সেদিন দেখা হয়েছিল – প্রসেনজিৎ রায়

সেদিন দেখা হয়েছিল – প্রসেনজিৎ রায়

সেদিন দেখা হয়েছিল         (অনুগল্প)

প্রসেনজিৎ রায়

ভীষণ ব্যস্ত আজ রেলস্টেশন। কানায় কানায় যাত্রীতে ভর্তি পুরো প্ল্যাটফর্ম। উজান বাড়িতে সাপ্তাহিক বন্ধ কাটিয়ে আজ সোমবার আবার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। স্টেশনে ঢুকেই টিকিট কাউন্টারের ভিড় দেখে ভাবছে ভাগ্যিস কাল রাতে অনলাইনে টিকিট করে রেখেছিলো নাহলে আজ….।
আকাশের মুখটা আজ সকাল থেকেই বেশ ভার। সূর্যদেবতার দেখা পাওয়া আজ দুষ্কর বলেই মনে হচ্ছে। হালকা হালকা একটা বাতাস বইছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে খুব জোরে। ট্রেন আজকে লেট, তাই হেডফোন কানে গুঁজে ওভারব্রিজটায় দাঁড়িয়ে গান শুনতেই মনস্থির করলো উজান। গানের সাথে হালকা হালকা বাতাস উজানের মনটাকে এই ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও কিছুটা শান্তি দিচ্ছিলো। হঠাৎ উড়োচিঠির মতো তমাল কোথা থেকে এসে জুটলো। তমাল উজানের পাড়াতেই থাকে, একটা বড়লোকের হাফ বিগড়ে যাওয়া ছেলে। কুশল বিনিময়ের পর তমালের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আজ পুরো ট্রেনযাত্রা একসাথে করার পরিকল্পনা তমালের।
কিন্তু এই হাবভাব এখন আর উজানের পছন্দ হয় না। একসময় সর্বদা হাসি-কথায় মেতে থাকা মানুষ কারো আঘাতে যখন বুঝতে শিখে একাকীত্বেই শান্তি তখন সে আর মানুষের সঙ্গ উপভোগ করতে পারে না। আসলে এমন মানুষরা বুঝতে পারে একাকীত্বেই জীবনের অকৃত্রিম আনন্দের ফল্গুধারা। মানুষ ততক্ষণই অন্যজনকে সঙ্গ হয় যতক্ষণ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি হয় অথবা নিজের স্বার্থের কণামাত্রও বিঘ্নিত না হয়। আর ততক্ষণে বিপরীত পাশের মানুষটার মাঝে যে নির্ভরতার জন্ম নেয়, তার তোয়াক্কা করার প্রয়োজন বোধ করে না কেউই। সুতরাং সবাইকে এড়িয়ে নিজেকে সময় দেওয়ার অভ্যাসটাই সর্বশ্রেষ্ঠ। নিজের সাথে কথা বলা, নিজের ভুলগুলি পর্যালোচনা করা, নিজেকে নিয়ে কল্পনা করা – এসবই টেনে নিয়ে যায় এক অনাবিল আনন্দ যজ্ঞে আর এর স্বাদ একবার কেউ সত্যিকার অর্থে আস্বাদন করতে পারলে এই একাকীত্বের আনন্দ থেকে দূরে যাওয়াটা তখন উল্টো বিরক্তিকর মনে হয়। এ ভেবেই তমালকে বললো — ভাই আজ আমি টিকিট কাটতে পারিনি, শরীরটাও বেশী ভালো না, পারলে আমায় একটা টিকিট করে দিতে পারো কিনা দেখো।
তমাল আমতা আমতা করে জানালো সেও টিকিট করেনি।
— দুজন একসাথে টিকিট ছাড়া উঠলে টিটি নির্ঘাত ধরে ফেলবে, যাও দুটো টিকিট করে আনো, আমি টাকা দিচ্ছি দুজনেরই।
— উজানদা, যা ভিড়, করতে পারবো বলে মনে হয় না। আর টিটি চেকও করে না লোকাল ট্রেনে।
— তবু আমার এমন ভালো লাগে না, আমিই করে নিতাম শরীর ভালো থাকলে, দুদিন থেকে জ্বর, হঠাৎ লাইনে মাথা ঘুরে না পড়ি তাই যাচ্ছি না, একটু চেষ্টা করে দেখো, টাকা দিচ্ছি নিয়ে যাও।
— টাকা থাক্ আচ্ছা। পারবো সিউর না তবু দেখি। করতে পারলে নিয়ে আসবো।
বলেই উধাও হলো তমাল। নিজের আসল কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্যের সফলতায় মুচকি হেসে উজান আবার হেডফোনে মন দিলো।

