সময় বিভ্রাট (অনুগল্প)
রণজিৎ রায়
সময়ের অভাবেই জুলাই মাসে আমরা মরুভূমি ঘুরতে বের হলাম। আমি, স্ত্রী সুমি ও কন্যা মনকে নিয়ে রাজস্থানের জয়সলমির ঘুরতে যাচ্ছি। আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে আমেদাবাদ, মাউন্ট আবু, উদয়পুর, যোধপুর, জয়সলমির ও জয়পুর দেখা শেষ করে আবার কলকাতা হয়ে আগরতলা ফিরে আসবো। যাত্রার কিছুদিন আগে থেকেই উষ্ণতা হজম করতে শুরু করলাম। অর্থাৎ গরমে ফ্যান না চালিয়ে অভ্যস্ত হচ্ছিলাম।
যথাসময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলে তেমন গরম অনুভূত হল না। জুলাইতে যেমন গরম পড়ে, তেমনি বৃষ্টিও হয়। মেঘলা আকাশের জন্যে গরম তেমন পড়েনি। মাউন্ট আবু চমৎকার দর্শনীয় জায়গা। গরম নেই। সারা বছরই প্রায় শীতের আবহাওয়া। মাউন্ট আবু থেকে উদয়পুর ঘুরে খুব ভালো লাগলো। আমার কেন যেন মনে হয়, রাজস্থানের উদয়পুর দর্শন করে ত্রিপুরার উদয়পুর শহরকে লেক দিয়ে একইভাবে সাজানো হয়েছে। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ত্রিপুরা মহারাজাদের।
উদয়পুর থেকে যোধপুর হয়ে জয়সলমির ঘুরতে গেলাম। মরুভূমি স্টেশন হলেও বৃষ্টির জন্যে গরম অনুভূত হল না। রাজপ্রাসাদ যাকে চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায় ‘সোনার কেল্লা’ নাম দিয়ে একটি সিনেমা তৈরি করেছেন, প্রাণভরে দেখলাম। বিশেষত্ব হচ্ছে, সোনার কেল্লার ইট ভাঙলেও ভেতরে সোনার মতো হলুদ রঙ। নানাভাবে পরীক্ষা করলাম। এ সোনার কেল্লা দর্শনের সময় কেরলের একটি পরিবারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে।
ওরা সাত জনের পরিবার। একসঙ্গে জয়পুর ঘুরতে এলাম। আমরা জয়পুর তিনদিন ঘুরে তারপর কলকাতা ফিরে যাবো। ওরা একরাত থেকে পরদিন রাতের ট্রেনে ফিরে যাবেন। কেন জানি না, ওরা আমাকে হোটেল ঠিক করে দিতে বলেন। শিক্ষিত পরিবার। ব্যবহারও চমৎকার। কেবল খাবারের সময় আমাদের হোটেল আলাদা। ওরা দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খাবেন। আমরা বাঙালি খাবার না পেলে গুজরাটি খাবার পছন্দ করি।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ওরা আমাকে বললেন, “আগামীকাল রাত একটায় আমাদের ট্রেন। হোটেল থেকে রাত দশটা কিংবা এগারোটায় বের হলে হোটেল চার্জ কি একদিনের বাড়তি দিতে হবে ?”
আমি বললাম, “দিনে বারোটার আগে বের হয়ে লাগেজ ক্লকরুমে দেখে দিয়ে ঘুরবেন। তারপর রাতে খেয়েদেয়ে ক্লকরুম থেকে লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়বেন।”
ওরা আমার কথায় খুশি হতে পারেননি। আমি যেন হোটেলের সঙ্গে কথা বলে একটা রফা করে চার্জ কম করার ব্যবস্থা করি। ওরা হোটেল থেকেই রাত এগারোটায় বের হবেন। কী আর করা যায়! আমি বললাম, “আপনাদের টিকিট কনফার্ম তো ? আমাকে একটু দেখাবেন ?”
একটু অখুশি হয়েই একজন ওনার টিকিট আমার হাতে তুলে দেন। আমি দেখেই ইলেকট্রিক শক খাবার মতো চমকে ওঠলাম। দ্রুত বললাম, “সবার টিকিট আগে আমার হাতে দিন।”
টিকিট মাত্র দুটি। দুটো টিকিটে সাতজন। একই সময়, একই তারিখ। নিজের হাতের ঘড়ি দেখলাম। রাত এগারোটা পনের মিনিট।
অত্যন্ত জোর গলায় বললাম, “আপনাদের ট্রেন একটু পরেই। আজ চৌদ্দ জুলাই। রাত বারোটা অতিক্রম করলেই পনের জুলাই হবে। রাত একটা মানে একটু পরেই। আগামীকাল নয়। আগামীকাল হলে আবার ষোলো জুলাই হয়ে যাবে।”
প্রায় অনেকক্ষণ নীরব থেকে সবাই বুঝতে পেরে আঁতকে ওঠেন। আমাকে বারবার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ওরা রাতের খাবার খেতে দ্রুত ছুটে যেতে থাকে।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সুমি ও মন তখনও কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো।