উত্তরণের পথে (ছোটোগল্প)
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য
— মা
ডাক শুনে চমকে ওঠে সুরমা। তাকিয়ে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে কৃপানন্দ। অবাক হয় সুরমা। বলে, তুমি আবার কষ্ট করে এলে কেনো মহারাজ?
পর পর তিন রাত ঘুম হয়নি সুরমার। হরপ্রসাদের বেডে বসেই রাত কাটিয়েছে। স্বামী অসুস্থ। একরাশ উদ্বেগ ছায়াসঙ্গী। দুপুর বেলায় নার্সিংহোমের রিসেপশনে বসে ছিল সুরমা। দুশ্চিন্তা নিয়ে আসে তন্দ্রা। ভারী হয়ে ওঠে দুচোখের পাতা। তন্দ্রা ভঙ্গ হয় কৃপানন্দের ডাক শুনে।
সুরমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে কৃপানন্দ। থাক থাক এখানে আর প্রণাম করতে হবে না বাবা। কৃপানন্দের মাথায় হাত রাখে সুরমা। বন্ধ দুচোখ। বুকের মধ্যে হঠাৎ করেই তোলপাড় শুরু হয়। সাত বছর পর স্পর্শ করে ছেলেকে। বলে ঠাকুর রক্ষা করুন। তোমার গুরু সহায় হোন। আশীর্বাদ করে সুরমা তার একমাত্র সন্তানকে। মাথা তোলে কৃপানন্দ। স্বামী কৃপনান্দ মহারাজ। কেমন আছো তুমি? জিজ্ঞাসা করে মাকে। তোমার বাবার শরীরের এই অবস্থা। এর মধ্যে কিভাবে…। কথা শেষ করে না সুরমা। মায়ের দিকে চেয়ে থাকে কৃপানন্দ। দুচোখে জল। তীব্র মানসিক উৎকণ্ঠার সুস্পষ্ট ছবি ফুটে উঠেছে সুরমার মুখে। চিন্তা করোনা। ঠাকুরের উপর ভরসা রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে। মাকে বলে কৃপানন্দ। ভরসা রাখবার মত ভরসাটুকু আর পাই না মহারাজ। ঠাকুরও স্বার্থপর। নিজের কথাই ভাবে। কথাগুলো বলে বুকের ভার হালকা করতে চায় সুরমা। বোঝে কৃপানন্দ। মায়ের এ কথার কোনো উত্তর দেয় না। সংসারী মানুষ। এমন ভাবনা অস্বাভাবিক নয়। আপন চাওয়া পাওয়ার হিসেবে গরমিল হলেই মান অভিমান চলকে চলকে বাইরে আসে। ঈশ্বরে বিশ্বাস দুমড়ে মুচড়ে যায়। মন ভালো তো জগৎ ভালো। সংসারী মানুষ এমন। ঈশ্বরে বিশ্বাস ঠুনকো বড়ো। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের কথা। গুরু পূর্ণানন্দের সামনে বসে এ কথা হাজার বার শুনেছে কৃপানন্দ।
কি ভাবে কি হলো মা ? সুরমাকে জিজ্ঞাসা করে কৃপানন্দ। চোখ বন্ধ রেখে বসে থাকে সুরমা। নিজেকে সামলে নেবার প্রয়াস। হয়তো নিঃশব্দে বলতে চায়, কি বলি তোমায় মহারাজ। সবই তো জানো। তোমার বাবার এমন অবস্থা কেনো, সে কি অজানা তোমার কাছে। আমাদের একমাত্র সন্তান তুমি। প্রাণের অধিক প্রিয় তুমি। সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছো। তারপরে বাবা মায়ের কি অবস্থা হয়, তাও কি তোমায় বুঝিয়ে বলতে হবে মহারাজ?
