পশুপতির জামাই – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

পশুপতির জামাই

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

বলি কোন ভাতারের কথা মনে পড়ছে শুনি? বার বার তালে ভুল! কি করে গান গাইবো? রেগে গিয়ে হলুদ শাড়ি পড়া হিজড়েটার উপর চোটপাট শুরু করে সোহিনী। সোহিনীর কথায় রা দেয় না, মুখ নামিয়ে বসে থাকে সে। ঘর থেকে এতক্ষণ সোহিনীকেই দেখছিল পশুপতি। বাড়িতে হিজড়ে আসায় বেজায় চটেছে পশুপতি, সে কথা ঠিক। তবে ওই সোহিনী বলে হিজড়েটাকে দেখতে দারুণ। আকাশী রঙের শাড়িতে অসাধারণ দেখতে লাগছে। এইবার হলুদ শাড়ি পড়া হিজড়েটার দিকে দৃষ্টি ফেলে পশুপতি। সোহিনীর ধমক খেয়ে ম্রিয়মাণ। বয়স বড়ো জোর ষোলো কি সতেরো হবে। এখনো কথার উপর কথা দিতে শেখেনি। নয়তো সোহিনীকে দু কথা সেও শোনাত ঠিক। হিজড়ে তো। মুখে ধান দিলেই খই, জানে পশুপতি। ওদের দু জনের থেকে তফাতে দাঁড়িয়েছিল আরো একজন হিজড়ে। বয়স পঞ্চাশ তো হবেই। পান চিবোচ্ছে। বেশ খানিকটা পিক ফেলে উঠানের একপাশে। দেখে গা ঘিন ঘিন করে পশুপতির। বাকি পিকটুকু মুখে নিয়েই সোহিনীকে বলে, দাঁড়া লো সোহিনী ওকে কয় বছর সময় তো দিবি। সবে এসেছে। এই সময় চেনা মানুষ দেখলে এমন মন খারাপ সবার হয়। বাপ ভাইয়ের কথা মনে বাজে। তুই কি পেরে ছিলি? প্রথম প্রথম তো বাড়ি ফিরে যাবি বলে জেদ নিয়ে বসে থাকতিস। সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হবে। সোহিনী বলে বাপ ভাই ছেড়েই সবাই আসে লো গঙ্গামাসী। তোর পীড়িতে মজে কেউ বাড়ি ছাড়ে না। বাড়ির লোক, আত্মীয়, পাড়ার লোক, গ্রামের লোক দুর দুর করে বলেই তো ঢোল কাঁধে নিয়ে ছেলে নাচাতে বের হতে হয়। কাজের কাজটা তো করবে মন দিয়ে। ভালো না লাগে নতুন ভাতার খুঁজে ঘর বাঁধলেই চলে, হ্যাঁ। গঙ্গার পাশে চুপটি করে বসে থাকে হলুদ শাড়ি পড়া হিজড়েটি। গঙ্গা আরো খানিকটা পানের পিক ফেলে ঢোলটা নিজের কোলে নেয়। বলে দেখ, বাজানো তোর মনের মত হয় কিনা।

পশুপতির নাতিকে নাচাতে এসেছে তিনজন হিজড়ে। গান শুরু হতেই তাল কাটে। সেই নিয়েই কথা কাটাকাটি চলে ওদের মধ্যে। ঘরের ভিতর থেকে শুনছে পশুপতি। বলছে বেশি সোহিনীই। দেখতেও যেমন, কথার ঝাঁঝও আছে তেমনই। বয়স পঁয়ত্রিশ কি সামান্য কম বেশি হতে পরে।  এক নজরে মনে হবে পঁচিশ। চোখ আটকে যায় সোহিনীর শরীরে। দেহের উঁচু নিচুর এমন নিখুঁত নির্মাণ খুব কমই দেখা যায়। এত কিছুর পরেও খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় চেহারায় পুরুষ বর্ণের আঁচড় আছে। সে যাই হোক দেখবার মত শরীর বটে। হলুদ শাড়ি পড়া হিজড়েটির উপর ভীষণ বিরক্ত সোহিনী। আজ পথে কোথাও তার পরিচিত জনকে দূরের থেকেই দেখেছে হলুদ শাড়ি পড়া হিজড়েটি। সদ্য ফেলে আসা অতীতের বাতাসে তোলপাড় তার মন। আনমনা তাই। ঢোল বেতালে বাজে। সেই নিয়েই অশান্তি। গানে সুর আসেনা সোহিনীর। বেশ খাপ্পা হয়ে উঠেছে। পশুপতির মনে হয় হলুদ শাড়ি পড়া হিজড়েটির গঙ্গার দাঁড়ে মন বসেনি এখনও।

