এ আই এবং আজকের সাহিত্য – অভিজিৎ চক্রবর্তী

এ আই এবং আজকের সাহিত্য – অভিজিৎ চক্রবর্তী

এ আই এবং আজকের সাহিত্য

অভিজিৎ চক্রবর্তী

সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি – এই ভাবকল্পটির সারবত্তা কবি ও কবিতার অতি গণতন্ত্রীকরণের যুগের সূচিমুখে দাঁড়িয়ে জীবনানন্দ ঠিক বুঝেছিলেন। তিনি কবি শব্দটির ব্যাখ্যা কী হবে আধুনিক যুগের প্রেক্ষিতে, তা নির্মাণ করতে চেষ্টা করেছিলেন। কবি শব্দটি প্রাচীন ভারতে ঋষিতুল্য মর্যাদা পেয়েছে। স্রষ্টার মূল্য পেয়েছে। প্রগতিবাদের যুগে, তাকে শ্রমিকশ্রেণি, যোদ্ধা, প্রতিবাদী, বাম বা লড়াকুদের সঙ্গে এক করে ভাবা হয়েছে। প্রলেতারিয়েতদের বা বিশেষ কোনো শ্রেণির প্রতিনিধি করে ভাবা হয়েছে। কবিকে সাধারণ করে তোলা হয়েছে। জীবনানন্দ সেই সময় কবি শব্দটিকে বিশেষ করে তুলতে চেয়েছেন। কবির হৃদয়, অস্থিমজ্জা নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু লক্ষণীয়, সেই চিন্তাকল্পটিকে পাশে রেখে সমান্তরাল আরেকটি কথা ততদিনে চালু করা হয়েছে, সকলেই কবি, কেউ লেখে কেউ লেখে না। সন্দেহ নেই, এই গণতান্ত্রিক চিন্তাটির ভেতরে রয়েছে প্রগতির দর্শন। সবার বোধ বুদ্ধিকে সমান মর্যাদা দানের প্রচেষ্টা আপাতদৃষ্টিতে শুনতে যতই শুভ মনে হোক, তা যে অনেক সময়ই বিভ্রম ছড়াতে পারে, তা সবার জানা। সবার আই কিউ লেভেল সমান নয়। আর প্রগতিবাদের দর্শন যতই কবিদেরকে বিশেষ শ্রেণিভুক্ত করে রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে চাক না কেন, কবি সমাজের কোনও নির্দিষ্ট শ্রেণি নয়। সবাই এক উদ্দেশ্য নিয়ে এক রকমভাবে লেখালেখি করে না। অথচ প্রগতিবাদ চায়, সবাই এক উদ্দেশ্য নিয়ে লিখুক, একই ফরম্যাটে ভাবুক। তা ততদিন পর্যন্ত কোনো সমস্যা করে না, যতদিন পর্যন্ত শাসন ক্ষমতাটি দখল করা হয়নি। অথচ শাসনকেন্দ্রটি করতলগত হলেই, সমস্যা। তখন কবিকে নির্দেশ দেয় রাষ্ট্র। হয়, মেনে চলো, না হলে বিবেক দংশনে মায়াকোভস্কির মত আত্মহত্যা করো। কবিতা আসলে একাই লিখতে হয়। এ একার সাধনা। তাই সবাই কবি নয়। কবি হওয়া একটা শক্ত কাজ। যুগদর্শী, ত্রিকালদর্শী হতে হলে কতদূর তার সাধনা থাকবে সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আজকে আমরা সবাই কবি আমাদেরই কবির রাজত্বের যুগে কবি জাস্ট একটা শ্রেণি বা সম্প্রদায়। সুতরাং কবি নামক অকবিই যে বিপুল, তা বোঝাই যায়। ঠিক এই সময় এ আই প্রযুক্তি একটা বিপুল সমস্যা বয়ে এনেছে। কবিতা বা কবির গণতন্ত্রের যুগে এই টুল বা উপায়টি অনেকের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছে নিশ্চিত। ব্যাপারটি একটু বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
