
গন্ধ বদলে যায় (ছোটোগল্প)
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য
“তপন দা, এইদিকে আসুন।”
সামনে তাকায় তপন। রাস্তার ওপাশের প্রতীক্ষালয়ে বসে রয়েছে মৌসুমী। আজ মৌসুমীর সঙ্গে একই বাসে বর্ধমান ফিরবে তপন। তপনের সারাদিনের ইচ্ছেটা অধীর হয়ে ওঠে মুহূর্তে, ডানা ঝাপটায়। চারপাশের বাতাস ভরে ওঠে সুগন্ধে। ব্যস্ত-ইচ্ছে স্তিমিত করবার চেষ্টা করে তপন। রাস্তার এই পার থেকেই মৌসুমীকে একবার দেখে। মনে মনে ভয় পায় বেশ। অধীরতায় লাগাম টেনে তাকিয়ে দেখে চারপাশ, কারোর নজর তপনের উপর আছে কিনা। ‘কারও’ মানে অফিসের দত্তবাবু, দাসবাবু, রায়বাবু, সাহাবাবু বা আরো যারা যারা থাকে। সোজা কথায় রোজ অফিসে এসে মৌসুমীর উপর যাদের নজর ঝুলে থাকে। মৌসুমী আর তপন একই সময়ে বাস স্ট্যান্ডে রয়েছে ব্যাপারটা এদের যে-কারো চোখে পড়লেই হলো। গল্পের চরিত্র হয়ে উঠবে তপন, আস্ত সরস কাহিনি রচনা করে ফেলবে সাহাবাবু। টেবিলে টেবিলে ঘুরে রসসিক্ত হবে সেই কল্প কাহিনি আরো। তারপর আদিরসে জারিত হয়ে করুণ রসের ক্ষরণ ঘটাবে তপনের মনে। তাই সাবধানের মার নেই, চারপাশে নজর ফেলে তপন। না, কেউ নেই। এইবার প্রতীক্ষালয়ের দিকে এগিয়ে যেতে নিশ্চিন্তে সামনে পা ফেলে। বাসে ওঠার আগে পর্যন্ত মৌসুমীর পাশে বসে দু চারটি কথা বলবে। আর, আর মৌসুমীর গায়ের পারফিউমের সুগন্ধে বিভোর হয়ে উঠবে তপন।
মৌসুমী বোলেপুরে যাবার বাস ধরে রোজ, তপন ফেরে বর্ধমান, পুরো উল্টো দিকে। আজ মৌসুমী বর্ধমান যাবে, পিসতুতো বোনের বিয়ে। গতকাল বলে ছিলো তপনকে, “আপনার সঙ্গে একই বাসে যাবো তপনদা, বসতে দেবেন তো বাসে। অত রাস্তা দাঁড়িয়ে…।” তারপর থেকে এক অদ্ভুত ভালোলাগা ঘুর ঘুর করেছে তপনের চারপাশে। মনের হাজারো প্রকোষ্ঠ সুগন্ধে ম ম করেছে।
আজ অফিসে এসে থেকে দত্তবাবুকে খুশি রেখেছে তপন, একটু আগে ছুটি চাই, তাই। দত্তবাবুকে চটালেই চটকে যাবে সব। রোজ ছুটির সময় বাস ধরবার তাড়া থাকে তপনের। ঠিক তখনই হাজার কাজ মনে পড়ে যায় দত্তবাবুর। “তপন, তেরো নম্বর আলমারির মাঝের তাকের ডান দিকের নীল ফাইলটা নিয়ে আয়।”
কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে নীল ফাইল এনে দেয় তপন। ফাইল খুলে দুই একটা কাগজ নাড়াচাড়া করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলে, “আরে না না। এইটা নয়। সেই বাঁশ পাতা রঙের ফাইলটা। দেখতো সাহার টেবিলে আছে কিনা। সেখানে না পেলে একবার দাসের টেবিলে দেখবি।” অফিসের এই মাথা থেকে ওই মাথা সব টেবিল দেখে তপন বলে, “পেলাম না স্যার।”
“ওহ্! থাক থাক। এখানেই ছিলো। পেয়েছি। তুই বরং নীল ফাইলটা তুলে রাখ।” বলে দত্তবাবু।
ততক্ষণে তপনের বাস চলে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তপন। দত্তবাবু বলে,”অত বাড়ি বাড়ি করিস কেনো তপন! এই বয়সে স্বামী স্ত্রী হলো ভাই বোন। সংসার হল আশ্রম আর তুই …।” তারপর বাসে দত্তবাবুর পাশে বসে ঘামের উৎকট গন্ধ নাকে নিয়ে বর্ধমান ফেরে তপন।
আজ অফিসে এসেই সময় মতো দত্তবাবুর কাছে সুপারিশও পেশ করে রেখেছে তপন, “আজ একটু আগে ছুটি দেবেন স্যার।”
“কেনো রে?”
