জীবন ডালের পাতায় পাতায় (ছোটোগল্প)
সুদীপ ঘোষাল
অনুপমা ছোটো থেকেই বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছের ভক্ত। তাছাড়া যে কোনো গাছের কাছে গেলেই সেই গাছের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। গাছটার সঙ্গে কথা বলে, আদর করে, গোড়ায় হাত বুলিয়ে দেয়। সে বলে বাড়ির উঠোনের আমগাছটাকে, কি রে, আমি আগের জন্মে তোর বোন ছিলাম? বুঝলি আমি আগের জন্মে আবার গাছ হবো। তোর ডালে ডালে আমার সোহাগ উথলে ওঠে। আমি তোর বোন হবোই। সুন্দর সহজ সরল জীবন নিয়ে আমি সুস্থ রাখবো জগতের সমস্ত জীবকুলকে। আমি গাছ হবো।
উঠোনের আমগাছটার ইতিহাস আছে। অনুপমার দাদু বিডিও অফিস থেকে চারা এনেছিলেন। তিনি উঠোনে ছায়া হবে, আর সিজনে কিছু আম পাওয়া যাবে বলে গাছটা লাগালেন। গর্ত খুঁড়তে গিয়ে হাতটার আঙুলে কোদালের চোট পড়ে কেটে গেছিলো সেদিন। অনুপমার ঠাকুমা রেগে বললেন, উঠোনের মাঝে আমগাছ লাগালে। তারপর আবার বাধা। অপয়া গাছ। পাতা পড়ে জঙ্গল হবে। দাদু কোনো কথা বলেনি। শুধু বলেছিলো, খবরদার এই গাছে কেউ যেনো হাত না দেয়। কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়বো।
তখন অনুপমা ছোটো। অনুপমা বললো, থাক ঠাকুমা, আমি পাতা পরিষ্কার করবো। তারপর ঠাকুমা নাতনির মুখ চেয়ে আর কিছু বলেননি। দাদু এবার দুবছর পরে বাড়ি এসেছে। থাকে অনেকদূরে। অনুপমা ভাবে, কেন এতদূরে থাকে দাদু। একদিন ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবে। কিন্তু বলতে সাহস হয় না। ঠাকুমা যদি বকাবকি করে।
তারপর অনেক বৈশাখ কেটে গেলো। শেষে অনুপমার আঠারো বছর বয়সে আমগাছের মুকুল এলো। এতদিন গাছে জল দেওয়া, পাতা কুড়িয়ে পরিষ্কার করা সবকাজ সে নিজেই করেছে। তার ভালো লাগে তাই করে। আমের শুকনো পাতাগুলো এক জায়গায় জড়ো করে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিতো। পরিষ্কার হতো তাড়াতাড়ি।
বাবা’মাকে অনুপমার মনে পড়ে না। দাদুর কাছে শুনেছে, সে যখন এক বছরের মেয়ে তখন তার বাবা রোড আ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। মা তার এক বছর পরেই বাবার বাড়ি চলে যায়। মা তাকে নিয়ে যেতে চাইছিলো কিন্তু দাদু দেননি। দাদু বলেছেন, ছেলের স্মৃতিটুকু তুমি নিয়ে যেও না বৌমা। তাহলে আমি বাঁচবো না। আমার আর কেউ নেই ও ছাড়া। মা তারপর আর জোর করেননি। একা চলে গিয়েছিলেন কাঁদতে কাঁদতে কোনো প্রতিবাদ না করে। তার মা নাকি এখন বিয়ে করেছে অনেক দূরে। মায়ের মুখ অনুপমার মনে পড়ে না। তাই মায়ের মায়া তাকে কাবু করতে পারে না। অনুপমা দেখতো, দাদু থাকে না বাড়িতে। তবু একটা ফর্সা, কটাপারা লোক ঠাকুমার ঘরে যায় প্রায়ই। তাকেও চকলেট দেয়। কিন্তু জানে না লোকটা কে? পাড়ার লোকেরা ওকে জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু ও বলে, আমি জানি না। তখন সবাই মুখ টিপে হাসে। ভালো লাগে না তার। মনে মনে বলে, একদিন ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করতেই হবে। কিন্তু ঠাকুমা যদি রেগে যায়।
একদিন দুপুরবেলা ঘুঙুর পরা হাঁসটা কেমন হেলেদুলে চলেছে। অনুপমার পিছনে পিছনে চলেছে হাঁসটা। তাকে এখন সরস্বতী ঠাকুরের মতো লাগছে। বাহন তার চলেছে সঙ্গে সঙ্গে। ঘাটে শান বাঁধানো সিঁড়িতে সে বসে পড়লো। আর হাঁসটা উড়ে গিয়ে পড়লো জলে। ডুব দিয়ে তাকে খেলা দেখিয়ে চলেছে। সে জলে ঝুঁকে পড়া গাছটার ডাল ধরে তুলে আনলো পানিফল। ছাড়িয়ে খেতে গিয়ে পানিফলের কাঁটা ফুটে গেলো। লাল একফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পড়লো মাটিতে। পাশে রাজু এসে বললো, দে দে আঙুলটা দে। অনুপমার আঙুলটা মুখে নিয়ে চুষতে লাগলো। তার খুব সুড়সুড়ি পেলো। সে হাসতে লাগলো। রাজু বললো, জানিস না, মুখের লালায় ঘা পর্যন্ত ভালো হয়ে যায়। রাজু আঙুল ছাড়ছে না, খুব ভালো লাগছে। সেও জোর করছে না। একটা ভালো লাগা শিরশিরে ভাবে সে বিহ্বল। সে আঁচল থেকে কটা পাকা কুল দিলো রাজুকে, হাত ছাড়িয়ে। রাজু বললো, তোর সব সময় কাঁটা নিয়ে কাজ। কুলগাছেও কাঁটা থাকে। সে হাসতে হাসতে বললো, তুই তো আমার মিষ্টি কুল। তাইতো কাঁটা ভালোবাসি। রাজু পাশের পাড়ায় থাকে। কিন্তু তার সঙ্গেই তার ভাব বেশি। রাজু বলে, আমার মাকে আমার বাবা রোজ মারধোর করে। মাথা ফাটিয়ে দেয়। বড়ো হয়ে আমি এর শোধ নেবো। অনুপমা বলে, ওসব বলতে নেই। