ফৈয়াজ চাচা ও বাপুরামের গল্প – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য

ফৈয়াজ চাচা ও বাপুরামের গল্প   (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য

(১)
… তারপর হারিয়ে গেলো ফৈয়াজ চাচা।
সে রাতে পুলিশ এলো গাঁয়ে। ফৈয়াজ চাচাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। আর ফেরেনি। আস্ত মানুষটা উবে গেল কর্পূরের মত। জগবন্ধু মিত্র বললো, তাইতো ফৈয়াজ কোথায় গেলো!

গল্পটা পুরনো। বেশ পুরনো। পথে ঘাটে হাটে বাটে সর্বত্র তখন জগবন্ধুবাবুদের রমরমা।
রাস্তায় কান পাতলে সব-হারানো মানুষের দুর্দশার সব কথা শোনা যেত। জগবন্ধুবাবুরা গলার শিরা ফুলিয়ে, মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত আকাশে ছুঁড়ে সবাইকে শোনাত সেই সব কথা। গল্পটা সেই সময়ের।
গ্রামের মাঝে বাজার। বাজারের মাঝে তারক কাকার চায়ের দোকান। জগবন্ধু মিত্র মধ্যমণি। সঙ্গে দোসর ইয়াসিন সাহেব।
তারক লাল চা দিবি, চিনি ছাড়া। বলে জগবন্ধু মিত্র।
দু গ্লাস লাল চা এগিয়ে দেয় তারক। সঙ্গে ইয়াসিন সাহেব আছে।
চুমুক দেয় জগবন্ধু মিত্র। বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী শক্তির মুণ্ডুপাত। সর্বহারাদের সর্ব যন্ত্রণার ময়না, তারপরই।
শুরু করে জগবন্ধু বাবু। সাবাস বলে ইয়াসিন। অবাক হয় তারক কাকা।
ফৈয়াজ চাচা বলে, ওসব ধাপ্পা। লোক ভুলানোর ছল। তারক কাকা চেয়ে দেখে ফৈয়াজ চাচাকে।
জগবন্ধু মিত্র বলে, ফৈয়াজ একটা বুর্জুয়া।
ফৈয়াজ হাসে।

পৃথিবীর মানচিত্র খাবলে খাবলে দুই হাতে নানা দেশ মহাদেশের গরীব হাভাতে মানুষগুলোর যন্ত্রণার কথা তুলে আনে জগবন্ধু। ইয়াসিন বলে জগবন্ধুদা সব জানে। কত পড়াশোনা করেছে! সারা দুনিয়ার খবর রাখে। তারক কাকা চেয়ে থাকত জগবন্ধুবাবুর দিকে।
আর ফৈয়াজ চাচা বলে ওসব ধাপ্পা। লোক ভুলানোর ছল।
জগবন্ধু মিত্র বলে, জঙ্গলের রাজত্ব চায়। ফৈয়াজ একটা বুর্জুয়া।
ফৈয়াজ হাসে।

তারক কাকা দাড়ি চুলকে বলে, জগবন্ধুদা তুমি যে সব জায়গার নাম বলো সে সব জায়গা কোথায় আছে? জগবন্ধু মিত্র হেসে বলে সে সব অন্য দেশ রে তারক। গরীব হাভাতে মানুষ সারা পৃথিবীতে আছে। সবার কথা ভাবতে হয়।
তারক কাকা কি বুঝত কে জানে। কেটলি মাজা ছেড়ে চেয়ে থাকে জগবন্ধু মিত্রের মুখের দিকে।
ইয়াসিন সাহেব বলে তুই অতশত বুঝবি না তারক। লাল চা চিনি ছাড়া দুটো দে। জগবন্ধুদার থৈ কি আর তুই পাবি!
ফৈয়াজ চাচা বলে ওসব ধাপ্পা। লোক ভুলানোর ছল।
জগবন্ধু মিত্র বলত, ফৈয়াজ একটা বুর্জুয়া। জঙ্গলের শাসন চায়।
ফৈয়াজ হাসে।

লাল চায়ে চুমুক মেরে জগবন্ধু মিত্র বলে বলিভিয়ায় বাজ পড়ে চারশ শ্রমিক মারা গেলো রে তারক। পরিবারগুলো ভেসে যাবে। মানব সম্পদ। মানব সচেতনতা ছাড়া কিভাবে চলে বল! যা পারিস সাহায্য করিস। ইয়াসিন সাহেব হাতের কৌটোটা উনুনের পাশে রাখে।
তারক কাকার দৃষ্টি পয়সা ভর্তি কৌটো ছুঁয়ে ফৈয়াজ চাচাকে আঁকড়ে ধরে।
ফৈয়াজ চাচা বলে ওসব ধাপ্পা। লোক ভুলানোর ছল।
জগবন্ধু মিত্র বলে, ফৈয়াজ একটা বুর্জুয়া। জঙ্গলের শাসন কায়েম করতে চায়। সাবধান ফৈয়াজ।
ফৈয়াজ হাসে।