“বিয়ের নিমন্ত্রণ আছে।”
“আজ আমি নিজের গাড়িটা নিয়ে এলাম। ভাবলাম তোকে নিয়েই বর্ধমান ফিরবো। আর তুই বলছিস আগে কাটবো। যাক গে, বিয়ে বাড়ি কি বর্ধমানে?” জিজ্ঞাসা করে দত্তবাবু।
“না না স্যার। গ্রামে, আমার বাড়ির পাশেই।” কথাটা আগেই সাজিয়েই রেখে ছিলো তপন।
কালচে দাঁতে খিল খিল হাসি ভাসিয়ে দেয় দত্তবাবু। বলে, “বুঝিরে তপন সবই বুঝি। মৌসুমীরও আজ বিয়ে বাড়ি যাবে। তোরও বিয়ের নিমন্ত্রণ। মৌসুমী বর্ধমান যাবে। একই বাসে তুইও যাবি সঙ্গে। তাইতো?” বলে আবার হাসতে থাকে দত্তবাবু।
দত্তবাবুর হাসির তালে দুর দুর করে তপনের বুক। দত্তবাবু কি অন্তর্যামী! মনের কথা বলে দেয়! নিজেকে বিন্যস্ত রেখেই তপন বলে,”কি জানি স্যার। সে সব তো বলতে পারবো না।”
ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ওঠেন দত্তবাবু। “গতকাল আমি নিজের কানে শুনেছি রে, মৌসুমী তোকে বললে বর্ধমানে বিয়ে বাড়ি…।”
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে তপন। এরপর আর কথা চলে না। মুখ খুললেই ছুটি নাকচ। দত্তবাবু বলে, “বুঝি রে তপন সব বুঝি। বেশ আজ না হয় আগেই যাবি। পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে নিয়ে…।”
পাশের টেবিল থেকে দাসবাবু বলে, “আপনিও যেমন কথা বলেন দত্তদা। হিসির বাসি গন্ধ শুঁকে তপনের জীবন গেলো। এই বয়সে সন্তান বোঝেন তো…।”
হাসতে হাসতে দত্তবাবু বলে, “সে কি আর বুঝি না ভাই। তপনের ঘরে বিকেলে ভোরের ফুল।”
‘বিকেলে ভোরের ফুল’ কথাটা আগেও দত্তবাবুর মুখে শুনেছে তপন, অর্থ বোঝেনি। জিজ্ঞেস করেছিল চায়ের দোকানের রঘুকে। রঘু বলে তপনদা “বেশি বয়সে ছেলে…।”
রাগ হয় তপনের। আগে বন্ধু বান্ধবরা তপনকে নিয়ে তামাশা করতো। এখন অফিসের লোকজন লোফালুফি খেলে। লতিকার জন্যই আজ এই অবস্থা। রাজি ছিল না তপন। লতিকা জোর করে রেখে দিল। বলে,”যে আসছে সংসারের মঙ্গলের জন্যই আসছে। এর থেকেই আমাদের সংসারের শ্রী ফিরবে দেখে নিও তুমি।”
ছেলে হবার পর থেকে সংসারের মঙ্গল অমঙ্গল কিছুই বোঝেনি তপন। বরং খরচ বেড়েছে। ছুটি নিয়েছে লতিকার অবসর। সারাদিন পরিশ্রম। রাতে বিছানায় পিঠ ছোঁয়ালেই ঘুমিয়ে যায় লতিকা। নিজের মত করে তখন বউকে আর কাছে পায় না তপন। ঘন অন্ধকারে রাতগুলো মুচকি হেসে চলে যায়। মাঝে মধ্যে নিঝুম রাতে হড়পা বান আসে তপনের মনে। ইচ্ছে হয় লতিকাকে সঙ্গে নিয়ে বানভাসি হয়। লতিকার গায়ে হাত রাখে তপন। ঘুম চোখে লতিকা বলে,”বিরক্ত করো না, ঘুমাতে দাও। বুড়ো বয়সে ভীমরতি। মেয়েদের বিয়ের বয়স…।”
