কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা – সুদীপ ঘোষাল

কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা – সুদীপ ঘোষাল

কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা

সুদীপ ঘোষাল

কবি মণীন্দ্র গুপ্ত। বিশিষ্ট ভারতীয় কবি, লেখক। মণীন্দ্র গুপ্ত স্বাধীনতা উত্তর বাংলায় তিনি সর্বাধিক প্রভাবশালী কবিদের অন্যতম। জন্ম ১৯২৬ – মৃত্যু ২০১৮। তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির দ্বারা ভূষিত হন, এবং ২০০৫ সালে ‘টুং টাং শব্দ নিঃশব্দ’-র জন্য পেয়েছিলেন রাজ্যের বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’। মণীন্দ্র গুপ্তর শৈশব কাটে অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। স্কুলের শিক্ষা প্রাপ্ত হন আসামের শিলচর এবং কলকাতায়। শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর তিনি ভারতীয় সেনায় যোগদান করেন এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে বেশ কিছুকাল কর্মরত ছিলেন।

তাঁর কবিতা ছড়িয়ে আছে জীবনে, প্রকৃতির মাঝে। তবে সবসময় সে ধরা দেয় না। প্রত্যকের অন্তরে জাগ্রত একজন, সদা কথা বলে নিজের সঙ্গে। তার জন্য আবেগ আর, সাধনার প্রয়োজন।
লেখার সময়ে সচেতন ভাবে লেখনীর মধ্যে কবিতার ভাব অনুভব করি না! অবচেতন মন থেকে উঠে আসা দিনলিপির বোধকে প্রকাশ করি কি শব্দচয়নে? শব্দচয়ন সঠিক হচ্ছে কি ? কাউকে আঘাত না করেই বলি, কবিতা সকলের জন্য নয়। মনের ভিতর জেগে ওঠা অনুভূতিকে শব্দের বিন্যাসে সুন্দর ক’রে গেঁথে ফেলেন পাঠকের উদ্দেশ্যে। সময়োপযোগী প্রতিবেদন হোক বা পুরাতনী ইতিহাস, সবকিছুতেই চেষ্টা করি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে। এই কবি অতি সুক্ষ্ম তরঙ্গের স্পন্দন শোনার অপেক্ষায় মৌন হয়ে অপরূপ প্রকৃতির, কোলে আশ্রয় নিতে চায়। চাওয়াপাওয়ার উর্ধ্ব জগতে ভাসতে ভাসতে ছাই হয় নশ্বর দেহের অহংকার।

তার কবিতা, নামতা লেখার স্লেটে পরীর গল্প, আমাদের অবাক করে।

নামতা লেখার স্লেট পেয়েছি সেই কবে কোন্ ছেলেবেলায়;
ভুল করে নীল পরীর গল্প মকশ করেছিলাম তাতেই
বাড়ির সবাই ঘুমোলে পর ঘর-পালিয়ে দুপুরবেলায়।
নামতাগুলো সব মুছেছে ঘুরতে-ফিরতে হাতে হাতেই;
পরীর সেই গল্পটাই শুধু নৌকো হয়ে যাচ্ছে ভেসে
বিকেলে লাল মেঘের তলায়—

স্থূল পদার্থ নিয়ে কবির মত পরমাণু বিজ্ঞানীরা অপেক্ষায় থাকেন না। অণু পরমাণু নিয়েই তাঁরা ব্যস্ত। তা না হলে হিমালয়ের চূড়া কিংবা জমি জায়গা নিয়েই তাঁরা টানাটানি করতেন বেশি।
আকাশকে আমরা পৃথিবীর মানুষ, স্বার্থপরের মত খণ্ড খণ্ড করেছি। এটা কাটোয়ার আকাশ, ওটা দিল্লীর, ওটা রাশিয়ার আকাশ। অখণ্ডতার বাণী আমরা ভুলে যাই। কবি বলেন, আকাশ চিরদিন অখণ্ডই থাকে। তাকে খণ্ডিত করার অকারণ অপচেষ্টা না করাই ভালো। তবু কাঁটাতার হয়, সীমানা ভাগ হয়। অদ্ভুত মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে আছে প্রাণীকুল। কবির আলোর অন্তরে বাদ্য বাজে, ‘অনন্ত নাদ’ এর ভেরী। সূক্ষ্ম তরঙ্গে মিশে যায় তার অস্তিত্ব, ভুলে যায় তার অবস্থান। এ অনুভূতি ঝরনার মত, কবিতার মত, ভালোবাসার মত, নদীর প্রবাহের মত। জোর করে সে গতি পাল্টায় না।