দেখতে দেখতে ট্রেন এলো, কোনোক্রমে ভিড় টেলে একটা সিট জুটলো উজানের। গরমের মাঝে বাইরে থেকে আসা হালকা হাওয়ার পরশ উপরন্তু ট্রেন ধরার জন্য তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠা দুইয়ে মিলে চোখ বুঁজে আসলো উজানের। ট্রেনের যাত্রীরা তখন আড্ডায় আর ক্লান্তিতে মশগুল। হঠাৎ শত শত যাত্রীর শোরগোল, ঝাড়মুড়ি-বাদাম বিক্রেতার হাঁকাহাঁকি, ট্রেন ইঞ্জিনের সাইরেন সব কিছু ছাপিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন উজানের কানে এলো খুব পরিচিত একটা কন্ঠস্বর। হৃৎস্পন্দন পাল্টে নিলো তার গতি। না এতো ভুল হতেই পারে না, মনে হচ্ছে লাগোয়া কামরাতেই ..
ভিড়ের ফাঁকে একটু উঁকি দিয়ে হঠাৎ যেমন আকাশটা ভেঙে পড়লো উজানের দৃঢ় বুকে, মনে হচ্ছিলো পায়ের নীচের অবলম্বনটা যেনো আর নেই — এ যে বাণী আর পাশের পুরুষটা নিশ্চয়ই…..

কর্মজীবনের একদম গোড়ার দিকে বাণীর সাথে পরিচয় ফেসবুকের সৌজন্যে। উজানের কলিগের এক আত্মীয়া বাণী। ধীরে ধীরে পরিচয়ের গণ্ডী পেরিয়ে সম্পর্কটা বিস্তৃত হয়েছিলো অনেক বেশি তবে পুরোটাই ভার্চুয়াল জগতে। সামনাসামনি দেখা হয়নি কখনো। একবার বাণী প্রচন্ড অসুস্থ ছিলো। অফিসে, তারপর বাড়ি ফিরে এসে সবসময় বাণীর খবর নিতো আর বাণীকে নিয়েই ভাবতো। ভীষণরকম মায়া পড়ে গেছিলো অসুস্থ বাণীর প্রতি উজানের। মায়া ছাড়া ভালোবাসা সম্পূর্ণ হয় না। ততদিনে বুঝতে পেরেছিলো উজান বাণীকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। বাণীর কথাবার্তায়ও মনে হতো সেও উজানকে পছন্দ করে, অথচ যেদিন উজান মনের কথা বাণীকে জানালো নিজেদের আলাদা সম্প্রদায়ের দোহাই দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিলো বাণী। জানালো তার অনেক আগে থেকেই বাড়ি থেকে খুব ভালো একটা ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করা, উজান কেবলই তার বন্ধু। অভিমানী উজান নিজেকেও সরিয়ে নিলো, একবারও নিজের বাণীর উপর নির্ভরতা, নিজের স্বপ্নভঙ্গের দোষারোপ এসব নিয়ে হাজিরা দিতে মন চাইলো না উজানের। ভেবেছিলো যেখানে মায়া বাড়ানোটা কষ্টের, সেখানে মায়া কাটানোই ভালো। কোনোদিন দেখা হয়নি উজান আর বাণীর, আর ভবিষ্যতে হবার ইচ্ছেও পুষে রাখেনি উজান।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ট্রেন পৌঁছে গেলো অভীষ্টে। নেমে এসে পেছন ঘুরে দেখলো বাণীর স্বামী নেমেছে ট্রেন থেকে, দেখে মনে মনে হাসলো উজান, চেহারা পোষাকাদিতে মনে হচ্ছে বাণী বুঝেশুনেই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আবেগী হওয়াটা উজানের ভুল, বাণী বাস্তব বুঝতে শিখেছে অনেক আগেই। ধীরে ধীরে নেমে এলো বাণী, ভিড়ের মাঝেও দাঁড়িয়ে রয়েছে উজান। কত পরিকল্পনা করেছিলো দুজনে প্রথম দেখা করবে কিন্তু আজ এভাবে দেখা হবে উজান স্বপ্নেও ভাবেনি। ভেবেছিলো অন্তত বাণীর চলে যাওয়াটা দেখবে, কিন্তু হঠাৎ বাণীর চোখ পড়লো উজানের চোখে, উজান তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরিয়ে পথ চলা শুরু করলো ..

