
শ্যাম্পেন (ছোটোগল্প)
চেখভ
(রাশিয়ান গল্প, ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ বিজয়া দেব)
যে সময় থেকে আমি গল্পটা শুরু করেছি, সেই সময়ে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একটি ছোট রেলস্টেশনে আমার চাকরি ছিল। আমি সেখানে উল্লসিত ছিলাম না কি নিস্তেজ ছিলাম তা পাঠকবৃন্দ ধারণা করে নিতে পারবেন সেই বর্ণনা থেকে যে ঐ ছোট রেলস্টেশনের পনেরো মাইল পর্যন্ত কোনও লোকবসতি ছিল না, একটি মহিলাও ছিল না, একটা ভদ্রস্থ সরাইখানাও ছিল না, আর সেই সময়ে আমি ছিলাম শক্তিশালী, উষ্ণ মস্তিষ্কের, চঞ্চল এবং কিছুটা বোকা টাইপের। ওই ক্লান্তিকর বসে যাওয়া মানসিক অবস্থান থেকে সম্ভবত আমি বিরতি পেতাম শুধু যখন প্যাসেঞ্জার ট্রেন যেত আর যখন ইহুদিদের ধুতুরা ফুলের মাদক-নির্যাস মেশানো বিষাক্ত ভদকা পান করতাম। মাঝেমধ্যে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের জানালায় কোনও মহিলার মুখ একঝলক দেখতে পেতাম। কেউ বা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ট্রেনের বাঁক ফিরে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতো যতক্ষণ না ট্রেনের বাঁক ফেরার দৃশ্যটি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে৷ কেউ বা যতক্ষণ না নিজে পুরো মাতাল হচ্ছে সেই পরিমাণে ওই পচা ভদকা পান করতো দীর্ঘ সময় ধরে, আর এই দিন ও রাতের চলে যাওয়াও বুঝতে পারতো না। আমি ছিলাম উত্তরের অধিবাসী। আমার কাছে এই দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জনমানবহীন খাড়াই অঞ্চলে বাস করাটা ছিল যেন তাতারদের কবরস্থানের নিবিড় নীরবতার মাঝে বাস করার মতোই। গ্রীষ্মকালে এই খাড়াই অঞ্চলটা আরও ক্লান্তিকর হয়ে উঠতো। একটানা ঝিঁঝির ডাক, অতি স্বচ্ছ জ্যোৎস্নার প্লাবন যেখানে নিজেকে একটুখানি লুকিয়ে রাখাও সম্ভব নয়, আমাকে আরও একঘেয়ে ক্লান্তির মাঝে ডুবিয়ে দিতো। আর শীতকাল তো ছিল আরও কষ্টকর। খাড়াই অঞ্চলটা সাদা বরফে ঢাকা থাকতো, জায়গাটার সাথে যেন একটা শীতল দূরত্বের সৃষ্টি হতো, লম্বা রাতগুলোতে নেকড়েদের একযোগে ডাক এক ভয়ঙ্কর দু:স্বপ্নের মাঝে আমাকে নিক্ষেপ করতো। এই ছোট স্টেশনে কতিপয় লোক ছিল, আমি ও আমার স্ত্রী, এক বদ্ধ কালা গলগন্ড রোগগ্রস্ত টেলিগ্রাফ ক্লার্ক আর তিনজন দারোয়ান, এছাড়াও আমার এক ক্ষয়রোগী সহকারি ছিল, সে অধিকাংশ সময় চিকিৎসার জন্যে শহরে থাকতো, সেই সময় তার কাজগুলো আমি করতাম, সে শুধু সময়মতো তার মাসমাইনেটা পকেটস্থ করতো। আমাদের সন্তানাদি ছিল না, সুতরাং তাদের নিয়ে কোনও উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজন করারও যেহেতু ব্যাপার ছিল না, সুতরাং কেক কাটার সময়ে অতিথির উপস্থিতির কোনও সুযোগও ছিল না। শুধু মাসে একবার রেল অফিসার আসতেন, ব্যস ঐটুকুই ছিল বাইরের কারও সাথে যোগাযোগের সুযোগ।
আমার মনে পড়ে সেই দিনগুলোতে আমি ও আমার স্ত্রী নিউ ইয়ারের দিনটির জন্যে অপেক্ষায় থাকতাম। আমরা চেয়ারে বসতাম, খাবার ধীরে ধীরে চিবোতাম, আর সেই কালা টেলিগ্রাফ কেরানির একটানা টরে টক্কার একঘেয়ে আওয়াজ শুনতাম। ততক্ষণে আমি মাদকতায় ভরপুর ভদকা খেয়ে নিয়েছি পাঁচ গ্লাসের মতো, নিজের ঝুলে পড়া মাথাটাকে দু’হাতের মুঠোয় আটকে রেখে বসতাম, ভাবতাম এই ভয়াবহ একঘেয়েমি থেকে পালানোর সত্যিই কি কোনও রাস্তাই নেই? আমার স্ত্রী আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকতো, এমনভাবে