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজু বলে, কিচ্ছু ঠিক হবে না। একটা রাক্ষস আমার ভেতরে আছে। তবু আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি। তুই আমার থেকে সাবধানে থাকিস। রাক্ষসটা কখন জেগে উঠবে আমিও জানি না।
অনুপমার ভয় হয়। তার মনে পড়ে, রাজু আর চাঁদু তার দশজন বন্ধু, পুজো বাড়ির শ্যাওলা পড়া দেয়াল ঘেঁষে বসতো। পিঠে সবুজ ছাপ পড়ে যেতো। পুরোনো কারুকার্যের মুগ্ধতা ছাড়িয়ে ভালোবাসার গান বিরাট বাড়িতে প্রতিধ্বনি শোনাতো। বন্ধুদের মধ্যে চারজন মেয়ে ছিলো। দেবীকা বলতো, বন্ধু শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ করিস না। ভালো শোনায় না। কোনোদিন রাজু তাদের মেয়ে মনে করেনি। বন্ধু তো বন্ধুই। তার আবার ছেলে আর মেয়ে কি? বলতো রাজু। একই কাপে তারা কফি খেতো পুজো বাড়ির পাশের কফি হাউসে। ভাগে কম হলে রূপসী বলে বন্ধুটা রাস্তায় লোকের মাঝে দীনেশকে ফেলে মারতো খুব। তাদের বন্ধুদল বিপদে, আপদে কাজ করতো গ্রামে। তাই তাদের অনেকেই সম্মান দিতো। আর আদরের এই মার খেতেই দুষ্টুমি করে তার ভাগেরটা কম রাখতো। অভিভাবকরা কোনোদিন ছেলে মেয়েদের মেলামেশায় বাধা দিতেন না। দরজা ঘাটের বাঁধানো ঘাটে পানকৌড়ি আর মাছরাঙার কলাকৌশল দেখে পার হয়ে যেতো অবাধ্য সময়।
অন্ধকারে ফুটে উঠতো কালীতলার সার দেওয়া প্রদীপ। ঘরে ঘরে বেজে উঠতো শঙ্খধ্বনি। হাতগুলো অজান্তে চলে যেতো কপালে। তারপর হাত পা ধুয়ে ভাইবোন একসাথে বসে সরব পাঠের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেতো পাড়া জুড়ে। কিন্তু অনুপমার ভাইবোন ছিলো না। সে চুপচাপ পড়তো। নীরব পাঠ। আর তার ফলে তার মনে ভেসে উঠতো রাজুর মুখ। বইয়ের পাতা জুড়ে প্রেমের খেলা।
কে কত জোরে পড়তে পারে, পাড়ায় প্রতিযোগিতা চলতো। একবার অতনুদের বাড়ি পড়তে গেছিলো অনুপমা মাটির দোতলা ঘরে। বুলু কাকা বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি শুনতে পেলেন অতনু পড়ছে, ন্যাটিওনাল মানে জাতীয়, ন্যাটিওনাল মানে জাতীয়। ঘরে ঢুকে কাকা বললেন, ন্যাটিওনাল নয় ওটা ন্যাশনাল। ঠিক করে পড়। অতনু জোরে পড়ছে বলে উচ্চারণটা ঠিক হলো। এই অতনু সেদিন বুলুকাকা যাওয়ার পরে তার পাশে বসে পড়ছিলো। আর বারবার তার হাঁটুতে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো। তারপর একটা আঙুল তার প্যান্টের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো যোনিপথে। খুব ভালো লাগছিলো। কিন্তু একটা অপরাধবোধ কাজ করছিলো ভিতরে। পড়া হয়ে গেলে সে চলে এলো নীচে।
তারপর পড়া হয়ে গেলে একান্নবর্তী পরিবারের সবাই উঠোনে খেতে বসলো। অনুপমা দেখলো, কি সুন্দর পরিবেশে অতনু বড়ো হচ্ছে। রাজুর বাড়ি যদি এই পাড়ায় হতো, তাহলে বেশ হতো। আলাদা করে কোনো শিশুকে খাওয়া শিখতে হতো না, জোর করতে হতো না। সবার খাওয়া দেখে ধীরে শিখে যেতো নিজে খাওয়ার কায়দা। পরের দিন রাজুকে গল্প বললো। অতনুদের বাড়িতে পড়তে যাওয়ার গল্প। কিন্তু আঙুলের কথা বলতে পারেনি লজ্জায়।
রাজু শুনে বলতো, আমাদের কাকার মেয়ে, ছেলে সবাই পড়তে আসে আমাদের বাড়িতে। আমরা শুই সবাই একসাথে। কাকার মেয়ের সাথে মারামারি করি। শোওয়ার পালা আরও মজাদার। বড় লেপে তিন ভাইবোনের ঢাকা। কেউ একটু বেশি টানলেই খেলা শুরু হয়ে যেতো রাতে। কোনো কোনো দিন ভোরে। মা আরও ভোরে উঠে শীতকালে নিয়ে রাখতেন জিরেন কাঠের খেজুর রস। সকালে উঠেই খেজুর রস। সেই দিনগুলো আর কি ফিরবে? বড় মন খারাপ হয় বড়ো হয়ে যেতো রাজুর। রাজুর গল্প শুনে অনুপমার অপরাধবোধ কমে যেতো। সে ভাবতো, তাহলে রাজুও কাকার মেয়ের সাথে এরকম করে। ওর তো নিজের কাকা নেই। পাড়ার কাকা হবে হয়তো। তাহলে রাজু তো সব কথাই বলে। ওগুলো বলে না কেন? ওসব বলতে নেই। সে ভাবে, চিরকাল ছেলে মেয়েরা গোপন করে যায় ভালোলাগার কিছু মুহূর্ত। এগুলো হয়তো বলতে নেই। আকাশ পাতাল চিন্তা করেও হিসেব মেলাতে পারে না অনুপমার মতো কিশোরী মেয়েরা।
