
চাবাণ (ছোটোগল্প)
সদানন্দ সিংহ
ভোরের শীতল হাওয়ায় পাখিরা কিচিড় কিচিড় হাসে। আর কমলাদের টিনের চালে ডানা ঝাপটায়। এ গ্রামের গাছগাছালি এবং ছোট ছোট বাঁশ কিংবা মাটির তৈরি বাড়িগুলির ওপর এখনো ভোরের রঙিন আকাশ দেখা যায়।
খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা কমলার অভ্যেস। নিতিদিনের মত সে ঘুম থেকে উঠে ঘরের দরজা খুলতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। সে দেখে উঠোনের মাঝ বরাবর কিছু জবাফুল এবং আরো কীসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে সে দেখে সিঁদুর দিয়ে মাটিতে এক ত্রিশূল আঁকা হয়েছে। আর সেই আঁকা ত্রিশূলের ওপর কিছু জবাফুল এবং চালের গুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এইসবের মাঝখানে এক ডিমের খোল মাটিতে পড়ে আছে। ডিমের সাদা অংশ এবং কুসুম ত্রিশূলের মাঝ বরাবর মাটিতে যেন ঢেলে দেওয়া হয়েছে।
এসব দেখে কমলা শিউরে ওঠে। সে হাউমাউ করে ওঠে, হায় হায়, আমরার বাড়িতে আইসা কেডা চাবাণ মাইরা গেল ? আমরার সব্বনাশ কেডা কইরা গেল ? অই রতন, হৌগতলু, তাড়াতাড়ি উঠো।
সাতসকালে মায়ের এই চিৎকারে রতনের ঘুম ভেঙে যায়। সে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এসে মায়ের কাছে যায়, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে। উঠোনে সিঁদুরের আঁকা ত্রিশূল, জবাফুল, চালের গুঁড়ো, ভাঙা ডিম — ইত্যাদি সব চোখ কুঁচকে দেখে।
কমলা ছেলেকে বলে, রতন রে, আমরারে কেডা চাবাণ মাইরা গেল কও দেখি ?
মায়ের কথা শুনে রতন এবার হাসে। চাবাণ মানে বাণ। চাবাণ মারা মানে বাণ মারা। চাবাণ শব্দটা মণিপুরি। রতনের মা আসলে মণিপুরি। রতনের বাবা ছিল বাঙালি। গ্রামের ইস্কুলের পিওন ছিল। সামাজিক ভাবে বিয়ে সম্ভব ছিল না বলে ভালোবেসে তিনি কমলাকে নিয়ে চেনবা মানে ইলোপ করেছিল।
একসময় এ গ্রামের শতকরা নব্বই ভাগ লোকজনই ছিল মণিপুরি। মাত্র দশ ভাগ ছিল বাঙালি। এই গ্রামের ইতিহাসও পুরোনো। ত্রিপুরার এই গ্রামের পত্তন হয়েছিল মণিপুরিদের দ্বারা এবং সেটা ইংরেজি ১৮১৯ থেকে ১৮২৬ সালের মধ্যে। মণিপুরের এই সময়টা ছিল ‘চহি তরেৎ খুন্তাকপা’ অর্থাৎ সাত বছর পরাধীন-র সময় যেখানে বর্মার রাজা মণিপুর দখল করে সেখানে এইসময় ব্যাপক হত্যা এবং ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে প্রচুর মণিপুরি মণিপুর ছেড়ে আসাম, ত্রিপুরা এবং বর্তমান বাংলাদেশে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। কমলার পূর্বপুরুষরাও এভাবে ত্রিপুরার এ গ্রামে এসেছিল। পরে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আস্তে আস্তে হিন্দু বাঙালিরা এসে এই গ্রামে বসতি স্থাপন করেছে ফলে এখন গ্রামের আশি ভাগ লোকজনই বাঙালি।
রতনের বাবা ছিল নেশাগ্রস্ত। প্রতিদিন সন্ধ্যেয় বাংলা মদ খেয়ে বুদ হয়ে থাকত। না, কোনো হৈচৈ করত না। স্কুলেও অনেক সময় বাংলা খেয়ে উপস্থিত হত। স্কুলেও অনেক দিন এজন্যে গণ্ডগোল হয়েছে। এইসব খেতে খেতে বোধহয় তার লিভারটা নষ্ট হয়ে গেছিল। ফলে রিটায়ার্ড হওয়ার দু বছরের মধ্যেই রতনের বাবা মারা গেল। স্বামীর মৃত্যুর পর কমলা এখন ফ্যামিলি পেনসন পায়। এ দিয়েই মা-ছেলের সংসার কোনোভাবে চলে যায়।
রতনের বয়েস ত্রিশের কাছাকাছি। স্কুলের গণ্ডির পর আর লেখাপড়া করেনি। তবে রাজনীতি তার ভাল লাগে। গ্রামের শাসক দলের নেতা বিপিন সিংহের এক নাম্বার চেলা। বান মারা বা চাবাণের ডর-ভয় তার একদম নেই। তাই সে মাকে বলে, আহা মা, তুমি এইগুলি নিয়া হদাহুদি ভয় কর ক্যান ? আমি এইগুলি ফালাইয়া দিতাছি।
কমলা জবাব দেয়, কিতা কইতাছ, ভয় করমু না ? যদি অমঙ্গল হয় ? না না, তুমি ঐ জিনিসগুলি ধইরো না। চাবাণের জিনিস যে ধরে তার নাকি মরণ পর্যন্ত হয়।
