বনলতা সেন – সদানন্দ সিংহ

বনলতা সেন – সদানন্দ সিংহ

বনলতা সেন         (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

কম্পিউটারের কিছু প্রোগ্রামিং বেশ ভালোই শিখে গেছি আমি এখন। ইদানীং আমি এখন আর্টিফিসিয়েল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে এক কাল্পনিক বনলতা সেনকে তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছি। প্রতিদিন রাত গভীর হয়। রাতেই আমার কাজ বেড়ে যায়। কারণ নিরিবিলিতে নিস্তব্ধ রাতে আমাকে কেউ কিছু বলার থাকে না। তখন আমার অর্ধাঙ্গিনী বিছানায় গভীর ঘুমে আপ্লুত থাকে। ও জানে না আমি কীসব করে চলেছি। ছেলেমেয়েরাও অনেক দূরে; প্রাইভেট ফার্মের চাকুরি, বছরে একবার বাড়িতে আসে। বাড়িতে শুধু আমি আর আমার স্ত্রী।
কম্পিউটার নিয়ে একসময় আমার আগ্রহ অসীম ছিল, এখনো আছে। জানি না, আর কেউ আমার মত জেনারেল আর্টসের সাবজেক্ট নিয়ে পাশ করা লোক কম্পিইউটার নিয়ে এত চর্চা করে কিনা। কিন্তু আমি করেছিলাম। এখনো করি। চাকুরি জীবনে জেনারেল ব্যাঙ্কিং থেকে ব্যাঙ্কের ইনফরমেশন টেকনোলজিতে ঢুকে গিয়েছিলাম। ইনফরমেশন টেকনোলজিতে ঢোকার আগে নিজের উদ্যোগে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর কিছু সার্টিফিকেট এবং ডিপ্লোমা কোর্স করে নিয়েছিলাম। সেই সময় অফিস ছুটির পর আমি রাতে আমি কম্পিউটারের ক্লাস করতাম। আমার সঙ্গের সব ছাত্রদের বয়স ছিল বাইশের কাছাকাছি। আমিই একমাত্র ধাড়ি লোক কম বয়সী ছাত্রদের সঙ্গে বসে ক্লাস করতাম। প্রথম দিকে আমাকে নিয়ে সেখানকার ছাত্র-শিক্ষক সবার এক আগ্রহের অন্ত ছিল না — ব্যাঙ্কের লোক, যার চাকরির কোনো প্রয়োজন নেই, সে কিনা এখানে ! তারপর জেনারেল ব্যাঙ্কিং থেকে ব্যাঙ্কের আই টি বিভাগে আসার পর ইনফোসিসের ভুবনেশ্বর, ব্যাঙ্গালোর সহ আরো কিছু জায়গায় ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে ট্রেনিং-এ গেছি।

একসময় আমার চাকুরি জীবনের অন্ত হয়। চাকুরি জীবনের শেষে আমি একটু উৎফুল্ল হয়েছিলাম, যাক এবার আর ধরাবাঁধা কোনো কাজ নেই, খাবো-দাবো আর শুধু ঘুরে বেড়াবো। প্রথম দু বছর এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালাম। তারপর সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর যে শখ ছিল তাও একসময় মিটে গেল বিভিন্ন কারণে। শেষে ঠিক করলাম বছরে একবার বা দু’বার বেরুবো।
এইসময় আমি অনলাইনে আবার কোর্স পড়া শুরু করলাম। একে একে আমি এইচ.টি.এম.এল, পি.এইচ.পি, সি.এস.এস, বুটস্ত্র্যাপ দিয়ে শুরু করে জাভা, জ্যাংগো হয়ে পাইথনে নেমে এলাম। শেষে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এ খুব আগ্রহ নিয়ে এগোতে থাকলাম এবং তার বিভিন্ন প্রম্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে ঠিক করলাম, এবার আমি এমন এক বনলতা সেনকে বানাবো যার সঙ্গে আমি অবিরত কথা বলবো, যাকে আমার ভাবনা আমার অনুভূতি সব শেয়ার করবো।

