পাকা ধানের ঘ্রাণ – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

পাকা ধানের ঘ্রাণ – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

পাকা ধানের ঘ্রাণ      (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

“গান টান চলবে না হে, হাত চালাও। আগে কাজ, তারপর সারারাত গান গাইবে।” জমির আলে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নিধু সর্দার। সুখীর কাণ্ড দেখে রেগে ওঠে ভীষণ।
সুখী হেসে বলে, “গান গাইছি বলে কি হাত থেমে আছে নাকি নিধুবাবু?” বলে গুনগুন করে সুর তোলে আবার।
সুখীর সুর বর্ষার ছন্দে গা মেলায়।
নিধু রেগে বলে, “আবার! বলেছি গান হবে না, তো হবে না। ব্যাস।”
সুখী বলে, “দেখি নিধু সর্দার কি করতে পারো তুমি! এই আমি গান… ” বলে গান ধরে।
এই বছর আষাঢ় মাসের শেষের দিকের ঘটনা।
মহিমবাবুর তালতলার মাঠে ধান রোয়ার কাজ চলছে। ধুম কালো মেঘ নেমে এসেছে জমির উপর। শনশনে হওয়া, সঙ্গে তেমনি বৃষ্টি। মহিমবাবু ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল জমির আলে। জনা আঠারো লোক বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করছে জমিতে। হঠাৎ করেই দামাল হওয়ায় মহিমবাবুর ছাতা গেলো উল্টে! ভারী ভারী জলের ফোঁটা, বৃষ্টি যেনো গায়ে বিঁধছে। বাবু বলে, “শীত শীত লাগছে রে নিধু আমি চললাম। কাজ শেষ করে বাড়ি যাবি। ভালো করে দেখে নিবি সব।” মহিমবাবু বাড়ি চলে যায়।
এমন দিনে জন মুনিশও বাহানা খোঁজে। নিধু সর্দার থাকতে কাজে ফাঁকি চলে না হে। কাজ ছাড়া দ্বিতীয় কিছু বোঝে না নিধু। বাবু পয়সা দিচ্ছে, কাজের হিসেব বুঝিয়ে দেবে নিধু। মাথার গামছা কোমরে বেঁধে জমির আলে দাঁড়ায় বলে, “তাড়াতাড়ি হাত চালাও হে, এখনো বিঘে ছয়েক জমির কাজ বাকি। বর্ষা তোমার আমার কথায় বছর-শাল রয়ে যাবে না। হু, গান হচ্ছে। যতোসব।”
হঠাৎ করেই সুখী বলে ওঠে, “এমন দিনে কি আর কাজ হয় নিধু। কালো মেঘ। মন ভাসানো হওয়া, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে, তাকিয়ে দেখো পৃথিবীর রূপ। আনন্দ বোঝো? দেখো চারদিকে শুধুই আনন্দ, মনে গান আসছে আর তুমি বলছ কাজ করতে, কি করে হয়?” সুখীর কথা শুনে হেসে ওঠে সবাই।
চরণ মাঝি বলে, “কাজের সময় ওসব থাক সুখী।”
নিধু চিৎকার করে ওঠে, “খবরদার বলছি সুখী, কাজে মন দে। ওই সব বাজে বকিস নে। চরণদা, ধান কাটার সময় ওকে আর আনবে না, বলেদিলাম।”
“আসবো কি আসবো না সে আমার খুশি। তোমার কথায় নাকি!” বলে সুখী। তারপর কাদা জমিতে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে তালি দিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরে সুখী।
“মেঘের গায়ে শ্যামের বরণ
দেখো রাধারাণীর নাচের ধরন
কানুর প্রেমে পাগল হয়ে…”
পাশের জমিতে দাঁড়িয়ে ছিল গ্রামের হরি সামন্ত। সুখীর গান শুনে বলে, “আহা মেয়ের গলা তো খাসা। চমৎকার গান। মেয়েটি কে নিধু ? আগে তো দেখিনি!”
চরণ মাঝি বলে, “আমার ভাগ্নি হরিবাবু, এই বছর প্রথম নিয়ে এলাম সঙ্গে।”
“খুব ভালো গানের গলা। আহা!”
