদের কয়েকটা রুম দেখাতে চাইল। অবশ্য প্রথম রুমটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেল।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে শুরু হলো গিন্নির তীর্থভ্রমণ আর আমার নান্দনিকভ্রমণ। হোটেল ম্যানেজারের মাধ্যমে দু হাজার টাকায় একটা গাড়ি ভাড়া করা হল। অবশ্য হোটেল ম্যানেজারের মাধ্যমে করা গাড়ি ভাড়ায় সবসময় ম্যানেজারের একটা কমিশন ধরা থাকে। কথা হল নন্দগ্রাম, বারাসানা, গোবর্ধন মন্দির এবং পথে যেসব কুণ্ড-সরোবর পড়বে সবগুলি এই ট্যুরে দেখিয়ে দেবে। প্রথমে গেলাম বৃন্দাবন থেকে ৫০ কিমি দূরের নন্দগ্রামে। আট বছর বয়স থেকে ষোল বছর বয়েস পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণ এই নন্দগ্রামেই বেড়ে উঠেছিলেন। রাধা ও গোপিনীদের সঙ্গে লীলাখেলা এইসময়েই হয়েছিল। সে হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন না। কংসের হাত থেকে বাঁচার জন্যে পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় নন্দমহারাজা নাকি এখানেই ঘর বানিয়েছিলেন। এখন পাহাড়ের একেবারে চূড়োয় মন্দির। কৃষ্ণ-বলরামের মূর্তি, শিবলিঙ্গ (নন্দেশ্বর), নরসিংহ ও বরাহের মূর্তি এখানে বিদ্যমান। পাণ্ডাদের ঝোপ বুঝে কোপ মারার একটা লক্ষণ এখানে আছে। আর পাণ্ডাদের প্রতি আমার গিন্নির একটু আস্থা বিদ্যমান। তাই আমাদের পাণ্ডা (উনি নিজেই এসে আমাদের সাথে জুড়ে গেছেন) যখন সব কিছু দেখিয়ে আমাদের মন্দির চত্বরের শেষ ওপরের ধাপে এসে আমাদের একসঙ্গে বসতে বললেন তখনই বুঝে গেলাম এবার পাণ্ডাদের খেলা শুরু হচ্ছে। লোকটি আমাদের গোত্র জেনে মন্ত্র পড়া শুরু করে দিলেন। তারপর আমাদেরকে পাণ্ডাজী তার সাথে সাথে মন্ত্র উচ্চারণ করতে বললেন। গিন্নি তো সব ঠিক ঠিক উচ্চারণ করতে লাগল, আর আমি গোবেচারা গিন্নিকে শুনিয়ে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলাম, বাকিগুলিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম। এই করে ছ’শো টাকার ওপর খসে গেল। যাক, কমেই সারা গেল। ফিরে আসার সময় পাণ্ডাজী পাহাড়ের মন্দিরের চূড়ো থেকে অনেক নিচে অনেকগুলি গাছ দেখিয়ে আমাদের বললেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ৫০০০ হাজার বছর আগে এই তমাল গাছগুলিতে বসে বাঁশি বাজাতেন। আমি দেখলাম, এই গাছগুলিকে তো একশো-দুশোর বেশি পুরানো মনে হচ্ছিল না।
তারপর এখান থেকে গেলাম বারসানা। মথুরা থেকে বারসানার দূরত্ব ৪২ কিমি। এখানেই শ্রমতী রাধিকা বাস করতেন এবং শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বহু সময় এখানেই নাকি অতিবাহিত করেছিলেন। গাড়ি থেকে নামতেই ঘোড়াওয়ালা, মোটরবাইকওয়ালা এবং ডুলিওয়ালারা আমাদের ডাকতে শুরু করল। ওরা কেবল আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল, বড় বড় ২৫০টির ওপর সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠতে খুব কষ্ট হবে। গিন্নির একটাই জবাব ছিল, আরে বাবা, কষ্ট করতেই তো এখানে এসেছি। যাহোক আমরা আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে শেষে পাহাড়ের চূড়োয় মন্দিরে পৌঁছে গেলাম। এখানে পাণ্ডার কোনো উপদ্রপ নেই। মন্দিরের ভেতরে শ্রীজীর মূর্তি অর্থাৎ শ্রীমতি রাধিকার মূর্তির সামনে অনেকে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করছে, অনেকে রাধার বন্দনায় বাহূ তুলে গান গাইছে, অনেকে ভোগ দেবার জন্যে ফাঁড়াফাঁড়ি করছে, অনেকে আবার প্রসাদ-মালা নেবার জন্যে ফাঁড়াফাঁড়ি করছে। একটু যেন বিশৃঙ্খল অবস্থা। এখানেই দেখলাম ভোগ হিসিবে মুড়ি উৎসর্গ করা হচ্ছে। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আমরা নিচে নেমে এলাম।
তারপর আমরা গোবর্ধন টাউনের দিকে চললাম। পথে পড়ল মানসী গঙ্গা, কুসুম সরোবর, গিরিরাজজীর মন্দির এবং আরেকটা মন্দির (নামটা ঠিক মনে পড়ছেনা) যেখানে সামনের বিশাল চত্বর জুড়ে গাছপালার ছায়া যেটা একটামাত্র মূল গাছ থেকেই অজস্র ডালপালা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। গাছটাকে দেখে বেশ পুরানো মনে হল। এর কোনোখানেই পাণ্ডার দেখা পেলাম না। তবে রাধাকুণ্ডে গিয়েই পড়লাম আবার পাণ্ডার খপ্পরে। রাধাকুণ্ডে ই-রিক্সা (টমটম) করে গেলাম। ওখানে দেখলাম নো এন্টি লাগানো, তবে ই-রিক্সা চলছে। তাই গাড়ি থেকে নেমে একশো টাকা ভাড়ায় ই-রিক্সা নিয়েছিলাম। অবশ্য হেঁটেও যাওয়া যায়। রাধাকুণ্ডের সামনে পৌঁছতেই এক দোকান থেকে আমার গিন্নির হাতে পুজোর থালা ধরিয়ে দিল। দোকানী বলল, পুজো সেরে থালাটা ফেরত দেবেন। হাতে থালা দেখে এক পাণ্ডা দৌড়ে চলে এলো। পাণ্ডা আমাদের নির্দেশ দিলো জলের কিনারে গিয়ে বসার জন্যে, পুজো শুরু করবে। এইসময় দেখলাম, একজন বয়স্ক মানুষ পিছলে ঘাট থেকে জলে পড়ে গেছেন। সেই বয়স্ক লোকটি ধীরে ধীরে উঠে এলেন। উনার কাপড়চোপড় একদম ভিজে গেছে। আমি গিন্নিকে বললাম, যাও তুমি পুজো দিয়ে এসো, আমি দেব না। কিন্তূ পাণ্ডাজী নাছোড়বান্দা, আমাকেও গিন্নির সঙ্গে বসতে হবে। গিন্নিও আমাকে অনুরোধ করল বসার জন্যে। অগত্যা আমি গোবেচারা বসে গেলাম। তারপর পুজো-আচ্চা শুরু হল, কিছুক্ষণ পরপর ফুল, ভোগ পাণ্ডার নির্দেশ মত জলে ফেলছি। পাণ্ডাজী আমাদের একসাথে মন্ত্র উচ্চারণ করতে বলছে, আমি আধা উচ্চারণ করছি। একসময় কুণ্ডের কয়েক ফোঁটা জল আমাদের খেতে বলল। কুণ্ডের জল বেশ অপরিষ্কার। আমি তাই খাওয়ার ভান করলাম। গিন্নিকে দেখলাম টুক করে কয়েক ফোঁটা মুখে দিয়ে ফেলেছে। তারপর রাধাকুণ্ড থেকে আবার কাছের শ্যামকুণ্ডে একই পুজো। এই পুজোর ভেতরেই পাণ্ডা আমাদের কেবল শপথ করাচ্ছিল কত বেশি টাকা ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্যে দান করবো। আমি বললাম, আড়াইশো টাকার বেশি দিতে পারব না। আমি নড়ছিনা দেখে শেষপর্যন্ত আমার কথাই মেনে নিলেন পাণ্ডাজী। রাধাকুণ্ড এবং শ্যামকুণ্ডের ঠিক মাঝামাঝি একটা ছোট্ট মন্দির আছে। এদিকে সেই মন্দিরের পূজারী আমাদেরকে মণিপুরি বলে চিনে ফেলেছে। আমরা শ্যামকুণ্ডে যখন নামছি তখন থেকেই পরিষ্কার মণিপুরি ভাষায় আমাদের ডেকে যাচ্ছিল, “এসো এসো এদিকে এসো। এটা তোমাদেরই বিগ্রহ। এখানে পুজো দাও। প্রণাম কোরো”। যাক, ওখানেও গেলাম। গিন্নি কিছু প্রণামী রাখলো। আগেও দেখেছি, পাণ্ডাদের কেউ কেউ মণিপুরি ভাষা ভালোই জানে। ছোটবেলা দেখেছি, বছরে এক-দু’বার বৃন্দাবন থেকে পাণ্ডাদের কেউ এসে মণিপুরি পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে মণিপুরি ভাষায় কথা বলে দান সংগ্রহ করতো। মা বলতেন, পাণ্ডারা শ্রীকৃষ্ণের বংশধর। মা বুঝতেন না, শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশধর আর পাণ্ডারা ব্রাহ্মণ।