উজান দ্রুত পা চালিয়ে চলে যাচ্ছিলো, কিন্তু ভেতরটা যেন এক অজানা ভারে ভারাক্রান্ত। তার চোখের কোণে একধরনের অস্বস্তি, এক ধরনের বিরক্তি, আবার সাথে যেন এক অসম্ভব শূন্যতা। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ থেমে গেলো সে। মনে হলো, কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ধরে রেখেছে। পেছনে ঘুরে চেয়ে দেখলো — বাণী এবার কিছুটা ধীরে ধীরে পা ফেলছে, ভীড়ের মধ্যে নেমে আসছে। কিন্তু তার চোখে আগের মতো স্বাভাবিকতা আর নেই। যেন কোনো অপ্রকাশিত গল্পের গল্পকথা, একটি গভীর আক্ষেপ আর নিজের প্রতি কোনো অভিযোগ ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে।

মনে পড়লো, একসময় বাণী বলেছিলো, “যতটুকু পছন্দ করি, তার থেকেও বেশি দূরত্ব চাই, কারণ আমি জানি, আমি যদি কাছাকাছি থাকি, আমি হারিয়ে যাবো।” অথচ সে তো হারিয়ে যায়নি, বরং উজানকেই দূর করে দিয়েছিলো বাণী।

উজান চোখ ফিরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো। তার পায়ের গতি যেন ভীষণ স্লথ। সময়টা যেন থেমে গিয়েছিলো, পৃথিবী এক চক্র ঘুরছিলো, কিন্তু সে চক্রের মধ্যে উজান নিজের স্থান খুঁজে পাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিল, সে সব কিছু ছাড়তে চায় — সব কিছু ছিঁড়ে ফেলতে চায়, সেই পুরনো সব অবশিষ্ট স্মৃতি, পুরনো যন্ত্রণা, পুরনো প্রেমকে, যেটি এখন আর তার কাছে কেবল বেদনা ছাড়া কিছুই নয়।

উজান জানতো না, ঠিক কী চায় সে। কিন্তু এই মুহূর্তে, সে শুধু জানতো যে সে একা। একান্তভাবে একা। বাণীও, হয়তো আজ ঠিক তাকে পুরোপুরি ভুলে গেছে, সেও তেমনি বাণীর স্মৃতি ঝেড়ে ফেলতে চায়। শুধু থাকবে — এক নিঃশব্দ অভিমান, যা কোনো দিন ভুলা যাবে না।

এটাই জীবনের অদ্ভুত বাস্তবতা, ভাবতে ভাবতে উজান ততক্ষণে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

আসলে, শেষ দেখা তো কখনোই সঠিক সময়ে আসে না…