— কী যে কও মা। ঠিকাছে, আমি হাত দিয়া ধরমু না। একটা কাইম দিয়া করতাছি।
রতন পলিথিনের একটা প্যাকেট এনে হাত খানেক লম্বা এক গাছের ডালের সাহায্যে জবাফুল, ডিমের খোসা ইত্যাদি যতটা সম্ভব পলিথিনের প্যাকেটে ঢুকিয়ে দিতে থাকে। তারপর বলে, আমি এইগুলি নদীতে ফালাইয়া আইগা। ফিরা আইয়া জল ঢাইলা বাকিগুলি পরিষ্কার করমু। বলে রতন নদীর দিকে যায়। যেতে যেতে ভাবে, কে এই কাজটা করে গেল ? এ গ্রামের কে হতে পারে লোকটা ? খাম্বা ? খাম্বাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীই বলা যায়। সে আর খাম্বা দুজনেই তো বিপিন সিংহের মেয়ে রঞ্জনার পিছনে লাইন দিচ্ছে। তবে খাম্বা মদখোর, সেজন্য রঞ্জনা তাকে দু চোখে দেখতেই পারে না।
আগামী বছর ভোট। সব দলই নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে। রতনের কাজও বেড়ে গেছে। আজ এখানে মিটিং তো কাল ওখানে। এই মিটিং-এর সুবাদে বিপিন সিংহের ডানহাত রতনের পোয়াবারো। রঞ্জনার সাথে রতনের প্রতিদিন দেখা হচ্ছে। এর আগে রতন একদিন রঞ্জনাকে বলে ফেলেছিল, ঐ নঙবু নুঙশি। অর্থাৎ কিনা আমি তোমাকে ভালোবাসি। উত্তরে রঞ্জনা ‘ধ্যৎ’ বলে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই সে দেখেছে তার প্রতি একটা আগ্রহ রঞ্জনার রয়েছে বটে, তবে কীভাবে রঞ্জনার মনে সে এক স্থায়ী দাগ ফেলবে ভেবে পাচ্ছে না। এজন্যে সে বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে পরিকল্পনার কথা ভেবে যায়। শেষে সে ঠিক করে ফলে চাবাণের ঘটনাগুলি সে রঞ্জনাদের উঠোনে একে একে সাজাবে। তারপরই সে দাবার এক মোক্ষম চাল দেবে রঞ্জনাকে পাবার জন্য।
যথারীতি পরিকল্পনা মত রতন এক গভীর রাতে গিয়ে রঞ্জনাদের উঠোনে সিঁদুর দিয়ে ত্রিশূল এঁকে, তার ওপর জবাফুল এবং চালের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে একটা ডিম ভেঙে ডিমের খোসাটা রেখে বাড়িতে চলে আসে।
পরদিন ভোরেই বিপিনের বাড়িতে রতনের ডাক পড়ে। রতন তড়িঘড়ি করে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে সেখানে এক হুলস্থুল কাণ্ড। লোকজন বেশ জমে গেছে। বিপিন ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে, আমার বাড়িতে চাবাণ ? কার এমন হিম্মত ? হেরে আমি দেইখা নিমু। রতনকে সামনে দেখে বিপিন বলে, দ্যাখ রতন, বিরোধী পার্টি লোকদের কাণ্ড! কেডা ইটা করছে বাইর করতে হইব। হেরা রে এমন শিক্ষা দিমু, বাপের নাম ভুলাইয়া ছাড়মু।
রতন গম্ভীর মুখে জবাব দেয়, ঠিক কথা কইতাছেন কাকু। একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। আমি বাইর করমু কেডা ইটা করছে। অখন আমি এগুলো পরিষ্কার করতাছি, আমারে একটা প্লাস্টিক ব্যাগ দ্যান।
বিপিন রতনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলে, কিন্তু রতন, আমি শুনছি চাবাণের জিনিসপত্র যে ছোঁয় তার নাকি মরণ পর্যন্ত হইতে পারে।
রতন দাবার চাল দেয়, হইলে হইবে। আমি ভয় করি না। আপনারার মঙ্গল আমি চাই।
— সইত্যি রতন, তুই আমরার সইত্যিই আপনজন।
তাড়াতাড়ি কেউ একজন এক বাজার করার নাইলনের ব্যাগ নিয়ে আসে। রতন নিজ হাতে ধরে, সেঁচে সাজানো চাবাণের জিনিসগুলি ব্যাগে ভরতে থাকে। জায়গাটাকে ঝকঝকে পরিষ্কার করার পর সে উঠে দাঁড়ায়। বলে, কাকু এইগুলো আমি নদীতে ফালাইয়া দিয়া আইতাছি।
যেতে গিয়ে দেখে সামনেই রঞ্জনা দাঁড়িয়ে আছে। রতন ফিসফিস করে তাকে বলে, ঐ নঙবু নুঙশি। রঞ্জনার চোখে আজ লাজুকতা, আর দৌড়ে পালিয়ে যায় না। সামনে এগোয় রতন। নদীর পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, খাম্বার ওপর দোষটা চাপিয়ে দিলে কেমন হয় ? মনে মনে আওড়ায়, আইছা, এক ঢিলে কি তিন পাখি মারন যায় ?