— মা, বাবার চিকিৎসা আমার কাছে রেখে করাব। এখান থেকে ছুটি দিলেই নিয়ে যাবো আমার আশ্রমে। বলে কৃপানন্দ।
— কেনো? এখানে কিসের অসুবিধা মহারাজ? জিজ্ঞাসা করে সুরমা।
— হার্টের পেশেন্ট। তুমি একা সামলাতে পারবে না মা। তাছাড়া …।
— দেখা যাবে মহারাজ। আগে তো এই বিপদ কাটুক।
দিন চারেক আগে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পরে হরপ্রসাদ। রোজ দিনের মতোই সন্ধ্যাবেলায় জপ আহ্নিক শেষ করে চায়ে চুমুক দেয়। বুকের বাম দিকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তি। ইতু পুজো ছিলো সেদিন । উপবাসী থেকে গৃহদেবীর নিত্যসেবা দিয়ে ইতু পেতেছে হরপ্রসাদ। অন্য দিনের চেয়ে দেরি হয়েছে ঠাকুর ঘর থেকে বের হতে। সময়ে খাওয়া হয়নি। ভেবেছে গ্যাসের ব্যথা। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বুকের যন্ত্রণা। হাত পা অবশ হয়ে আসে। ঘাড়ের যন্ত্রণায় আরো কাহিল হয়ে পড়ে হরপ্রসাদ। বাড়িতে একা সুরমা। বিভ্রান্ত। শেষে অতীনকে ডাকে। নার্সিংহোমে নিয়ে যায় হরপ্রসাদকে। পর পর তিন রাত হরপ্রসাদের পাশে বসেই রাত কাটিয়েছে সুরমা। অতীন ছাড়াও পাড়ার কয়জন ছেলে নিয়ম করে এসে দাঁড়িয়েছে সুরমার পাশে। ওষুধ ইঞ্জেকজন স্যালাইন এনে দিয়েছে সময়ে।
আমাকে খবর দাওনি কেনো? জিজ্ঞাসা করে সুরমাকে কৃপানন্দ। তুমি তো জানো মহারাজ, তোমার বাবা এসব পছন্দ করেন না। তাছাড়া অত দূরে ছিলে তুমি। অবশ্য আমি চেয়েছিলাম তোমার বাবার খবর তোমাকে…।
হরপ্রসাদ বরাবর অন্য রকম মানুষ। ছেলে সংসার ত্যাগী। সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর সংসার থাকে না। বৃহত্তর জীবনে তার কর্ম। পরমেশ্বরের সন্ধানে তার সাধন। জীব সেবায় অপার আনন্দ। জগৎ জুড়ে ঈশ্বরের কর্মযজ্ঞে তার সমুজ্জ্বল উপস্থিতি। তাকে আবার পিছুটানা কেনো। যতদিন কাছে ছিলো দাবি ছিলো তার উপর। কৃপানন্দের জীবন এখন অন্য খাতে বয়ে চলে। নিজের কোনো প্রয়োজনে ছেলেকে কাছে ডাকতে রাজি নয় হরপ্রসাদ। যাকে একবার ছেড়েছে তাকে মন থেকেই ছেড়েছে। আর আঁকড়ে ধরা চলে না। মুক্ত মনে এগিয়ে দিয়েছে তার খোকাকে। সেদিন বুক কাঁপেনি হরপ্রসাদের। ছেলে সন্ন্যাসী হতে চায়। এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কিই বা হতে পারে। সুরমা পারেনি মেনে নিতে। কোনো ভাবেই পারেনি। ছেলেকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেবার আগে বারবার অনুযোগ জানিয়েছে হরপ্রসাদের কাছে। অটল থেকেছে হরপ্রসাদ তার ভাবনায়। সুরমাকে বলেছে, খোকা তো আর ছোটো নেই। কলেজে পড়াচ্ছে। তার জীবন পুর্ণানন্দকে উৎসর্গ করবে সে। আধ্যাত্বিক জগতে তার সাদর আমন্ত্রণ। সে পথে বাধা দেওয়া কেনো । স্বামীর উপর অভিমান করেই কৃপানন্দের সাধন পথে বাধা দেয়নি সুরমা। গৃহদেবীর চরণ স্মরণ করে সায় দিয়েছিল তার খোকার ইচ্ছেয়। তারপর