ভালবাসা – চেখভ

ভালবাসা – চেখভ

ভালবাসা         (ছোটোগল্প)

চেখভ

(রাশিয়ান গল্প, ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ বিজয়া দেব) 

সকাল ন’টা। এই নরম এপ্রিল মাসের রাতে রাতের আকাশের তারাগুলো উদাসীনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি ঘুমোতে পারছি না, ইস, আমি এত সুখী!
আমার আপাদমস্তক এক অন্যরকম অনুভূতিতে উপছে পড়ছে, কী সেই অনুভূতি আমি এখন ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছি না – আমার যেমন সময় নেই, তেমনই অলস – থাক অত ব্যাখ্যারই বা কী প্রয়োজন! কারণ ব্যাখ্যা করা এই সময়ে সম্ভব নয়। ঐ অবস্থায় কী আর আমি আছি! যদি কেউ এইমাত্র জানতে পারে যে সে দুই লক্ষ টাকা জিতেছে, কিংবা তার মাথা গির্জার ঘন্টার ওপর দিয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে যাচ্ছে, তথন তার মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণ করার মতো অবস্থায় কী আর থাকে!
আসলে আমি পড়েছি প্রেমে। একটি উনিশ বছরের মেয়ে, নাম তার সাশা। তাকে আমি প্রেমপত্র যে লিখছি তা এই আমার মানসিক অবস্থা প্রকাশের জন্যে কমবেশি হয়তো হবে। আমি এই প্রেমপত্র লিখলাম পাঁচবার। লিখছি আর ছিঁড়ছি, কাটাকুটি করছি, আবার ঐটাকেই নকল করছি। এতসময় খরচ করেছি যে সুস্থিরভাবে লিখলে এই চিঠিটি একটি উপন্যাস হয়ে যেত। এটা নয় যে আমি প্রেমপত্রটিতে বিস্তারিত কিছু লিখতে চাইছিলাম বা দীর্ঘ পত্র লিখতে চাইছিলাম বা আরও আন্তরিক হতে চাইছিলাম। আমি চাইছিলাম লেখাটির লম্বা প্রক্রিয়া যেখানে সে এক বসন্তের রাতে জানালার পাশে স্থির হয়ে বসে মগ্ন হয়ে চিঠিটি পড়বে, আর তার দিবাস্বপ্নের সাথে চিঠির কথাগুলো মেলাতে চেষ্টা করবে।
দুটো লাইনের মাঝে আমি আমার ভালবাসার মানুষটির ছবি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমরা একই টেবিলে বসে একইসাথে লিখছি, তার ডুবে যাওয়া মনটা আমার মতোই অনেকটা বোকা, বিচারবুদ্ধিহীন সুখে আপ্লুত, আনন্দে তার মুখে সুখের স্মিত হাসি, ঠিক আমারই মতো। আমি অবিরাম লিখছিলাম, নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে লিখছিলাম, যেখানে একটু আগেই তার হাতের স্পর্শ লেগে আছে, এক মধুর ব্যথাময় স্পর্শ; একটু দূরে চোখ ফেরালেই চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সবুজ লতাপাতা জড়ানো ছোট্ট গেটের জালি। দুটো লাইনের মাঝখানে আমি আমার ভালবাসার মুখের ছবি দেখতে পাচ্ছিলাম। ওই ছোট্ট সবুজ লতাপাতা সমন্বয়ে জড়ানো জালির মধ্যে দিয়ে সাশা আমাকে দেখছে, যখন তাকে বলেছিলাম, “এবার আসি তাহলে”! যখন তাকে আমি একথা বলেছিলাম তখন আমি কিছুই ভাবছিলাম না, শুধু তার অবয়বকে সম্মান করছিলাম যেমন যে কোন ভদ্র মানুষ এক সুন্দরী মহিলাকে করে থাকে; যখন আমি সেই সবুজ জালি দেওয়া গেটের ভেতর দিয়ে তাকাতাম, তখন আমার চোখের সামনে দুটি বড় বড় চোখ ভেসে উঠত, হঠাৎ করেই আমি যেন এক প্রেরণা খুঁজে পেতাম, আর বুঝতে পেরেছিলাম, আমি ভালবেসেছি, এই সব অনুভূতি দুজনের মধ্যেই অজান্তেই হয়েছিল, আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার আর কিছুই করার নেই শুধু নিশ্চিত কিছু অনুভূতিকে নিয়ে চলা ছাড়া।