তারা একসাথে ঘুরতো। অনুপমারা খেলতো নানারকমের খেলা। চু কিৎকিৎ, কবাডি, সাতগুটি, ঘুড়ি ওড়ানো, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ও আরও কত কি। বন্ধুরা জড়ো হলে, এলাটিং, বেলাটিং সই লো, যদু মাষ্টার কইলো…, তারপর আইশ, বাইশ কত কি। হাততালি দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খেলতাম, কাটুরিস, চায়না প্লিজ, মেম সাব, মেইন আপ… । তারপরের কথা, খেলা ডুব দিয়েছে কোন অতলে জানি না। অনুপমা বলতো, সব কথা পুরো মনে পড়ে না। ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতিগুলো হৃদয়ের পদ্মপুকুরে ভেসে উঠেই ডুব দেয়, আর হারিয়ে যায় ব্যস্ত সময় সংসারে। সেখানে আবেগ মানে ছেলেখেলা পাগলামি। তবু তার মনে হয়, এরকম পাগলের সংখ্যা আরও বাড়ুক। বাড়লে পাওনাটা মন্দ হয় না। ভালো পরিবেশে মানুষ হয়েছে অনুপমা ও রাজু। সেই রাজুর মনে কি করে রাক্ষস ঢুকলো বুঝতে পারে না অপরূপা। সে ভাবে, মানুষ হয়তো পাল্টে যায় পরিস্থিতির চাপে। যে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে হয়ে যায় ডাকাত। আর যে সংসারী হয়ে সুখে থাকতে চায় সে হয়ে যায় খেলার পুতুল, রূপাগাছির অপরূপা বেশ্যা।
অনুপমা ভাবে, তিরস্কারের থেকে জীবনে পুরস্কারই বেশি পেয়েছি। পুরস্কার বলতে মানুষের আদর, ভালোবাসা। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এর থেকে বড় পুরস্কার আমার অভিধানে নেই। আমার যোগ্যতার বেশি, তার পরিমাণ। ঈশ্বর সময় হলেই প্রত্যেকের যোগ্য পাওনাটুকু দিতে ভোলেন না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য আর সহনশীলতা। সময় কিন্তু কারও কথায় এগিয়ে আসবে না বা পিছিয়ে যাবে না। অভিজ্ঞ লোকেরা প্রথমে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। অন্য মানুষকে সহ্য করা, সম্মান করা ধর্মেরই নামান্তর। মানুষের জন্যই মানুষ। শুধু শুকনো লোক দেখানো ধর্ম যা মানুষকে ছোটো করে সেটা কখনই ধর্ম হতে পারে না। ধর্ম হচ্ছে অণুবীক্ষণের মতো। ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখে। পোকামাকড়ও ঈশ্বরের করুণা থেকে বাদ পড়ে না। ভাবনা আমার ভালো কিন্তু ভাগ্যের চাকাটা যে বনবন করে ঘোরে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে।
অনুপমা কদিন ধরেই দেখছে রাজু কতগুলো ছেলের সঙ্গে মেশে। তাদের কোনোদিন দেখে নি সে। রাজুকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, অনেক দূরে বাড়ি ওদের। এখানে এলে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়। অনুপমা বলে, তুই খারাপ হয়ে যাস না, ভালো হয়ে থাকিস। তুই আমার জীবনের ভরসা। আমার ভালোবাসার ধন।
রাজু ভাবে, অনুপমা আমাকে ভালোবাসে। সে আমাকে ভালো হতে বলে। আর তো আমরা ছোটো ছেলে নই। বড়ো হয়েছি। বুঝতে শিখেছি ভালোমন্দ। কি করে সে ভালো হয়ে থাকবে। বাড়িতে নিত্য নতুন অশান্তি। বাবা-মায়ের মারামারি। মা সন্দেহ করে বাবাকে। এখন আমিও সন্দেহ করি বাবাকে। বাবা রোজ রাতে কোথায় যায়? বারোটার পর বাড়ি ফেরে। এত জানাশোনা আছে তার। তবু সে জানতে পারে না। রাজু ভাবে, কোনোদিন যদি জানতে পারি, আমার বাবাকে কেড়ে নিচ্ছে কে? আমি তাকে খুন করবো। আমাদের বাড়িতে অশান্তি ঢোকানোর বদলা আমি নেবোই। অনুপমা বলে, তুমি পুলিশকে জানাও, আইনের সাহায্য নাও। কিন্তু বাবার ভয়ে অতদূর এগোতে সাহস হয় না। তবে মনে মনে ভাবে সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। রাজু মাকে বলতে শুনেছে, তুমি অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করা ছেড়ে দাও। অন্য মেয়েছেলের সঙ্গ ছেড়ে দাও। অন্যায় করে রোজগার করা ছেড়ে দাও। তা না হলে আমি রোজ তোমার সঙ্গে অশান্তি করবো। রাজু ভাবে, কি করে একটা ভালো ছেলে বড়ো গুন্ডা হয়ে যায়, ডাকাত হয়ে যায়। খুনি হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় পাগল সেজে, মাতাল সেজে। পরিবারের পরিবেশ ভালো না হলেই এইসব হয়।
অনুপমা তার দাদুকে দেখেছে। অনুপমা ভাবে, দাদু তার জীবনের আদর্শ। মন মতো দাদু আমার খুব প্রিয় ছিলো। দাদু আমাদের জন্য নিরামিষ রান্না করতেন। কখনও-সখনও দেখেছি নিজে ডেঙা পাড়া, থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। ব্রয়লার মুরগির ডিম ভালোবাসতো না দাদু। দেশি মুরগির ডিম আনতেন কিনে। নগদ টাকার টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল, ডাল, গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন ঠাকুমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা। আমি পূর্ব মেদিনীপুরের মেয়ে। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয়ে শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো। একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ভূতের গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজ কিন্তু ভূত আসতে পারে। জানিস তো ছড়াটা — ভর্তি দুকুরবেলা, ভূতে মারে তালা। থাপ্পড়কে দাদু বলতো তালা। রেগে গেলেই বলতো, এক তালাতে ভুবন ঘুরিয়ে দোবে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার বন্ধুরা সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম, বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ভূত আসবে। দিনে ভূত দেখা যাবে। ছেলে মেয়ে সবাইকে ধরবে। বস্তায় ভরে নিয়ে যাবে অন্য দেশে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। আমের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পাড়ছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে কালো টিনের হাতে ভূত হাজির। টিনের হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের। আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গেলাম। আমরা তাড়িয়ে নিয়ে গেছিলাম লোকটাকে। ভূত তখন ভয়ে পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু মিথ্যা কথা বলে ভয় দেখাতেন। দাদু খুব ভালো লোক ছিলেন। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পড়েছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতে এসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে রাতে উঠে, সড়কি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠি, সড়কি, বগি ছিলো প্রধান অস্ত্র। সড়কিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন, আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। বারোজন মরদ সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার গিন্নি দাদুকে বললেন, আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো, আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম। সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। তা বলে কোনো ডাকাত কি কোনোদিন ভালো হয়? মনে মনে প্রশ্ন করে নিজেকে। ভালো আর মন্দ মিলেমিশে মানুষের গঠন।
আজ আর দাদু নেই। এতবড় সাহসী লোক হয়েও দাদুর ঘরে শান্তি ছিলো না। দাদু বলতো, বাঘের ঘরে ঘোগার বাসা। দাদু আপশোশ করতো, নিজের বৌ যদি বেইমানি করে জগতে কারও সাধ্য নাই তাকে বাঁচায়। সে মরবেই। শান্তি তো কোনোদিন পাবেই না। দাদুর ক্ষেত্রে এই কথাগুলো সত্য হয়ে উঠেছিলো অভিশাপের মতো।
দাদুর মৃত্যু খুব মর্মান্তিক, ভয়ংকর। লোকে বলে, একহাত জিভ বেরিয়ে গেছিলো গলায় দড়ি দেবার পরে। সেই ঘটনা অনুপমার মনে পড়ছে।
আমি আর ঠাকুমা দুজনের সংসার। ঠাকুমা অসুস্থ। ঠাকুমা বলেন, তুই যাকে ভালোবাসিস, তাকে বিয়ে কর। আমি হঠাৎ মরে গেলে তোর কি হবে বলতো?
আমি বলতাম, কিছু হবে না ঠাকুমা। আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। আমি তোমার কাছেই থাকবো। ঠাকুমা বলেন এ আবার কেমন কথা? মেয়েরা বিয়ে না করলে হয় নাকি?