সেদিন জমে উঠেছে আলোচনা। এলাকায় কয়লার সন্ধান মিলেছে। কালো হীরে! হীরে তো হীরেই। মূল্যবান। অতএব জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাও।
তারক কাকার দোকানের একপাশে বসে নেপাল মুর্মু, হারান টুডু, তুকু হেমরম। বেদনাস্নাত চাউনি সবার।
লাল চায়ে চুমুক দিচ্ছে জগবন্ধু মিত্র।
নেপাল মুর্মু বলে, জগোবনদুবাবু আমাদের ভিটেনাশ হচ্ছে। এই সর্বনাশ…।
জগবন্ধু মিত্র বলে, “কি করবি বল! মাটির নিচে কয়লা কি আমরা রেখেছি! তাছাড়া মন্দ কি রে? পয়সা পাবি। দেখি যদি কাজের ব্যবস্থাটাও করতে পারি…।”
নেপাল মুর্মু বলে, আমাদের ভিটেনাশ!
হারান টুডু বলে, আমাদের পেটে লাথি!
তুকু হেমরম বলে, আমরা সব হারাবো!
জগবন্ধু মিত্র বলে, দেখছি, দেখছি। চিন্তা কি? আছি তো তোদের পাশে। তোদের পাশেই থাকবো।
এই কথা শুনে তারক কাকা ভীষণ জোরে চিৎকার করে বলে, ও সব লোক ভুলানোর ছল। ধাপ্পা। ধাপ্পা। ধাপ্পা।
ফৈয়াজ চাচা হাসে। হা হা করে হাসে।
রাগে মুখ গন গন করে জগবন্ধুবাবুর। তারক এমন কথা বলবার সাহস পেল কিভাবে? প্রশ্নটা ভাবিয়ে ছিল জগবন্ধুবাবুকে।
সেই রাতেই পুলিশ এলো। কালো গাড়িতে ফৈয়াজ চাচাকে নিয়ে চলে গেলো নিঃশব্দে।
পরদিন সকালে জগবন্ধু মিত্র বললো, ফৈয়াজ কোথায় গেলো! লোকটা ভালো ছিল।
তারক কাকা চুপ। কথা নেই মুখে। দুটো লাল চা, চিনি ছাড়া এগিয়ে দেয়। একা জগবন্ধু মিত্র নয়। ইয়াসিন সাহেব আছে সঙ্গে।
ফৈয়াজ চাচা আর নেই।


(২)

