কালাবাবুর রকমসকম – সদানন্দ সিংহ

কালাবাবুর রকমসকম – সদানন্দ সিংহ

কালাবাবুর রকমসকম        (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

বিকেলবেলায় রোদের সে তেজ আর থাকে না। তখন ছাদের ওপর এসে পাখিরা কিচির কিচির করে। পাখিদের সে ডাক শুনতে পান না কালাবাবু, তবু সঠিক সময়ে এক বাটিতে চাল এবং দু লিটার বোতলভর্তি জল নিয়ে ছাদে যান প্রতিদিন। ছাদে গিয়ে পাখিদের জন্য রাখা পাত্রে জল ঢালেন। তারপর পাখিদের দিকে চালগুলি ছুঁড়ে দেন। সাধারণত কবুতর, শালিখ, চড়ুই পাখিরাই থাকে। মাঝে মাঝে অন্য প্রজাতির পাখিরাও আসে। অপেক্ষারত পাখিরা ওড়ে এসে টুকুর টুকুর করে চালগুলি খায়, পাত্রে রাখা জল পান করে। পাখিদের খাওয়া দেখে কালাবাবু খুশি হন। আসলে তিনি পাখিদের ভালোবাসেন। পাখিদের খাইয়ে তিনি এক তৃপ্তি পান।
কালাবাবুর পুরো নাম কালাচান শর্মা। সরকারি চাকুরি থেকে দু বছর হল অবসর নিয়েছেন। স্টেনোগ্রাফার হিসেবে চাকুরিতে ঢুকেছিলেন, চাকুরি জীবনের ছ বছর আগে প্রমোশন পেয়ে গেজেটেড অফিসার হয়েছিলেন। গেজেটেড অফিসার হয়ে প্রমোশন পাওয়ার পর অফিসে যাওয়া-আসা এবং অফিসের অন্যান্য কাজের জন্য তাঁকে একটা কার দেওয়া হয়েছিল অফিস থেকেই। সেই কারের ড্রাইভার বন্ধের দিন বাদে প্রতিদিন সাড়ে নয়টার দিকে কালাবাবুর বাড়ির সামনে এসে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করত। এতে পাড়ার লোকদের কাছে কালাবাবুর মানটা হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল। তখন পাড়ার লোকেরা তার সাথে এক সম্ভ্রমের চোখে কথাবার্তা বলত। চাকুরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পাড়ার লোকদের সে সম্ভ্রমটা উবে গিয়েছিল। এটা নিয়ে অবশ্য কালাবাবুর কোনো দুঃখ নেই। তিনি বোঝেন, চাকুরি জীবন শেষ হবার পর পিওন-অফিসার সবাই সমান, যেহেতু সবাই তখন এক-একজন অবসরপ্রাপ্ত লোক বা এক্স-সার্ভিসম্যান বা পেনশনার মাত্র।

কালাবাবু অনেকদিন কানে শোনেন না। আগে থেকেই একটু কম শুনতেন। চাকুরিজীবন শেষের দু বছর আগে থেকে তিনি একদম শুনতে পেতেন না। শেষের দিকে চাকুরির সময় অফিসে সবারই বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। অফিসের শেষ দিন কলিগরা সবাই জোরে বলাবলি করছিল, যাক খুব ভাল হয়েছে। অবশ্য সেটা কালাবাবু শুনতে পাননি।