একটি প্রেমপত্রের খামের মুখটা আঠা দিয়ে লাগানোর মাঝে যে এতো চমৎকার লাগে কে জানতো! ধীরে ধীরে কোট আর টুপি লাগানো, খুব শ্লথ এবং হালকাভাবে হাতে সেই মণিমুক্তাময় প্রেমপত্রের মতো সম্পদ হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া, এবং তা পোস্ট করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া, আহা! আকাশে এখন কোনও তারা নেই, তাদের জায়গায় লম্বা সাদা একটা রেখা দেখা যাচ্ছে, অদূরের ঘোলাটে বাড়িগুলোর ছাদের ওপর রেখাটি ছেঁড়াখোঁড়া মেঘের জন্যে কেমন যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। এই সাদা রেখাটি থেকে একটা অস্পষ্ট ফ্যাকাশে আলো সারা আকাশে ছড়িয়ে আছে। শহর নিদ্রামগ্ন, শুধু জলবাহী গাড়িগুলো বেরিয়ে এসেছে। দূরে কোথাও কারখানা থেকে শ্রমিকদের জাগিয়ে তোলার জন্যে ভোঁ বাজছে। পোস্টবক্সের দেহ হাল্কা শিশিরে ভেজা, তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো পাঠক, ওখানে গেলে একটা ঝাপ্সা অবয়ব দেখতে পাবে, সে এক বাড়িরক্ষক, গায়ে ঘন্টার আকৃতির ভেড়ার লোমের পোশাক পরা, এবং হাতে একটা ছড়ি। সে যেন ঘুমিয়েও নেই, আবার জেগেও নেই, দুটোর মাঝামাঝি কোনও অবস্থানে রয়েছে, স্থির দাঁড়িয়ে, মনে হয় ডাকলেও সাড়া দেবে না। যদি এই পোস্টবক্স বুঝতে পারতো যে মানুষ সবসময়ই কীভাবে নিজের স্বার্থের জন্যে কিম্বা ভাগ্য বদলের জন্যে তাকে ব্যবহার করে তাহলে নিশ্চয়ই সে এতো সুবাতাস বইয়ে দিতো না তার ব্যবহারকারীদের জন্যে। আমি অবশ্য বেশিরভাগ সময়েই তাকে একটা চুমু দিই। আমি তার দিকে তাকিয়ে ভাবি পোস্ট বক্স হলো মানুষের জন্যে সবচাইতে বড়ো আশির্বাদ।
আমি সবাইকে বলতে চাই ভোররাতে চিঠি পোস্ট করে তাড়াতাড়ি নিজের বাসস্থানে ফিরে এসে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ুক আর সকালে শুয়ে শুয়ে দেখুক কীভাবে সকালের আলো অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে চারদিকে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে তোড়জোড় করছে।
যাই হোক….পরদিন মাঝসকালে সাশার কাজের মেয়েটা আমার চিঠির উত্তর নিয়ে এলো।
“আমি নিশ্চিতভাবেই খুব আনন্দীত হব যদি তুমি দিনের বেলায় আমাদের বাড়ি আসো প্লিজ আমি কিন্তু তোমাকে আশা করছি। তোমার স।”
একটি কমা পর্যন্ত নেই, এবং ‘আনন্দিত’ শব্দটির ভুল বানান এবং গোটা চিঠি এবং একটা লম্বা সরু খামে পুরে আমার কাছে পাঠানো হয়েছে যার হৃদয় ভালবাসায় পূর্ণ হয়ে আছে! আমি চিঠি হাতে নিয়ে তাকেই দেখছিলাম, তার হাঁটার ছন্দ, হাসবার সময় তার ভ্রূ তুলে রাখার স্টাইল, কথা বলার সময় তার ঠোঁটের চাঞ্চল্য…কিন্তু তার চিঠির বিষয় কিন্তু আমাকে তৃপ্ত করল না। প্রথম কথা, কাব্যিক চিঠি কখনোই