নিধু বলে, “বাবু আমাদের কাজের জন্যে পয়সা দেবে হরিকাকা গানের জন্যে নয়। গান গাইতে হলে পালাগানের দলে যাও। যত সব জুটেছে এখানে!”
সুখী বলে, “যাবো যাবো একদিন কপিল দাসের পালাগানের দলে গাইতে যাবো।”
“তাই যা।” বলে নিধু।
“তুই বড্ড বেরসিক নিধু, শুকনো কাঠ এক্কেবারে।” বলে হরি সামন্ত। রাগে গজগজ করে নিধু।
কাজ সেরে মহিমবাবুর বাড়ির পথ ধরে সবাই। জমির মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে নিধু। মাঠ ছাড়বার আগে দেখে নিচ্ছে কাজে ফাঁক ফোকোর রয়ে গেলো কিনা। সুখী এগিয়ে এসে বলে, “একটা কথা বলি, কোনোদিন গান গেয়েছো নিধুবাবু? শুনেছো গান মন দিয়ে? জানো গান কখন আসে? সেই মন তোমার নাই নিধুবাবু।”
সুখীকে এক ঝলক দেখে নিয়ে জমিতে নজর ফেলে নিধু। সুখী বলে, “চাইলেই লোকে গান গায়তে পারে না গো। আনন্দ দুঃখ যন্ত্রণা মনকে নাড়া দিলে তবেই মনের কথা সুর নিয়ে বাইরে আসে। নয়তো তোমার মত পাথুরে কথা বলে সবাই। পালাগানের আসরে গেলে বুঝতে এ কথার মানে।”
কথা শেষ করেই হাঁটা দেয় সুখী। নিধু চেয়ে থাকে সুখীর দিকে। রাগত স্বরে বলে, “ধিঙ্গি মেয়ে একটা।”
চরণ মাঝি বলে, “সুখীর কথায় রাগ করো না নিধু। ভাগ্নীটি আমার ওই রকম আমাদের আদরে…।”
চরণ মাঝির ভাগ্নি সুখী। মহিমবাবুর বাড়ি এই বছর প্রথম কাজে এসেছে। সুখীর বাপ জোর করে বিয়ে দিতে চায়। রাজি নয় সুখী। বিয়ে সে করবে না কোনো মতেই, তাই বাপের চোখে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছে মামার কাছে।
মুখে মুখে গান বাঁধতে পারে সুখী। নিমেষে সুর করে তাক লাগিয়ে দেয় সকলকে। আবার বলে কপিল দাসের দলে পালাগান গাইবে। সেই কথা শুনে এক প্রকার জোর করেই নিজের সঙ্গে মহিমবাবুর বাড়ি কাজে নিয়ে এসেছে চরণ। এখন বুঝিয়ে শুনিয়ে ভালো ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলে বাঁচে।
সব শুনে নিধু বলে, “বিয়ে দিয়ে দাও। ও মেয়ে কোনো কম্মের নয়। কথায় কথায় গান! কাজ পণ্ড করে শুধু।”
“পাত্র খুঁজছি। বললেই কি আর তেমনটি পাওয়া যায় গো।” বলে চরণ মাঝি।
সেদিনের সেই কথা মনে করে এখন হেসে ওঠে নিধু। ভাবে, নিধু কি পাত্র হিসাবে তেমনটি নয়! কথাটা ভেবে হো হো করে হেসে ওঠে নিধু। আচ্ছা যদি তেমন হয়! চরণ মাঝি বললো, “সুখীকে তুমি …।”
“গোয়াল ঘর ঝাঁটা টেনে পরিষ্কার করতে আর কতক্ষণ লাগবে নিধু? কাল পুজো। এখনো নতুন ধানের শীষ নিয়ে এলি না! এরপর কখন কোন কাজটা করবি তুই!”