পাখিপর্ব শেষে, পড়ন্ত বিকেলের দিকে কালাবাবু বাড়ি থেকে প্রতিদিন বের হন। পাড়ার কালুর চায়ের দোকানে যান প্রতিদিন। সেখানে তাঁকে দেখামাত্র পাড়ার পাঁচ-ছ-টা রাস্তার কুকুর দৌড়ে চলে আসে। খুশি হয়ে কুকুরগুলি লেজ নাড়াতে নাড়াতে তাঁর ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। তিনি প্রতিদিন কালুর দোকান থেকে স্লাইজ পাউরুটি কিনে কুকুরগুলিকে খাইয়ে দেন। এতে তাঁর প্রতি মাসে হাজার তিনেক টাকা খরচ হয় পেনশনের টাকা থেকে। খুশিমনেই তিনি খরচ করেন। অবশ্য এ নিয়ে সংসারে মাঝেমাঝে এক খটামটি হয় অবশ্য। কিন্তূ কালাবাবু স্থির করেছেন, তার এই পাখিপর্ব এবং কুকুরপর্ব যতদিন বেঁচে থাকবেন তিনি চালিয়ে যাবেন। অতঃপর কালুর দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে পাউরুটি-চায়ের পয়সা মিটিয়ে দিয়ে তিনি কিছু পথ হেঁটে ডিমসাগর পার্কে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি লেকের তীরে চক্কর কেটে ইভিনিং ওয়ার্ক করেন আধা ঘন্টার মত। তারপর বাড়ি ফিরে আসেন।

প্রতিদিনের মত পড়ন্ত বিকেলে আজ কালাবাবু যখন বাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছে তখন চম্পা মানে কালাবাবুর অর্ধাঙ্গিনী তাকে ডেকে নিয়ে বোর্ডের সামনে দাঁড় করায়। এই ছোট বোর্ডটা কালাবাবুই একদিন লাগিয়েছিলেন নিজেদের সুবিধার জন্যেই। কালাবাবু দেখেন বোর্ডে লেখা রয়েছে — আলু ১ কেজি, মুগ ৫০০ গ্রাম, মশুরি ৫০০ গ্রাম। “আচ্ছা, আনব” বলে কালাবাবু কালুর দোকানের দিকে যাবার জন্যে রাস্তায় নামেন।
আর তখনই এক আজব কাণ্ড ঘটে যায়। রাস্তায় নামার কিছুক্ষণ পরই কালাবাবু হঠাৎ কানে কী এক মৃদু চিঁ চিঁ আওয়াজ শোনেন। শুনে আশ্চর্য হন তিনি। আস্তে আস্তে এই মৃদু আওয়াজটা বাড়তে থাকে। ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে আওয়াজটা একনাগাড় সাইরেনের মত তীব্র হয়। অসহ্য এই আওয়াজ। কালাবাবু যন্ত্রণায় দু হাতে কান চেপে ধরেন। তারপর হঠাৎ আবার এই আওয়াজটা চলে যায়। তখনই কালাবাবু আশ্চর্য হয়ে টের পান, তিনি এখন কানে শুনতে পাচ্ছেন। হ্যাঁ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। চারদিকের সব আওয়াজ তিনি শুনতে পাচ্ছেন। তিনি ভাবেন, প্রকৃতির এক লীলাখেলা বুঝি। খুশিতে কালাবাবুর মন যেন নাচতে থাকে।

পাড়ার রাস্তা দিয়ে এগোতে এগোতে তিনি চারপাশের বিভিন্ন কথাবার্তা শুনতে থাকেন। এর মধ্যে দুজন লোকের কথাবার্তা তার স্পষ্ট কানে ঢোকে। প্রথমজন বলছে, “মাইরি বলছি, তপু যদি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় তাহলে আমি তাকে গুম করে দেব।” দ্বিতীয়জন বলছে, “আহা চেঁচাচ্ছিস কেন্, আস্তে বল্।” প্রথমজন আবার বলে, “ভয় নেই। এই ব্যাটা বদ্ধ কালা, শুনতেই পাবে না।” কথা বলতে বলতে তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কালাবাবু এদের চিনতে পারেন, পাড়ার জগাই মাধাই — অসামাজিক কাজকর্ম করা, মিটিং-মিছিলে অগ্রভাগে থাকা, মারপিট করাই এদের প্রধান কাজ।