আমগাছটাকে বলছে অনুপমা, ছোটোবেলার বন্ধু রাজুকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। রাজুও ভালোবাসে। কিন্তু রাজুর বাড়ির লোকজন রাজি নয়। আমরা লুকিয়ে দেখা করি। ঠাকুমা জানে, কিন্তু ঠাকুমাকে একা রেখে আমি চলে গেলে, ঈশ্বর আমাকে মাপ করবে না। আমি কি করবো বলো? তবু হয়তো একদিন যেতেই হবে। বিয়ের ফুল ফুটলে কেউ অবিবাহিত থাকে না।
আমগাছটা তার ডাল দুলিয়ে, পাতা নাড়িয়ে হাওয়া দেয়। বুদ্ধি দিতে পারে না। অনুপমা ভাবে, গাছগুলো কথা বলতে জানলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। গাছের নিচু ডালে বসে সে আকাশপাতাল চিন্তা করতে আরম্ভ করলো।
মনে পড়ে, দাদু যেদিন মারা যায় সেদিন ঠাকুমা খুব কাঁদছিলো। ঠাকুমার বিয়ের পর থেকে দাদুর সঙ্গে অশান্তি হতো। ঠাকুমার মুখে শুনেছে সে। ঠাকুমা বলেছিলেন, আমি আমাদের গ্রামের একটা ছেলেকে মানে…ভালোবাসতাম।
অনুপমা বলে, ঠাকুমা বলো না ঠিক করে। তুমি তো আমার বন্ধুর মতো। সব কথা বলা যায় বলো।
ঠাকুমা বলছেন, ছেলেটার সঙ্গে মিশতাম। ভালোবাসা হয়ে গেলো। আমার মা-বাবা না থাকলে ছেলেটা সুযোগ বুঝে ঘরে ঢুকে পড়তো। রান্নায় সাহায্য করতো। আদর করতো। চুমু খেতো। কিন্তু আমাকে যে ভালোবাসতো না সেটা আমি জানতে পারলাম দুবছর পরে। আমার বন্ধু বিমলের কাছে শুনলাম আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে ও এরকম ব্যবহার করে। ওরা সাত ভাই। তাই কেউ ভয়ে কিছু বলে না তাকে। তারপর একদিন চুপি চুপি ও আমাদের বাড়ি এলো। আমি বলে দিলাম, বাবা-মা না থাকলে আমাদের বাড়ি আসবে না। ও জোর করে আমাকে নগ্ন করলো। ও বললো, আর আমি আসার সুযোগ পাবো না
ও বললো, কেন? আসবো না কেন?
আমি বললাম, কেন, তুমি জানো না? সব জানো তুমি। হাজারটা মেয়ের সর্বনাশ করছো তুমি। নিজেকে খুব চালাক ভাবো তুমি না?
তারপর দেখলাম ওর মুখ পেঁচার মতো হয়ে গেলো। ও মরিয়া হয়ে গেলো। আমাকে চিৎ করে ফেলে চেপে বসলো। আমি হাত দুটো মাথার উপরে তুলতেই পেয়ে গেলাম কাটারি। অই কাটারির উল্টো পিঠে মারলাম এক ঘা। বাবারে বলে, ভয়ে পালিয়ে বাঁচলো শালা।
তারপর থেকে কোনো কথা ছিলো না। কিন্তু আমার বিয়ের পর অশান্তি ঢুকিয়ে দিলো আমাদের জীবনে। তোর দাদুকে সব কথা বলে দিলো। ও আমার অপমানের আমার কাছে মার খাওয়ার বদলা নিলো।
তোর দাদু তারপর থেকে আমাকে মারধোর করতো। সন্দেহ করতো। আমি বারবার তোর দাদুকে বুঝিয়েছি। ওই খচ্চরটা আমার ইজ্জৎ নিতে পারেনি। তবু বিশ্বাস করতো না আমার কথা। আমাকে পেটাতো লাঠি দিয়ে। একবার মাথায় লেগে মরেই যেতাম। কোনো রকমে বাঁচলাম হাসপাতালে দেখিয়ে। সেখানেই পরিচয় হলো এক পুরুষের সঙ্গে। খড়কুটো ধরে ডোবার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম আমি। পুরুষটা ধান্দাবাজ, কামুক। আমার কথা শুনে বললো, কোনো চুতিয়া কিছু করতে পারবে না। আমি আছি তোমার সঙ্গে। টাকা পয়সার অভাব হবে না। শুধু চাই তোমার শরীর। একদম ষোলো আনা। আমি ষোলো আনাই দেবার প্রতিশ্রুতি দিলাম।
আমি বাধ্য হয়ে এক শক্তিশালী যুবককে প্রেমের খেলায় ফাঁসালাম। সে আমার ঘরে বসতো। আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতো। তোর দাদুকে ও বলেছিলো, যদি শুনি মারধোর করেছিস, সেদিন তোর শেষ দিন। আমি গুন্ডা-বদমাশ লোক। মাথা গরম হলে খুন করে দেবো। এই কথা বলে কোমর থেকে বের করে একটা বড়ো নেপালা দেখিয়েছিলো। তারপর তোর দাদু সোনাপাড়ার জমি দেখাশোনা করতো। আমার কাছে আসতো না। আমিও খবর নিতাম না। তোর দাদু সড়কিখেলায়, লাঠিখেলায় ওস্তাদ ছিলো। কিন্তু নেপালা দেখে, মারমুখী মূর্তি দেখে তাকে বললো, ঠিক আছে আজ খালি হাতে আছি। তোর মৃত্যু আমার হাতে। মনে রাখিস, আমি ফালতু কথা বলি না।