গিন্নিমায়ের কথায় চটকা ভাঙ্গে নিধুর। এতক্ষণ কি সব ভাবছিল।
ধান কাটার দিন যত এগিয়ে আসছে নিধুর মন যেনো সরস হয়ে উঠছে। শ্রাবণের বৃষ্টি বুঝি এতো মাস পরে নিধুর মনজমিকে সিক্ত করে তুলেছে। দিনের কোনো না কোনো সময়ে সুখীর কথা মনে পড়ে রোজ। একলা কাজ করবার সময় গান করে গুনগুন করে। নিধুর হলো কি! তখন মনে মনে হাসে নিধু। নিজেই ভাবে এত গান আসে কোত্থেকে! আর ফিসফিস করে সুখী যেনো বলে, “… গান কখন আসে জানো?”
নিধু বোঝে ইদানীং তার মনে কাজ ছাড়াও নানা রকম ভাবনা আসে। অলস দুপুরে যখন ঘুঘু ডাকে বাবুর গোয়ালে বসে চাষের দিনের নানা কথা ভাবে। আর আনমনা হয় মন। কেনো ? সে কথাও জানে নিধু, সুখীর কথা ভেবেই এমন হয়। তখন মনে হয় গান জানলে বোধ হয় ভালো হত। এইবার ধান কাটার সময় সুখী এলে নিধু বলবে তাকেও যেনো দুটো গান শিখিয়ে দেয় সুখী। নিধুর সে কথা শুনে সুখী কি বলবে? হয়তো হেসে বলবে, “তোমায় দিয়ে হবে না গো নিধুবাবু। গান গাইতে হলে মন লাগে, মন। সে সব তোমার নাই।” নিধুর মন আছে ? নিশ্চয় আছে, নয়তো নির্জন দুপুরে বুকের মধ্যে শূন্যতা ঘুরপাক খায় কেনো!
মহিমবাবু বলে, “ইদানীং মাঝে মধ্যেই কি আকাশ পাতাল ভাবিস নিধু? কাজ ছেড়ে জমিতে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকিস!” বাবুর কথা শুনে চুপ থাকে নিধু। ভিতরে ভিতরে লজ্জা পায়। বেশ লজ্জা পায়।
আজ নিধুর হাতে অনেক কাজ রয়েছে। বিকেল বেলার মধ্যে চরণমাঝি লোকজন নিয়ে হাজির হবে মহিমবাবুর বাড়ি। সুখীও আসবে। থাকবে দিন পনেরো কুড়ি। ধান কাটা শেষ হলে পরে ফিরে যাবে আবার।
চরণ মাঝির লোকেদের থাকা খাওয়ার জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে না রাখলে গিন্নিমা রেগে যাবে। তাই সাত সকালে মহিম ঘোষের বাড়িতে এসে কাজে লেগেছে নিধু আর সুখীর কথা বারবার পিছন টেনে ধরে।
কাল আবার লক্ষ্মী পুজো। নবান্ন লক্ষ্মী। গ্রামের লোকে বলে “নবান”। নতুন ধানের অন্ন মা লক্ষ্মীকে উৎসর্গ করে তবেই গেরস্থের মুখে ভাত ওঠে, নিয়ম এমন। সারা গ্রামের লোক এমনটাই মানে। প্রত্যেক বছর ধান কাটা শেষ হলে পরে নবান্ন উৎসব হয়। তবে এই বছর তা হয়নি। সামান্য কিছু নতুন ধান কেটে এনে নিয়ম রক্ষা করবে চাষি। তারপর হবে ধান কাটা। ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত লেগেছে নিধুর। গিন্নিমাকে জিজ্ঞাসা করে, “ধান কাটলাম না, গোলায় নতুন ধান এলো না, তার আগেই নবান? এটা কেমন হলো মা!”
“তিথি নক্ষত্র কি আমার কথায় চলে নিধু? যে বার যেমন হয়। তুই হাতের কাজ শেষ করে আমাকে ধানের শীষ এনে দে, লক্ষ্মীর ঘটে দেবো। আর শোন বিকেল বেলায় পাল বাড়ি থেকে প্রতিমা নিয়ে আসবি, তোর বাবু প্রতিমা পছন্দ করে রেখে এসেছে। আমি যাই খানিকটা খড়ি মাটি ভিজিয়ে রাখতে হবে। সুখী বিকেলে এসে আলপনা দেবে।” সুখী আলপনা দেবে!
