পয়লা বৈশাখ – লোপামুদ্রা সিংহদেব

পয়লা বৈশাখ – লোপামুদ্রা সিংহদেব

পয়লা বৈশাখ         (অনুগল্প)

লোপামুদ্রা সিংহদেব

চৈত্রের শেষদিনে আজ বাজার গরম। চারিদিকে চিৎকার ‘সেল, সেল’। বাজারে খদ্দেরের ঢল নেমেছে। আজ বছরের শেষদিন। কাল নতুন পোষাকে সেজে মন্দিরে পুজো দিতে যাবে সবাই।
তাড়াতাড়ি হাত চালাবার চেষ্টা করে অমিতা, বিকেলের মধ্যেই সব অর্ডার রেডি করে দিতে হবে। কাল পয়লা বৈশাখ। দোকানগুলোতেও পুজোর আয়োজন।
অতনুর কথা আজ বড়ো মনে পড়ছে অমিতার। মাঝে মাঝেই চোখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
মিনতি বলে – “কি হলো দিদি, চোখে কিছু পড়ল”? কিছু না বলে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে আসে অমিতা।

কাজ শেষ করে মালিকের হাতে জমা দিলে খুশি হয়ে পাওনা টাকার সাথে আরও পাঁচশো টাকা দেন তিনি। বলেন – “কাল পুজো আছে, তাড়াতাড়ি এসো”। “হ‍্যাঁ” বলে বেরিয়ে পড়ে অমিতা।
মায়ের জন্যে একটা লালপাড়ের শাড়ি, আর বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি কেনে। নিজের জন্য কেনার কথা ভাবে না। মাসের বাকি কটা দিন চালাতে হবে তো।
ভিড় ঠেলে, বাস ধরে ফিরতে একটু দেরিই হয়ে যায়। বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। মা রোজকার মত না খেয়ে বসে আছে। হাতের ব্যাগটা আড়াল করে ঘরে ঢোকে অমিতা।
খাওয়ার পাট চুকিয়ে নিজের বিছানায়। ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসে না। অতীত আজ বড়ো পিছু টানছে। মনে পড়ে যাচ্ছে অতনুর হাসিমাখা মুখ, একমাথা কালো চুল আর উজ্জ্বল চোখ দুটোর কথা। পয়লা বৈশাখে ভোরে উঠেই দেখতে পেত মাথার পাশে শাড়ির প্যাকেট, সিঁদুর, টিপ আর একটা ফুলের মালা।
সেদিন অতনুর অফিস ছুটি। দুজনে মিলে মন্দিরে যেতো ওরা। বাবা বলতেন – “আজ রান্নাঘর আমি সামলাব, তোমরা ঘুরে এসো”।
চোখের জলে বালিশ ভেজে অমিতার। মনে পড়ে যায় কেমো নেবার পর অতনুর বিধ্বস্ত চেহারাটার কথা। অতগুলো কেমোথেরাপি নেবার পরও চলে যেতে হলো অতনুকে। অসহায় অমিতার কোন প্রার্থণাই ভগবান শুনলেন না।
সকালে উঠে, স্নান সেরে মা, বাবাকে প্রণাম করে প্যাকেট দুটো দিতেই প্রশ্ন আসে, “আর তোমার কাপড়?” না শোনার ভান করে অমিতা বলে, “আজ দোকানে পুজো আছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে”।
মা বলেন, “আমি জানি তুই নিজের জন্য কিচ্ছু কিনিসনি। আমরা তো তোর মা, বাবা। আমরা সব বুঝতে পারি। অতনু যাওয়ার পর থেকে তুই যেভাবে আমাদের আর সংসারটাকে আগলে রেখেছিস, কে বলবে তুই আমাদের ছেলের বউ। নিজের মেয়ে থাকলেও বোধহয় এতটা করতো না”।
একটা প‍্যাকেট হাতে দিয়ে বলেন, “এই শাড়িটা পরে আজ তুমি পুজোয় যাবে”। এটা আমাদের নিজের টাকায় কেনা মা। তুই কাজে চলে যাস, আমরা দুই বুড়ো বুড়ি বসে বসে ঠোঙা বানাই। পাড়ার দোকানের হারুই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যা মা শাড়িটা পরে আয়”।
জল ভরা চোখ নিয়ে অতনুর ছবির সামনে দাঁড়ায় অমিতা।