পরদিন সকালেই ঘুম ভেঙে গেল বানরের তীব্র কিচির কিচির আওয়াজে। কাছাকাছি এক মন্দিরের ওপর বানরেরা নিজেদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া করছে। হোটেলের চারিদিকে ঘিরে অবশ্য লোহার জাল এবং লোহার তারকাঁটা, এতে বানরগুলি হোটেলের ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়না। বাঁকে বিহারী মন্দিরের কাছাকাছি বানরগুলি তো মহা পাজি। অহরহ এই বানরগুলি চশমা, মোবাইল, টুপি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গ পরে বলছি। অবশ্য আমাদের হোটেলের কাছাকাছি বানরগুলি অত পাজি না, তবে হাতে কলার ব্যাগ দেখলে এরাও ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
স্নান ছেড়ে হোটেলের বাইরে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার দ্বিতীয় দিনের সফর শুরু হল। এবার গাড়ি আমরা নিজেই ঠিক করলাম। ছুটে চললাম গোবর্ধন পাহাড়ের দিকে। গিন্নির ইচ্ছে গোবর্ধন পরিক্রমা সেরে নেবে।
বৃন্দাবন থেকে গোবর্ধন পর্বতের দূরত্ব প্রায় ২৮ কিমি। ড্রাইভার জানাল, আজ পূর্ণিমা বলে ওখানে খুব ভিড় হবে। মনে মনে বললাম, তাতে কী, আমরা তো পায়ে হেঁটে আর যাচ্ছিনা। অবশ্য যাঁরা ট্র্যাকিং হিসেবে হাঁটতে আগ্রহী, তাঁরা অবশ্যই হেঁটে পরিক্রমা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে ২৩-২৪ কিমি দূরত্ব হাঁটতে হবে। এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম গোবর্ধন পর্বতের মুখে। ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে জানাল, পরিক্রমা শুরু হতে যাচ্ছে, আপনাদের জুতোগুলি খুলে ফেলুন। পরিক্রমা খালি পায়ে করতে হয়। আমি ড্রাইভারকে বললাম, কেনো, আমরা তো নিচে নামছি না। ড্রাইভার বললো, না না, নামতে হবেনা। ভেতরেই বসে থাকুন, শুধু জুতোগুলি খুলে একপাশে রেখে দিন। গিন্নি তার জুতো খুলে ফেললো, তারপর আমার দিকে তাকালো। তাই আমিও খুলে ফেললাম।
ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো। আমরা সামনের দিকে আবার এগোতে থাকলাম। দেখলাম, ডানে-বাঁয়ে অজস্র লোক গোবর্ধন পরিক্রমায় চলেছেন। বুড়ো, বুড়ি, কিশোর, কিশোরী, যুবক, যুবতী, মধ্যবয়স্ক সবধরনের লোক আছেন। বেশ কয়েকটি দলকে দেখলাম একসঙ্গে হাততালি দিয়ে কৃষ্ণনাম গাইতে গাইতে পরিক্রমায় চলেছেন। পরিক্রমারত লোকের ভিড়ে আমাদের গাড়ি মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছিল। চারজন লোককে দেখলাম মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে প্রণাম করে করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। চারজনের মধ্যে দু’জন কিশোর, একজন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক, আর অন্যজন মধ্যবয়স্ক। হয়তো একই পরিবারের। ধীরে ধীরে রোদের তেজ বেড়ে যাচ্ছে। এই রোদের মাঝে এইভাবে প্রণাম করে করে পরিক্রমা সারাদিনে শেষ করতে পারবে কিনা ভেবে পেলাম না।