বিগত কয়েক বছরে প্রযুক্তিবিদ্যার জগতে বড়সড়ো পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ব্যাপারটা এত ব্যাপক অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য যে তা আধুনিক মানুষের জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আমূল প্রভাবিত করেছে। আমরা বলছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আইয়ের কথা। মানব সভ্যতা এমন একটা বৈপ্লবিক অবস্থার মুখোমুখি কখনোই হয়নি। গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই বলেছেন, আগামী কয়েক বছরে মানুষের জীবন যে কতদূর পরিবর্তিত হতে চলেছে, আমরা কেউ ধারণাও করতে পারছি না। একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এর কল্পনা করাও খুব শক্ত। তবে একটা বিষয় আমরা বেশ বুঝতে পারি, এই পরিবর্তন এত দ্রুত যে বিষয়টা পুরো বুঝে উঠবার অবকাশ সাধারণ মানুষের কাছে আসলে নেই। 
কথাটি এমন নয় যে, হঠাৎ করে মানবসমাজকে এমন একটি আগামীর মুখোমুখি হতে হয়েছে। আসলে এই প্রক্রিয়াটি বহুকাল ধরে চলে আসছে। সভ্যতার সূচনা থেকেই। বিশ শতকের চার থেকে পাঁচের দশককে অনেকে তার গোড়া ভাবলেও যন্ত্রনির্ভরতা বাড়ার শুরু থেকেই এমন একটা ভবিষ্যতের সম্ভাবনার জন্ম। তবে প্রথম যুগের যন্ত্র আর আজকের যুগের যন্ত্রের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ও প্রায়োগিক দিক পুরোটাই আলাদা। একসময় যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কাজকে সহজ করে তোলা। এই চিন্তাকল্পটিতে যন্ত্র মানুষের কাজের সহায়ক হিসেবেই ভূমিকা রেখেছিল। পরে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়লে যন্ত্র হয়ে উঠল তার সহচর। সহচরের উপর নির্ভরতা বাড়ে। সহচরকে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়, অথবা কখনো কখনো সে সমমর্যাদা দাবি করে। মানুষের যন্ত্র নির্ভরতাই তাকে যন্ত্রের অধীন করে তুলেছে। এখন যন্ত্রহীন একটি মুহূর্ত কল্পনাতীত, পুরো মানবতন্ত্রটির ধ্বংস হয়ে যাবার মতন। এটা খুব স্বাভাবিক। এর আগ্রাসী তীব্রতা থেকে মুক্তি এক ধরনের অবাস্তব ভাবনা।
আজ ছোট্ট একটা গুগল ট্রেন্সলেটর সিস্টেম পৃথিবীর প্রধান সব ভাষাকে অনুবাদ করতে পারে। আন্তর্জালের অজস্র সিস্টেম এখন কারো ছবি চিনতে পারে, কথা বললে টাইপ করে দেয়। ভিডিও থেকে শুরু করে অডিও সব এখন আলাদা করে চেনা যায়, চিহ্নিত করা যায়। একটা মোবাইল হাতে থাকলে সবই করা যায়। ভিডিও গেম থেকে আধার কার্ড, ফিল্ম মেকিং থেকে রেশনিং ব্যবস্থা, ট্রেভেল টিকিট বুকিং থেকে পড়াশোনা। মানুষের অর্থনীতি থেকে স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, সুরক্ষার দিকটি সে এখন নিশ্চিত করে। এতদূর নিশ্চিত করে যে ভুলের সুযোগ নেই। তবুও এ আই গবেষকেরা মন্তব্য করছেন, এ নাকি এখনও রয়ে গেছে আদিম পর্যায়ে। যেমন ফেসবুক ইউটিউব টুইটার এখনো মানুষের কমান্ডের বা নির্দেশের অপেক্ষা করে। এখনো সে মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে। ডাটা ইনপুট হোক বা ডাটা এক্সপ্লোর, সবই মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন। ফেসবুক এখনও বলে, এখানে কিছু লিখুন। বলে ক্রিয়েট ইওর অউন ভিডিও। অর্থাৎ এখনও মানুষের হাতে রয়েছে ক্ষমতা। কিন্তু যদি সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে শুরু করে, তবে আতঙ্কের একটা পরিসর থেকে যায়।