একমাত্র সেসব মেয়েরাই তাকায় যাদের এই দুনিয়ায় সুঠাম সৌন্দর্যের এক স্বামী ছাড়া আর কিছুই নেই। সে আমাকে পাগলের মতো ভালবাসতো, দাসীর মতো সে আমাতে সমর্পিত ছিল, এই ভালোবাসা শুধু আমার বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্যে নয়, কিম্বা আমার আত্মিক সৌন্দর্যের জন্যেও নয়, মনে হয় সেটা আমার পাপের জন্যে, আমার বিচ্ছিরি সব রসিকতার জন্যে, কিম্বা আমার নিষ্ঠুরতার জন্যে, মাদকাসক্ত অবস্থায় আমার চরম উগ্রতার জন্যে, সে জানতোই না কীভাবে আমার অশালীন সব রসিকতার জন্যে কী প্রতিক্রিয়া জানাবে। আমি মাতাল অবস্থায় তাকেই গালাগালি দিতাম, তাকেই পীড়ন করতাম।
যদিও এই অসহ্য একঘেয়েমি আমাকে ক্রমশই গ্রাস করে নিচ্ছিল, তবু একটুখানি ব্যতিক্রমী উৎসব পালনের জন্যে আমরা নিউ ইয়ার্স ডে-টির জন্যে প্রস্তুতি নিতাম, এবং নিউ ইয়ার্সের সেই মধ্যরাতের জন্যে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। ব্যাপারটি ছিল এই যে, আমরা দুটি শ্যাম্পেনের বোতল নিউ ইয়ার্স ডে-র জন্যে সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম যা ছিল বিখ্যাত ফরাসি ব্র্যান্ডের শ্যাম্পেন ভ্যুভ ক্লিকো ( Veuve Clicquot); এই সম্পদ আমি বাজি জিতে নিয়েছিলাম এক হেমন্তে ডি স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে, যখন আমি তাঁর সাথে মদ্যপান করছিলাম একটি ব্যাপ্টিস্ট অনুষ্ঠানে।
এই শ্যাম্পেন এর ব্যাপারটা নিয়ে এই যে আমার ও আমার স্ত্রীর মাতামাতি, সেটা অনেকটা এইরকম, যেমন ধরুন, একটি অঙ্কের ক্লাস, একটা ভারী পরিবেশে ছাত্রদের মাথা ধরে যাচ্ছে, সেই সময়ে একটা প্রজাপতি ক্লাশে ঢুকে পড়ল, ছাত্রদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সেই প্রজাপতির দিকে, অহেতুক প্রজাপতির এই যে পাখার ঝটফটানি, ছাত্ররা তাতে যেন একটু ব্যতিক্রমী পরিবেশ খুঁজে পেল, আমাদের ব্যাপারটা অনেকটাই সেইরকম ছিল, এই নির্বান্ধব দ্বীপান্তরে সাধারণমানের কোনও শ্যাম্পেন এসে পৌঁছোবে সেটা কল্পনারও অতীত, আর এই নামী ব্রান্ডের দু ‘বোতল শ্যাম্পেন এই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে সেই ভারগ্রস্ত অঙ্কের ক্লাশে চঞ্চল প্রজাপতির মতোই আমাদের মনটাকে খানিকটা মুক্তি দিয়েছিল, আমরা যেন কীসের এক অপেক্ষায় থাকতাম।
এক নিউ ইয়ার্স ডে তে আমরা দুজনে নি:শব্দে বসেছিলাম দুটি বোতলকে সামনে নিয়ে, একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম আর একবার তাকাচ্ছিলাম বোতলের দিকে।
যখন বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি আমি ধীরে ধীরে বোতলের ছিপি খুলতে শুরু করে দিয়েছিলাম। আমি জানি না ভদকার প্রতিক্রিয়া না কি বোতলের দেহটা ভেজা ছিল, বোতলটা আমার হাত ফস্কে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল, তবে আমি সাথে সাথেই সেটাকে তুলে নিয়েছিলাম, খুব বেশি নয়, মনে হয় একগ্লাসেরও কম মদ মেঝেতে পড়েছিল। দুটো গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢেলে স্ত্রীকে বললাম — নতুন বছর খুব ভালো কাটুক তোমার। নাও। বলে গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
স্ত্রী তার গ্লাসটা হাতে নিলে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। তার মুখটা ফ্যাকাসে আর ভীত দেখাচ্ছিল।
তারপর জিজ্ঞেস করলো — বোতলটা কি তোমার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল?
— হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কি হয়েছে?
— এটা অলক্ষুণে। গ্লাসটা টেবিলে রেখে দিল সে। তার চেহারাটা আরও ভীত ও ফ্যাকাসে লাগছিল।
— এটা অলক্ষুণে। এটার মানে হলো খুব খারাপ কিছু একটা ঘটবে এই বছরে।
— কী আজেবাজে বকছ! আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি এক বুদ্ধিমতী মহিলা। কিন্তু কথা বলছ সেকেলে বুড়ো নার্সের মতো। গ্লাসটা নাও, এসো চুমুক দাও।
— ঈশ্বর বুঝিয়ে দিয়েছেন এ বছরে খারাপ কিছু ঘটবে, আর তা ঘটবেই।
সে গ্লাসে চুমুক দিল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দিয়ে তার এই ভাবনার ভেতর ডুবে রইলো। আমি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে পুরনো কিছু প্রচলিত কথা বললাম, অর্ধেক গ্লাস পান করলাম, ঘরের এদিক ওদিক পায়চারি করলাম তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
বাইরে তখন কুয়াশাচ্ছন্ন শীতল রাত। অনাহূত সৌন্দর্য। চাঁদ ও দুটো সাদা হালকা মেঘ ঝুলে আছে ঠিক স্টেশনের মাথার ওপর, গতিহীন এবং ঐ জায়গায়টিতেই যেন আঠালো হয়ে আটকে আছে, মনে হচ্ছে যেন কোনও কিছুর জন্যে সে অপেক্ষারত। একটা ক্ষীণ স্বচ্ছ আলো খুব নম্রভাবে এই কুয়াশা ও জ্যোৎস্নায় মেশা পৃথিবীকে স্পর্শ করে আছে। যেন কেউ তার পেলবতাকে বিনষ্ট না করে ফেলে। সে তার পেলব আলো দিয়ে সব কিছুকেই আলোকিত করে আছে এক স্থির স্তব্ধতায় তুষার স্তুপকে.. রেলের বাঁধকে।
আমি রেলের বাঁধের দিকে সোজা রওনা দিলাম। আকাশের ঝকমকে তারার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম – “বোকা মহিলা! বুঝলাম কেউ কেউ স্বীকারও করে যে অলক্ষুণে ব্যাপার স্যাপার কিছু কিছু নাকি ঘটেও যায়। তাই বলে আমাদের সাথে এই মুহুর্তে কী এমন অশুভ হয়েছে যে এভাবে ভয়ে বিহ্বল হতে হবে? দুর্ভাগ্য আমরা ইতিমধ্যে সহ্য করেই চলেছি, এখন যা সহ্য করছি তা এতটাই বড়ো যে এরচাইতে খারাপ কিছু কল্পনার অতীত। একটা মাছকে ধরে ভাজা করে স্যসের সাথে পরিবেশন করার পর তার আর কী ক্ষতি করা যেতে পারে!”