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি হূ হূ করে। পর্বতের সব পরিক্রমার রাস্তায় আমরা সবখানেই লোক দেখেছি লাইন ধরে পরিক্রমায় চলেছেন। ড্রাইভার মাঝে মাঝে কোনো মন্দিরের সামনে দাঁড় করাচ্ছিল, আর আমরা নেমে মন্দিরে ঢুকছিলাম। এক মন্দিরের সামনে তো কয়েকটা গরু পথ আটকে দাঁড়িয়ে ছিল কলা খাবার জন্যে। কলা দিলে রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছিল। যেতে যেতে আমরা তাউজীর অর্থাৎ বলরামজীর মন্দিরের সামনে এলাম। ওখানেও একটা কুণ্ড আছে। সেখান থেকে বেরিয়ে একটু এগোবার পর দেখলাম এক জায়গায় এক ভদ্রমহিলা এবং দু’জন ভদ্রলোক মিলে গোবর্ধন পরিক্রমারত তীর্থযাত্রীদের জন্যে পরোটা-তরকারি বিলি করছেন। ড্রাইভার লোকটির বোধহয় খিদে পেয়েছে, সে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পরোটা-তরকারি আমাদের জন্যে এনে দিল, নিজেও দু’বার নিয়ে খেলো। যারা বিলি করছিলেন তাদের মধ্যে একজন আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, আরো পরোটা-তরকারি লাগবে কিনা। আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আর লাগবে না। আরো দশ মিনিট এগোবার পর দেখলাম রাস্তার পাশে আরেকটা জায়গায় মিষ্টান্নপ্রসাদ বিলি চলছে। ড্রাইভার লোকটি মহা পেটুক, গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে প্রসাদ নিতে গেল। যাবার আগে আমাকে বলেছিল, চলিয়ে বাবুজী। আমি বললাম, না, আমি খাবো না। গিন্নিকেও দেখলাম প্রসাদ নিতে চলে গেছে। বলেছিলাম খাবো না, তা সত্ত্বেও ড্রাইভার দৌড়ে এসে একটা শালপাতার প্লেটে আমাকে প্রসাদ দিয়ে গেল। একটু খেয়ে দেখলাম, বেশ মিষ্টি। আমার ব্লাড সুগার। তাই নেমে এককোণে ওটা ফেলে দিলাম। এভাবে গোবর্ধন পরিক্রমা একসময় শেষ হল। চিন্তা করতে থাকলাম শ্রীকৃষ্ণ কী করে এক আঙুলে এতবড়ো পর্বতটাকে উঠিয়েছিলেন! তবে কি ক্রেন দিয়ে ? তাই যদি হয় তবে যত বড়ো ক্রেনই হোক একসঙ্গে পাঁচশো-ছ’শো ক্রেন লাগবে। তখনকার যুগে যদি ইন্টারনেট থাকে, তবে তো ক্রেনও থাকতে পারে।
সেখান থেকে আমরা ছুটে চললাম রাবলের (Raval) দিকে। মথুরা থেকে রাবলের দূরত্ব ৯ কিমি। গোবর্ধন পর্বত থেকে রাবলের দূরত্ব ১৯ কিমির কাছাকাছি। রাবল হচ্ছে শ্রীমতি রাধিকার জন্মভূমি। এই রাবল থেকে নাকি শ্রীমতি রাধিকার মাতাপিতা বারসনাতে একসময় চলে গিয়েছিলেন। রাবল বা রাওল এক গ্রাম। রাস্তাঘাট ভালো না। রাস্তায় গোবরের ছড়াছড়ি। গ্রামের বেশ ভেতরে মন্দির। মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। মন্দিরে ভক্ত লোকজনের সমাগম প্রায় নেই বললেই চলে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রাবল থেকে বেরিয়ে এলাম। চললাম গোকুলের দিকে। রাবল থেকে গোকুলের দূরত্ব বেশি নয়, প্রায় ছয় কিমির কাছাকাছি হবে। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই গোকুল পৌঁছে গেলাম। শ্রীকৃষ্ণ সাত বছর বয়েস হওয়া পর্যন্ত এই গোকুলেই কাটিয়েছিলেন। এ জায়গা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যভূমি। গোকুলের মন্দিরগুলি পরিচালনা করার জন্যে একটা ট্রাস্ট আছে। আমাদের ড্রাইভার এই ট্রাস্টের লোকজনের হাতে আমাদের তুলে দিলো। ট্রাস্ট থেকে আমাদের একজন পাণ্ডা (ট্রাস্টেরই লোক) নিযুক্ত করে দিলো। গোকুল ধামের ভেতরে যাযার সময় গিন্নি পাণ্ডাটিকে জিজ্ঞেস করলো, বংশীবট কোথায়? পাণ্ডা আমাদের একটা বটগাছ দেখিয়ে বললো, এটাই বংশীবট, পাঁচ হাজার বছর পুরনো। চেয়ে দেখলাম, গাছটাকে দু’শো বছরের বেশি মনে হল না। তাই পাণ্ডাকে বললাম, এই গাছটার বয়েস মোটেই পাঁচহাজার হবেনা। পাণ্ডা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, মনে হল আমার মত অবিশ্বাসী লোক খুব কমই দেখেছে। কিছুক্ষণ পর পাণ্ডা উত্তর দিলো, হতে পারে আসল গাছটা মরে যাওয়ার পর, আরেকটা গাছ লাগানো হয়েছে। বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে আমাদের বলা হয়েছে এটাই বংশীবট। শুনে আমি আর কথা বাড়ালাম না। গোকুলের অলিগলিগুলি বেশ সরু, ঘরগুলি ছোট ছোট। পাণ্ডা বললো, জন্মাষ্টমীর দিন এখান থেকে দূরদর্শনে লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়। মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পাণ্ডা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের ঘটনাগুলি একে একে বলে যেতে লাগল। মন্দিরের সবকিছু বর্ণনা করতে করতে দেখাল। শেষে শ্রীকৃষ্ণের বালকমূর্তি দরজার সামনে আমাদের দাঁড় করালো। মন্দিরের দরজার সামনে পর্দা লাগানো, ভেতরের বালক শ্রীকৃষ্ণকে দেখা যাচ্ছিল না। সামনেই আরেকজন পাণ্ডা বসে আছে, তিনি আমাদের নিচে বসার জন্যে বলল। আমরা বসে পড়লাম। সেই বসে থাকা পাণ্ডা আমাদেরকে একদম সামনে এগিয়ে মাটির ওপর বসার জন্যে বললো। দেখলাম, সামনে প্রায় তিন ফুট বাই তিন ফুট জায়গা জুড়ে মাটির মেঝে। আমরা এগিয়ে গিয়ে মাটির ওপর বসলাম। বসে থাকা পাণ্ডাটি বললেন যে আমরা যে মাটির ওপর বসে আছি, একদিন এই মাটিতেই শ্রীকৃষ্ণ খেলা করতেন। মা যশোদা এই মাটিতে বসেই শ্রীকৃষ্ণকে দোলনায় দোলাতেন, মাখন খাওয়াতেন। আরো অনেক শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকালের কথা বলে গেলেন। গিন্নিকে দিব্যি করালো, চিরজীবন যেন স্বামীর সুখেদুঃখে সঙ্গ দেয়। তারপর আমাদের জিজ্ঞেস করলো, সাধ্যানুযায়ী কত কেজি মাখন বালক শ্রীকৃষ্ণের জন্যে উৎসর্গ করতে চাই। গিন্নি উত্তর দিলো, এক হাজার এক টাকা। পাণ্ডাটি জানালো, এত কমে তো হয় না, সর্বনিম্ন হলে দু’হাজার আটশো টাকা লাগবে। গিন্নি বললো, ঠিক আছে, দেবো। সঙ্গে সঙ্গে বসে থাকা পাণ্ডাজী মন্দিরের পর্দা খুলে দিল। দেখলাম ভেতরে দোলনায় বালক শ্রীকৃষ্ণ। আমাদেরকে দোলনার দড়ি দেওয়া হল। দড়িতে টান মেরে মেরে বালক শ্রীকৃষ্ণকে দোলালো গিন্নি। মন্দিরের এলাকার মধ্যেই ট্রাস্টের অফিস ছিল। আমরা ওখানে টাকা জমা দিলাম। ওরা একটা রসিদ দিল। ফেরার সময় আগের পাণ্ডাজী আমাদের কাছে কিছু পারশ্রমিক চাইল। একশো টাকা দিলাম।