ইতিমধ্যে আমাদের সবার ব্যাঙ্ক তথ্যাদি থেকে একান্ত ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি সবই আমরা গচ্ছিত করেছি আন্তর্জালে। সামাজিক মাধ্যমগুলির দৌলতে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার খবর, কোথায় যাই, কী খাই, কার সঙ্গে ওঠাবসা, কী পরি, কী কী রুচি বা অভিরুচি – সমস্ত কিছুই নিজেদের আনন্দে নিজেরাই পাবলিক করে তুলেছি। ব্যক্তিগত বলতে আর কিছু নেই। আমার বেডরুমের ছবি এখন বিশ্ব জানে। যে কেউ আমাকে ট্র্যাক করতে পারে। ফেসবুক ঘাঁটলেই জানতে পারে আমার চিন্তাধারা চালচলনের খবর। সেখানেই আসে হ্যাকিংয়ের কথা। মেশিনের হাতে যখন আমরা সমস্তই দিয়েছি, তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সেটা চিন্তার বাইরে নয়। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে আন্তর্জালের নানা অংশ যদি স্বয়ংক্রিয় হয়ে যায়, মানুষ সম্পূর্ণভাবে তখন আন্তর্জালের অধীন হয়ে পড়বে। তার কাছে কোন ক্ষমতা থাকবে না। এটাই আসলে আশঙ্কা। যন্ত্র মানুষকে চালাবে। সমস্ত বিষয়টা যেন হলিউডি সিনেমার আদল পেয়ে যাচ্ছে। যেখানে ইন্টারনেট বা কোনো সিস্টেমকে হ্যাক করে যেমন সমস্ত বিশ্বকে বিপদের সম্মুখীন করে তোলা হয়।
যন্ত্র বা কোনও সিস্টেম যতদিন মানুষের কমান্ড বা নির্দেশ পালন করে ততদিন তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোন প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয় না। অর্থাৎ সে তখন মানবসভ্যতার অধীন। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় কোন সিস্টেম বা যন্ত্র তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই শঙ্কিত হবার কারণ থেকে যায়। কারণ সেই সিস্টেম নিজে নিজে কাজ করে। সে এখন আর মানুষের নির্দেশ বা কমান্ডের অপেক্ষা করে না। অটোমেটেড মেশিনের ভাবনা সেই ১৯৪০ এর দশক থেকে শুরু। মানুষ তৈরি করার চেষ্টা করল রোবট। রোবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে না, কিন্তু মানুষের নির্দেশ মত সব কাজ করে। ধীরে ধীরে সেই পরিকল্পনা আরো জোর হাওয়া পেল যখন রোবটকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করানো গেল। ঠিক এইখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিজে নিজেই প্রোগ্রামিং করছে। কোনো মানুষের সাধ্য নেই ততদূর নিখুঁতভাবে কোনও বিষয়কে উপস্থাপন করা বা প্রকাশ করার। মানুষের হাজার বছরের সমস্ত জ্ঞান, কর্মপদ্ধতি, চিন্তাকে যদি এক জায়গায় আনা যায়, তো সেটি কতদূর ব্যাপক হতে পারে, তা ধারণার বাইরে। 
কিছুদিন আগে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম, ভয়েস কমান্ড পেলেই তবে ঘরের দরোজা খোলে এমন একটা বাড়ির মালিক সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে নানা কাজের পর যখন ঘরে প্রবেশ করতে যায়, তখন ঘরের দরজা তার ভয়েস কমান্ড নেয় না। কারণ ঠাণ্ডা লেগে তার গলার স্বর বদলে গেছে। বিজ্ঞাপনটি ভাবার। মানুষের বানানো সিস্টেম মানুষকেই একদিন বের করে দেবে না তো! হয়তো ভবিষ্যতের এ আই এসব জটিলতা মিটিয়ে দেবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ আইকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স না বলে ইওভাল নোয়া হারারির মত লেখক চিন্তকেরা অনেকেই এলিয়েন ইন্টেলিজেন্স বলা শুরু করেছেন। এলিয়েন যেমন বহিরাগত, বিচ্ছিন্নতার পরিচায়ক। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানব সভ্যতাকে কি বহিরাগত করে তুলবে? সোজা কথা মানুষকে রিকোয়েস্ট করলে অনেক সময় কাজ হয়, মেশিন তো সেটা নেবে না। অবশ্য আধুনিক মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই মেশিনের মতনই আচরণ করে।