একটি শিশিরবিন্দুমেশা তুষার গায়ে মেখে একটি পপলার গাছ এই নীলাভ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এক দৈত্য গায়ে সাদা কাপড় জড়িয়ে কবরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পপলারটিকে খুব বিষন্ন ও
হতাশ লাগছিল, যেন আমার মতোই সে একাকীত্ব অনুভব করতে পারছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে অনেকসময় দাঁড়িয়েছিলাম।
একা একাই স্বগতোক্তি করছিলাম- “আমার যৌবন আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে পোড়া সিগারেটের মতোই। যখন একেবারে ছোট তখন আমার বাবা মা মারা গেল। উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হলো। আমি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম, কিন্তু না পেলাম শিক্ষা না পেলাম সন্তান। এক নম্রতম মেকানিকের যতটুকু জ্ঞান থাকে তার চাইতে বেশি জ্ঞানও আমার নেই। আমার কোনও আশ্রয় নেই, কোনও আত্মীয় নেই, নিজের পছন্দসই কোনও কাজ নেই। কোনও কিছুর জন্যেই আমি মানানসই নই। ক্ষমতার দিক দিয়েও এক ছোট্ট রেলস্টেশনে আটকে থাকা অপদার্থ মানুষ। যন্ত্রণা আর ব্যর্থতা ছাড়া আমার আর আছে কি! এর চাইতে খারাপ আর কী হতে পারে! “
দূর থেকে লাল আলো এগিয়ে আসছিলো। একটি ট্রেন আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। এই নিস্তব্ধ তৃণভূমি ভেদ করে ট্রেনের শব্দ নৈ:শব্দ আরও বাড়িয়ে তুলছিল। আমার ভাবনা এতটাই তিক্ত ছিল যে মনে হচ্ছিল আমি আমার ভাবনাগুলোকে জোরে জোরে ব্যক্ত করছি আর টেলিগ্রাফ তারের মৃদু আওয়াজ ও ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ আমার ভাবনাকেই ব্যক্ত করছে।
‘’আমার এরচাইতে বেশি কি ক্ষতি হতে পারে? আমার স্ত্রীকে হারানো?’’ আমি চমকিত হয়ে ভাবছিলাম। ‘’এটিও আমার কাছে ভয়াবহ কিছু নয়। নিজের বিবেকের কাছে গোপন করা ঠিক নয় যে আমি আমার স্ত্রীকে ভালবাসি না। আমি তাকে বিয়ে করেছিলাম যখন তখন আমি এক ছন্নমতি বালক। এখন আমি যুবক এবং পুরোমাত্রায় শক্তিধর, আর আমার স্ত্রীর অনেকটাই বয়েস বেড়ে গেছে আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কিছু পুরনো সংস্কার আঁকড়ে ধরে বসে আছে। কী আছে তার ঐ ভাবপ্রবণ ভালবাসায়? তার ফাঁপা বুকে? মাদকতাবিহীন দৃষ্টিতে? আমি তাকে রেখেছি, সহ্য করছি, সে আছে, কিন্তু তার প্রতি আমার আগ্রহ নেই। আর কি ঘটতে পারে? আমার যৌবন বিনষ্ট হয়ে গেছে, যেমন বলা হয়ে থাকে, যেন এক চিমটে নস্যির নেশায়। প্যাসেঞ্জার ট্রেনের জানালায় বসে থাকা মহিলারা আমার চোখের সামনে উল্কাপাতের মতো ভেসে ওঠে। ভালবাসা আমি কখনও পাইনি, আজও নয়। আমার পুরুষত্ব, আমার সাহস, আমার অনুভব ক্ষমতা ক্রমশই ধ্বংস হচ্ছে…সবকিছুই আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, আমার সমস্ত সম্পদ এই জনমানবশূন্য তৃণভূমিতে ফুরিয়ে যাচ্ছে, তার একবিন্দুও কাজে লাগছে না।”
ট্রেনটা তার হেডলাইট আমার ওপর ফেলে সশব্দে আমাকে পেরিয়ে গেল, সবুজ আলো দেখে একটু থেমে আবার ঘড়ঘড়িয়ে চলে গেল। প্রায় দেড় ঘন্টা হাঁটার পর আমি ফিরছিলাম। বিষাদগ্রস্ত চিন্তাগুলো তখনও আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। এই বিষাদ আমার কাছে এতোই বেদনাদায়ক ছিল যে এখনও আমি মনে করতে পারি, আমি যেন চেষ্টা করছিলাম যে এই বিষাদ যেন আমাকে আরও বিষন্নতার ভেতর ডুবিয়ে দেয়। আপনারা হয়তো জানেন যে কিছু ব্যর্থ বা অকেজো মানুষ আছে যারা খুব একটা চালাক কিম্বা ধূর্ত নয়, তাদের কাছে ওই বিষাদ কিম্বা ব্যর্থতার ভাবনা একটা ইতিবাচক তৃপ্তি দেয় এবং এই ধরনের বিষাদ যেন তাদের কাছে অনেকটা বিনোদনের মতোই। বলতে পারি, আমি যা ভাবছিলাম তার মধ্যে সবটাই সত্যি, আবার যদি বলি তার মধ্যে অহংজনিত অযৌক্তিকতাও ছিল, এবং তারমধ্যে বালকসুলভ একটি ঔদ্ধত্য তো ছিলই, “এর চাইতে খারাপ আর কি হতে পারে?’’