এইভাবে লেখা হয় না, এবং দ্বিতীয়ত, ওর বাড়িতে আমি কেন যাবো, অপেক্ষা করব ওর শক্তপোক্ত মোটাসোটা মা, ভাইয়েরা, নানারকম আত্মীয়স্বজনদের জন্যে যতক্ষণ পর্যন্ত না ওরা আমাদের একা বসে কথা বলার অনুমতি না দেয়! আমাদের দুজনের সম্পর্কের মাঝে ওদের মাথা গলাতে দেওয়া যাবে না, দুজনের মাঝখানে ওদের এই অনুমতি আদায় করাটা একেবারেই ঘৃণ্য, এবং আরও ঘৃণ্য তাদেরকে এই মাথা গলানোর ব্যাপারটাকে প্রতিরোধ করা, কেনই ওই শক্তপোক্ত আধা কালা মহিলার প্রশ্ন একটা বাচ্ছা মেয়ের ওপর পড়বে? আমি পরিচারিকাকে উত্তর লিখে দিলাম, লিখলাম যে সে দেখা করার জন্যে কোনও একটি পার্ক অথবা দু’দিকে সবুজের সারি দেওয়া রাস্তা পছন্দ করুক। আমার প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গেই গৃহীত হলো, আমি সঠিক সুতোয় টান দিয়েছি, সেটা বলতেই পারি।
বিকেল চার অথবা পাঁচটার দিকে আমি পার্কের সবচাইতে দূরত্বে সবচাইতে সবুজ ঝোপঝাড় ও আগাছায় ভরা অংশের দিকে রওনা দিলাম। সেখানে কোনও মানুষের আত্মাও ছিল না, আমাদের মিলনস্থল কাছাকাছি কোনও সুন্দর রাস্তা কিম্বা কোনও সুন্দর ছায়াবীথিকায় হতে পারতো, কিন্তু মেয়েরা কোনও রোমান্টিক সম্পর্কে অর্ধেক পথে থেমে থাকতে চায় না, সেটা অনেক দূরত্বে হোক, নির্জন ঝোপঝাড়ে হোক, পাহাড় পর্বতে হোক কিম্বা সেখানে হঠাৎই কোনও রুক্ষ মদ্যপ লোক আসুক না কেন! যখন আমি সাশার কাছে পৌঁছোলাম তখন সে আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল এবং তার পেছন দেখে গভীর রহস্যলোক যেন আমি পড়তে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন তার পিঠ এবং ঘাড়ের পেছনদিকে এবং তার পরনে কালো বুটিদার জামা বলছে : এই! … মেয়েটির পরনে সুতির জামা, তার ওপর একটা হালকা ওড়না জড়ানো, হালকা সাদা কাপড়ের একটা মুখাবরনও রয়েছে, যা এই আবহকে আরও রহস্যাবৃত করে তুলেছে। আমি আবহকে নষ্ট করতে চাইছিলাম না, আমি জানতাম আমি তার কানের কাছে গিয়ে পায়ের দু’ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ফিসফিস করব, কথা হবে অর্ধ উচ্চারিত।
এখনও আমি স্মরণ করতে পারি, এই দেখাসাক্ষাৎ এ আমি তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম না। সাশা আমাদের মধ্যে কথাবার্তায় এই রোমান্টিক রহস্যময়তায় তেমন জড়িত ছিল না, আমার চুম্বন কিম্বা আত্মনিবেদনের ভঙ্গিমা, বিষণ্ণ স্তব্ধ প্রকৃতি তাকে একমুহূর্তের জন্যে বিহ্বল করেনি…সে একমুহূর্তের জন্যে নিজেকে ভুলে যায়নি, সে এইসবের উর্ধ্বেই ছিল, কোনও রহস্যময় অনুভবের রহস্যমন্ডিত প্রকাশ সে হতে দেয়নি, এবং প্রকৃতপক্ষেই আমার জায়গায় ইভান সিদরিচ অথবা সিওদর যে কেউ থাকলেই সে নিজেকে এভাবেই সুখী ভাবতে পারতো। অপরদিকের ব্যক্তিটির তাহলে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারতো? সে কি ভাবতো সে ভালবাসা পেয়েছে অথবা পায়নি? ভালবাসা বলে সত্যিই কিছু কি আছে? ভালবাসা শব্দটা কি “সত্য কিছু’’ অথবা কিছুই নয়?