আমরা নিজেরাই জানি না, কবে কবে মেশিনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিয়েছি। ছোট্ট একটা এটি এম মেশিন এখন আমার প্রয়োজন মত টাকা দেয়। ট্রেনের ঘোষণা থেকে শুরু করে বিভিন্ন টোল ফ্রি নম্বরগুলি দিয়ে মেশিনের সঙ্গেই কথা বলে মানুষ। আমরা খেয়ালই করিনি এই কিছুদিন আগেই কল সেন্টারগুলিতে লক্ষ লক্ষ লোক কাজ করত। অথচ এখন মুষ্টিমেয় কিছু লোক কোনো অফিস নয়, বাড়ি থেকেই অন্য আরও কাজের সঙ্গে সেটি করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই করে মেশিন ভয়েস। মেশিনের উপরেই ভরসা করতে শিখে গেছে মানুষ।
যেকোনো জিনিস আবিষ্কার হলে একটা শঙ্কা যেমন তৈরি হয় তেমনি সুবিধাটাও বড় হয়ে ওঠে। আমরা ভাবতে পারি নিউক্লিয়ার এনার্জির কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিউক্লিয়ারের বিস্ফোরণের ফল সবাই জানি। মানব সভ্যতার সে গভীর ক্ষত মুছে যাবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিউক্লিয়ারকে যখন এনার্জি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হলো বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে ফ্যাক্টরি, মহাকাশ ইত্যাদি নানা ধরনের জ্বালানির কাজে, তখন সেটি অভিশাপ না হয় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল। হতে পারে এ আই গবেষকদের দাবি মত, এ আই মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্যই এসেছে, সংকট তৈরির জন্য নয়। জলবায়ু পরিবর্তন থেকে জটিল সার্জারি, মানুষের কাজটিকে আরও নিখুঁত ও সফল করার জন্য সে বিকল্প হয়ে উঠবে। অন্যদিকে কেউ হয়তো বলবেন, তবে কি কর্মহীনের সংখ্যা বাড়বে না! ফের কেউ হয়তো বলবেন,  জনগণকে কর্ম বা পেশার নিশ্চিতিকরণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এসব বিতর্ক ভবিষ্যতের কাছেই তোলা থাকুক। আমাদের ভাবার বিষয় এই প্রেক্ষিতে ভাষা, সমাজ ও আমাদের সাহিত্যের দিকটি। কী হবে তার ভূমিকা।
এ আই বটগুলি দিয়ে প্রথম যে কাজটি করানো গেল, তাকে যা জিজ্ঞেস করা হয়, সে তার উত্তর দিতে পারে। সে তো গুগলই পারে। সব তথ্যাদি চোখের সামনে এনে ধরে। কিন্তু আজকের এ আই যেমন ওয়েবসাইট বানাতে পারে, কোডিং করতে পারে, তেমনি কবিতা লিখতে পারে, গল্প লিখতে পারে। প্রবন্ধ লেখার একটা বিষয় ঠিক করে দিলে মুহূর্তেই ঐ বিষয়ের অনেকগুলি বিকল্প এনে দাঁড় করায় চোখের সামনে। কোনও বিষয়ের উপরএকটা কন্টেন্ট বা ভিডিও তৈরি করতে চাইলে টাইপ করে দিলেই হল। অনেকগুলো বিকল্পসহ সে হাজির। ভিডিওতে কোনো শহর বা নিসর্গ নির্মাণ করতে চাইলে সে একেবারে এই বাস্তব পৃথিবীর আদলে তা কয়েক সেকেন্ডেই করে দেয়। দেখলে মনেই হবে না, এ আসলে কোথাও নেই। এ আই দিয়ে বানানো মানুষের ছবি দেখেও মনেই হয় না এ আসলে কোথাও নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই বাস্তব জগতের সমান্তরাল আরেকটি জগত তৈরি করে ফেলছে। যা আসলে কোথাও নেই। অনেকেই দীর্ঘদিন ধরেই প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বলেছেন, মহাকাশে না হোক এ আই সেই সন্ধান দিয়েছে। একে কি অবাস্তব বলা যায়! এ তো আরও অধিকতর বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে জীবনে।