একসময় কালাবাবু কালুর দোকানের সামনে এসে পড়েন। কালুর দোকানের সামনে একটা লম্বা বসার টুল পাতা থাকে। ওখানে রবিবাবু, প্রণয়বাবু এবং নরেশবাবু বসে চা খেয়ে আড্ডা মারছেন। রবিবাবু আর প্রণয়বাবু তাঁর মতই রিটায়ার্ড, তবে নরেশবাবু এখনো চাকুরি করেন। কালাবাবু স্পষ্ট শুনতে পান রবিবাবু বলছেন, “এই রে কালাসাহেব এসে পড়েছেন, এখন উনি রাস্তার কুকুরদের নিয়ে মিটিঙে বসবেন।” সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন। প্রণয়বাবু যোগ করেন, “খেয়ে দেয়ে আর তো কাজ নেই, কী আর করবেন !” নরেশবাবু এবার বলেন, “আসলে বোধহয় উনার সাথে বৌয়ের একদম মিল নেই, তাই উনি বাইরে ঘুরে বেড়ান।” সবাই আবার হো হো করে হাসে্ন। এসব শুনে কালু জবাব দেয়, “আপনারা বসুন আপনাদের মত। উনি রাস্তার এককোণে অভুক্ত কুকুরদের পাউরুটি দেন, খারাপ তো কিছুই করছেন না। কী বলেন ?” এসব কথাগুলি শুনে কালাবাবু এবার বুঝতে পারেন, পাড়ার লোকজন তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, খারাপ কথা বলে, হয়তো গালিগালাজও করে। আগে আড়ালে তা করত, এখন সামনাসামনি করে।

কুকুরপর্ব শেষ করে এবার কালাবাবু নিত্যদিনের মত ডিমসাগর পার্কে যান। পার্কের লেকের ধার দিয়ে ইভিনিং ওয়াক করতে থাকেন। ইভিনিং ওয়াক করার সময় তাঁর  একসময়ের অধস্তন কলিগ শ্যামলবাবুর সাথে হঠাৎ দেখা হয় যায়। শ্যামলবাবু এবং তাঁর স্ত্রীও ইভিনিং ওয়াক করছেন। শ্যামলবাবুও রিটায়ার্ড। শ্যামলবাবু এগিয়ে এসে বলেন, “স্যার ভালো আছেন তো ?” তারপর শ্যামলবাবু কালাবাবুকে দেখিয়ে স্ত্রীকে বলতে থাকেন, “রীতা, ইনি ছিলেন আমাদের বস, বদ্ধ কালা, কানে একদম শোনেন না। অফিসে ইনি বড্ড ফ্যাচাং ফ্যাচাং করতেন। আমাকে বেশ জ্বালিয়েছেন। অনেক সময় ইচ্ছে হত, এক চড় মেরে উনার সব দাঁতগুলি ফেলে দিই।” প্রাক্তন কলিগের এই মনোভাব দেখে কালাবাবু একদম রাগেন না। “আচ্ছা, ভালো থাকুন” বলে সামনে এগিয়ে যান।

কালাবাবু এখন বুঝে যান, আজ কানে শোনার পর থেকেই একের পর এক লোকদের অপ্রিয় সত্যি তার সামনে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। আরো কী কী সব আসছে — তা তিনি ভেবে উঠতে পারেন না। স্থির করেন, তিনি এখন কাউকে জানাবেন না যে তিনি এখন সব শুনতে পাচ্ছেন। সবার কাছে তিনি বদ্ধ কালা হিসেবেই দেখিয়ে যাবেন। কারণ তিনি এখন দেখতে চান, তাঁর পরিচিত সব লোকজন — এক এক জনের সত্যিকারের চেহেরাটা ঠিক কী ধরনের ? তা সে স্ত্রীই হোক, পুত্র-কন্যাই হোক কিংবা অন্য কেউ ! যাক, এখন কিছু চাল-মুগ-মশুরি কেনা যাক। তারপর নিজের স্ত্রীর ওপরই প্রথম পরীক্ষাটা হোক।
কালাবাবু দ্রুত এগোতে থাকেন।