বড়ো অদ্ভুত লাগে এদের। দু একজন হিজড়ের কথা শুনেছে পশুপতি। কে বলেছিলো মনে নেই। তবে শেষ যে ঘটনাটা শুনেছিলো বীরভূমের কোন এক গ্রামের। মেয়ে বড়ো হলো মেয়ের মতই। বাপ, মা ভাই সবাই ছিলো। বয়সের সঙ্গে শরীরে ডাল, পালা, ফুল সবই গজালো আর পাঁচটা মেয়ের যেমন হয়। বয়ঃসন্ধি এলো। মেয়ের ঋতুমতী হবার নাম নেই। গ্রামের মানুষ। তাবিজ মাদুলি করে শেষে মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় বাড়ির লোক। ডাক্তার শোনায় অন্য কথা। বলে ওর শরীরে পুরুষের অঙ্গও আছে! বাইরে নয়। শরীরের ভিতরে। রজস্বলা হবার সম্ভাবনা নেই। মেয়ে মানুষ, ঋতুমতী হবে না! কেমন মেয়ে? কথাটা চাপা থাকেনি। ব্যস। শুরু হয় সেই মেয়ের উপর শারীরিক নির্যাতন। মানসিক যন্ত্রণা ও কম পায় না মেয়েটি। সহ্যের সীমা ছাড়ায়। আত্মীয় স্বজন পরিবার ফেলে বাধ্য হয় গঙ্গামাসির মত কারোর হাত ধরতে। নিজের কারবারে গ্রামে গঞ্জে ঘোরে পশুপতি। এমন কথা শুনেছে বেশ কয়বার।

এই কয়দিন পশুপতি দু একবার ভেবেছে হিজড়েদের কথা। ওদের দুঃখ বা কষ্টের কথা নয়। নিজের অদৃষ্টের কথা ভেবেছে।পশুপতির মেয়ে পুত্র সন্তান প্রসব করেছে। তাই যেকোনো দিন ওরা আসবে। হাজার বিশ টাকা দাবি করে মেরে ফেলবে পশুপতিকে। আজ পশুপতিও বাড়ি ফিরেছে। হিজড়েরাও হাজির।
খানিক আগেই তারকেশ্বর থেকে ফিরেছে পশুপতি। ভাগ্নের বউভাত ছিলো গতকাল। যেতেই হয়। কাজের বাড়ি। সারারাত জেগেই কাটিয়েছে সেখানে। বাড়ি ফিরেছে একটু আগে। কিছু সময় পরেই ঢোল বাজিয়ে হাজির তিন জন হিজড়ে। মাথায় বাজ পড়ে পশুপতির। একেই আজ বছর দুয়েক তার ধানের কারবারে মন্দা। এরই মাঝে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে। মেয়ে সন্তান সম্ভবা হবার পর থেকে তার দায়ও এসে পড়েছে পশুপতির উপর।
দিন বারো হলো পশুপতির মেয়ে ছেলে কোলে নিয়ে বাড়ি এসেছে। নার্সিংহোমের খরচ পশুপতিকেই দিতে হয়েছে। আজ আবার খরচ। বিশ হাজারের নিচে রফা হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। মনে মনে জামাইকে গালাগালি দেয় পশুপতি। শালা, পুলিশের চাকরি। শরীরে আহা মায়া নেই! শহরের উপর বাড়ি। হাত বাড়ালেই ডাক্তার, গাড়ি সব পাওয়া যায়। তবুও হাত পা ঝেড়ে সব কিছু চাপিয়ে দিলো শ্বশুরের উপর।

ওদিকে গঙ্গামাসির হাতের চাপড়ে বেজে উঠেছে ঢোল। গান ধরেছে সোহিনী। পাড়ার ছেলে ছোকরার দল ভিড় জমিয়েছে পশুপতির বাড়ির উঠানে। বাদ যায়নি বউ মেয়েরা। কয়েক জন অতি উৎসাহী ফচকে ছেলে আবার নাচ গানের মুহূর্তটিকে ধরে রাখছে নিজেদের মোবাইলে। খানিক পরেই ছড়িয়ে পড়বে নেট দুনিয়ায়। আমাদের গ্রামে হিজড়েদের নাচ গান। ওহ, কি কাল এলো। ঘোর কলি। ছেলে পিলে সিটি মারছে। গা জ্বলে যাচ্ছে পশুপতির। বারণ করবে কাকে!

