
ফাঁকা ফ্রেম (ছোটোগল্প)
প্রসেনজিৎ রায়
বর্ষার বিকেল। সকলের অলক্ষ্যে চরম কর্মব্যস্ত মেঘের রাশি আকাশের বুকে অল্প অল্প করে নিজের সিংহাসনে আসন দখল করে নিচ্ছিল। যেমনটা প্রিয়তমের বুকে প্রিয়তমার স্থান এক চিরন্তন সৌন্দর্যের জন্ম দেয়, ঠিক তেমনই বর্ষাকালে নীল আকাশের বুকে বিবিধ আকৃতির মেঘের ঘনঘটা রোমান্টিক কবির লেখনীতে এসে রোমাঞ্চ সঞ্চার করে প্রাকৃতিক নিয়মেই। চারিদিকে এর মাঝেই জীবনের কর্মযজ্ঞে মানুষের স্বস্তঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চলছে। আকাশের বুকের সেই নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাই অধরা রয়ে গেছে কতিপয় আঁখিযুগলের। একটু পরপরই রাজপথে জ্যামে আটকে থাকা মানুষের ক্লান্তির দীর্ঘনিশ্বাস, কারো কারো এর মাঝেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবার তাড়া অন্যদিনের থেকে আজকের দিনটা কোনো মতেই আলাদা বলা চলে না। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যদেব মেঘের ফাঁকে মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে নিজের আলো ধরিত্রীর বুকে ছড়িয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এমন বিকেলে রাজপথ থেকে একটু দূরে নজরুল পল্লীর শেষ মাথায় দোতলা বাড়ির বারান্দায় আরাম কেদারায় পিঠ হেলিয়ে বসে আছেন ষাটোর্ধ বৃদ্ধ বীরেশ্বর মুখার্জী। পাঁচ-ছয় বৎসর আগে সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। জীবনের পাঠ চুকিয়ে জীবনের কর্মব্যস্ততা থেকে রিটায়ার করেছেন স্ত্রী প্রায় তিন বৎসর হল। আজ বীরেশ্বরবাবু জীবন সংগ্রামে সঙ্গীহীন, বড়ো একা। না, এমনটা ভাবার কারণ নেই যে তিনি সন্তানহীন। বীরেশ্বরবাবুর একমাত্র সন্তান অনিকেত মুখার্জী শহরের এক নামী কোম্পানীতে উচ্চপদে কর্মরত। একই শহরে খানিকটা দূরে একটা ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সুখের স্বর্গ গড়ে তুলেছেন অনিকেতবাবু। শুধু একমাত্র স্ত্রীর আদুরে আব্দার মেটাতে সেই স্বর্গের উদ্যানে স্থান হয়নি ভগবানের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ ফুলটির যার সুবাসে অনিকেতবাবুর জীবনে আজ এতো সুখ ভ্রমরের আনাগোনা।
বড়ো আশা নিয়ে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছিলেন। বীরেশ্বরবাবুর পছন্দসই মেয়েকেই বিয়ে করেছিল অনিকেত। মেয়ে ছিল খুব গরীব পরিবারের। বিয়ের সময় এক টাকাও পণ নেননি। ভেবেছিলেন গরীব কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাকে মুক্ত করা এক মহাপূণ্য। বিয়ের পর বৌমাও খুব জমিয়ে সংসার আগলে রেখেছিল। বৌমা ও শ্বাশুড়ি মিলে এক সাথে সুন্দরভারে সংসারের কাজ সামলাতেন। কিন্তু শ্বাশুড়িমা গত হওয়ার সাথে সাথেই বৌমা হঠাৎ পাল্টে গেল। অকর্মণ্য, অলস বৃদ্ধ শ্বশুরকে নিয়ে এক সাথে থেকে শ্বশুরের অতিরিক্ত কাজ করা সুন্দরী বৌমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই নিজের স্বামীকে