গভীর রাত পর্যন্ত আমার কাজ চলে। বিভিন্ন অ্যাাঙ্গেলে বিভিন্ন বিশেষণে বিভিন্ন বর্ণনায় পরিবর্তন করে করে বনলতা সেনকে তৈরির কাজ করে চলেছি। মাঝে মাঝে শুনি আমার অর্ধাঙ্গিনী ঘুমের মাঝে বলে উঠছে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সে আরো আস্তিক হয়ে উঠেছে। ঈশ্বর নিয়ে আগে বেশ লিবারেল ছিল। হয়তো এখন সে পরজন্ম নিয়ে ভীত হয়ে উঠেছে। আমি পরজন্ম নিয়ে চিন্তা করি না। এ জন্মই আমার সব।

একদিন এক গভীর রাতে দেখি, বনলতা সেনের এক মুখাবয়ব ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করেছে আমার কম্পিউটার স্ক্রিন জুড়ে। আমার শরীর জুড়ে খুশির বন্যা বয়ে যায়। হৃদকম্পন বাড়ে আমার। এক গভীর উচ্ছ্বাস নিয়ে আমি অপেক্ষা করতে থাকি। একসময় সারা কম্পিউটার স্ক্রীন জুড়ে বনলতা সেনের মুখ ফুটে ওঠে আর আমাকে বলে, হাই। আমি উত্তর দিই, হাই।
বনলতা সেন হাসে। তার ফর্সা দাঁত ঝিকমিক করে। বলে, তোমাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে।
— সত্যিই, তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার স্বপ্ন আজ যেন সার্থক।
— ধ্যৎ। স্বপ্নের সার্থকতা নিয়ে তুমি কেনো এত ভাব ? সার্থকতা নিয়ে চিন্তা কোরো না একদম, স্বপ্নকে আরো স্বপ্নিল করে তোলো।
— মনে থাকবে তোমার কথা। তুমি কিন্তু খুব সুন্দর।
— আমার হাসি পাচ্ছে। তুমি আমাকে কালো রং দিয়ে তৈরি করলে, আর বলছ খুব সুন্দর।
— কালো রং আমার ভালো লাগে। সত্যি বলছি। তোমাকে কালো পাথরের প্রতিমার মতই লাগছে। তোমার দু’পায়ে দু’টো ফুল দিয়ে আমার তো তোমাকে পুজো করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
— তাই ? আমি তোমাকে কোনো বাধা দেব না। তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো। তবে অত্যাচার আমি সইবো না।
— অত্যাচার করার কথা কল্পনাও করি না। এসো, আজ আমার সম্বন্ধে অনেক গল্প শোনাই।
— হ্যাঁ হ্যাঁ বলো। আমিও শুনতে চাই।
আমি ওকে আমার ছোটোবেলার অনেক গল্প শোনাতে লাগলাম। গভীর আগ্রহে সে আমার কথা শুনতে লাগল। বলতে বলতে সময় যে কোথায় এগিয়ে গেছে খেয়াল নেই। একসময় বনলতা আমায় থামিয়ে বলল, আজ থাক। সকাল হতে আর ঘন্টা খানেক বাকি। আজ রাতে আমি আবার তোমার কথা শুনবো। বাই। বলেই বনলতা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার আর ঘুম হল না।