“এখন তাহলে কি ঘটতে পারে?” নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছিলাম। আমি মনে করি, আমি সব কিছুই সহ্য করছি। হ্যাঁ, আমি অসুস্থ হতে পারি। আমার টাকাপয়সা হারিয়ে যেতে পারে, আমি প্রতিদিন আমার সিনিয়রদের কাছ থেকে তিরস্কৃত হতে পারি, আমি ক্ষুধার্ত হতে পারি, স্টেশন চত্বরে একটি পাগলা নেকড়ে ঢুকে যেতে পারে। এর চাইতে বেশি কি হতে পারে, অপমানিত হতে পারি, অবমানিত হতে পারি.. অথবা অন্যকেও আমি অপমানিত করতে পারি। কিন্তু আমি অপরাধমূলক কাজ করি না, এটি সত্যি, কারণ অপরাধমূলক কাজ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ওসবের জন্যে শাস্তি পাবো তা মনে করি না।’’
দুটি ছোট মেঘ এখন চাঁদের কাছ থেকে সরে গেছে, একটু দূরত্বে তারা দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে দুটিতে ফিসফিস করে কিছু কথা বলছে এমনভাবে যেন চাঁদ শুনতে না পায়। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইতে শুরু করেছে হাওয়ায় সাথে ট্রেনের ঘড়ঘড়ে স্তিমিত আওয়াজ ভেসে আসছে।
দরজার মুখে আমার স্ত্রীকে পেলাম। তার চোখদুটো আনন্দে হাসছিল, তার হাসিতে একটি সুন্দর রসালো আমেজ ছিল।
— তোমার জন্যে একটি খবর আছে। সে ফিসফিস করল, তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে তোমার নতুন কোটটা পরে নাও। আমরা এক অতিথিকে পেয়েছি।
— কে অতিথি?
— আন্টি নাতালিয়া পেত্রনোভা।
— কে নাতালিয়া পেত্রনোভা?