সেদিনের কথা ভেবে বহুবার বিস্মিত হয়েছে সুরমা। পেরেছিল কি ভাবে! একমাত্র সন্তান। চোখের সামনে গৃহত্যাগী হতে চলেছে। কি ভাবে সহ্য করেছিল সুরমা? খোকাকে সন্ন্যাস নেবার অনুমতি দিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ছিলো সুরমা। একদিন নয়। কতো কতো দিন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ঠাকুরের কথা শুনিয়েছিল হরপ্রসাদ। কানে নেয়নি সুরমা। চলেই যখন গেছে তখন তত্ত্ব কথায় স্বান্তনা খোঁজার বিলাসিতা দেখানো অর্থহীন। বরং আগুন জ্বেলেছে বুকের মধ্যে। প্রতিদিন নিজেকে পুড়িয়েছে। সুরমা তো মা। সন্তানের মঙ্গল চেয়ে শান্ত হতে চেয়েছে। লড়াই করেছে। নিজেই হয়েছে নিজের প্রতিপক্ষ। কোনো কোনো দিন মন বুঝেছে। আবার তারপরেও রাত দিন বুকের ভিতর কি যে চলত। ঝড়, দামাল ঝড়ে বিধ্বস্ত হতো সুরমা। কখনো ছুটে গেছে আসানসোলে। আশ্রমে। গুরু পূর্ণানন্দের কাছে। অঝোরে কেঁদেছে সুরমা। খোকা আমার একমাত্র সন্তান বাবা। আপনি বললেই সে ফিরে যাবে পূর্বাশ্রমে। আকুতি জানিয়েছে সুরমা কৃপানন্দের গুরুদেবের চরণে। আমি বলার কে মা। ঠাকুরের ইচ্ছেয় জগৎ চলে। তাঁর ইচ্ছেতেই মনের ভাব। গতিও। যা হয়েছে জানবে ভালোর জন্যই হয়েছে। কতো তপস্যা করে গর্ভে এমন সন্তান আসে মা। পূর্ণানন্দের কথা শুনে মনের আগুন কয়েক গুন বেড়ে উঠেছে। নিশ্চিত হয়েছে সুরমা তার খোকা ফিরবে না আর। কঠিন হয়েছে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। তারপর কবেই যেনো অভ্যাস হয়ে গেলো গনগনে তাপের মধ্যে বেঁচে থাকা। মনের বাসনা সেই গনগনে তাপে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে। সাত সাতটা বছর পার হয়ে গেছে। আজ এতদিন পর খোকাকে দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সুরমা। পাশে থেকেও কতো দূরের মানুষ তার খোকা। মুণ্ডিত মস্তক। গৈরিক বসন। এ মানুষ তার অচেনা। ইনি স্বামী কৃপানন্দ। তাকে মহারাজ বলে ডাকতে হয়। হরপ্রসাদের নির্দেশ। সন্ন্যাসী মানুষকে এভাবেই সম্বোধন করতে হয়। চোখ বন্ধ রেখে বসেছিল সুরমা। সামনে দাঁড়িয়ে কৃপনান্দ।
— মা, ডাকে কৃপানন্দ।
বেসামাল সুরমা। মায়ের পাশে বসে কৃপানন্দ। বলে, চলো বাবার কাছে যাই।
বেডে শুয়ে হরপ্রসাদ। ঘুমাচ্ছে। স্যালাইন চলছে।
— আজ সকালে অক্সিজেন খুলে দিয়েছে। বলে সুরমা। হরপ্রসাদের পাশে দাঁড়ায় কৃপানন্দ। হাত রাখে হরপ্রসাদের মাথায়। অপলক হয়ে দেখে বাবাকে। চেনাই যায় না হরপ্রসাদকে। আজ বছর সাতেক পর বাবাকে দেখছে কৃপানন্দ। পুরানো সেই মানুষটার কঙ্কাল যেনো। গালে সাদা দাঁড়ি। মুখের চামড়ার সহস্র কুঞ্চন। বয়স পয়ষট্টি থেকে আরো তিরিশ বছর সামনে এগিয়ে এসেছে এই কয় বছরে। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কৃপানন্দ। হাত ছোঁয়ায় বাবার কপালে। চোখ খোলে হরপ্রসাদ। কয়েক মুহূর্তের জন্য মেলে ধরে দৃষ্টি। স্থির চাউনি আঁকড়ে ধরে কৃপানন্দকে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে হরপ্রসাদ? না। তন্দ্রাচ্ছন্নতা আছে ঠিকই। তবে এ স্বপ্ন নয়। কৃপানন্দ এসেছে হরপ্রসাদের কাছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটে। কম্পিত দুহাতে প্রণাম মুদ্রা ধরার চেষ্টা করে হরপ্রসাদ। সন্ন্যাসী দেখলে এমন ভাবেই সম্মান প্রদর্শন করে এসেছে হরপ্রসাদ। আজও সে অভ্যাসে বজায় রাখতে চায়। থাক, থাক তুমি ব্যস্ত হচ্ছো কেনো। চ্যানেল করা আছে তোমার হাতে। স্যালাইন খুলে যাবে। বিপদ বাঁধবে আবার। বলে সুরমা। চোখ বন্ধ করে হরপ্রসাদ। দুই চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করে। নিচু স্বরে বলে, প্রণাম মহারাজ। প্রতিনমস্কার জানায় কৃপানন্দ।
হরপ্রসাদের চোখে জল! অবাক হয় কৃপানন্দ। হরপ্রসাদকে কোনো দিন কাঁদতে দেখেনি কৃপানন্দ। জীবনের উত্থান-পতন ঘাত-প্রতিঘাত সমস্ত কিছুই মেনে নিয়েছে হরপ্রসাদ। আস্থা রেখেছে নিজের উপর। বিশ্বাস করেছে ঈশ্বরের ইচ্ছেয়। যা হবার তা তো হবেই। নিয়তি কেন বাধ্যতে।
— ভালো আছো মহারাজ?
— হ্যাঁ।
— তোমার আশ্রমের সবাই ভালো আছেন?
— হ্যাঁ।
কিছু সময়ের জন্য চুপ থাকে হরপ্রসাদ। তারপর বলে, তোমাকে আমার সংবাদ দিলো কে?
— অতীন।
— ও। তুমি কি আজই আশ্রমে ফিরে যাবে মহারাজ?
— না। আমি এখানেই থাকবো।
সে কি করে হয়। তোমার যে অনেক কাজ। বলে সুরমা।
— অসুস্থ মানুষের সেবা কি কাজ নয় মা?
— বেশ। তোমার যেমন ইচ্ছে।
চোখ বন্ধ করে হরপ্রসাদ। ঘুমিয়ে যায়। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আমি অতীনকে ফোন করছি। তুমি বাড়ি যাও আজ। ঘুমের প্রয়োজন তোমার। মাকে বলে কৃপানন্দ।
নার্সিংহোমের বাইরে আসে কৃপানন্দ। বাড়ি ফিরবে সুরমা। অতীনকে ফোন করে কৃপানন্দ। ছেলেবেলার বন্ধু অতীন। বাড়ি পৌঁছে দেবে সুরমাকে।
আশ্রমের কাজে ইদানীং গিরিডিতেই থাকতে হয় কৃপানন্দকে। সেদিন রাতে অতীন ফোন করে। হরপ্রসাদের অসুস্থতার খবর দেয়। সুরমাকে ফোন করে কৃপানন্দ। তোমার বাবা ঠিকই আছেন। কাজে মন দাও তুমি। বলে সুরমা। মায়ের কথা শুনে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারেনি। হরপ্রসাদের জন্য চিন্তা হয়। সুরমা একা। সামলাবে কি ভাবে। অতীন আছে ঠিকই। তারও কাজ আছে। আশ্রমের কাজ অন্যজনকে বুঝিয়ে দিয়ে তবে আসতে পেরেছে কৃপানন্দ।
অতীন এসেছে। রাতে কোনো প্রয়োজনে ফোন করিস। সুরমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়।