পার্ক থেকে আমি সাশাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। ভালবাসার নারী যখন এরকম অবিবাহিতের বাড়িতে পা রাখে তখন মদ ও সঙ্গীতের মতোই তা অভিভূত করে। সাধারণত এক্ষেত্রে একজন নিজের অতীত সম্পর্কে বলতেই থাকে এবং তার কথাবার্তায় প্রবল আত্মবিশ্বাস থাকে, এই আত্মবিশ্বাস একেবারে সবকিছুকেই ছাড়িয়ে যায়। কতো রকমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুরু হয়, নানারকমের কাজের পরিকল্পনা, খুবই আন্তরিকতায় একজন জেনারেলের পদ নিয়ে আলোচনা, যদিও তোমার একজন লেফটেন্যান্ট এর পদ সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই, সবকিছু মিলিয়ে একটা উচ্চমার্গের বৃত্তে নিরর্থক ঘোরাফেরা করা যাতে তোমার ভালবাসার মানুষটি আরও ভালবাসে এবং এই অজ্ঞ পরিকল্পনাকে সমর্থন করে। ভাগ্যক্রমে, মেয়েরা তাদের ভালবাসার অনুভূতিতে অনেকটাই অন্ধ হয় এবং জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। শুধু সম্মতি নয়, এক অজানা বিস্ময়ে তাদের মুখের রঙ বদলায় এবং পরিপূর্ণ শ্রদ্ধায় অনেকটা লোভীর মতোই প্রেমিকের পাগলের প্রলাপের জালেও আটকে পড়ে। সাশা আমার কথা পুরো মনোযোগে শুনছিল, কিন্তু শীঘ্রই আমি আবিষ্কার করলাম সে আসলে কিছুই শুনছিল না, তার মানসিক অনুপস্থিতি আমি অনুভব করতে পারছিলাম, সে আমাকে বুঝতেই পারছিল না। ভবিষ্যৎ নিয়ে তার ভাবনা ছিল বাহ্যিক,আর আমি আমার কাল্পনিক ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে গিয়ে শুধু সময় নষ্ট করছিলাম। তার আগ্রহ ছিল তার ঘরে কী কী বস্তু সাজানো থাকবে, কেন আমার ঘরে খাড়া পিয়ানো রয়েছে কিন্তু বড় পিয়ানো নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। সে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার টেবিলে রাখা ছোট ছোট বস্তুগুলো লক্ষ করছিল, ছবিগুলো দেখছিল, বোতলের গন্ধ নিচ্ছিল, খামের স্টাম্পগুলো খুলছিল, বলছিল তার এগুলো দরকার।
“প্লিজ আমার জন্যে এগুলো সংগ্রহ করে রাখবে’’ – গম্ভীর মুখে সে কথাগুলো বলল। “ প্লিজ এটা করে রেখো।’’
তারপর সে জানালার কাছে একটা বাদাম খুঁজে পেল, শব্দ করে সেটাকে ভাঙল এবং সশব্দে খেয়ে ফেলল।
“তুমি কেন বইয়ের পেছনে ছোট করে লেভেল লাগিয়ে রাখো না?’’ –  বুকশেলফের দিকে তাকাতে তাকাতে সে বলল।
কেন?
অহো, এতে করে প্রত্যেকটি বইয়ের একটা নম্বর থাকবে। আর আমার বই কোথায় রাখব? তুমি জানো! আমারও বই আছে।
তোমার কি ধরনের বই আছে?
সাশা তার চিরাচরিত ভ্রূভঙ্গি করে বলে – সবরকমের বই।
এইবারে আমি যদি তাকে জিজ্ঞেস করতাম তার ভাবনা সম্পর্কে, তার বিশ্বাস সম্পর্কে কিম্বা তার লক্ষ্য সম্পর্কে, সে এইভাবেই ভ্রূভঙ্গি করে একমিনিট ভাবতো, তারপর বলতো – সব ধরনের।

এরপর আমি সাশার সাথে বাড়িতেই দেখাশোনা করতাম এবং তার ঘর থেকে নিয়মিত বিদায় নিতাম। আমরা দুজনেই আনুষ্ঠানিক ভাবে বাগদত্ত, আমাদের বিয়ে হওয়া পর্যন্ত সবাই তা গণ্য করতো। যদি পাঠক আমাকে অনুমতি দেন যে এই বিষয়ে শুধু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিচার করি, তাহলে বলব বাগদত্ত হওয়াটা একটা ভীষণ কষ্টদায়ক ব্যাপার, স্বামী হওয়া কিম্বা কিছু না হওয়ার চাইতেও। একজন বাগদত্ত মানুষ এদিকেও নয় আবার ওদিকেও নয়, সে ছেড়ে এসেছে নদীর একটা তীর, আবার ওদিকের তীরেও পৌঁছাতে পারছে না, সে বিবাহিত নয়, আবার সে নিজেকে ঠিক “ব্যাচেলর” বলেও ভাবতে পারছে না, ভারবাহী মালবাহকের মতোই খানিকটা বললেও বুঝি বাড়িয়ে বলা হয় না।