ভিতর থেকে কুঁকড়ে যায় তপন। কেমন একটা জমাট লজ্জা নিয়ে লতিকার পাশ থেকে সরে আসে। ঠিকই তো বড়ো মেয়েটা এই বছর উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলো। ছোটো মেয়ে ক্লাস টেন। ছেলে সবে আড়াই বছরে। বয়স যেনো রেসের ঘোড়া! ছুটেই চলে সামনে। ঘরের পাতলা অন্ধকারে নানা কথা ভাবে তপন। ছেলেটা কাঁথা ভিজিয়ে শুয়ে থাকে। ভিজে কাঁথা সরিয়ে শুকনো কাঁথা পেতে দেয় তপন। সোঁদা গন্ধে নাসারন্ধ্র জ্বলে যায়। মৌসুমী ম্যাডামের পারফিমের গন্ধটা চেতনায় আনার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়, বাকি রাতটা হিসির গন্ধে ডুবে থাকে তপন।
অফিসে বেশ সুন্দর সময় কাটে তপনের। আড়াল আবডাল থেকে দেখে মৌসুমী ম্যাডামকে। ভারী মিষ্টি দেখতে। নরম গলায় হেসে হেসে কথা বলে। ঘাড়টা সামান্য হেলিয়ে দেয় কথা বলবার সময়। হাসলে গালে টোল পড়ে। একদম সিনেমার নায়িকার মতো লাগে মৌসুমীকে। আর কি পারফিউম মাখে কে জানে। গোটা অফিস ম ম করে সেই সুগন্ধে। সাহাবাবু একদিন বলছিল, “এটা প্যারিসের জিনিস। নয়তো অফিস সুদ্ধু সবাই মাতাল হতো না।”
দাসবাবু বলে, “ভাবুন আমাদের তপনদার কি সৌভাগ্য। সারাদিন পারফিউমের বোতলের মধ্যেই রয়েছে।” দাসবাবুর কথা শুনে আশেপাশের টেবিলে হাসির হিল্লোল ওঠে। ভয় পায় তপন। মৌসুমী ম্যাডাম শুনলে কি হবে!
দিন কয়েক আগে তপনকে সরিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় ফাইল খুঁজছিল মৌসুমী নিজে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তপন। অসীম মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে দেখছিল মৌসুমীকে। দত্তবাবু নিজের চেয়ার থেকে ডাক দেয় তপনকে। তপন কাছে এলে বলে, “চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিস মেয়েটাকে। দেখে ফেললে জুতো পেটা করবে।” বলেই সেই কালচে দাঁতের হাসি ভাসিয়ে দেয়। তপন ভাবে গোটা অফিস তাকে নজরে বেঁধে রেখেছে। সাবধান করে নিজেকে। আড়ালে তপনকে শাসন করে তপন। তবুও দিনে দিনে একটা বেহায়া হ্যাংলামি লক লক করে তপনের মনে। তাড়িয়ে নিয়ে যায় মৌসুমীর দিকে। বাধ্য করে মৌসুমীর দিকে তাকিয়ে থাকতে। জোরে জোরে বাতাস টেনে সুগন্ধে মজিয়ে দিতে চায় নিজের ভিতরটাকে। ভিতরের সমস্ত দুর্গন্ধ ঢাকতে চায় মৌসুমীর পারফিউমের গন্ধে। মৌসুমী অফিসে থাকলে কাজ করতে ভালোলাগে তপনের। মনে হয় একাই সব কাজ করতে পারবে। দত্তবাবু একদিন তপনকে বলে ছিল “মিডিল এজ ক্রাইসিস।” কথাটার অর্থ বোঝেনি তপন।
“তপনদা আসুন।” এইবার একটু জোরেই ডাকে মৌসুমী।