নার্সিংহোমের ভিতরে আসে কৃপানন্দ। হরপ্রসাদের পাশে এসে বসে। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। জাঁকিয়ে পড়েছে ঠাণ্ডা। উলের চাদরটা রেখে গেছে সুরমা। সেই দিয়ে হরপ্রসাদের মাথা কান ভালো করে ঢেকে দেয় কৃপানন্দ। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে একজন থাকতে পারবেন। বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করুন। বলতে বলতে একজন সিস্টার এগিয়ে আসে। কিছু সময়ের মধ্যেই থিতিয়ে আসে ওয়ার্ডের ভিতরের কোলাহল। ঘুমাচ্ছে হরপ্রসাদ। প্রণাম মহারাজ। আপনি এই টুলে বসুন। সিস্টার এসে একটা টুল দিয়ে যায় কৃপানন্দকে। ডাক্তার বাবু কি আসবেন আর ? সিস্টারকে জিজ্ঞাসা করে কৃপানন্দ। আটটার দিকে আসবেন স্যার। বলে সিস্টার।
সামনের দেওয়ালের বড়ো ঘড়িটার দিকে তাকায় কৃপানন্দ। রাত এগারটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। দশটার দিকে হরপ্রসাদকে দেখে গেছেন ডাক্তার বাবু। বিপদ মুক্ত হরপ্রসাদ। আগামী কালই বেলায় ডিসচার্জ করবেন। সুরমাকে সে কথা জানিয়েছে কৃপানন্দ। হরপ্রসাদকে নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। একজন ভালো কার্ডিওলজিস্ট এর কাছে নিয়ে যাবে। গ্রামের বাড়িতে রেখে তা সম্ভব নয়। নিজের আশ্রমে নিয়ে যাবে কৃপানন্দ। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে হরপ্রসাদ। সুরমাকে নিজের ভাবনার কথা রাতেই জানিয়েছে কৃপানন্দ। রাজি হয়েছে সুরমা।
বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নেয় গায়ে মাথায়। দুই চোখ বন্ধ করে। স্মরণ করে গুরুদেবের চরণ। আজ সারা দিন জপের মালা হাতে নেওয়া হয়নি। সন্ন্যাসী মানুষ। অজপা থাকা চলে না। প্রত্যেক শ্বাস প্রশ্বাস ঈশ্বরের নামে উৎসর্গিত। ঝোলা থেকে মালা বের করে হাতে নেয়। শুরু হয় বীজমন্ত্র জপ। সসীমে অসীমের সন্ধান। সাত চক্রে শ্বাসের যাতায়াত। মূলাধার থেকে সহস্রা, প্রত্যেক চক্রে তন্ময় হয়ে সচ্চিদানন্দ স্মরণ। অজ্ঞান থেকে প্রজ্ঞানের আলোর সন্ধান। জপ জপ জপ। জপাত সিদ্ধি। তাঁর পবিত্র নামেই জেগে ওঠে আত্মশক্তি। তবেই আত্মজ্ঞান লাভ। সহজ নয় সে পথ। দুর্গম। অগম্য নয়। শাস্ত্রে আছে —
ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।
জপ মগ্ন কৃপানন্দ। নিশ্চল। কানে আসে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর।মহারাজ, মহারাজ। চোখ মেলে। হরপ্রসাদ ডাকছে।
— বলো।
— তোমার মা কোথায়?
— আজ আমিই রয়েছি তোমার কাছে।
— ও।
কিছুক্ষন চুপ থাকে হরপ্রসাদ। বাবার দিকে শান্ত দৃষ্টি মেলে ধরে কৃপানন্দ। কিছু বলতে চায় হরপ্রসাদ। দু চোখে ক্ষনিকের চঞ্চলতা দেখতে পায় কৃপানন্দ। আকাশে বিদ্যুৎ বিকাশ যেনো। একটা প্রশ্ন করবো মহারাজ?
— বলো।
— তুমি কেনো এলে মহারাজ?
হরপ্রসাদের প্রশ্ন শুনে বিস্মিত কৃপানন্দ। বলে, এতো আমার কর্তব্য।
— বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য। ভালো। তবে মহারাজ…।
কিছু একটা বলতে চায় হরপ্রসাদ। চুপ করে আছে কৃপানন্দ। তবে কি জানো মহারাজ, আমার মনে হয় সংসারের মায়া ত্যাগ করা কঠিন। খুব কঠিন। বাবা মায়ের কথা শুনে তোমার মন আজ বিচলিত ভীষণ। তাইতো?