অনেকবার চেষ্টা করেও পারেনি। তবে তোর দাদুর হাতে একটা নেপালার কোপ পড়েছিলো। সেই দাগ আজও আছে। আমি জানি, তোর দাদু এই লোকটাকে খুন করবেই।
তারপর তোর বাবা বড়ো হলো। বিয়ে হলো। তুই হলি। ঘর ভর্তি আলো। তোর জন্মদিনে বিরাট আয়োজন করেছিলো। তারপর হঠাৎ একটা পথ দুর্ঘটনায় তোর বাবা মরে গেলো। তোর মা তার মাসখানেক পরে চলে গেলো। তোর দাদু তোকে রেখে দিলো। তোর মাকে আমি বাধা দিই নি যাওয়ার সময়। কারণ আমার বাড়িতে যে ঢ্যামনা আসতো তার নজর পড়েছিলো তোর মায়ের গতরে। তোর মতোই সুন্দরী ছিলো তোর মা।
ধীরে ধীরে, সময়ের পাকে, তুই বড় হয়ে গেলি। তারপর তুই তো সব ঘটনা জানিস। তোর দাদুর ক্যান্সার হয়েছিলো লিভারে, অতিরিক্ত মদ্যপানে। তোর দাদু তখন বুদ্ধি করে এক রাতে আমার ঘর থেকে বেরনোর পর লম্পট লোকটাকে সিপাই দিঘির জঙ্গলে সড়কি পেটে ঢুকিয়ে খুন করে এলো। আমি দেখলাম হাতে রক্তমাখা সড়কি। বললো, তোর প্রেমিককে খুন করে এলাম রে খানকি মাগী এই বুড়ো বয়সে। শালা আমার সঙ্গে টক্কর, শালা আমার সঙ্গে পাঙ্গা। এবার তোর কুটকুটানি মরবে। তোকে মারবো না। বেঁচে থেকে তুই শাস্তি ভোগ করবি। আমি ভূত হয়ে দেকবো।
তারপর আমি কিছু বোঝার আগেই গলায় দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়লো, তারই হাতে লাগানো আমগাছে।
ওই আমগাছটা সব জানে। ও তো আর কথা বলতে পারে না। ওই প্রধান সাক্ষী। তারপর পুলিশের ঝামেলা পেরিয়ে আজ এই অবস্থা। হয়তো আমার পাপেই তোর দাদু, বাবা মারা গেলো। এবার আমি গেলেই বাঁচি। অনুপমা বললো, না, না, ঠাকুমা সব বিধির লিখন। তোমার কপালে যা ছিলো তাই হয়েছে। দুঃখ কোরো না।
ঠাকুমা বলছে, তোরা দুজনে বিয়ে করে পালা। ওরা মানবে না ভালোবাসার বুলি। আজকেই পালিয়ে যা। অনুপমা কথাটা বলতে পারছিলো না। আজকে ঠাকুমা সব পথ সহজ করে দিলো।
অনুপমা ছুটতে ছুটতে ঠাকুমার দেওয়া সোনাদানা নিয়ে রাজুর সঙ্গে দেখা করলো। রাজু তখন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলো। বন্ধুদের সঙ্গে রাজু পরামর্শ করে, অনুপমাকে নিয়ে সোজা চলে গেলো সিপাই দিঘির জঙ্গলে। বললো, কি এনেছিস দেখা। অনুপমা বললো, সব সোনা এনেছি। নে এবার চ। ও অনুপমাকে চুমু খেলো। জঙ্গলে শুয়ে ওরা নিশ্চিন্ত হলো। তারপর বিয়ের আগেই ওরা মিলিত হলো প্রচণ্ড আবেগে। অনুপমা নগ্ন হয়ে রাজুর ওপরে উঠে দীর্ঘস্থায়ী খেলা খেললো। রাজু পাল্লা দিয়ে সাড়া দিলো প্রচণ্ড শীৎকারে। রাজু ভাবছে, শালি খানকির কায়দা কি করে শিখলো। খানকির বংশ তো।
হঠাৎ জঙ্গলে এলো কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা গুন্ডার দল। তারা বললো, এখানে তোরা কি করছিস। আমাদের আড্ডার কথা জেনে গেছিস রাজু। মেয়েটা কে রে? বেশ ডবকা মাল। একবার দেখি, বলেই অনুপমার উদ্ধত খোলা বুকে হাত দিলো। টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো তার মাইযুগল। একজন বললে, এক্কেবারে রেডি মাল। শালির রস গড়িয়ে পড়ছে। শালা গরম গরম, হাতে গরম।
রাজু মুষ্ঠিবদ্ধ হাত চালিয়ে দিলো একজনের মুখে। রক্ত পড়তে শুরু করলো। একটা ডাল ভেঙে মারতে আরম্ভ করলো। অনুপমা দেখলো রাজু সবাইকে চেনে। কারণ রাজু বলছে, শালা বন্ধু হয়ে মুখোশ পরে চালাকি রাজুর সঙ্গে। তোদের থেকে বড় গুন্ডা আমি। মুখোশধারী একজন বললো, আমরা তোর বন্ধু নই, যম। ওরা বললো, মেয়েটাকে ছেড়ে দেবো ছিবড়ে করে। কিন্তু তোকে মরতেই হবে। ওরা দড়ি দিয়ে রাজু আর অনুপমাকে বেঁধে ফেললো। অন্ধকারে পাড়ার এই জঙ্গলে কেউ আসে না। একটা বড় পাথর দিয়ে থেঁতলে দিলো বোধহয়, রাজুর মাথাটা। রাজু চিৎকার করে থেমে গেলো।