তারপর আমরা ছুটলাম মথুরার দিকে। এখানে উল্লেখ্য যে মহম্মদ গাজী (১০১৭ সালে), সিকন্দর লোধি (১৫০০ সালে) এবং ঔরঙ্গজেব ( ১৬৬৯-৭০ সালে) দ্বারা মথুরা-বৃন্দাবনের প্রায় সমস্ত পুরনো মন্দিরগুলি বারে বারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। মথুরায় কেশব দেও মন্দিরের এলাকা বেশ বড়। বর্তমান মন্দিরগুলি জাহাঙ্গীরের আমলে রাজা বীর সিং বুন্দেলা নির্মাণ করেছিলেন। ঔরঙ্গজেব ১৬৭০ সালে মন্দিরগুলি দখল করে মন্দিরের একজায়গায় মন্দিরকে মসজিদে পরিণত করেছিল। এখন এখানে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে প্রচুর সেনাবাহিনির লোককে দেখলাম। চেকিং-ও একটু কড়াকড়ি। এখানেই কংসের কারাগার অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান। ভেতরে অনেক দেবদেবীর মূর্তি আছে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং শ্রী শঙ্করাচার্য একসময় এখানে এসেছিলেন। এখানেও পাণ্ডা নেই। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়।
মথুরা-বৃন্দাবনের বেশির ভাগ মন্দিরের দরজা সকাল আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে, বিকেলে আবার চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালে এই সময়টা এক ঘন্টা করে পিছিয়ে যায়।
পরদিন ভোরে কাছাকাছি এক কীর্তনের এক মোলায়েম সুরে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে তাড়াতাড়ি কিছু কাপড় কেঁচে নিলাম। গিন্নি আগেই উঠে পড়েছে। তারপর হোটেলের বাইরে বেরুলাম ব্রেকফাস্ট করার জন্য। আমরা যখন ইসকন মন্দিরের সামনে হেঁটে যাচ্ছি তখন দুজন কিশোরী হঠাৎ সামনে এসে আমার আর গিন্নির কপালে চন্দন-তিলক লাগিয়ে দিল। তারপর আমার কাছে লম্বা কিশোরীটি বিশ টাকা করে চাইল। তা শুনে অন্য কিশোরীটি বললো, দশ টাকা করে রেট, তুমি কেনো বিশ টাকা চাইছ। বাবুজী আপনি দশ টাকা করে মোট বিশ টাকা দিন। আমি ওদেরকে মোট বিশ টাকা দিয়ে বললাম, তুমি কেনো আমাকে এসব লাগিয়ে দিলে? বলেই আমি রুমাল দিয়ে চন্দন-তিলক মুছে দিলাম। গিন্নি কিন্তু মুছলো না।
ইসকনের সামনের একটা দোকানে পরোটা-তরকারি খাচ্ছিলাম। এইসময় হঠাৎ লক্ষ করলাম একজন সাহেব বৈরাগী এসে আমার সামনে তার পাত্র মেলে ধরেছেন। আমি দশ টাকা ফেলে দিলাম তার পাত্রে। উনি চলে গেলেন। অনেক বিদেশী লোক এখানে এসে বৈরাগী হয়ে মাধুকরী করে দিন গুজরান করছেন। এঁদের বেশির ভাগই প্রচুর ভোগবিলাসে বিতৃষ্ণা আসায় বৈরাগী ধর্মে আসক্ত হয়েছেন। এছাড়া আছে প্রচুর দেশী বৈরাগী-বৈরাগিনী। প্রায় প্রতিটি মন্দিরে দেশী বৈরাগী-বৈরাগিনী দেখেছি। কোনো কোনো জায়গায় তো সারি সারি। গিন্নি তো আগেই এদের দেবার জন্যে দশ টাকার বাণ্ডিল নিয়ে এসেছিল। তাতেও কুলালো না শেষে।
গতকাল রাতে একটুকুর জন্যে বেঁচে গিয়েছিলাম। রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন আচমকা একটা ঘূর্ণিঝড় এলো। আমি আর গিন্নি দৌড়ে সামনের একটা খাবার দোকানের ভেতরে ঢুকে গেলাম। দেখলাম ঝড়টা সামনের অনেক কিছুকে দুমড়েমুচড়ে ওড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঝড় থামলে আমরা রাতের ডিনার শেষে যখন হোটেলে ফিরছি তখন দেখলাম রাস্তার পাশের গাছের একটা বিরাট ডাল ভেঙে একটা মারুতি সুইফট গাড়ির ওপর পড়ে আছে। গাড়ির মাঝখানটা গাছের ডালের চাপে একেবারে চ্যাপটা হয়ে গেছে। গাড়ির আরোহীদের মধ্যে একজন মহিলার মাথায় আঘাত লেগে গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। ইলেকট্রিকের