প্রতি বছর চাষের শুরুর দিন গিন্নিমা ধানের গোলার সামনে পুজো দেয়। মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ নিয়ে তবে জমিতে হাল নামে। এই বছর পুজোর সময় আলপনা দিয়েছিল সুখী। সেই আলপনার টান দেখে খুব খুশি হয়েছিল গিন্নিমা। বলে, “নবানের সময় সুখীকে নিয়ে আসবে চরণ। নবান্ন লক্ষ্মীর সামনে সুখী আলপনা দেবে। খুব ভালো মেয়ে তোমার ভাগ্নি সব কাজে…।”
চরণ বলে, “হ্যাঁ মা অবশ্যই নিয়ে আসবো।”
“ও নিধু, আর কখন যাবি বাবা। শীতের বেলা। শুরু হতেই শেষ।” আবার তাড়া দেয় গিন্নিমা।
হাত চালিয়ে কাজ শেষ করে নিধু। কাস্তে নিয়ে হাঁটা দেয় জমির দিকে। তালতলার মাঠে এসে দাঁড়ায়। পাকা ধানের গন্ধে ম ম করছে বাতাস। এক বুক বাতাস টানে নিধু। যেদিকে তাকায় ধান আর ধান। কে যেনো সোনার গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির বুকের উপর। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে নিধু। সোনালি ধান দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আহা পৃথিবীর কি রূপ! আগে কখনও দেখেছে নিধু, এইভাবে দেখেছে! দিগন্ত ব্যাপী ধানের বাহার দেখতেই থাকে নিধু। যেনো নতুন কোনো আনন্দ উপত্যকার সামনে দাঁড়িয়েছে যার মনোমুগ্ধকর রূপ আগে কোনোদিন দেখেনি নিধু।
শেষ দু বছর বর্ষা বিমুখ ছিল। ধানের ফলন ভালো ছিল না একদম। শ্রাবণ মাসেও জমির মাটি ফেটে চৌচির! বোঝো। সেচের জলে কি আর তেমন চাষ হয়? কথায় বলে, “পাতালের জলে পুষ্ট ধান নাহি ফলে।”
এই বছর বর্ষা নিজের ছন্দে ছিল। আর মা লক্ষ্মীও সুদে আসলে সব পুষিয়ে দিয়েছে। চাষিরা খুব খুশি। সেদিন মহিমবাবু গিয়েছিল জলার মাঠে। নিধু ছিল সঙ্গে। জমি উপচে ধান, বাবু বেজায় খুশি। বলে “নিধু এইবার নবানের সময় তোকে ভালো দেখে একটা জামা প্যান্ট কিনে দেবো।” নিধু ভাবে শুখা বছরে এই বাবুই কেমন বদলে যায়। মেজাজ তিরিক্ষি থাকে। শুধু মহিমবাবু কেনো গেলো বার হরি সামন্ত হাটের মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে, “দুর দুর চাষ করে বোকায়। জমি জায়গা বেচে দিয়ে ব্যাংকে টাকা রেখে দেবো। সারা বছর রোদে জলে পুড়ে চাষ করে হাত টাকা নেই, শুধু ঝাঁটা আর কুলো।” আর এই বছর তার-ই মুখে অন্য কথা। বলে, “নিধু ফলন দেখে মন ভরে যাচ্ছে রে। বাড়িতে বসেই পাকা ধানের বাস পাচ্ছি।” এই হলো চাষির কথা। নতুন ধানের গন্ধ পেলেই চাষি খুশি। নিধুর বাপ বলতো “নতুন ধানের বাসে, চাষির মন ভাসে।” কথাটা ঠারে ঠারে সত্যি। ছেলেবেলা থেকে তাই শুনে আসছে। এইবার চাষের সময় সুখী বলছিল “ভেবে দেখেছো কোনোদিন নতুন ধানের বাস চাষি কখন পায়? যে বছর ফলন ভালো হয়। কই শুখা বছরে তো নতুন ধানের বাস পায় না চাষি। সে-ই বছর কি ধান কাঁকোরের হয়? তা তো নয়। তাহলে? আসলে মনের আনন্দ। বেজায় ফলন দেখে চাষির মন উপচে খুশি আসে তখন সোনালি ধান দেখলেই ধানের বাস পায়। আসল কথাটা হল অন্য। মনে খুশি তো জগৎ আলো, মনে আঁধার তো দুনিয়া কালো, বুঝলে নিধুবাবু, এ কথা সবার জন্য সত্যি।” সুখীর কথাটা একলা বসে ভেবেছে নিধু। সুখী বলে, “ও কথার মানে তুমি বুঝবে না নিধুবাবু। মনের কাছে জানতে চেয়েছো কোনোদিন তোমার মন কি চায়? সময় কোথায় তোমার! শুধু ধান আর কাস্তে। শুখা আর বর্ষা। রোয়া আর নিরান। মাঠ আর গোলা, এই তোমার জীবন। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলবে, জানতে পারবে অনেক কিছু।”
নিধু বলে ছিল ,”যত বাজে বকিস। কাজের কথা বল।”
সুখী বলে, “তোমার কাজ নিয়েই থাকো নিধুবাবু, কে বলেছে বাজে কথা ভাবতে।” সেদিন সুখীর চোখে চোখ রেখেছিল নিধু। পড়ন্ত বিকেলে অন্য রকম লেগেছিল সুখীকে।
হরি সামন্তের জমিতে ধান কাটা চলছে। পাশের জমি থেকে নিধুকে দেখে হরি বলে, “কি নিধু একলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবিস?” সম্বিত ফেরে নিধুর। কথায় কথায় ভেসে গিয়েছিল সুখীর ভাবনায়।
ধানের শীষ কাটার আগে জমির আলে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে। বলে, “লক্ষী মা গো, বছর বছর এমন ভাবেই এসো মা।” কথাটা শিখিয়ে দিয়েছে গিন্নিমা। প্রত্যেক বছর ধানের শীষ কাটার আগে নতুন গামছা জমির আলেতে বিছিয়ে নেয় নিধু তারপর প্রণাম করে মা লক্ষ্মীকে।
ধান গাছের গোড়ায় কাস্তের পোঁচ মারে নিধু। গুন গুন করে গান গেয়ে ওঠে,
” লক্ষী মা গো এ বর মাগি
যেনো মোটা ধানে সুখেই থাকি।
হাজার জ্বালার জ্বলন মাগো
অন্ন কষ্ট দিও না, মাগো…”
গানটা সুখীর গলায় শুনেছিল নিধু। তারপর থেকে মনে থেকে গেছে।
জমির আলে পা রাখলেই ইদানীং গেয়ে ওঠে গানটা। একটা কথা ভেবে অবাক হয়ে যায়, সুখীর গাওয়া গান গুলো মনে থেকে গেছে কি করে! অথচ কতো গানই তো কানে আসে, কই সেসব গানের একটা কলিও তো গাইতে পারে না। কেনো? আবার কখন সুখী উঁকি মেরেছে মনের জানালায়।
“ধান কাটা হচ্ছে কবে?” সামনের জমি থেকে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে হরি সামন্ত।
“কাল নবান, পরশু থেকে শুরু হবে হরি কাকা।” বলে নিধু।
“জন মুনিশ আসছে তো?”