অনুপমা কিছু দেখার আগেই মনে ভাবলো, রাজু হয়তো মরে গেছে। অতবড় পাথর দিয়ে মাথায় মারলে কি আর মানুষ বাঁচে। তবু একটা আশা। সে বলছে, ভগবান আমাকে মারো কিন্তু আমার রাজু বেঁচে থাক। অনুপমা কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার বুকে নির্মম ভাবে আড়াল করে বসে আছে দুই নগ্ন পাষণ্ড। তার বুকযুগল দলে, মুচড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে লম্পটের দল। রাজুর মরা মুখ সে ভাবতেই পারছে না। শুধু শুনতে পেলো, দে শালার মাথা থেঁতলে। কেউ যেনো চিনতে না পারে। তারপর নদীর জলে ভাসিয়ে দেবো। এই কথা শুনে অনুপমা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো। সেই সুযোগে ওরা পাঁচজন অমানুষিক অত্যাচার করলো তার উপর। তারপর সবাই ওরা চলে গেলো, অনুপমাকে নগ্ন অবস্থায় ফেলে।
প্রায় দুঘন্টা পরে অনুপমার জ্ঞান এলো। দেখলো রাজুর দেহটা নেই। ওরা হয়তো গাড়ি করে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও বা কোনো নদীতে ফেলে দেবে। সে রক্তমাখা শরীর নিয়ে উঠলো। বুঝতে পারলো পশুরা তার সব সম্পদ কেড়ে নিয়েছে। কোনোরকমে ছেঁড়া জামাটা পরলো। ব্যাথায় টনটন করছে তলপেট। আর বাঁচার কোনো মানে হয় না রাজু নেই। পড়ে যাচ্ছে বারেবারে। সিপাই দিঘির এই জঙ্গলে আসতে মানা করতো ঠাকুমা। রাজু তাকে নিয়ে এলো। কতবার মানা করলাম শুনলো না। অনুপমা দেখলো দড়িটা ওর তার গলায় বেঁধেছিলো পশুরা কিন্তু সে মরে নি। টান করে বাঁধা তাও সে মরেনি। সে ভাবে মরে গেলেই ভালো হতো। ওরা হয়তো ভেবেছে, মরে গেছি আমি। দাদুকে মনে পড়লো ওর। দাদু ডাকছে আর বলছে, গলায় দড়িটা শক্ত করে বাঁধ। ও আগে শুনেছে যাদের অপমৃত্যু হয় তারা এভাবেই ডাকে। অনুপমা দাদুকে বলছে, দাদু ওরা রাজুকে মেরে ফেলেছে। তাহলে আমি বেঁচে কি করবো। আমি তোমার কাছে যাবো। দাদু ডাকছে, দাদুর কথা শুনতে পাচ্ছে ও। দাদু ডাকছে, আয় আমার হাতে লাগানো বাড়ির আমগাছে আয়। ওখানেই ঝুলে পড়। আমি আছি, আয়, আয়। অনুপমা ভাবের আবেশে বাড়ির উঠোনে এলো। এখন অন্ধকার রাত। মনেও কালো অন্ধকার, অনুপমার অন্তর জুড়ে চাপ চাপ কালোর দলা পাকানো রক্ত। নীচু ডালে পা দিয়ে উঠে পড়লো গাছে। দড়িটা শক্ত করে বাঁধলো ডালে। কোনোদিন কঠিন কাজ সে করেনি। কি করে দড়ি বাঁধলো সে নিজেও বুঝতে পারলো না। অবশেষে রাজুকে মনে করে ঝুলে পড়লো ডাল থেকে।
সকালবেলা অনুপমার ঠাকুমা কাঁদতে শুরু করলো। মরা কান্না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখে, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে নগ্নপ্রায় নাতনি। ঠাকুমা দেখলো, অনুপমা গলায় দড়ি দিয়েছে দাদুর মতো। আর দেখলো পাড়ার সবাই ভিড় করে এসেছে তার নাতনিকে দেখতে। ভিড়ের মাঝে রাজুকে দেখতে পেলো ঠাকুমা। রাজু বলছে, ঠাকুমা এই অভিশপ্ত আমগাছটা কেটে ফেলতে হবে। অনুপমার ঠাকুমা বলে, তোমার সঙ্গে কাল দেখা হয় নি অনুপমার। রাজু বললো, না তো, আমি কাল একটু মামার বাড়ি বেড়াতে গেছিলাম। আসতে অনেক রাত হয়ে গেছে।
₋₋ কিন্তু ও যে বললো, তোমার কাছে যাবে।
₋₋ না, ঠাকুমা, আমাকে তো বলেনি কিছু।
₋₋ না, ও আমাকে বলে বাড়ি থেকে বেরোলো। আমার কাছে সোনাদানা নিয়ে বললো, আমি রাজুর কাছে যাচ্ছি। তোমার কোন পাড়ায় বাড়ি বাবা।
₋₋ ও আপনি চিনবেন না। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। ছোটোবেলায় এই বাড়িতে কত খেলেছি। আপনিও তো আমাকে দেখেছেন।
₋₋ ঠাকুমা বললেন, হ্যাঁ দেখেছি। আমি সব জানি। কিন্তু ও গলায় দড়ি দিলো কেন?