বারান্দার সামনেই বসে পশুপতির মেয়ে অনিতা। কোলে ছেলে। পাশেই বসে পশুপতির বউ। ঘর থেকে চোখের ইশারায় বউকে কাছে ডাকে পশুপতি। শুরু থেকে হিজড়েদের কথায় অত গলে জল হওয়া ঠিক নয়। গম্ভীর না থাকলে শেষে দরাদরি করা যাবে না। কথাটা বউকে বলে দেবার প্রয়োজন। পশুপতিকে ইশারা করতে দেখে ওর বউ মাথা নাড়ে। মানে সময় নেই। ভিতরে ভিতরে ফুঁসে ওঠে পশুপতি। ওহ্, হিজড়েদের আশীর্বাদ পেয়ে নাতি আজই বিধান রায় হবে। তোমাদের আর কি। লাগে টাকা দেবে পশুপতি। আবার হাজার কুড়ি চলে যাবে। সত্যি কপাল করে জামাই পেয়েছে পশুপতি।

অনিতার বাচ্ছা হবার পর থেকে এই কদিনে বউকে হাজার বার বলেছে পশুপতি। আজ নয়ত কাল বাড়িতে হিজড়ে আসবেই। অনিতাকে বলবে। জামাইকে যেনো কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে বলে। নয়তো একা পশুপতির পক্ষে সম্ভব নয়। শুনে বউ বলেছিলো অত ভয় পাচ্ছো কেনো। তোমার জামাই পুলিশ। তেমন তেমন দেখলেই ফোন করবে অনিতা। ঠিক ব্যবস্থা হবে। বউয়ের কথা শুনে মনে মনে হেসে বাঁচে না পশুপতি। হিজড়েদের কাছে আবার পুলিশ! দাবি মতো টাকা না পেলে খিস্তি খেউড় করে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে ওরা। এখানে তো আর ছেলের বাপকে পাবে না, পশুপতির পিণ্ডি চটকে দেবে। কপাল করে জামাই পেয়েছে পশুপতি। কোনো দায়িত্ব বোধ নেই! কিছু বললেই ঠিক কোনো অজুহাত খাঁড়া করে দেবে।

এইতো, অনিতার সন্তান হবার খবর পেয়ে মেয়ের বাড়ি গিয়েছিল পশুপতি। বলেছিলো তোমার শহরের উপর বাড়ি। সমস্ত সুযোগ সুবিধা হাতের মুঠোয়। একজন সর্বক্ষণের কাজের মেয়ে রাখলেই হলো। বিধবা মা আর অনিতা কারোর অসুবিধা হবে না। শুনে পশুপতির জামাই বলেছিলো, কি বলি, আমার থানার ডিউটির তো আর রাত দিন নেই। আর মায়ের মাথার সামান্য প্রবলেম আছে। কোন ভরসায় অনিতাকে এই অবস্থায় মায়ের কাছে একা রেখে যাবো। জামাইয়ের মায়ের মাথার যে সামান্য সমস্যা আছে কথাটা বিয়ের পর বাপের বাড়ি এসে অনিতাও বলেছিলো। জামাইয়ের মুখেই শুনেছে অনিতা। মেয়ের শোকে অনিতার শাশুড়ি মাঝে মধ্যেই থম মেরে থাকে। মুখের কথা হারিয়ে যায়। কতো দিন আগের ঘটনা। আজও সেই সব কথা দুঃস্বপ্নের মতই ধেয়ে আসে পশুপতির বেয়ানের মনে। কেমন বেভোল হয়ে বসে থাকে। কথাটা চিন্তায় ফেলেছিলো পশুপতিকে। ব্যাপারটা মেয়ের বিয়ে দেবার আগে জানা হয়নি। কি বিপদ। ছোটো সংসার, শহরের উপর বাড়ি, ছেলের চাকরি দেখে লাফিয়ে উঠেছিল পশুপতি। অনিতার বিয়ের পাকা কথা থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত জামাইয়ের বন্ধু আর সহকর্মীরাই তো দেখভাল করছিল সব কিছুর। পশুপতির জামাইয়ের তরফের আত্মীয় স্বজন দু একজনকে দেখেছিলো বলে মনে নেই পশুপতির। বিয়েতে বাড়ির লোক থাকবে না! জামাই বলেছিলো আত্মীয় থাকলেই যন্ত্রণা। কেউ কাজের নয়। শুধু বিপদে ফেলার ফন্দি। তাছাড়া পারিবারিক কারণেই নাকি যোগাযোগ রাখে না। কে জানে। সত্যি মিথ্যা তলিয়ে দেখেনি পশুপতি। তবে বাড়ির লোকের সঙ্গে গল্প গুজব করলে কথায় কথায় সত্যিটা মেয়ের বিয়ে পাকা করবার আগে নিশ্চয় আগেই জানতে পারত পশুপতি। ইস। বেশ সমস্যার কথা। মেয়ের শাশুড়ির মাথার গণ্ডগোল! শেষে মেয়ের কি বিপদ হয় কে জানে। ব্যাপারটা জানা প্রয়োজন। কথায় কথায় প্রসঙ্গটা তুলেছিল পশুপতি জামাইয়ের কাছে। জামাই বলে বছর বিশ বাইশ বছর আগের ঘটনা। মেয়েকে হারানোর যন্ত্রণা মা ভুলতে পারেনি আজও। আপন মেয়ের চলে যাওয়া কেউ কি মানতে পারে। কারোর শূন্যস্থান ভরাট হয়না সংসারে। সে কথা সত্যি। পশুপতির জামাই তখন বছর সাত কি আটের ছেলে। কি করে কি হয়েছিল বোঝেনি সে দিন। তবে মনে আছে সে ভীষণ অভিসম্পাতে বিপর্যস্ত তাদের পরিবার। ঘরে বাইরে যন্ত্রণা অসহনীয়। শেষে জামাইয়ের বাবা গ্রামের বাড়ি ঘর ছেড়ে এসে আসানসোলে বসবাস শুরু করে। আত্মীয় স্বজনদের থেকে যতো দূরে থাকা যায়, ততই জামাইয়ের মায়ের মঙ্গল। এমনটাই বলেছিলো ডাক্তার। এ কথা শুনে খানিক স্বস্তি পেয়েছিলো পশুপতি। যাক, যেমন ভেবেছিলো তেমন পাগল নয়। মাথার সামান্য ব্যামো।

