
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
সোমা মুখোপাধ্যায়
আমরা ভারতবাসী, পরে আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী, ও আরো পরে আমরা বাঙালি। বাঙালি জাতির চলনে-বলনে, কথাবার্তায়, পোষাক পরিচ্ছদে, খেলাধুলায়, আমদে-প্রমোদে প্রতিটি মুহূর্তে তার সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্গ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র তার ধর্ম। ধর্ম যেমন সমাজের চালিকা শক্তি; তেমনই ধর্মকে কেন্দ্র করে ক্রমশ বিকশিত হয় সংস্কৃতির বিশাল ধারা। ধর্ম নির্দিষ্ট শিক্ষার উদ্দেশ্য এই যে, তাহার অনুগমণ করিয়া আমরা পবিত্র, প্রেম, মন্ডিত নম্র ও নিঃস্বার্থ হইব। সকল ধর্মই এক। মূল দেশে তারা বিভিন্ন নয়। প্রত্যেক ধর্মই তার নিজের সংস্কৃতির কথা বললেও একইভাবে পথ দেখিয়ে বলে — ভগবানের দিকে তাকাও ঊর্ধ্বমুখী হও, ভয় দূর করো, নিজের ক্ষুদ্রতা ভুলে সহজ সরল হও, দীনতার আশ্রয় লও। সকল ধর্ম সংস্কৃতি আমাদের পূর্ণতার পথে অগ্রসর হওয়ার শিক্ষা দেয়।
সমগ্র জাতির চিন্তাধারা-ভাবধারা-কর্মধারার গৌরবময় প্রতিচ্ছবি হল তার সংস্কৃতি। মানবীয় আচরণ, শিক্ষার পদ্ধতি, মানসিক উন্নতি পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব এইসবের সমন্বয়ে সৃষ্ট এক অপূর্ব মনোভাবই সংস্কৃতি। বাংলার সংস্কৃতি বাঙালি জাতির সর্ববিধ বিষয়ে সর্বাঙ্গীন উন্নতির চরমতম স্বাক্ষর। এই সংস্কৃতি সমগ্র সমাজের সম্মিলিত সফলতা, জাতির প্রাণ ছন্দের চিন্ময় ও কর্মময় অভিব্যঞ্জনা। কাজেই সমগ্র জাতির কল্লোলিত ধ্বনি সংস্কৃতি ও ইতিহাস রচনা করে। সংস্কৃতির মধ্যে আছে দুটি দিক। সামগ্রিক সমান অধিকার ও কৃতিত্বময়তা। বাঙালি জাতি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলেছে একটি জীবন্ত সংস্কৃতির বহমান ধারা যা ঐতিহ্য প্রণোদিত। সংস্কৃতি জাতীয় প্রাণময়তার সামগ্রিক রূপ ও অভিব্যক্তি। বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূলে রয়েছে তার অফুরন্ত প্রাণ প্রাচুর্য ও প্রকৃতির ওর অবারিত দাক্ষিণ্য। সর্বভারতীয় প্রাণগঙ্গা বাঙালির সাংস্কৃতিক ধারা-উপধারাকে নিয়ে অবিচলিতভাবে প্রবাহিত।
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য শিষ্টাচার। শিষ্টাচার প্রকাশের মাধ্যম সৌজন্যবোধ। কেবল ব্যক্তি জীবনেই নয়, সমাজ জীবনেও শিষ্টাচার এক গৌরব জনক আভরণ। যে সমাজ যত সভ্য তার লোক ব্যবহার তত মার্জিত ও সুরুচি ব্যঞ্জক। শিষ্টাচার একটি অমূল্য সামাজিক অলংকার — সমাজের গর্বের এবং গৌরবের বস্তু। অর্থ কিংবা ঐশ্বর্য দিয়ে তা ক্রয় করা যায় না। বাইরের ঐশ্বর্য অন্তরের ঐশ্বর্যকে অপহরণ করে নিঃস্ব দরিদ্র, অন্তঃসারশূন্য হৃদয়হীনে পরিণত করে। আশৈশব আত্মসংযম ও মার্জিত প্রকাশভঙ্গির অনুশীলন ফল হল শিষ্টাচার। বাঙালি সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে উচ্চমার্গে স্থানান্তরিত করতে হলে সমগ্র বাঙালি জাতিকে সর্বপ্রথমে শিষ্টাচারের পাঠ নিতে হবে। ছেলে-ভোলানো ছড়া, ব্রতকথা, রূপকথা ,যাত্রা, পাঁচালি ,কবি গান, বাউল গান, কীর্তন, লোকসংস্কৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি যা শিষ্টাচারের পদাঙ্ক অনুসরণেই সম্ভব।
বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে চলেছে শীতল পাটি-মোড়া-মাদুর-কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ইত্যাদি। তেমনি চন্ডী, ষষ্ঠী, মনসা, ধর্মঠাকুর সব লৌকিক দেবদেবী ওদের নানা মূর্তি নানা চিত্রপট লোকসাহিত্যের বিশাল ধারা উঠে এসেছে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যে। বাঙালি শিক্ষা, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ক্রমশ উদীয়মান ক্রমশ জয়ের পথে অগ্রসর হচ্ছে। যুগ-যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনা ভাবলোকের গৌরব সমুন্নতি তিলে তিলে সৃষ্টি করছে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সর্ববিষয়ে সর্বাঙ্গীন উন্নতির চরমতম ফল; বাঙালি চেতনা, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, সবেতেই সৌজন্যবোধ ও শিষ্টাচারের পরিচয়ে উন্নীত হয়েছে। এবং রূপ রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে সংকটোত্তীর্ণ হবে এবং জন্মলাভ করবে আগামীকালের প্রাণোচ্ছল, উজ্জ্বল বঙ্গসংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।