হরপ্রসাদের প্রশ্ন কৃপানন্দের দিকে।
— হ্যাঁ। সে তো হবেই।
— তুমি সর্বত্যাগী। মনের এই বিচলন তোমার সাধন পথের অন্তরায় না হয়। ভয় পাই আমি। আমি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবো। তুমি আশ্রমে ফিরে যেও কাল।
চোখ বন্ধ করে হরপ্রসাদ। স্তম্ভিত কৃপানন্দ। কি সাংঘাতিক মনের জোর হরপ্রসাদের। বয়স, অসুস্থতা কোনো কিছুই কেড়ে নিতে পারেনি তার আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা। বড়ো অদ্ভুত মানুষ হরপ্রসাদ। জীবনের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই তার। তুলনায় সুরমা দুর্বল। এই কয় বছরে মাঝে মধ্যে বাবা মায়ের সংবাদ নিয়েছে কৃপানন্দ। ফোন করেছে বাড়িতে। বেশির ভাগ সময় ছেলেকে এড়িয়ে গেছে হরপ্রসাদ। কথা বললেও অতি সামান্য শব্দ খরচ করেছে। সুরমা আবার অন্য রকম। যতো না বলেছে বলতে চেয়েছে তারও বেশি। পারেনি।মনের কথা ভেসে গেছে চোখের জলে। দূরের থেকে সান্ত্বনা দিয়েছে মাকে।
— মহারাজ। ডাকে হরপ্রসাদ।
— বলো।
— তুমি ফিরে গেলে তোমার মা…।
কথা অসম্পূর্ণ রাখে হরপ্রসাদ। অর্থ বোঝে কৃপনান্দ। কাছে এসে আবার চলে যাওয়া ভীষণ আঘাত করবে সুরমাকে। ছেলের ক্ষণিক সঙ্গ সুখ বিদ্রুপ করবে আবার। মাত্র কয়েক ঘন্টার উপস্থিতি মরীচিকার ধাঁধায় ছুটিয়ে নিয়ে চলবে সুরমাকে। কষ্ট পাবে মা।
ভোরের আলো ফুটেছে। ওয়ার্ডের সামনের করিডোরে এসে দাঁড়ায় কৃপানন্দ। শীতের কুয়াশার মায়াজাল ভেদ করে নবারুণের আলো প্রবাহ। এ যেনো গৈরিক বসনাবৃত আদি ঋষির আশীর্বাদ। প্রাণ চঞ্চল হবে এবার বিশ্ব চরাচর। দুই হাত জোড় করে চেয়ে থাকে কৃপানন্দ। উচ্চারণ করে, জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং…।
— মহারাজ।
মুখ ঘোরায় কৃপানন্দ। সুরমা এসেছে। সঙ্গে অতীন।
— এতো সকালে কেনো এলে মা? জিজ্ঞাসা করে কৃপানন্দ।
— ঘুম হয়নি মহারাজ। আসলে…।
কৃপানন্দকে কিছু একটা কথা বলতে গিয়ে থমকে যায় সুরমা। কৃপানন্দ চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। বোঝার চেষ্টা করে মায়ের না বলা কথা।
— আমি বর্ধমান যাচ্ছি আজ। বিকেলে ফিরবো। কাকু কাকিমা কে নিয়ে চিন্তা করিস না তুই।
ট্রেন ধরবে অতীন। চলে যায়। সুরমা গিয়ে বসে হরপ্রসাদের কাছে। বেসিনের দিকে এগিয়ে যায় কৃপানন্দ। চোখে মুখে জল দেয়। রাত জাগার শ্রান্তি দুর হয় খানিক।
ডাক্তারবাবু এসেছেন। হরপ্রসাদের রিপোর্টস দেখে। বলেন, অবস্থা স্থিতিশীল। বাড়ি নিয়ে যান। কয়দিন রেস্টে থাকতে হবে। ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম সিস্টার বলে দেবেন।