নিয়ে আলাদা সংসার পেতেছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জীবনটা এমন ছন্নছাড়া হয়ে যাবে এমনটা কোনোদিনই ভাবতেও পারেননি তিনি। আজ তিনি বয়সের ভারে, একাকীত্বের চরম চাপে মূহ্যমান। অন্ধের একমাত্র যষ্টি পুত্র আজ থেকেও নেই। এতোদিন ধরে আলাদা থাকতে থাকতে নিজের অজান্তে কবেই এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরী হয়ে গেছে ওনার ও অনিকেত-এর মধ্যে। নিজের হতাশাগ্রস্থ জীবনটাকে ভাগ্যের পরিহাস বলেই মেনে নিয়েছেন। ভাগ্যের পরিহাসই তো, নইলে কি আর এ বয়সে কাজের মেয়ে উমা না এলে নিজেকে হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হতো। তবু ওনার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। বরং আছে এক চাপা অভিমান — ছেলে কি একটুও প্রতিবাদ করতে পারল না? যে আঙুলগুলির উপর ভর করে ছোট্ট অনিকেত হাঁটতে শিখেছে, আজ এই বৃদ্ধাবস্থায় সেই অনিকেতের বড়ো হওয়া আঙুলগুলি যে ওনার খুব দরকার। সব থেকেও আজ কেন নিস্তব্ধ আরাম কেদারাটা তার একমাত্র সঙ্গী। বারবার চেষ্টা করছেন জীবনের হিসাব মেলাতে, কিন্তু বার বার ভুল হিসাব করেছেন। সে যে বড়ো কঠিন অঙ্ক। আবার পরক্ষণেই মন বলে উঠে, আমি আর ক’দিন। ওরা সুখে আছে, এটাই আমার কাছে বড়। ভগবান যাতে তাদের পৃথিবীর সব সুখ পাইয়ে দেন।
এমন ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কোন খেয়ালে বীরেশ্বরবাবু কেদারা ছেড়ে উঠে পড়লেন — নেমে এলেন খোলা রাজপথের বুকে। তার বৃদ্ধ মস্তিষ্কে অবিরত চলছে ক্ষয়ে যাওয়া স্মৃতির রোমন্থন, বার বার উঁকি মারছে জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব, উত্তর না পাওয়া অজস্র প্রশ্ন। অবসন্ন শরীর ও মন নিয়ে ছুটে চললেন খোলা রাজপথের মাঝ দিয়ে — এতো যানবাহন, ভিড়, জ্যাম তার মনে কোনো দাগ কাটছে না আজ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটাও শুরু হয়েছে তার একাকীত্বের সাথী হিসাবে ততক্ষণে। তিনি আজ তার নিজের মধ্যেই নেই। আর জগতের কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণকারী মানুষদেরও সময় নেই একজন বৃদ্ধ কেন এইভাবে খোলা রাজপথে প্রায় মাঝ বরাবর ছুটে চলেছেন তা নিয়ে অযথা মাথা ঘামাবার।
হঠাৎ চৌধুরী লেনটার সামনে যেতেই উল্টোদিক থেকে প্রবল গতিতে ছুটে আসা ট্রাকটার বিশাল কায়ায় ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লেন এই অসহায় মানুষটি। সাথে সাথে কাছাকাছি মানুষ ট্রাকটিকে থামিয়ে ট্রাকের চালককে উত্তম মধ্যম দিতে শুরু করল। ট্রাক চালকটি উন্মত্ত ছিল নেশায়। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়েই গেছে। ওনার ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহটি ছটফট করতে করতে ততক্ষণে বদলে গেছে এক নিথর পাষাণে। মৃতদেহটি দেখতে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। কেউ বা শুধু দেখছে। কেউ মুখ বিগড়ে বলছে — ইস্ কি অবস্থা, কেউবা অ্যানড্রয়েড মোবাইলে রক্তাক্ত দেহটির ছবি নিতে ব্যস্ত, কারো এই বিভীষিকাময় চিত্র দেখে গা-বমি ভাব করছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না, চেষ্টা করছে না। শেষবারের মতো যদি এই বৃদ্ধটাকে বাঁচানো যায়। কেউ কেউ এই ঘটনা দেখেও তেমন পাত্তা দিচ্ছে না বরং তাদের কাছে আলোচ্য বিষয় ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল, ইস্ একটুর জন্য কাপটা হাতছাড়া হলো। মুখের ভাবটা এমন বিজ্ঞ যেন এর আগের বছর নিজে দেশকে বিশ্বকাপ বা অলিম্পিক মেডেল এনে দিয়েছে। আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে হলফ করে বলা যায় পৃথিবীতে নাই হোক অন্তত ভারতে কর্মঠ মানুষের চেয়ে সমালোচকের সংখ্যা অনেক বেশি।
উল্টোদিকে আজ বন্ধবার। তাই নিজের ফ্ল্যাটেই রয়েছে অনিকেত। স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে সকালেই গেছে বাপের বাড়ি। সন্ধ্যার দিকে আসার কথা ছিল। বিকেলে ভেবেছিল অনিকেত বাবাকে একটু দেখে আসবে। অনেকদিন যাওয়া হয়নি। কিন্তু বৃষ্টির ভাব দেখে অনিকেতের আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই ডেক্সটপ খুলে ব্যস্ত মুখবই খুড়ি ফেসবুক নিয়ে। নিউজ ফিড এ গিয়ে একটা করে লাইক দিচ্ছে ছবিতে। হঠাৎ ভেসে উঠল একটা রাস্তা দুর্ঘটনার ছবি। ভালোভাবে না দেখে একটা ‘লাইক’ নিয়েই সদাব্যস্ত আধুনিক নাগরিকের কর্তব্য পালন করল। হঠাৎ কলেজ জীবনের বান্ধবী রীতা মেসেজ দিল। তার সাথে চ্যাটিং করবে ভাবতেই দরজায় ধাক্কা পড়লো। দরজা খুলেই অনিকেত তো অবাক। এ যে তার বাবার বাড়ির পাশের দোকানের রামু। তার ওপর এমন ভয়ার্ত, অসহায় শুকনো মুখ দেখেই কেমন একটা খটকা লাগ অনিকেতের।
অনিকেত বলে — এসো, ভেতরে এসো।
রামু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে — না, ভেতরে আসবো না।
অনিকেত — তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন? ভেতরে এসো। বড়ো করে বৃষ্টিও আসছে। এখন কোথায় যাবে? বৃষ্টি থামলে যেও।
রামু নিরুত্তর রইল।
অনিকেত হাত ধরে রামুকে ঘরের ভিতর এনে দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, ভেবেছিলাম বাবাকে দেখতে যাবো। বৃষ্টি আসায় আর যাওয়া হয়নি। ভালো হয়েছে তুমি এসেছো। তুমিই বলো বাবা কেমন আছে? শরীর ভালো তো?
এ সব শুনেই রামু কেঁদে দিল।
বাবার কথা জিজ্ঞেস করাতে এমন প্রতিক্রিয়া পেয়ে অনিকেত খুব ঘাবড়ে গেল — ঠিক করে বলো কি হয়েছে বাবার? তুমি এমন কেন করছো?
রামু কেঁদে কেঁদে বলল — নিজেকে শক্ত কারো অনিকেতদা। বুঝতে পারছি না তোমায় কিভাবে কথাটা বলতো।
— বলো, বলো রামু, কি হয়েছে। তাড়াতাড়ি বল।
রামু সব কথা খুলে বলল চৌধুরী লেনটার সামনে কিভাবে লরিটা বীরেশ্বরবাবুকে চাপা দিয়েছে। এ সব শুনে অনিকেতের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। রামু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল কিছু, এমতাবস্থায় কি আর সান্ত্বনা দেবে?