প্রতিদিন যখনই আমি অবসর পাই দ্রুত আমার প্রেমিকার কাছে যেতাম । রোজই আমি উত্তুঙ্গ আশা, ইচ্ছে, পরামর্শ ও অনেক বাক্য কিম্বা বাক্যাংশ বহন করে নিয়ে যেতাম। আমি সবসময়ই কল্পনায় থাকতাম যেই না তার পরিচারিকা দরজা খুলে দেবে আমার অবদমিত কল্পনার আশা সমুদ্রের টাটকা হাওয়ায় আমায় খুশিতে ভরিয়ে দেবে। কিন্তু বাস্তবে অন্য কিছুই হতো। সবসময়ই আমার প্রেমিকাকে তার পরিবার পরিজনের মাঝে পেতাম আর সবাই বিবাহের পোশাক ইত্যাদি নিয়ে খেলো কথাবার্তায় মেতে থাকতো (উল্লেখ্য, বিগত দু’মাস থেকে ওরা বিয়ের পোশাক সেলাইয়ের কঠোর পরিশ্রম করছিল যাতে দু’শ রুবলের কিছু কমে পোশাক তৈরি করা যায়)। সেলাইয়ের ঘরে অনেক জিনিস ডাঁই করা, সেখানে একটা গন্ধ উঠতো, লোহার,গলানো মোমের, পা ফেললে পায়ের নীচে পোকামাকড়ের খোলসের মতো খচমচ শব্দ উঠতো। বাড়ির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘরগুলো ছিল লিনেন, ক্যালিকো, মসলিন কাপড়ের পোঁটলা পুটলিতে পূর্ণ তার ভেতর দিয়ে সাশার ছোট্ট মাথাটা দেখা যেতো তার দাঁতের দুটো সারির মাঝখানে সুতো আটকানো অবস্থায়। এইসব সেলাই করা পার্টি আমাকে উল্লাসে স্বাগত জানাতো এবং হঠাৎই আমাকে খাবার ঘরে নিয়ে আসতো যেখানে তাদের আমি লুকিয়ে রাখতে পারতাম না কারণ এখানেই তাদেরকে বিশেষভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। আমার এইসব অনুভূতি সত্ত্বেও আমাকে খাবার ঘরে বসতে হতো এবং সাশার দরিদ্র আত্মীয় পিমেনোভনার সাথে কথা বলতে হতো। সাশাকে উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত দেখাত, সে হাতে দস্তানা, উল ইত্যাদি একঘেয়ে জিনিসপত্র হাতে নিয়ে আমার পাশ ঘেঁষে তার ছোটাছুটি অব্যাহত রাখত।
— দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমার কাছে এক মিনিটও সময় নেই। – সে এভাবেই বলতো যখন আমি অনুনয়ের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতাম।
— স্তেপানিদা আমার নরম হালকা পোশাকটার বডিস একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে।
এইসব ছিল তার কথাবার্তা।
অযথা খানিকটা অপেক্ষা করে আমি মেজাজ হারিয়ে ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতাম রাস্তায় আমার নতুন কেনা ছড়িটাকে সঙ্গী করে। অথবা যদি আমি কখনও প্রেমিকাকে সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিম্বা গাড়ি চালিয়ে যাবার জন্যে বেরোতাম তখন দেখতাম সে বেরোবার পোশাক পরে তার ছোট ছাতাটা নিয়ে মায়ের সাথে হলঘরে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
“দারুণ, আমরা “আর্কেড” ( শপিং মলের সাথে তুলনীয়) এর দিকে যাচ্ছি” সে বলতো। “আমরা কিছু উল কিনব আর মাথার এই টুপিটাও বদল করব।”
আমার বাইরে যাওয়ার আনন্দ পুরোপুরি মাটি হয়ে যেত। আমি মেয়েদের সঙ্গে কেনাকাটায় যাচ্ছি, এরা দরদস্তুর করছে আর কেনাকাটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে সেই ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল নিদারুণ বিরক্তিকর। সবচাইতে লজ্জা লাগতো যখন সাশা দোকানির সাথে অনেক দরদস্তুর করে কিছু না কিনেই দোকান থেকে বেরিয়ে আসতো। তারপর সামান্য কয়েক রুবল বা হাফ রুবলের জন্যে নিদারুণ দরদস্তুরে মেতে থাকতো।
যখন তারা দোকান থেকে বেরিয়ে আসতো, সাশা ও তার মাকে দেখাত চিন্তিত ও খানিকটা ভীত। অত:পর তাদের শপিং এ কী কী ভুল করেছে তা নিয়ে চলতো লম্বা আলোচনা, কিম্বা তারা ভুলভাল জিনিস কিনেছে তা নিয়ে আক্ষেপ করতো, যেমন ছিটের কাপড়ের ফুলগুলো বেশি কালো ইত্যাদি।

হ্যাঁ আমি বাগদত্ত হয়ে ক্লান্ত। যদি এই সময়কাল পেরিয়ে যায় তাহলেই আমি খুশি হই।

এখন আমি বিবাহিত। আমি আমার পড়ার ঘরে বসে আছি। আমার পেছনে সোফায় সাশা বসে কড়মড় করে কিছু চিবোচ্ছে। আমি একগ্লাস বিয়ার খেতে চাই।
সাশা কর্ক খোলার স্ক্রুটা নিয়ে এসো… সেটা কোথাও পড়ে আছে।
সাশা লাফিয়ে উঠল, উল্টোপালটা ভাবে কিছু খুঁজল কাগজপত্রের ডাঁই এর ভেতর, কিছু ম্যাচবাক্স নীচে ফেলে আবার এসে বসে পড়ল একেবারে চুপচাপ হয়ে…পাঁচ মিনিট চলে গেল…দশ মিনিট গেল, এদিকে আমি বিরক্ত হচ্ছি ও তৃষ্ণার্ত হচ্ছি।
— সাশা, ভালো করে খুঁজে দেখো!