গাড়ির বন্দোবস্ত করেই রেখেছে কৃপানন্দ। পরিচিত ড্রাইভার আসবে গাড়ি নিয়ে। বাবা মা কে নিয়ে যাবে আশ্রমে। গতকাল রাতে সেই মতো কথা বলেছে সুরমার সঙ্গে। হরপ্রসাদকেও বলেছে সে কথা। আমরা গেলে তোমার নিজের কাজের ক্ষতি হবে মহারাজ। তবে তোমার কর্তব্যের…
হাইরোড ধরে ছুটে চলেছে গাড়ি। সুরমার কথা ভাবতে থাকে কৃপানন্দ। সাত বছরে কতো বদলেছে সুরমা। ছেলের মঙ্গল কামনায় নিজেকে …।
মহারাজ, ডাকে ড্রাইভার ছেলেটি। ভাবনায় ছেদ পড়ে কৃপানন্দের।
— মহারাজ আপনার বাবা আর মা এলেন না কেনো? জিজ্ঞাসা করে ড্রাইভার ছেলেটি।
নিরুত্তর কৃপানন্দ। দৃষ্টি বহু দূরে ভেসে যায়।
হরপ্রসাদ আর সুরমা কৃপানন্দের সঙ্গে আসেনি। রয়ে গেছে গ্রামে।
ছেলে সন্ন্যাসী। সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে উদ্ভাসিত হোক কৃপানন্দের জীবন। বৃহত্তর থেকে মহত্তরে হবে নিশ্চিত উত্তরণ। সে নিশ্চয়তায় কোনো পিছুটান রাখতে চায় না সুরমা। যন্ত্রণার আগুনে নিজের যন্ত্রণা পুড়িয়েছে প্রতিদিন। সবার অলক্ষ্যে। সন্তানের আধ্যাত্বিক পথে বাধা হতে চায় না কোনো ভাবেই। অনন্তের সন্ধানে একমাত্র সন্তানকে এগিয়ে দিতে পেরেছে হরপ্রসাদ। সুরমাও পেরেছে আজ । তার খোকা এখন সন্ন্যাসী। উত্তরণের পথ আগলে দাঁড়ায়নি সুরমা। আজ তার বুক কাঁপেনি আর। ক্ষনিকের সুখ দিয়ে আমাকে ভুলিয়ে রেখো না। যা সত্যি তা মেনে নেবার মত সাহস আমি অনেক কষ্ট করে সঞ্চয় করেছি মহারাজ। কিছুদিন আমার সঙ্গে থেকে মনের বাঁধন শিথিল করে দিও না। পৃথিবী বদলেছে তোমার। এ জগতের সবাই তোমার আপন। এগিয়ে চলো মহারাজ। মাভৈ। এগিয়ে চলো।
সুরমার মুখে এমন কথা শুনে বিস্মিত কৃপানন্দ। হরপ্রসাদও চেয়ে ছিলো সুরমার দিকে। সুরমার ভিতরের বদলে যাওয়া সুরমাকে দেখে অবাক হয়েছে।
সত্যি, সংসার কি বিচিত্র। নিরাসক্তি, আসক্তি, বন্ধন, মুক্তি, ভোগ, ত্যাগ এই সমস্ত গুণের ব্যতিক্রমী প্রকাশ এখানে। সংসারের বাইরে থেকে সংসারী মনের ভাঙ্গা গড়ার হিসাব বোঝা দুঃসাধ্য বড়ো। সুরমাকে দুর্বল বলেই ভেবে এসেছে কৃপানন্দ। ভেবেছে ছেলেকে এতদিন পর দেখে হয়তো বলবে, চলেই যখন গেছো মহারাজ মাঝে মাঝে এসে অন্তত দেখাটুকু দিয়ে যেও…।
ভুল ভেঙেছে কৃপানন্দের। মনের সেই বাসনা ত্যাগ করেছে সুরমা। মায়ের অন্য এক রূপ দেখলো কৃপানন্দ।
ঝোলা থেকে মালা বের করে কৃপানন্দ। অসীমে দৃষ্টি রেখে সচ্চিদানন্দের নাম জপ করবে এইবার। বন্ধ করে চোখ। চিদাকাশে ভেসে ওঠে উজ্জ্বল এক মুখ। সুরমা। জয় মা। জয় মা। জয় মা। দুহাত কপালে ছোঁয়ায় কৃপানন্দ। প্রণাম করে সুরমার উদ্দেশ্য। উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করে, ‘ ভূমেগরীয়সী মাতা স্বাগাৎ উচ্চতর পিতা জননী জন্মভূমিশ্চ…।’