— আমার আঙ্কেল সেমোয়েন ফিওদোরিচের স্ত্রী। তুমি তাকে জানো না। সে চমৎকার, খুব ভালো এক মহিলা।
হয়তো আমার ভ্রুকুটিভরা দৃষ্টি ছিল, আমার স্ত্রীকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
সে দ্রুত ফিসফিস করলো-নিশ্চয়ই সে হঠাৎ এসেছে,কিন্তু তুমি মানা করো না আর তার প্রতি কঠিন হয়ো না। সে ভীষণ অসুখী। আঙ্কেল খুব আক্রমণাত্মক, ভীষণ রূঢ় স্বভাবের, ওর সাথে বসবাস করা ওর পক্ষে ভীষণ কঠিন হয়ে উঠেছে। সে বলছে শুধু তিনটে দিন সে আমাদের সাথে থাকবে, সেইপর্যন্তই থাকবে যতক্ষণ না তার ভাইয়ের চিঠি আসে।
আমার স্ত্রী ফিসফিস করে তার আঙ্কেলের স্বৈরাচারী স্বভাবের কথা বলতে লাগল, মানবসভ্যতার মেয়েদের প্রতি অন্যায় সংক্রান্ত দুর্বলতার কথা বলতে লাগলো সাধারণ বিচারে, আর এই মহিলাটির দু:খের কথা বলতে লাগলো বিশেষভাবে, বলছিল এই অত্যাচারিত মহিলাটিকে আশ্রয় দেওয়া আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে, যদি সেই মহিলাটি মহাপাপীও হয়ে থাকে তবু্ও… ।
এসবের মাথামুণ্ড কিছু মাথায় না নিয়ে আমি নিজের ঘরে গিয়ে নতুন কোটটা পরলাম আর নবাগত আন্টির সাথে পরিচিত হতে পা বাড়ালাম।
ঘন কালো দুটি বড় বড় চোখের এক ছোটখাটো মহিলা টেবিলের পাশে বসেছিলেন। আমার টেবিলের পেছনে ছাইরঙা দেয়াল, আমার পালিশবিহীন সোফা, ঘরের ভেতরের এমনকি ক্ষুদ্রতম ধুলোটিও মনে হচ্ছিল একেবারেই নতুন, ঝকঝকে হয়ে উঠেছে এই সুন্দরী, যুবতী, ও যৌন আবেদনময়ী অনবদ্য মহিলাটির উপস্থিতিতে। প্রথম দর্শনেই যেন আমি তার সবটুকুই গ্রহণ করে নিয়েছিলাম। একথা বলতেই হয়, সমগ্র ইউরোপে এমন কোনও পুরুষ কি আছে যে এই ধরণের মহিলাকে দেখে এক নজরেই চিনতে পারে না!
— আমি জানতাম না, আমার এত বড় এক ভাইপো আছে! কথাটা বলে আন্টি আমার সাথে হাত মেলালেন।
— আর আমিও জানতাম না আমার এত সুন্দরী এক আন্টি আছে। আমি উত্তর দিয়েছিলাম।
রাতের শেষ খাবার আবার শুরু হলো। দ্বিতীয় শ্যাম্পেনের বোতলটির ছিপি খুলতেই শ্যাম্পেন উছলে উঠল। আমার আন্টি তার অর্ধেক গ্লাস এক ঢোকে গিলে ফেললেন। আমার স্ত্রী যখন কয়েক মুহূর্তের ঘর ছেড়ে গেলে আন্টি গ্লাসের বাকিটুকুও কিন্তু ফেলে দিলেন না। আমি মাতাল ছিলাম মদ ও সুন্দরী মহিলার উপস্থিতিতে। পাঠক সেই গানটা স্মরণ করতে পারেন?
“কালো চোখদুটো যেন পিচফলের মতো
উজ্জ্বল সুন্দর চোখের প্রজ্জ্বলনে
আমি কি তোমাকে ভালবাসি
না কি ভয় করি!’’
আমার মনে নেই এরপর ঠিক কী ঘটেছিল। কেউ যদি জানতে চায় ভালবাসা কীভাবে শুরু হয় তাহলে তাদের বলব তারা যেন উপন্যাস কিম্বা দীর্ঘ গল্পপাঠ করে। আমি শুধু সংক্ষেপে বলতে পারি,
“ সময়টা অশুভ ছিল
যখন প্রথম তোমাকে আমি দেখেছিলাম।’’
যা কিছু ঘটেছিল মনে হয় আমি যেন শয়তানের ফাঁদে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আমি মনে করতে পারি যেন এক ভয়সঙ্কুল, উন্মত্ত ঘূর্ণাবর্তে আমি পাখির পালকের মতো চক্রাকারে ঘুরে মরছিলাম। এই পরিস্থিতি অনেকদিন ছিল, আর সেই পরিস্থিতি এই পৃথিবীর বুক থেকে আমার স্ত্রীকে, আমার আন্টিকে এবং আমার সমস্ত শক্তিকে উপড়ে নিয়েছিল। সেই তৃণভূমির অন্ধকার ছোট্ট রেলস্টেশন এবং সেই ঘটনা আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, যেমন আপনারা আমাকে এখন দেখতে পাচ্ছেন, এক অন্ধকার রাস্তায়!
বলুন তো, এর চাইতে অশুভ আমার জন্যে আর কী হতে পারে?