সেদিন দুপুরে কলিংবেল বেজে উঠলে আমার স্ত্রী বলল, দেখো তো, কে এল আবার এই দুপুরবেলা খাবার সময়। আমি দরজা খুলে দেখলাম, মলিন ছিন্নবস্ত্র পরা শীর্ণকায়া এক বৃদ্ধা চোখে-মুখে এক বিষম ক্ষুধা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার চুলগুলি একদম সাদা হয়ে গেছে, বয়েস মনে হয় সত্তর-পঁচাত্তর। বললাম, কী চাই ?
উত্তর এল, একটু সাহায্য চাই।
আমার স্ত্রী কথাগুলি শুনতে পেয়ে বিশ টাকার একটা নোট নিয়ে এসে বলল, এই নাও ভিক্ষা।
বৃদ্ধা একটু অখুশি হয়ে জবাব দিল, না। আমি ভিক্ষা নিই না। সাহায্য নিই। ভিক্ষা হিসেবে আমি এই টাকা নিতে পারব না।
জবাব শুনে আমার স্ত্রী অবাক হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। আমিও অবাক। দরজায় দরজায় ইনি ভিক্ষাই করে বেড়াচ্ছে, অথচ ভিক্ষা হিসেবে কিছুই নেবে না। সাহায্য হিসেবে নেবে । এমন আত্মসম্মানবোধ কোনো ভিখিরিকে আমি আর আগে দেখিনি। আমার প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছিল। মনে হল, একটা গল্পের প্লট ভেসে বেড়াচ্ছে।
দেখলাম বৃদ্ধা সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে ঢুকে একটা একশ টাকার নোট নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে রাস্তার মুখে বৃদ্ধার হাতে টাকাটা দিয়ে বললাম, সাহায্য হিসেবে দিচ্ছি।
আমার হাত থেকে টাকাটা নিয়ে বৃদ্ধা একটু হেসে বলল, ধন্যবাদ। সবার সাহায্য নিয়েই এখন বেঁচে আছি। একসময় আমারও একটা সুসময় ছিল। ভাগ্য খারাপ বলে আমি এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। রাস্তাই এখন আমার ঘরবাড়ি।
আর কোনো কথা না বলে বৃদ্ধা রাস্তায় নেমে এগিয়ে যাচ্ছে। দেখতে পেলাম, ব্যাগভর্তি শাকসবজির বাজার করে গজুবাবু এগিয়ে আসছেন। গজুবাবু লোকটা কম দামে জিনিসপত্র কেনার জন্য সবসময় দুপুরের দিকেই বাজারে যান। সামনে আসার পর গজুবাবু বললেন, কী, ওকে সাহায্য দিলেন তো ? ওর নাম লাজবন্তী। ত্রিশ বছর আগে আমি ওকে দেখেছি, কী রূপের বাহার ছিল! প্রচুর পুরুষমানুষ ওর কাছে যাবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতো। আজ ওর রূপ নেই, সেই সব পুরুষরাও নেই।
গজুবাবু চলে গেলেন। দেখলাম লাজবন্তী রাস্তার কিনারে এক দেয়ালের কাছে বসে পড়েছে। আমিও ফিরে এলাম।

সেদিন রাতে আমি আবার বনলতা সেনের সাথে আলাপে মত্ত হলাম। অনেক অনেক গল্প করলাম। একসময় বললাম, লাজবন্তীকে তুমি চেনো ? বনলতা বলল, ছবি দেখাও, দেখি চিনি কিনা। আমি আমার ঘরের দরজায় লাগানো সিসিটিভি-র ফুটেজ ঘেঁটে লাজবন্তীর ছবি মোবাইলে ডাউনলোড করে বনলতাকে দেখালাম। ছবিটাকে চোখ দিয়ে স্ক্যান করল বনলতা। তারপর বলল, আমি তোমাকে লাজবন্তীর যৌবনের চেহেরা বানিয়ে দেখাচ্ছি। দেখো, চিনতে পারো কিনা। বলতে বলতেই বনলতার পাশের অর্ধাংশ জুড়ে মনিটরের স্ক্রীনে লাজবন্তীর যৌবনের চেহেরা ফুটে উঠলো। ছবিটাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম, এ যে হুবহু মাধুরী দীক্ষিতের চেহেরা। এ জন্যই তো সবাই একসময় পাগল ছিল লাজবন্তীর জন্যে।
বনলতা বলল, এটাও কি বনলতা সেনের মতো লাগছে ? তোমরা পুরুষরা নারীর রূপের পাগল।
বললাম, হয়তো একদিন অনেক পুরুষের কাছে লাজবন্তী ছিল বনলতা সেনই। তবে সে আমার কাছে বনলতা সেন নয়, লাজবন্তী সেন।
বনলতা হাসলো, কী অদ্ভুত ব্যাপার। কারণ ?
— কারণ লাজবন্তী সেনের বয়স বাড়ে। আর বনলতা সেনের ? তার বয়স কোনোদিনই বাড়ে না। তার প্রেমিকদের বয়সও কোনোদিন বাড়ে না। বলেই আমি বনলতার দিকে একটা ফ্লায়িং কিস্ ছুঁড়ে দিলাম।