অভাগী – স্বাতী ধর

অভাগী – স্বাতী ধর

অভাগী         (অনুগল্প)

স্বাতী ধর

বছর চারেক আগে শহরতলির এই জায়গায় বাড়ির সীমানায় সাজিনা গাছের কাছেই নিজেদের সুলভ পায়খানা বানিয়েছিল মদন। এর আগে তাদের ছিল কাঁচা পায়খানা। শহরতলির এইসব পুরোনো ঘরবাড়ির মাঝে এ্যাটাচড্ টয়লেট বানাবার মতো ইচ্ছে মদনের ছিল না। ঘর থেকে বেরিয়ে ত্রিশেক ফুট হেঁটে পায়খানায় যেতে হয়। এই পায়াখানা বানাবার এক বছরের মাথায় মদনের বাপ পায়খানায় গিয়ে স্ট্রোক করেছিল। তারপর হাসাপাতালে মারা গেছিল। তারপর তিন বছর পেরিয়ে গেছে। ব্যাপারটা সবাই ভুলতে বসেছে কালের নিয়মে। কিন্তু হঠাৎ বোঝা গেল ব্যাপারটা সবাই ভুলতে বসলেও একজন ভোলেনি।
শরৎকাল। বাতাসে তখন উৎসব উৎসব গন্ধ। এর মধ্যে মদনের ছেলে নবীন নিজেদের পায়খানায় ঢুকতে গিয়ে দেখল ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। সে ভাবল, বাড়ির কেউ বুঝি ওখানে গেছে। কিন্তু ঘরে গিয়ে দেখে বাড়ির কেউই সেখানে যায়নি। ব্যাপার জেনে বাড়ির সবাই আশ্চর্য হয়, পায়খানায় তাহলে কে গেল ? ভাবল, এ এলাকার জানাশুনা কেউ বুঝি গেছে। সবাই তাকিয়ে রইল পায়খানার দিকে, দেখি কে বেরোয়। কিন্তু বিশ মিনিট পার হয়ে গেল, কেউ বেরুচ্ছে না। আস্তে আস্তে ত্রিশ মিনিটের ওপর হয়ে গেল, কেউ তখনো বেরুচ্ছে না। এদিকে নবীনের ভীষণ চাপ এসে গেছে। সে থাকতে না পেরে পায়খানার দরজায় কড়া নেড়ে বলল, ভেতরে কে আছ, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এস। ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। নবীন এবার দরজায় দু হাত দিয়ে ধম ধম বাড়ি মেরে আবার বলল, বেরিয়ে এস, ভেতরে কে আছ? তখন মৃদু স্বরে ভেতর থেকে কাঁপা কাঁপা মহিলা কণ্ঠে আওয়াজ আসে, বেরুচ্ছি বাবা, বেরুচ্ছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই যে পায়খানার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল তাকে দেখে বাড়ির সবাই বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল। সে আর কেউ নয়, দক্ষিণ পাড়ার নিঃসন্তান কাশিবুড়ি। যে একবার স্বামীর মৃত্যুর বিশ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে কাশি ঘুরতে গিয়েছিল বলে সে এখনো কাশির গল্প বলে বেড়ায় সবাইকে। বেরিয়ে এসে কাশিবুড়ি বলতে থাকে, হল না, হল না, কিছুই হল না। ভেবেছিলাম এই পায়খানায় বসে মদনের বাপের মতো আমারও মৃত্যু এসে যাবে। কিন্তু হল না। পৃথিবীতে আমার মত অভাগী আর নেই। মদনের বাড়ির সবাই হা করে কাশিবুড়ির মত অভাগীর দিকে তাকিয়ে থাকে।