জঙ্গল ফুঁড়ে হাজির হলো লোকটা।
ভীষণ ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সামনে। ইমরানের দিকে।
ইনসাস উঁচিয়ে তৈরি ইমরান। ট্রিগারে আঙুল। জঙ্গলের কাক-পক্ষীও জঙ্গলের বাইরে বের হতে পারবে না ইমরানদের ফাঁকি দিয়ে।
লোকটাকে নিশানায় ধরেছে রজতরাম। তারও হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। আর কয়েকটা মুহূর্ত হয়ত।তারপরেই ঝাঁঝরা হয়ে যাবে কালো জীর্ণ শরীরটা।
লোকটা এগিয়ে আসছে। ক্লান্ত পদক্ষেপ। ভয় নেই ইনসাসে!
রজতরাম চাপা গলায় বলে, “ইমরান, রিস্ক মত লেনা। চালা দে।”
“রুক যা। আনে দে”, বলে ইমরান।
“ইয়ে হামারা মুলুক হ্যায় ভাই। হাম জনতা ইন লোগোকো।”
রজতরামকে চুপ থাকতে ইশারা করে ইমরান। লোকটা আরো কয়েক পা সামনে এসেছে। এতক্ষণে স্পষ্ট চোখে পড়ে তার হাড় জিলজিলে শীর্ণ চেহারা। শতছিন্ন এক টুকরো কাপড় কোমরে বাঁধা। লজ্জা নিবারণ হয়নি মোটেই। লজ্জায় লজ্জা নেই লোকটার। হাতে একটা কিছু রয়েছে। টিফিন কৌটা হতে পারে। কথাটা ভাবতেই শরীরের স্নায়ু সতেজ হয়ে ওঠে ইমরানের। কৌটো বোমা! হতেই পারে। অবিশ্বাস্য নয় কিছু। এরা কৌটো বোমা ব্যবহারে ওস্তাদ। ছেলে, মেয়ে, বুড়ো সবাই বোমা বানাতে পারে। অবলীলায় বোমা নিয়ে মেরে ফেলতে পারে শত্রুকে। পরোয়া করে না নিজের জীবনের। এদের সম্পর্কে এই কথাগুলো বহুবার শুনেছে ইমরান।
রজতরাম সিং ফিসফিসিয়ে বলে, “রিস্ক মত লে ইমরান। চালা দে গোলি।” বলেই হাতের ইনসাস তাক করে লোকটার দিকে।
“নেহি। ওয়েট”, বলে ইমরান।
পাঁচস্তরীয় নিরাপত্তা প্রাচীরের একেবারে বাইরের প্রাচীর স্তম্ভ ইমরান, রজতরাম। আরও অনেকে।
নগরীর প্রান্তে জঙ্গল। ঘন সবুজের প্রলেপ। বিশাল বিশাল জলাশয়। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আকাশ ছোঁয়া মর্মর মূর্তি। এক অক্ষয় কীর্তি। নব প্রযুক্তির মুকুটে রঙিন পালক। বিশ্ববাসীর সামনে গর্বিত দেশ। সেই মূর্তির উন্মোচন, আজ। ঠিক সকাল সাড়ে নয়টায়। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটা মিলিয়ে মন্ত্রী মহোদয় আসবে। নিরাপত্তা সেই কারণেই।
আরো একটা কারণ আছে। সে নিয়ে ভাবনা ও ভয় দুটোই বেশি। ভীষণ বেশি। জমাট, নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা তাই। এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে বিক্ষোভ আছে। তাদের সহজ সরল জীবনের ছন্দ ব্যাহত হয়েছে। পরিস্থিতি তাই অস্বাভাবিক। এলাকার সমস্ত মানুষ শেষ দুই দিন ধরে উপবাসী। প্রতিবাদী এই ভাবেই। সে খবরে আগ্রহ নেই দেশ দুনিয়ার।
লোকটা এগিয়ে এসেছে আরো খানিকটা। ইমরানের থেকে কয়েক ফুট দূরে। রজতরাম প্রস্তুত।
ভাবনার বিভ্রান্তিতে অগোছালো ইমরান। এমনটা হবার কথা নয়। নিজেকে বিন্যস্ত করতে চেয়েও ব্যর্থ হয় বারবার। সামান্য ভুলের বিরাট মাসুল দিতে হতে পারে। তবুও লোকটাকে কাছ থেকে দেখতে চায় আজ। মারলে তো এখনই শেষ করে দিতে পারে।
লোকটা ইমরানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে। জীবন যন্ত্রণার হাজার বর্ণ ফুটে উঠেছে মুখের কুঞ্চনে। কিছু বলতে চায় যেন। অস্ফুটে ধেয়ে আসা শব্দের অর্থ অধরা ইমরানের কাছে। এগিয়ে আসে রজতরাম। বাপুরামের ভাষা রজতরাম বোঝে।
এলাকায় কারোর বাড়িতে চুলো জ্বলেনি শেষ দুই দিন। জঙ্গলের মানুষ বাপুরাম। অনাহারের সঙ্গে সহবাস। মরণে ভয় নেই তার। বাপুরাম ভালোবাসে তার ছোট্ট নাতনিকে। খিদেয় ছটপট করে একরত্তি মেয়ে। বাপুরামের ছেলের বউ বুকে তুলে নেয় মেয়েকে। কান্না থামে না মেয়ের। বুকে আর দুধ কোথায়! সেখানেও খরা। মুখের লালায় কি বাচ্চা মেয়ের পেট ভরে!
খিদের জ্বালায় মরেই যাবে বাপুরামের নাতনি। তার মরণ দেখে কি ভাবে! ভোর হতেই টিফিন কৌটো হাতে এদিকে এসেছে। বড় বড় মানুষদের আনাগোনা এদিকে, শুনেছে বাপুরাম। খাবার এখানে মিলবে নিশ্চয়। বিপুল আশা নিয়েই এদিকে আসা।
সামান্য খাবার চাই। শুধু বাচ্চাটার জন্য। বাপুরাম টিফিন কৌটো এগিয়ে দেয় ইমরান আর রজতরামের দিকে।
আপসোস হয় ইমরানের। ইনসাস হাতে মন্ত্রীদের অভয় দিয়ে পারে। বাপুরামকে অন্ন দেবে কি ভাবে! কাজেই…।

পেট্রোল ভ্যান এসেছে। তিন জোড়া মজবুত হাতে বন্দী হয়েছে বাপুরাম, জঙ্গলের লোক। খতরনাক আদমি। টিফিন কৌটো নিয়ে ব্যস্ত বোম্ব স্কোয়ার্ড। মন্ত্রী মহোদয় খুব বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছে! নয়তো জঙ্গলের ওরা মেরেই ফেলত! কৌটো বোমা ফেটে হাজার টুকরো হয়ে ছড়িয়ে …। ব্রেকিং নিউজ। আজ কা তাজা খবর! গরম মিডিয়া।
কর্তব্যে গাফিলতি। অভিযুক্ত ইমরান আর রজতরাম। অভিযোগ গুরুতর। জঙ্গলের মানুষের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ। দেশদ্রোহী। প্রিজন ভ্যান তুলে নিয়ে যায় ইমরান, রজতরামকে। ব্রেকিং নিউজ।
প্রিজন ভ্যানের জাল ফুঁড়ে বাপুরামের নজর টিফিন কৌটোর দিকে। নাতনিটা না খেয়ে মরেই যাবে বুঝি। বোম্ব স্কোয়ার্ড নিরাপদ দুরত্ব থেকে কৌটো বোমাটাকে ডিফিউজ করতে প্রস্তুত হচ্ছে। কৌটো বোমা!
বাপুরাম অবাক হয় ভীষণ। নাতনির কথা ভেবে চোখে জল আসে বাপুরামের। এগিয়ে চলে প্রিজন ভ্যান।