পর পর কয়েকটা গান নেচে নেচে গেয়ে থেমেছে সোহিনী। ভিড় থেকে কে একজন একটা বাজার চলতি হিন্দি গানের ফরমায়েশ করে। গঙ্গামাসী বলে, দে লো সোহিনী গান শুনিয়ে। তোর রসের নাগর এসেছে। সোহিনী বলে ফেলো না দেখি একটা পাঁচশ টাকার পাতি। রসে ভেজা গান শোনাবো। কথাটা শুনেই পশুপতির বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে। খানিক পরেই টাকার খাঁড়া নেমে আসবে পশুপতির গলায়। কপাল করে জামাই পেয়েছে বটে! আজ অব্দি অনিতার জন্য এতো টাকা খরচ করে ফেললো পশুপতি। আর জামাই মাঝে একদিন এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে এলো। ছেলেকে দেখলো। চলে গেলো। ব্যস, কর্তব্য শেষ। পশুপতির জামাইয়ের চোখের চামড়া নেই!

কই গো গিন্নি মা নাতিকে কোলে দাও। আর সর্ষের তেল নিয়ে এসো। অনিতার কোল থেকে বাচ্ছা নিয়ে সোহিনীর কোলে দেয় পশুপতির বউ। সামলে বাবা, বাচ্ছা নয়তো ননীর পুতুল। হ্যাঁ গো হ্যাঁ, ছেলে নাচিয়ে বুড়িয়ে গেলাম। কোনো ভয় নেই তোমার। সোহিনীর হাতে তেল দেয় পশুপতির বউ। অনিতার ছেলের মাথার তালুতে তেল বুলিয়ে দেয় সোহিনী। উঠানের ভিড়ের থেকে কোন এক মহিলা বলে দেখো বাপু সাবধানে, ছেলের যেনো তালু বসে না যায়। ধেয়ে আসা কথার দিক ধরে ঘাড় ঘোরায় সোহিনী। বলে, কে রে পুত বিয়ানি? জ্ঞান দিতে এসেছে। একটা হাসির ফুলকি জেগে ওঠে ভিড়ের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে পশুপতির বউ। যাও না বাপু এবার। অনেক দেখেছো। এইবার নাতিকে আশীর্বাদটুকু করতে দাও। হাসির ফুলকি নিভে যায়। ঢোল বেজে ওঠে আবার। দু লাইন গান ধরে সোহিনী। আশীর্বাদ পর্ব মেটে। কই গো বাড়ির কর্তা। বাইরে এসো। কথাটা কানে যেতেই মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে পশুপতির। একটা ভয়ও আসে মনে। কতো টাকা চাইবে কে জানে! বারান্দায় এসে দাঁড়ায় পশুপতি। এগিয়ে আসে সোহিনী। গঙ্গার কথা শুনে হলুদ শাড়ি পড়া হিজড়েটিও এসে দাঁড়ায় সোহিনীর পাশে। পশুপতির সামনে হাত পাতে সোহিনী। বলে দাও গো কর্তা, মনের ঘড়া উপুড় করে দাও। তাতেই আমি খুশি। কতো দিতে হবে? রাগত স্বরে জিজ্ঞাসা করে পশুপতি। সোহিনী বলে অতো রাগ কেনো গো? আমায় পছন্দ হয়নি! একদম বাজে কথা বলবে না। আমার জামাই পুলিশ। এই পাঁচশ দিচ্ছি। নিয়ে রাস্তা দেখো। বলে পশুপতি।

