গোবর্ধনের উদ্ধার – সদানন্দ সিংহ

গোবর্ধনের উদ্ধার – সদানন্দ সিংহ

গোবর্ধনের উদ্ধার             (ছোটদের গল্প)

সদানন্দ সিংহ

“যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।” বলেই গোবর্ধনদা হাসলেন। আবার বললেন, কথাগুলি আমার দাদার, উনি এটা আমাকে প্রায়ই বলেন। এর মর্ম বুঝলেই নাকি আমার ভবিষ্যৎ আলোয় ভরে যাবে।
শুনে আমি হাসলাম। বললাম, এটা তো আপনার দাদার মানে হর্ষবর্ধনদার কথা নয়, এটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। আর এটা আ্মাদের স্কুলের পাঠ্য বইয়ের একটা ভাবসম্প্রসারণ।
— তাই নাকি ! আশ্চর্য তো !
বুঝতে পারলাম, আমার কথাগুলি গোবর্ধনদা বিশ্বাসই করছেন না। আমি তাই আমাদের স্কুলের ব্যাকরণ বইটা এনে ভাবসম্প্রসারণ খুলে দেখালাম।
— তাই তো দেখছি। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা মিথ্যে হতে পারে না। তাই তো দাদা আমাকে এর মর্ম বোঝার কথা প্রায়ই বলেন।

তারপর থেকেই আমি দেখতাম কোনোখানে ছাই পড়ে থাকতে দেখলেই গোবর্ধনদা ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিতেন। আমি অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে কথাগুলির মানে হচ্ছে ক্ষুদ্র কোনো কিছুকে তুচ্ছ করা উচিত নয়। কিন্তু গোবর্ধনদা কি আর আমার কথা শোনে ? ছাই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি আর থামানো গেল না।

চৈত্র মাস। ঝিরঝিরে আবহাওয়া। গরম পড়েনি একদম। এইসময় একদিন সকালে গোবর্ধনদা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বললেন, আজ সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে এসো। তোমার বন্ধুবান্ধবদেরও সঙ্গে নিয়ে এসো। একটা পুজো আছে।
শুনে খুশি হলাম। পুজো মানেই খাওয়াদাওয়া। খাওয়াদাওয়ার সাথেই আমাদের বেশি সম্পর্ক। সন্ধ্যেবেলা আমি সুদেব, পিন্টু, গদা, ফটকে এবং জগাকে নিয়ে গোবর্ধনদা-হর্ষবর্ধনদার বাড়ি চললাম।
গিয়ে দেখলাম আমাদের আগেই পৌঁছে গেছে জংলিমামা, বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে উনি এক কাগজের থালায় তারিয়ে তারিয়ে প্রসাদ খাচ্ছে। আমাদের দেখে বললে, হাভাতের দল এসে গেছিস ? বোস, প্রসাদ খা।
ফটকে রেগে উঠল, আমাদের নিয়ে তুমি যা তা বলবে না বলে দিচ্ছি।
— কেন, নিজেদের আসল পরিচয় জেনে খারাপ লাগছে বুঝি ? বেশি ফ্যাচফ্যাচ না করে প্রসাদগুলি সাবাড় কর। আমার খাওয়া শেষ। তোদের মত পেটুকদের সঙ্গে বসে থাকা আমার চলবে না। আমি যাচ্ছি। বলে জংলিমামা গোবর্ধনদার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
আমাদের সবাইকে দেখে গোবর্ধনদা খুশি হলেন। হর্ষবর্ধনদাও খুশি হলেন। গোবর্ধনদা ঘরের ভেতর থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার বের করে আমাদের বারান্দায় বসালেন। তারপর ঘরের ভেতরের দিকে মুখ করে চেঁচালেন, মাসি, এখানে ছ’টা প্রসাদ বারান্দায় নিয়ে এস।
ভেতর থেকে মাসির আওয়াজ ভেসে এল, প্রসাদ দশ রকমের আছে, কোন্ ছ’টা নিয়ে আসব ?
গোবর্ধনদা আবার বলল, মাসি তোমার মাথায় কিস্যু নেই। আমি ছ জনের জন্যে প্রসাদ আনতে বলেছি।
— অঃ তাই বলো।
— আচ্ছা ঠিক আছে। সাত জনের জন্যে আনো, আমিও খেয়ে নেব।
— তুমি তো কিছুক্ষণ আগে খেলে।
— তাতে কী হয়েছে, আবার খাবো।
মাসি মানে গোবর্ধনদাদের কাজের মাসি। প্রতিদিন দু বেলা এসে রান্না এবং ঘরের কাজ করে দিয়ে যায়।

সেদিন আমরা পেট ভরে খিচুরি এবং অন্যান্য প্রসাদ খেলাম। খাবার পর গোবর্ধনদা বললেন, প্রসাদ খেলে, কিন্তু কীসের পুজো তোমরা জিজ্ঞেস করলে না দেখছি।
আমি বললাম, ও হ্যাঁ, মনে হচ্ছে নারায়ণ পুজো।
গোবর্ধনদা মাথা নাড়লেন, উহ হলো না। আচ্ছা চলো, নিজে গিয়েই দেখো।
আমরা ঘরের ভেতরে গেলাম। দেখলাম, হনুমানজীর মূর্তি। কিন্তু মূর্তিটাকে দেখে আমার চেনা চেনা মনে হলো। মনে হচ্ছে, এই মূর্তিটাকেই আমি জংলিমামার টেবিলের ওপর দেখেছিলাম। চুপিচুপি জগাদের সবাইকে আমার সন্দেহের কথা বললাম। সবাই জানাল, ওরাও দেখেছে।
আমি গোবর্ধনদাকে জানতে চাইলাম কোত্থেকে মূর্তিটাকে পেয়েছে ? গোবর্ধনদা জানালেন, জংলিমামার বাড়ির উঠোনে ছাই ঘাটতে গিয়ে মূর্তিটাকে পেয়েছে। বেশ বুঝতে পারলাম, এটা জংলিমামার কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। মুখে কিছুই বললাম না, তবে চুপিচুপি বন্ধুদের বললাম যে আসল ব্যাপারটা গোবর্ধনদাকে যেন না জানানো হয়, তাহলে গোবর্ধনদা দুঃখ পাবে। সাথে পাবে হর্ষবর্ধনদার তীব্র তিরস্কার। গোবর্ধনদা আরো বললেন, দাদা তো প্রথমে হনুমানজীকে পুজো করার জন্যে রাজিই হচ্ছিল না। বলেছিল মূর্তিটাকে তাকের ওপরে সাজিয়ে রাখতে। আমি যখন বললাম তোমার কথামত ছাই ঘাঁটাঘাঁটি করেই আমি মূর্তিটাকে উদ্ধার করেছি। নইলে কি আমি মূর্তিটাকে খুঁজে পেতাম?