সাশা লাফিয়ে উঠল ও আমার সামনে সেই কাগজের ডাঁই টেনে এনে সশব্দে খুঁজতে লাগল, ব্যাপারটা এমন অসহ্য ছিল যে, মনে হচ্ছিল আমারা দুজনেই যেন দুজনের জন্যে ছুরিতে শান দিচ্ছি….আমি উঠে দাঁড়ালাম, বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম কর্ক খোলার স্ক্রু-টা, বিয়ারের বোতলটির কর্ক অত:পর খোলা গেল। সাশা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে লম্বা করে কিছু একটা বলতে লাগল।
তুমি এখন কিছু একটা পড়লে ভালো হয়। – আমি তাকে বললাম।
সে একটা বই হাতে নিয়ে, আমার মুখোমুখি বসে পড়ল আর ঠোঁট নেড়ে নেড়ে পড়তে লাগলো…আমি তার ছোট্ট কপাল, আন্দোলিত ঠোঁট দেখতে দেখতে ভাবনায় ডুবে যেতে লাগলাম। তার বয়েস কুড়ি বছরে ঢুকছে – আমি ভাবলাম। যদি সে শিক্ষিত শ্রেণির কোনও ছেলেকে জীবনে গ্রহণ করে তাহলে দুজনের মাঝে কতটাই না তফাৎ! ছেলেটির গভীর জ্ঞান, প্রত্যয় এবং কিছু বুদ্ধিমত্তা থাকতে পারে।
তবে আমি এই তফাতটুকু ক্ষমা করে দিতে পারি ওই ছোট্ট কপাল, নড়তে থাকা ঠোঁটদুটোর জন্যে। আমি স্মরণ করতে পারি সেই প্রথম ভালবাসার অনুভূতির দিনগুলোকে, আমি মেয়েদের মোজার দাগের জন্যে, তাদের বোকা বোকা কথার জন্যে, তাদের দাঁত পরিষ্কার না করার জন্যে পরিত্যাগ করেছিলাম, আর এখন আমি এই মড়মড় শব্দে চিবিয়ে খাওয়া, কর্ক খোলার স্ক্রু-টি খুঁজে বের করার জন্যে কাগজের ডাঁই তছনছ করা, এইসব অশ্লীলতা, লম্বা করে নিরর্থক কথার চাষ সব সবকিছুই সহ্য করতে পারছি, ক্ষমাও করতে পারছি, কোনও কিছুই আটকাচ্ছে না আর। আমি অচেতন ভাবেই এতসব ক্ষমা করে যাচ্ছি, বিনা চেষ্টাতেই, যেন ওর সব ভুল আমারই ভুল, ওর সব দুর্বলতা আমারই দুর্বলতা এবং অনেক ব্যাপার আমাকে পেছন নিয়ে যাচ্ছে কিছু কোমল অনুভূতির কাছে এবং সব কিছু কেমন যেন ভেঙেচুরে যাচ্ছে। এই সমস্ত ব্যাখ্যার পেছনে হয়তো আমার সাশার প্রতি ভালবাসা রয়েছে, অথবা ভালবাসার ব্যাখ্যা ঠিক কী তা হয়তো প্রকৃতপক্ষে নিজেই জানি না।