মৌসুমীর ডাক না শোনার ভান করে তপন। আজ একই সঙ্গে ফিরবে। বাস আসবার আগে তো আর চলে যেতে পারবে না মৌসুমী। তাড়াহুড়ো না দেখানোই ভালো। বাস রাস্তার দিকে তাকায় তপন। দৃষ্টি ভাসিয়ে দেয় বহুদূরে। বাসের দেখা নেই। এই সময়ের বাসটা রোজ লেট করে। বুক পকেট থেকে সন্তর্পণে মোবাইল বের করে তপন। সময় দেখবে। বোতাম টেপা পুরানো ফোন। কিপ্যাডে গার্ডার দেওয়া। স্ক্রীনে ফাটা দাগ। ছেলেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এমন হাল করেছে। আড়াই বছরের বাচ্ছা। খাবার সময় বায়না করে। বড়ো মেয়ের মোবাইলে গান বাজিয়ে দেয় লতিকা। খেয়ে নেয় ছেলে। দিন কয়েক আগে মেয়েটার অনলাইন ক্লাস চলছে এদিকে ছেলেটা খাবে না কিছুতেই। কাঁদছে। সামলাতে না পেরে ছেলেটাকে দু ঘা ধরিয়ে দেয় লতিকা। সে দিন বাড়িতে ছিলো তপন। মায়া লাগে ছেলের কান্না শুনে। নিজের ফোনটা ছেলের হাতে দেয় তপন। তপনের ফোন হাতে দিতেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। স্ক্রীনটা ফেটে যায়। কিপ্যাড …।
পরদিন থেকে অফিসে সবার আড়ালে ফোন বের করে তপন। না জানি তপনের ফোন নিয়ে আবার কোন কথা টেবিলে টেবিলে গড়াগড়ি খাবে।
হাতের মধ্যে লুকিয়ে ধরে সময় দেখে তপন। মিনিট দশেকের আগে বাস আসবার সম্ভাবনা নেই।
রাস্তার ওপারে যাবার আগে দুপাশ দেখে নেয় তপন। বড়ো রাস্তায় পা ফেলতেই শোনে কে যেনো ডাকছে “তপনদা”
ঘুরে দেখে তপন, চায়ের দোকানের রঘু ডাকছে। রঘু কেনো ডাকে? অন্য দিন তো তপন একাই দাঁড়িয়ে থাকে। কই তখন তো ডাকে না রঘু। ভয়ে বুক ছ্যাৎ করে ওঠে তপনের। মৌসুমী তপনকে ডেকেছে তা নজর এড়িয়ে যাবার কথা নয় রঘুর। এই কথা অফিসের কাউকে না কাউকে বলবে রঘু। তারপরই শুরু হবে নতুন আর এক গল্প। রায়বাবু দত্তবাবু বলবে, “তপন বাড়িতে বৌ আর মনে মৌ!” ইস। বড্ড লজ্জার কথা। আরো কিছুটা সময় পার করে ওপারে গেলে ভালো হতো। আপশোশ করে তপন। ততক্ষণে আরো দুই বার হাঁক দিয়েছে রঘু।
রঘুর দোকানে আসে তপন। কপট গাম্ভীর্য এনে গম্ভীর গলায় বলে,”যা বলবার তাড়াতাড়ি বলো রঘু। বাস আসবে। তার আগে ম্যাডামকে একটা জরুরি কাগজ দিতে হবে।” গলা কেঁপে ওঠে তপনের। তবে কথাটা বলতে পেরেছে। চায়ের প্যান থেকে চোখ তুলে তপনকে একবার দেখে রঘু। ভাবটা এমন, কায়দা মেরে লাভ নেই। আমি বুঝি সব। সসপ্যানে চামচ নাড়াতে নাড়াতে রঘু বলে, “এটা কি ঠিক কাজ হচ্ছে তপনদা? এইবার কিন্তু পাঁচজন জানবে। এতদিন চুপ ছিলাম। এইবার বলবো সব।”
রঘুর কথা শুনে গলা শুকিয়ে আসে তপনের। তার মনের কথা রঘু জানলো কি করে। বলে “রঘু, তুমি যা ভাবছো তা নয়। আসলে…।”
“আসলে আবার কি? লজ্জা নেই!” তপনকে থামিয়ে দিয়ে বলে রঘু।
“রঘু ভাই যা বলতে চাও একলা আমাকে বলবে। সবার সামনে বলে…।” অনেক কথা একসঙ্গে বাইরে আসতে চায়। আলাদা করে কোনো কথা বলতে পারে না তপন। খরিদ্দার দুই চার জন যারা ছিলো রঘুর দোকানে সবাই চেয়ে থাকে তপনের দিকে। তপনকে চেনে। কেউ কেউ পিয়নবাবু বলে সম্মানও দেয়। কি বিপদ হলো! ছি ছি ছি।
“এটা কি ঠিক হচ্ছে তপন দা?”