খাম্বা ও গাছ উপড়ে গাড়ির রাস্তাও বন্ধ। মিনিট দশেকের মধ্যে দমকল বাহিনি এলো এবং ভদ্রমহিলাকে আগ্রার হাসপাতালে নিয়ে গেল। ভাবলাম, এই কিছক্ষণ আগেও তো আমরা এই গাছের নিচ দিয়েই গেছিলাম। বেঁচে গেছি। পরদিন আবার ঝড় এসেছে রাতে। আমরা তখন প্রেম মন্দিরের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরদিন জানলাম এই দুদিনের ঝড়ে সমগ্র উত্তর ভারতে ১২৫ জনের মত মারা গেছে। গাছপালা এবং অন্যান্য সম্পত্তির অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বৃন্দাবনে আমরা ছিলাম ইসকন মন্দিরের কাছের এক হোটেলে। ওখান থেকে প্রেম মন্দির বেশ কাছে, হেঁটেই যাওয়া যায়। বাঁকে বিহারী এবং অন্যান্য মন্দিরও দূরে নয়। প্রচুর ই-রিক্সা ও অটো দাঁড়িয়ে থাকে। শেয়ারে বা রিজার্ভ করে ঘোরা যায়। রিজার্ভ করলে স্পট প্রতি একশো টাকা। পাঁচটা স্পট দেখলে পাঁচশো টাকা, সাতটা স্পট দেখলে সাতশো টাকা। বৈষ্ণোদেবীর মন্দির একটু দূরে, গোবর্ধন যাওয়ার পথে পড়ে। বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরের কাছাকাছি দেখার মত আরেকটা মন্দির আছে। গাড়িওয়ালারা সাধারণত এ মন্দিরগুলিগুলি দেখার জন্য গোবর্ধন যাওয়ার পথে বা ফেরার পথে থামায় না। এটা ওদের ব্যবসায়িক কায়দা। তবে হাতে সময় থাকলে এবং ড্রাইভারের সাথে আগেই কন্ট্রাক্ট করে নিলে এই দুটো মন্দির গোবর্ধন যাওয়ার পথেই ঢুকে দেখা যায়।
বৃন্দাবন ও মথুরায় অসংখ্য মন্দির। আনাচেকানাচে ডানেবাঁয়ে কত যে মন্দির গজে ওঠেছে তার কোনো হিসেব নেই। দিনে দিনে মন্দিরের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। সব মন্দির দেখার কোনো দরকারও নেই। পুরনো ঐতিহাসিক মন্দিরগুলি দেখলেই হয়, সেই সঙ্গে কিছু ট্যুরিস্ট স্পট। যেমন বাঁকে বিহারী মন্দির, শ্রীশ্রী রাধাদামোদর মন্দির, মদনমোহন মন্দির, গোবিন্দদেব মন্দির, ইসকন মন্দির, প্রেম মন্দির, বৈষ্ণোদেবী মন্দির, পাগলবাবা মন্দির, রাধাবল্লভ মন্দির, কেশীঘাট, রাধারমণ মন্দির, সেবাকুঞ্জ এবং নিধিবন। মোগল আমলে একসময় রাজপুত রাজাগণ সুরক্ষার জন্যে রাধাদামোদর, গোবিন্দদেব, গোপীনাথ, মদনমোহন ইত্যাদি বিগ্রহগুলি বৃন্দাবন থেকে রাজস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন, পরে ১৭৩৯ সালে এই বিগ্রহগুলিকে আবার বৃন্দাবনে ফেরত নিয়ে আসা হয়।
বাঁকে বিহারী মন্দিরে অজস্র ভক্তদের ভিড়। মন্দিরে যাবার রাস্তাও প্রশস্ত নয়। মন্দিরের ভেতরে ভক্তদের ঠেলাঠেলি। তাড়াতাড়ি ভোগ করিয়ে দেবার জন্যে ব্রাহ্মণ গাইড পঞ্চাশ টাকায় পাওয়া যায়। এদেরকে বললে বাঁকে বিহারীর কাছে ভক্তদের অর্পিত একটা-দুটো ফুলের মালাও আপনাকে এনে দেবে। এখানের বানরগুলি খুব বদমাশ। কেন জানি এখানকার বানরগুলি চশমা পরা লোক দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে চশমা ছিনিয়ে নিয়ে ভেঙে ফেলে। আমার আর গিন্নির দু’জনের চোখেই চশমা। আমরা ভেতরে যখন যাচ্ছিলাম তখন সবাই আমাদের সাবধান করছিল চশমা খুলে ফেলার জন্যে। আমরা খুলেও নিয়েছিলাম। একটু অসুবিধে হচ্ছিল। তারপর মন্দির থেকে বেরিয়ে আসার সময় ভাবলাম এবার চশমাটা পরে নিই। আর চশমাটা পরে যেই দু’কদম