সুতরাং বিগত কয়েক বছরে আমাদের সমাজের চেহারা বা কাঠামো (স্ট্রাকচার) পুরো ভেঙে গেছে। আগে একটা কেন্দ্র থাকত। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন হতো। এখন অনেকগুলি কেন্দ্র। এই কিছুদিন আগেও বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনা সকল রাজনৈতিক সামাজিক দল বা সংগঠনগুলির এজেন্ডা ছিল। গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলার প্রকল্পগুলো তো তারও বহিঃপ্রকাশ। বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনায় প্রশাসন অর্থনৈতিক রাষ্ট্রনৈতিক সুবিধাগুলো সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার ভেতরে তো ছিল সেই পরিকল্পনাই। এখনো যদিও এই কাজগুলি হয়ে চলেছে। কিন্তু মোবাইল আবিষ্কার ও তার গণতন্ত্রীকরণের পর গ্রাম আর শহরে বাস্তব জগতে পার্থক্য থাকলেও ভার্চুয়াল জগতে বা আন্তর্জালের মধ্য দিয়ে কোনো সীমারেখা রইল না। যে কোন প্রান্তে বসে সে সেটা একসেস করতে পারে। কোনো সংস্থা পরিচালনা করতে পারে। মডার্নিজমের ভাবনায় একটা কেন্দ্র ছিল, এবং তার বিরুদ্ধে কথাও ছিল। এখন অসংখ্য। আগে যেমন নিউজ পড়া হতো একটা জায়গা থেকে। তাকে বলা হত ব্রডকাস্টিং কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানবিরোধীরা পত্রিকা অফিসকেও টার্গেট করতেন। তাদের নিজস্ব প্যারালাল ন্যারেটিভ দিয়ে ভেঙে দিতে চাইতেন কাগজওয়ালাদের ন্যারেটিভ। এখন অজস্র চ্যানেল, অজস্র ন্যারেটিভ। ডিক্টেটরশিপে বা একনায়কতন্ত্রে থাকতো একজন বক্তা। তিনি কথা বলতেন। তার কথা সবার শুনতে হতো। পরে এল ডেমোক্রেসির যুগ। অর্থাৎ উভয়পক্ষই এখন বলছে। দুজনকেই শুনতে হচ্ছে একে অপরের কথা। শাসক দল আর বিরোধী দল। ডান আর বাম। কিন্তু আজকের যুগে এসে সেই বাইনারি ভেঙে গেছে। শুধু ডান বাম নয়। অজস্র দল উপদল। এরা এক এক ইস্যুতে একে অপরের সঙ্গে বিরোধ করে, আবার মিলে যায়। একজন লোক বার বার দল পাল্টায়। এমনকি কখনো কখনো প্রতিষ্ঠাতা কর্মীরাও। সুতরাং কোনো স্থির বা ধ্রুব কিছু নেই। কাকে বলা যাবে কেন্দ্র! ছিল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। দ্বন্দ্বের আসল ভিত্তি দুই। তবেই না দ্বন্দ্ব হবে। ডায়ালগের জন্ম হবে। ছিল বস্তু। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এসে বস্তুই আর থাকছে না। বস্তু ভেঙে যেমন অসংখ্য পার্টিকল। তেমনি অসংখ্য কেন্দ্র, অসংখ্য দল, অসংখ্য ডায়ালগ, অসংখ্য ন্যারেটিভ। সবমিলে গ্র্যান্ড বা ম্যাটা ন্যারেটিভের কথা বলা হয়েছিল। এই কেন্দ্রীকরণের ভাবনাও আধুনিক চিন্তার ফসল। কিন্তু আধুনিকতার পর উত্তরাধুনিকতার শেষ পর্যায়ে আমরা এসেছি। হয়তো বা সেই যুগ পার করতে চলেছি। যেখানে ভাব বা বস্তু নয়, ছোট ছোট কণায় সব ছড়িয়ে গেছে। ব্যক্তির একক অবস্থানের ভেতর সে চলে গেছে। প্রত্যেকেই যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্ব ন্যারেটিভ আমরা তৈরি করতে পারি, আমরা নিজের মতো করে প্রত্যেকেই নিজের অবস্থান রাখতে পারি, তেমনি লড়াইটাও হয়ে গেছে একান্ত ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে তৈরি। সব মিলিয়ে যে একটা আদর্শ কাঠামো বা বিশ্বাস সেটা গড়ে ওঠেও কোথাও থাকছে না। সমাজের গঠন যেহেতু ভেঙে গেছে, তাই পাশের বাড়ির বিপদে কেউ আসে না। প্রতিটা মানুষকে যদি সমাজদেহের এক একটা পার্টিকেল ভাবা যায়, তবে এ তার একার লড়াই নয় যদিও, কিন্তু ব্যক্তিগত। যদিও বিপক্ষে কে সে জানে না। ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে গাত্র হল ব্যথার মতন।
এখানে আমাদের সাহিত্য সম্পাদকদের এক বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সম্পাদকদের প্রস্তুতি কাব্যবোধ এখানে বিচার্য বিষয়। গণহারে অনির্বাচিত বা সম্পর্কের কারণে নির্বাচিত লেখা যারা ছাপেন তাদের ক্ষেত্রে সেটা আরো সমস্যাজনক। কারণ এখানেই দুধ আর জল মিশে যাবার বিপুল সম্ভাবনা। কোনটা এআইয়ের দ্বারা লেখা আর কোনটা মানুষের লেখা সেটা তাদের বুঝতে হবে। হয়তো সেটা এত সহজ নয়, বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে যেখানে ভাষা নিয়ে নিরীক্ষা হয়ে থাকে। তবু সেটা সম্ভব হতে পারে অনেকাংশেই কবি-সম্পাদকদের পাঠ প্রস্তুতির জন্য। আক্ষরিক অর্থেই নতুন লেখা, ভালো লেখা ছাপতে হবে। ভাষা এখানে একটা বিষয়। কবিদের কাব্য ভাষা তৈরির কথা সব কবিরাই বলে যান। সম্পাদক শুধু নয় কবিদেরও পাঠ প্রস্তুতি তাই দুর্দান্ত হতে হবে, যাতে সে নতুন লেখাটি লিখতে পারে। যেটা ইতিহাসের পুরানো লেখাগুলোর মত নয়। তথ্য ও তত্ত্ববহুল প্রবন্ধ রচনা করা গেলেও একজন সত্যিকারের লেখকের গদ্যের নতুনত্ব তো এ আই দেবে না। উপন্যাস বা গল্পের কাহিনি বা ঘটনা পরম্পরা দিলেও একটি গল্প বা উপন্যাসে শুধু কাহিনি বলাটা মুখ্য থাকে না। সেখানে আরো কিছু বিষয় থাকে থাকে। বর্ণনা, ভাষার উপর নিরীক্ষা লেখকসত্ত্বাকে বুঝতে সাহায্য করে। সর্বোপরি ব্যক্তিগত লেখাগুলো, ব্যক্তিগত জীবন, আত্মজীবনী, লড়াই, সেখানে এ আইয়ের হাত থাকবে না। তবে একজন দুষ্ট লেখক একজন পাতি সম্পাদককে নিশ্চয়ই ঘোল খাইয়ে দিতে পারেন। তবে সেটাও দীর্ঘকালীন হবে না। 
অনেকেই এ আইয়ের এই ব্যাপক উন্নতির যুগে সাহিত্যক্ষেত্র নিয়ে শঙ্কিত হয়েছেন। এটা স্বাভাবিক। মুহূর্তেই সে কবিতা উপন্যাস গল্প লিখে ফেলবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এগুলো মানুষের বিগত কর্মপদ্ধতির অভিজ্ঞতা থেকে সে সঞ্চয় করেছে। অর্থাৎ বলতে চাইছি এতদিন যে  গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা লেখা হয়েছে তার একটা আদল বা বিকল্প এ আই তৈরি করছে। কারণ তার প্রোগ্রামিং-এ এগুলোই ইনপুট করানো হয়েছে। সে হয়তো কবিতা বানাতে পারে দেখা যাবে তার ভাষার কাঠামো ভিক্টোরিও যুগের বা রবীন্দ্র যুগের বা পরবর্তী সময়ে জীবনানন্দ যুগের। কিন্তু মৌলিক কোন রচনা সে করতে পারবে না। করতে পারবে না কারণ মানুষ ভুল করে। এ আই ভুল করতে পারে না মানুষ ভালোবাসে তার মন আছে সুখ দুঃখ ব্যথা অনুভব আছে। যেটা তার নেই।