“কোনটা?” গলাটা কেঁপে ওঠে তপনের।
রঘু বলে “আজ একমাস ধরে চলছে। কিছু বলছি না।”
“কি চলছে?”
“পান, চা আপনিই তো নিয়ে যান। তাই আপনাকেই শোনাচ্ছি। বলে দেবেন…।”
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে তপনের। যাক। চা আর পানের কথা বলছে। দত্তবাবু রোজ ধারে পান নেয়। চা নেয়। পয়সা দেবার নাম নেই। “ঠিক আছে কাল এসে…।” রঘুকে আশ্বস্ত করে রাস্তার এইপারে আসে তপন।
মৌসুমী বলে ভিতরে বসুন। কখন থেকে ডাকছি। মৌসুমীর ঠিক পাশের চেয়ারে বসে তপন। সেই সুগন্ধে ভরে ওঠে মন-মরূদ্যান। এক অপার্থিব সুখ হেসে ওঠে খিল খিল করে। সত্যি জীবনের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকা যায় মৌসুমীর পারফিউমের সুগন্ধে। আনন্দ ধারায় ভেসে চলে তপন। এই সময়ে ঠিক কি কথা বলা উচিত ভেবে পায় না। কেমন একটা অবাধ্য আড়ষ্টতা চেপে বসে। সময় এগিয়ে চলে ঘড়ির তালে।
বাস আসে। সময়ের চেয়ে অনেক পরে। ভিড়। ভীষণ ভিড়। তিল ধারণের জায়গা নেই। “ওঠা যাবে!”
তীব্র সংশয় মৌসুমীর গলায়।
“যাবে ম্যাডাম। আমার পিছন পিছন উঠে পড়বেন। পিছনের গেটে উঠলে পরিচিত কয়জন নিত্যযাত্রী থাকে। কোনো অসুবিধা হবে না আপনার।” তপনের আশ্বাস।
ভিড় ঠেলে ভিতর ঢোকে তপন। কোনো রকমে দাঁড় করায় নিজেকে। তারপর দেখতে চেষ্টা করে মৌসুমী উঠছে কিনা। দেখতে পায় না মৌসুমীকে। আবার গেটের দিকে ফিরে আসবার চেষ্টা করে। মানব জটলা ভেঙে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিচ্ছে কন্ডাক্টর। মৌসুমীর কথা জিজ্ঞাসা করে তপন। সামনের গেটে উঠেছে মৌসুমী। কাল থেকে কত কি ভেবে ছিলো তপন। মৌসুমী আর তপন একই সঙ্গে বর্ধমান ফিরবে। নিত্যযাত্রীদের সাহায্য নিয়ে পাশাপাশি দুটো সিটে বসবে। মৌসুমীর থেকে দুটো চারটে কথা শুনবে। যা কেউ শোনেনি। কোনোদিন শোনেনি। নিজের না বলা কথা সাজিয়ে গুছিয়ে বলবে। আর মন মাতানো সুগন্ধে মাতিয়ে নেবে নিজেকে। আশাহত তপন। আজ পরিচিত নিত্য যাত্রীদের এড়িয়ে আলাদা থাকতে চায়। আরো জমাট ভিড়ের মধ্যে ঘাড় ধরে গুঁজে দেয় নিজেকে। ঘর্মাক্ত মানুষজনের মধ্যে নিজেকে সেঁধিয়ে দেয় তপন। উৎকট সোঁদা গন্ধ নাকে আসে। ভিড়ের মধ্যে ভিড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তপন।