কবিতা ও কিছু কথা (প্রবন্ধ-নিবন্ধ)
সুদীপ ঘোষাল
কবিতা ছড়িয়ে আছে জীবনে, প্রকৃতির মাঝে। তবে সবসময় সে ধরা দেয় না। প্রত্যেকের অন্তরে জাগ্রত একজন, সদা কথা বলে নিজের সঙ্গে। তার জন্য আবেগ আর, সাধনার প্রয়োজন। কবিতালেখক, লিখতেই পারেন কিন্তু কবিতা হল কি না পাঠক বলবেন। প্রেম করা যায় না, হয়ে যায়। একজন কবির মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, মনের ভিতর ভীষণভাবে অনুরণনশীল বস্তুর বহিঃপ্রকাশ কবিতা লেখায় সমৃদ্ধ হচ্ছে কী?
লেখার সময়ে সচেতন ভাবে লেখনীর মধ্যে কবিতার ভাব অনুভব করি না! অবচেতন মন থেকে উঠে আসা দিনলিপির বোধকে প্রকাশ করি কি শব্দচয়নে? শব্দচয়ন সঠিক হচ্ছে কি? কবিতা লেখার কি কোন নিয়ম হয়। কবিতার কি ব্যাকরণ হয়? নানা মুনির নানা মত? অনেকে বলেন, প্রচুর পড়াশোনা না করলে কবি হওয়া যায় না। আবার বাস্তবে দেখি নিরক্ষর এক কবি রাষ্ট্রপতির কাছে পুরষ্কার নিচ্ছেন তাঁর স্বভাবজাত কবিতা রচনার কারণে। তিনি কবিতার লাইন বলেন আর একজন তাঁর কবিতা লেখেন। কাউকে আঘাত না করেই বলি, কবিতা সকলের জন্য নয়। স্বভাবজাত আবেগ না থাকলে কাক কখনও কোকিল হয় না। মনের ভিতর জেগে ওঠা অনুভূতিকে শব্দের বিন্যাসে সুন্দর ক’রে গেঁথে ফেলি পাঠকের উদ্দেশ্যে। সময়োপযোগী প্রতিবেদন হোক বা পুরাতনী ইতিহাস, সবকিছুতেই চেষ্টা করি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে।
অনেকেই বলেন, কবির দায়িত্ব নয় পাঠকের দৃষ্টিকে দেখা বা লেখা। তাঁর উদ্দেশ্য শুধু লিখে যাওয়া। কে কতটা নিতে পারল বা বুঝতে পারল, সেটা সম্পূর্ণ পাঠকের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আমি ভিন্নমত পোষণ করি।
কবিতা না বুঝতে পারলেও কিছু করার থাকে না। কবিতা বোঝানোর দায়িত্ব কিন্তু কবি নেবেন না। পাঠকই শেষ কথা।
কবি অতি সূক্ষ্ম তরঙ্গের স্পন্দন শোনার অপেক্ষায় মৌন হয়ে অপরূপ প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিতে চায়। চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্ব জগতে ভাসতে ভাসতে ছাই হয় নশ্বর দেহের অহংকার।
স্থূল পদার্থ নিয়ে কবির মত পরমাণু বিজ্ঞানীরা অপেক্ষায় থাকেন না। অণু পরমাণু নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত। তা না হলে হিমালয়ের চূড়া কিংবা জমি জায়গা নিয়েই তারা টানাটানি করতেন বেশি।
আকাশকে আমরা পৃথিবীর মানুষ স্বার্থপরের মত খণ্ড খণ্ড করেছি। এটা কাটোয়ার আকাশ, ওটা দিল্লির, ওটা রাশিয়ার আকাশ। অখণ্ডতার বাণী আমরা ভুলে যাই। কবি বলেন, আকাশ চিরদিন অখণ্ডই থাকে। তাকে খণ্ডিত করার অকারণ অপচেষ্টা না করাই ভালো। তবু কাঁটাতার হয়, সীমানা ভাগ হয়। অদ্ভূত মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে আছে প্রাণীকুল।
কবির আলোর অন্তরে বাদ্য বাজে, ‘অনন্ত নাদ’ এর ভেরী। সূক্ষ্ম তরঙ্গে মিশে যায় তার অস্তিত্ব,ভুলে যায় তার অবস্থান। এ অনুভূতি ঝরনার মত, কবিতার মত, ভালোবাসার মত, নদীর প্রবাহের মত। জোর করে সে গতি পাল্টায় না।
কবিগুরুর মানবের আত্মার স্বরূপ হচ্ছেন সর্বজনীন মানব বা পরম পুরুষ। যিনি সব মানুষের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট থেকে মহত্ত্বের শ্রেয়োবোধের প্রেরণা দিচ্ছেন। চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় তার পরিচয় আছে।
‘কে সে? জানিনা কে! চিনি নাই তারে-
শুধু এইটুকু জানি-তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে
ঝড়ঝঞ্চা বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তর প্রদীপখানি! …
মানুষের অন্তরে এক মহামানবত্বের প্রেরণা, যা তাকে অনুপ্রাণিত করে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যায় তাকে অনুভব করেন কবি। তবে মহামানবের কর্ণে তার আহ্বান পৌঁছায় সবার আগে। তাঁরা সংসারের সীমা ছেড়ে ছুটে আসেন। নতুন নতুন ত্যাগ ও দুঃখবোধ প্রকাশিত হয়। মানুষের অন্তর্নিবিষ্ট মহামানবই কবির ‘সদা জনানাং হৃদয়ে আছে। মহামানবকে লাভ করার সাধনাই কবির ধর্ম সাধনা। এর নাম মানবধর্ম। কবিগুরুর আত্মদর্শন বিভিন্ন কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। গীতমাল্যের কবিতায় মহামানবকে লাভ করার জন্য ত্যাগ ও দুঃখবরণ করে মানবাত্মার অভিসারের কথা বলা হয়েছে। দুঃখকে আত্মসাৎ করার আনন্দের কথা ‘আত্মপরিচয়ে’ বলেছেন তিনি। দুঃখের মধ্য দিয়ে সুন্দরের পরমসত্তার আবির্ভাব ঘটে।
কবি বলেন সৃষ্টির সবাই ভয়ে কাজ করি। অস্তিত্ব বিনাশের ভয়ে। পৃথিবী ঘোরে ভয়ে, তা না হলে সে ধ্বংস হবে। সূর্য তাপ দেয় ভয়ে, তা না হলে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
সৃষ্টি মানুষের প্রশ্বাস, স্থিতি মানুষের ক্ষণিক ধারণ, প্রলয় মানুষের নিশ্বাস।
কবি হলেন আলোর অনুসন্ধানী, তার ভয় নেই, তাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই নেই। লোভ নেই, তাই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নেই। অকাল বার্ধক্য নেই।
আছে শুধু আনন্দ, ছেলেমানুষি, বোকামি, সরলতা, সোজা পথে হাঁটার সোজা রাস্তা…
কবিবন্ধুর মত, লোভলালসা নির্বিশেষে অখণ্ডতার অসীম ভালোলাগায় মনসায়রে আপনি ডুব দিতেই পারেন…