“আজ বিকেলে আসবে।”
এলাকায় সবাই বড়ো বড়ো চাষি। ধান কাটার সময় প্রচুর লোকের প্রয়োজন পড়ে। এলাকার বাগদি, আদিবাসী, বাউরিদের কাজে নেবার পরেও জন মুনিশ নিয়ে চাষিদের মধ্যে অশান্তি বাঁধে। সবাই চায় সময়ের মধ্যে ধান গোলায় তুলতে। কাজের লোক নিয়ে দড়ি টানাটানি পছন্দ নয় মহিম ঘোষের। তার মুনিশ আসে বাঁকুড়া থেকে। প্রতি বছর চরণ মাঝি জনা সতেরো লোক নিয়ে চাষের সময় হাজির হয়। বাবুর চাষ তুলে দিয়ে ফিরে যায়। আবার ধান কাটার সময় এসে মহিমবাবুর জমির কাজের সামাল দেয়। বাবুকে খবর পাঠিয়েছে চরণ মাঝি আজ সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে যাবে লোকজন নিয়ে।
নতুন ধান নিয়ে বাবুর বাড়ি ফেরে নিধু। বিকেল বেলায় যাবে পাল বাড়ি, প্রতিমা নিয়ে আসবে।
শীতের দুপুর। টুকুস সময় পরেই দূরের ধানের ক্ষেতে ডুব দেবে সূর্য আর কুয়াশার জাল জড়িয়ে নিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসবে। পাল বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় নিধু।
পাল বাড়ি থেকে প্রতিমা মাথায় নিয়ে যখন মহিমবাবুর বাড়ি আসে নিধু সন্ধ্যা গাঢ় হয়েছে। গিন্নিমা উলু দেয়। বাড়ির উঠানে সুন্দর আলপনা ফুটে উঠেছে, দেখে ভালো লাগে নিধুর। এই আলপনার জন্যই যেনো অপেক্ষা করেছিল সকাল থেকে। চরণ মাঝি আর কয়েক জন মিলে আটনে বসিয়ে দেয় লক্ষ্মী প্রতিমা।
গিন্নি মা বলে, “তুমি খুব অন্যায় করলে চরণ। এতবার করে বলেছিলাম তবুও সুখীকে নিয়ে এলে না!”
গিন্নিমায়ের কথা শুনে দু পা পিছিয়ে আসে নিধু। সুখী আসেনি! বিমর্ষতার আঁধারে ভরে ওঠে মন।
চরণ মাঝি বলে, “আসলে সুখীর বাপ…।”
সুখীর বিয়ে দেবে সুখীর বাপ। পাত্রপক্ষ আসবে সুখীকে দেখতে, তাই নিয়ে গেছে মামার বাড়ি থেকে। এ ব্যাপারে নিরুপায় চরণ। হাজার হলেও বিয়ে তো দিতে হবে মেয়ের।
“নিধু তোর জামা প্যান্ট কিনে এনেছি। কাল পড়বি।” নতুন জামা কাপড়ের প্যাকেটটা নিধুর হাতে দেয় মহিমবাবু। বাবুর হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে উঠানের একপাশে দাঁড়ায় নিধু। সময় যেন হেঁয়ালি করছে নিধুর সঙ্গে।
সবার আড়ালে অন্ধকারে বাবুর বাড়ির বাইরে আসে নিধু। তালতলার জমির পাশ দিয়ে যে রাস্তা গেছে সেই পথে পা রাখে। এই কয়দিন এই পথে যাতায়াতের সময় পাকা ধানের গন্ধে বিভোর হয়েছে নিধুর মন। সকাল সন্ধ্যা সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখেছে একলা দাঁড়িয়ে। বড়ো ভালো লেগেছে। আজ বড়ো বিষণ্ণ লাগে, পাকা ধান বুকে নিয়ে কুয়াশার চাদরের নিচে শুয়ে থাকা এই দিগন্ত বিস্তৃত তালতলার মাঠকে গন্ধহীন চরাচর মনে হয়। বুকের ভিতরে কে যেনো গান গেয়ে ওঠে,
“মনের ব্যথা শোনাই কারে
আমার মনের মানুষ রয় সে দূরে।
হায়রে বিধি …”
বাবুর দেওয়া নতুন জামা প্যান্টের প্যাকেটটা শিশির ভেজা ঘাসের উপর নামিয়ে রেখে অন্ধকারে বসে নিধু। গ্রামের ঘরে ঘরে লক্ষ্মী প্রতিমা আটনে বসেছে, উলু আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত বাতাস। মা লক্ষ্মীর আবাহনে ব্যস্ত গৃহিণীরা, এক আনন্দঘন মুহূর্ত। এদিকে নক্ষত্র খচিত আঁধার আকাশের নিচে নির্জনে বসে নিধু। হিমে ভেজা শীতল বুক ফেটে কান্না আসে। সুখীকে মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে। নিধুর যন্ত্রণার সঙ্গী হয়ে নিঃসাড়ে পড়ে থাকে তালতলার মাঠ।