— শোন লো গঙ্গামাসী, মিনসের কথা শোন! এ্যাই, আমি ভিক্ষা চাইছি? এতক্ষণ তো দু চোখে গিলে খেলে আমার শরীরটা। দেখিনি মনে করছ। সোহিনীর কথায় হাসির ফোয়ারা ছোটে উঠানে। লজ্জায় চুপসে যায় পশুপতি। কি বলবে ভাবছে। আর ঠিক তখনই পশুপতির বাড়িতে আসে পশুপতির জামাই আর বেয়ান। বাড়িতে এই সময়ে জামাইকে দেখে অবাক হয় পশুপতি। আজ অনিতার শাশুড়ি কে নিয়ে জামাইয়ের আসবার কথা ছিল। গতকাল বাড়িতে না থাকায় সে সংবাদ শোনা হয়নি পশুপতির। জামাইকে দেখে সাহস পায় বুকে। বলে এই দেখো…।

বাড়ির পরিস্থিতি বুঝতে অসুবিধা হয়না পশুপতির জামাইয়ের। হিজড়ে দেখেই ভীষণ জোরে চিৎকার করে ওঠে। একদম মেরে ফেলবো। এখুনি ভাগো, নয়তো থানায় খবর দিয়ে অ্যারেস্ট করিতে দেবো। ভাগো। রাগে লাল হয়ে ওঠে পশুপতির জামাই। কাঁপতে থাকে থর থর করে। ওদিকে নাতিকে দেখার আগেই বাড়ির পরিস্থিতি দেখে সংজ্ঞা হারায় পশুপতির বেয়ান। কি বিপদ। পশুপতির বউ বেয়ানের চোখে মুখে জল দেয়। টেবিল ফ্যানটা বেয়ানের মাথার সামনে চালিয়ে দেয় পশুপতি। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে হিজড়ে তিনজন। পাড়ার লোক জন ফিসফিসিয়ে বলে পশুপতির জামাইয়ের মাথায় ছিট আছে। নয়তো হিজড়ে দেখে কেউ এমন করে! চেয়ারে বসে হাঁপাতে থাকে পশুপতির জামাই। শ্বাস নেয় ঘন ঘন। এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসে। অনিতা তার স্বামীকে বলে শান্ত হও তুমি। অমন করছো কেনো? চলে গেছে ওরা। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। টেনশন করছো কেনো? তুমি…।

পশুপতির বাড়ির বাইরে এসে গঙ্গা বলে পুলিশের ভয়ে তুই টাকা ছেড়ে দিলি সোহিনী! নীরব থেকে মাথা নাড়ে সোহিনী। অর্থাৎ পুলিশের ভয় নয়। নিজের বাম হাতের অনামিকার সোনার আংটিটা খুলে গঙ্গার হাতে দেয়। বলে বাচ্ছাটার মায়ের হাতে দিবি গঙ্গামাসী। অবাক হয় গঙ্গা। বলে কেনো! কথা নেই সোহিনীর মুখে। দু চোখের কোল ছাপিয়ে বান ডাকে। পশুপতির বেয়ানকে দেখে কেঁপে উঠেছে সোহিনীর বুক। মনে পড়েছে ফেলে আসা পরিবার আর আপনজনদের কথা। ছেলেবেলার সেই গ্রাম, বাবা, হাজারো স্মৃতির কোলাজ ভেসে আসে দুচোখের সামনে। পশুপতির জামাই সোহিনীর চেনা। বড্ড চেনা। সোহিনীর দেওয়া সোনার আংটি নিয়ে পশুপতির বাড়ির ভিতরে যায় গঙ্গা। হলুদ শাড়ি পড়া হিজড়েটিকে জড়িয়ে ধরে সোহিনী। বলতে না পারা সহস্র কথা আটকে রয়েছে গলায়। সোহিনী ফোঁপাতে থাকে। অবুঝ কান্না ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় সোহিনীকে।