রামু খানিকটা পর চলে গেল একটা ফোন পেয়ে। আর কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরল অনিকেতের। একটু আগে ফেসবুকে যে দুর্ঘটনার ফটোতে সে ‘লাইক’ দিয়েছিল তার কথা মনে পড়ল, আরে, ওই ছবিটা তো যেন চৌধুরী লেনের সামনেরই। সাথে সাথে আবার ফেসবুক খুলে যা দেখল তাতে পুরোপুরি ভেঙে পড়ল সে। মৃতদেহটি আর কারো নয়, এ যে তার বাবারই। এইতো পরনে সেই পাড় দেওয়া ধুতিটা যেটা সে নিজের হাতে দিয়েছিল যে বৎসর চাকরি পেয়েছিল। আর এই তো সেই লাল পাঞ্জাবিটা যেটা তার মার বাবাকে দেওয়া শেষ উপহার। মুখটা চেনা যাচ্ছে না। রক্তিম রঙে রাঙানো কি বীভৎস রূপ ! যে লোকটা অনিকেতের একটা ছোট আঘাত সহ্য করতে পারতো না, আজ তার সামনে লোকটার এ কি অবস্থা !
কেন বাবাকে বৃদ্ধ বয়সে সে একা ছেড়ে চলে এল ? কেন স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে সাহস করে প্রতিবাদ করলো না সে — কেন? আজ তার সেই সিদ্ধান্তের ভুলে এই ঘটনা ঘটল !
পুরো ঘটনার জন্য তার নিজেকে দায়ী মনে হতে লাগল। চোখের সামনে নিজের তিন বছর বয়সী ছেলের মুখটা ভেসে উঠতেই বিড় বিড় করে নিজের অজান্তেই বলে উঠল — হায় ঈশ্বর। এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যা। তুমি এই হত্যাকান্ডের দোষীদের বিচার করো। আরও বীভৎস মৃত্যু প্রাপ্য এই খুনীর! অবসন্ন চিত্তে চেয়ার থেকে টলে পড়ল মাটিতে। উঠে দাঁড়াবার শক্তি অবধি নেই শরীরে। চোখ পড়ল দেওয়ালে ধূলিমাখা বাবার ছবিটার দিকে। কোনদিন প্রয়োজন বোধ হয়নি ছবিটার ধুলো ঝাড়ার। কিন্তু আজ অশ্রুসজল নয়নে বড়ো অস্পষ্ট লাগছে ধুলিমাখা ছবিটা। বাবার মুখটা কেমন যেন মলিন, যাক্ তবু তো এই নিষ্প্রাণ ফটোফ্রেমে বাবার অবহেলিত মুখটা আছে, কিন্তু জীবনের ফ্রেমে যে বাবা সবার মধ্যমণি হয়ে থাকার কথা ছিল আজ তো সেই ফটোফ্রেমটি পুরো ফাঁকা। আর কোনোদিন সেই ফ্রেমে বাবা ফিরে আসবেন না! মনে হল ধন-সম্পত্তি, সম্পর্ক কিছুই নয়, মৃত্যুই মানুষের জীবনের চরম সত্যি।
অনিকেতের মনে হলো তার বাবার মৃত্যু তো আজ হয়নি, হয়েছে সেদিন যেদিন সে তার বাবাকে একা ফেলে চলে এলো। আর তারপর থেকে বৃদ্ধ বয়সে বাবা মারা গেছেন বারবার প্রতিদিন প্রতিটি মূহূর্তে। এ মৃত্যুর জন্য দায়ী অনিকেত নিজে। অথচ ভদ্রলোকের মুখোশ পরা এই খুনীর কোনো শাস্তি নেই — এ কথা ভেবেই বুক চাপা কান্না বেরিয়ে এলো সব দ্বিধা উপেক্ষা করে। ততক্ষণে বাইরে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে আরো প্রবলভাবে।