এগিয়েছি অমনি কোত্থেকে একটা বড় বানর সেকেণ্ডের মধ্যে লাফ মেরে আমার ঘাড়ের ওপর বসে চশমাটাকে ছিনতাই করতে চাইল। আমি অবশ্য বানরটাকে আগেই এক ঝলক দেখতে পেয়েছিলুম বলে চশমাটা তৎক্ষণাৎ খুলে নিচে নামিয়ে এনেছিলাম। সেজন্য ও নিতে পারেনি। নিতে না পেরে সেকেণ্ডের মধ্যেই আমার ঘাড় থেকে লাফ মেরে সরে গিয়েছিল। সেখান থেকে চলে আসার সময় পেছন থেকে কে জানি বলছিল, আরে আপনি দেখি শচীন তেণ্ডুলকারকারের মত খেললেন। আরেকদিন ই-রিক্সায় চড়ে নিধিবনের দিকে যাচ্ছিলাম। রাস্তা জ্যাম ছিল কিছুক্ষণ, তাই ই-রিক্সাটা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এমন সময় একটা অপ্রাপ্তবয়স্ক বানর লাফ মেরে ই-রিক্সায় উঠে গিন্নির চশমার দিকে আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়েছিল। গিন্নি একটু চেঁচিয়ে উঠতেই বানরটা পালিয়ে গেছিল। এই বানরটা অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে ছিনতাইয়ের কায়দা ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারেনি। ধাড়ি বানরগুলি নাকি বুকপকেট থেকে অনেকেরই মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। টুপি ছিনিয়ে নিতে দেখেছি। জুতোও নিয়ে যায়। গিন্নি যমুনাঘাটে একটু জুতো খুলে রেখেছিল, এই ফাঁকে এক বানর দৌড়ে এসে একটা জুতো নিয়ে চলে গিয়েছিল। নিধিবনে পঞ্চাশ টাকায় গাইড পাওয়া যায়। গাইড আপনাকে যেসব গল্প বলবে তা অবিশ্বাস করলেও চুপচাপ শুনে যান, কারন গাইডরাই আপনাকে বানরের হাত থেকে রক্ষা করবে। যমুনা নদীতে নৌকোবিহারের জন্যে কেশীঘাটের অনেক জায়গায় নৌকো পাওয়া যায়। একটা নৌকোর মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাড়া কতো, কতোক্ষণ সময় নিয়ে ঘোরাবে? মাঝি বললো, ভাড়া একশো আশি টাকা, আর সময় নেবে চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট। উঠে পড়লাম নৌকোয়। যমুনা নদীর জলের রং কালো। হাতে নিলে আবার পরিষ্কার মনে হচ্ছিল। তবে জলটা যে দূষিত তাতে সন্দেহ নেই। যাহোক নৌকো করে যেতে যেতে মাঝি আমাদের বিভিন্ন ঘাটের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। জলে অনেক মাছ ও কচ্ছপ দেখলাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে এলাম। নৌকো থেকে নেমে আমি মাঝিকে একশো আশি টাকা দিলাম। মাঝি বললো, তিনশো ষাট টাকা হয়েছে, জনপ্রতি একশো আশি টাকা করে। আমি ওকে বললাম, আশ্চর্য, জন প্রতি একশো আশি টাকা তা তুমি আগে বলো নি কেনো? আমাদের কথা শুনে অন্যান্য মাঝিরাও এসে উপস্থিত। শেষে তিনশো ষাট টাকাই দিতে হল।
ঐতিহাসিক নয় এমন নতুন মন্দিরগুলির মঘ্যে ইসকন এবং প্রেম মন্দিরের নাম করা যায়। প্রেম মন্দিরে রাত সড়ে সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত মিউজিক্যাল ফোয়ারা এবং ফোয়ারার জলের ওপর ভক্তিমূলক শর্ট ফ্লিম প্রদর্শিত হয়।
সারাবছর ধরে বৃন্দাবন-মথুরায় দেশ-বিদেশ থেকে ভক্তদের আনাগোনা চলে। এখানে এসে ভক্তগণ ঠিক কী পান জানিনা। আমি কিছু পাওয়ার আশা করে এখানে আসি নি। গিন্নিকে সঙ্গ দিয়েছি, দাম্পত্য জীবনকে ভালোবাসি বলে। তাই এই ভ্রমণের জন্যে কাউকে কৈফিয়ত দিতে রাজি নই।