₋₋ ঠাকুমা, সোনা দিয়েছেন ওকে। ও একা একা অন্ধকারে বেরিয়ে গেলো। আপনি ভুল করেছেন ঠাকুমা। সোনাদানা আর অন্ধকারে একা যুবতী মেয়ে। না না, ঠাকুমা এটা আপনি ঠিক করেননি। পাড়ার লোক বলুক। আপনি ভাবুন তো একবার।
রাজু দেখলো ওর পাশে ওর সব শাগরেদ হাজির। ওদের দেখে ডাকাতের ছেলে রাজুর সাহস বেড়ে গেলো। বললো, শুনুন ঠাকুমা পুলিশ যদি জানে, আপনি নিজে সোনাদানা সমেত একটা যুবতী মেয়েকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন, তাহলে ঝামেলা হবে। তারপর পুলিশ এলে পোষ্টমর্টেম হবে। যদি রেপ হয়েছে বুঝতে পারে আপনার নাতনির বদনাম হবে। কাগজে, কাগজে ছেপে যাবে আপনার বাড়ির ইতিহাস। আপনার পরিবারের ইতিহাস। আপনার সমগ্র ইতিহাস।
₋₋ তা হলে কি করা যায় বলো তো। মেয়েটা তো মরেই গেছে। তাছাড়া আমি বুড়ি। এই বয়সে আমি অত ধকল সইতে পারবো না। তুমি যা ভালো বোঝো করো। আমাকে বাঁচাও।
₋₋ ঠিক ভেবেছেন আপনি। আমার উপর ভরসা রাখুন। আমি দিল দিয়েছিলাম ওকে। আমার কথা মনে করলো না ও। কি নিষ্ঠুর তুমি অনুপমা।
ঠাকুমা রাজুর চোখ মুছিয়ে দিলেন। বললেন, যা হয়েছে তা আর ফিরে আসবে না। তুমি পাড়ার লোক ম্যানেজ করে তাড়াতাড়ি শ্মশানে নিয়ে যাও।
রাজু তার দলবল নিয়ে পাড়ার লোকদের বললো, আপনারাই বলুন। একা বুড়ি মানুষ পুলিশের ঝামেলায় যেতে চাইছে না। তাহলে আমরা কি মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবো। পাড়ার সব লোক ফিসফাস করলো। কেউ ঝামেলায় থাকবে না। একজন বয়স্ক মহিলা বললেন, নিয়ে যাও, ওর ঠাকুমাই তো মালিক। উনি যা বলবেন, তাই করো। আমাদের আপত্তি থাকবে কেন?
রাজু ভাবছে এখনও শালি বুড়িটা টাকা দিলো না। মদমাংস খেতে হবে। পাড়ার লোক, বন্ধু, বান্ধব, শ্মশান খরচ খানকি বুড়ি…
₋₋ তাহলে ঠাকুমা, চাঁদা তুলি।
₋₋ আরে ছি ছি বলো কি? টাকার কোনো অভাব নেই। যত লাগে দেবো। সব তো নাতনির জন্যই রাখা আছে।
দশ মিনিট পরে ঠাকুমা রাজুর হাতে কুড়ি হাজার টাকা দিলেন। বললেন আরও লাগলে দেবো। টাকার কোনো অভাব নেই।
রাজু টাকা নেয় আর ভাবে, শালি, আমার বাবার কাছে ঝাড়া মাল। আমার বাবাকে খুন করেছে তোর স্বামী। তার ফল ভোগ কর শালি, খানকি।
তারপর হাসি হাসি মুখে বলে, আর কোনো চিন্তা নেই। আপনি চেয়ারে বসে দেখুন।
রাজুর নেতৃত্বে তার দল আমগাছে উঠে লাশ পাড়লো। ট্রাক্টর চলে এলো। কুড়িজন লোক সঙ্গে করে চলে গেলো শ্মশানে।
বন্ধুকে আড়ালে বলছে রাজু, শালা এবার বুড়ির পালা। তারপর ওই জায়গায় গজিয়ে উঠবে আমাদের আড্ডা। শালা প্রথমে ক্লাব হবে, পাশে মন্দির হবে।
রাজু বলে উঠলো, বলো হরিবোল…
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, বোলহরি…
শ্মশানের চিতাটা রাজুর চিৎকারে হেসে উঠলো দাউ দাউ শব্দে…