
অচেনা মুখ (অনুগল্প)
সদানন্দ সিংহ
বিকেলবেলা। আমার অর্ধাঙ্গিনী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে চেঁচাল, বাজারে যাচ্ছি, ঘরে শাকসবজি কিছুই নেই। দরজাটা টেনে যাচ্ছি, তুমি ছিটকিনি মেরে দিও।
আমিও ভেতর থেকে চেঁচালাম, ঠিক আছে। দিচ্ছি।
দিচ্ছি বললাম বটে, কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। একটু ঘুমও পাচ্ছে। তাছাড়া উঠে, লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে দরজার ছিটকিনি লাগাতে আমার এখন একটু কসরত করতে হবে। তিন সপ্তাহ আগে আমার ডান পা এক দুর্ঘটনায় ফ্র্যাকচার হয়ে গেছিল। ফলে চার পেয়ে ওয়াকারের সাহায্যে গিয়ে এক পা দিয়ে লাফিয়ে হেঁটে আমাকে দরজাটা বন্ধ করতে হবে। ভাবলাম, একটু পরে বন্ধ করি। এইসময় আমার চোখ দুটো লেগে গেল। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেল। ঠিক তখন আমি কলিং বেলের আওয়াজ শুনলাম। আমি বিছানায় উঠে বসলাম, কে আবার এল ! আবার কলিং বেলের আওয়াজ হল। আমি ওয়াকারটা টেনে লিভিং রুম থেকে আস্তে আস্তে বেরুচ্ছিলাম। ঠিক তখনই দেখলাম একটা লোক দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে লিভিং রুমের দরজায় এসে পড়েছে। আমাকে দেখে লোকটা একটু থমকে গেল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই বদনখানিতে এক চওড়া হাসি এনে লোকটি বলল, আমায় চিনতে পারছেন স্যার ? কিন্তু স্যার, আপনার পায়ে ব্যান্ডেজ, কী করে এ অবস্থা হল ? আহা-হা, খুব ব্যথা হচ্ছে নিশ্চয় ?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি ? দরজা ঠেলে কেন ঢুকে পড়েছেন ?
লোকটি বলল, আমাকে চিনতে পারছেন না স্যার ? কুড়ি বছর আগে আপনার বিল্ডিং তৈরি করার সময় আমি কিছুদিন কাজ করেছিলাম। তখন আপনি আপনার ছেলেমেয়ের অনেক পুরনো স্কুলের বই আমার ছেলের জন্যে দিয়েছিলেন। সে বইগুলি আমার ছেলের খুব কাজে লেগেছিল।
কুড়ি বছর আগের কথা আমার সঠিক মনে পড়ল না। হয়তো বইগুলি দিয়েছিলাম।
লোকটি আবার বলল, দশ বছর আগেও এসেছিলাম, আমার মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য চাইতে। আপনি তখন টাকা দিয়ে সাহায্যও করেছিলেন।
আমার ঠিক মনে পড়ছিল না। হয়তো করেছিলাম। তাই বলে বিনানুমতিতে বন্ধ দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে ঘরের আরো ভেতরের দিকে কেউ এগোয় নাকি ? লোকটার কি অন্য উদ্দেশ্য আছে ? এছাড়া লোকটাকে তো চিনতেই পারছি না। ইদানীং আমাদের পাড়ায় দিনে দুপুরে ঘর থেকে মোবাইল হাওয়া হয়ে যাচ্ছিল।
আমি তাই বললাম, চলে যাও এখন।
লোকটা আর কথা বলল না, ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে গেল।
লোকটা চলে গেলে আমি লোকটার মুখটাকে আবার মনে করার চেষ্টা করলাম, লোকটার মুখটাকে চেনা চেনা লাগছে কি ? হয়তো, হয়তো চেনামুখ ছিল, কোনো এক সময়। কিন্তু পরিস্থিতির জোরে অন্য রকম ডাইমেনশানে চেনামুখও কোনো কোনো সময় অচেনা হয়ে যায়। অচেনা মুখ নিয়েই তখন বেঁচে থাকতে হয়।