তাঁর কবিতা, প্রলয় বা সমাধি, মৃত্যুচেতনার অভিঘাতে উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

বেলপাতা ও টুপটাপ বৃষ্টির জলের নিচে
চাপা পড়ে আছে শিবলিঙ্গ।
সেই ভিজে পাতার স্তূপের নিচে
দিন : আষাঢ়সন্ধ্যার মতো,
রাত : দেহ-মাটি-হয়ে-যাওয়া বনগর্ভের মতো।
ওখানে, ঐ সম্পূর্ণ অবলম্বনহীনতার নৈঃশব্দ্যে
আমি শিবলিঙ্গের মতো আছি— শুধু এই কল্পনাতেই
আমি প্রলয়ের ধারণা পাই।

অনেক চেনাজানা শব্দকে তিনি কীভাবে নিপুণ শিল্পীর মত বুনে গেছেন, আমি পড়ছিলাম আর বিস্মিত হচ্ছিলাম। এমন সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী কবিতা খুব কম পড়া হয়।
প্রথম দিকের কয়েকটা কবিতা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল জীবনানন্দের কবিতা নতুন ফ্লেভারে পুনর্নির্মিত হয়েছে। ‘ছাই’ কবিতাটা মনে গেঁথে গেলো, এবং এর পরের প্রতিটা কবিতাই অনন্যসাধারণ।

তাঁর, নীল, কবিতায় তিনি লিখেছেন,

বৃদ্ধ কুকুরের চোখের মতো বিষাদগ্রস্ত হয়ে গেছে আমার পুংস্ত্ব
অবলুণ্ঠিত শরীর বহুদিন হল নীরব অপমানের কাছে আত্মসমর্পিত।
তবু এখনো, শব্দে অভ্যাসস্পৃষ্ট সেই বোজা চোখেই যখন
আধা খোলে— ধক করে ওঠে চৈত্রের সিংস্র পিঙ্গল।
আলপিনের কপিশ মাথা ছুঁচের চকিত ছ্যাঁদার মধ্য দিয়ে

বাস্তবিক প্রাণের সংরাগে জীবন্ত অনুভবের ধারক। দেখার মধ্যেও একটা আলাদা দে।খা থেকে যায় । যাকে নতুন করে দেখতে শিখি। দার্শনিকের প্রজ্ঞার সঙ্গে রসিকের রসাচার মিশে গেলে যা হয়৷ অথবা চেতনা ও অতিচেতনার মাঝখানে এক নতুন বাস্তবের নির্মাণ ঘটে চলে যা আমাদের কাছে অভূতপূর্ব, অনাস্বাদিত৷ যুক্তি থাকে, মুক্তি থাকে, বিস্ময় থাকে, ব্যাপ্তি থাকে, মোহ ও মোচড় থাকে মেধা ও হৃদয়ের ঘোর লেগে যায় পরতে পরতে। মনোরম রম্যতা বজায় রেখেও নিষিদ্ধ ক্রুর কথকতা চলে আসে ৷ তাকেও এড়াতে পারি না। বজ্রের পাশে ফুল ফোটে, বাস্তবে নেমে আসে কল্পনা, ছবির ভেতর প্রাণের অফুরন্ত মহিমার ছড়াছড়ি৷ অদ্ভুত রহস্যাচারী বিন্যাস রূপকথার প্রতিরূপে প্ৰবৃত্তিকে ধারণ করে কখনো তা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকে। ঝরঝরে মুখের ভাষাতেও এত জাদু আছে তখনি তা বোঝা যায়। শুধু মনের জটিল স্তরগুলি জীবনের বৃত্তকে ঘোরালো করে তোলে৷ কাব্যের আকাশ তখন রহস্যময় এক আড়ালে ঢেকে যায়৷ অবশ্য সময়ের কাছে জীবনের সাক্ষ্য দেওয়ার নিরিখেই কবিরও কিছুটা দায় থাকে।

ম্লান জীবন

দিন যায়। পরতে পরতে জমে ধুলো। সে চলে যাবার পর
অর্গানের রীডে— যাকে আমি সুরের পাঁজর বলতাম—
আর কেউ আঙুল রাখে না। না রাখুক আমি বেশ আছি।
বাড়িময় আলস্যের ঘুম-ঘুম ঘোর, আকাঙ্ক্ষারা ফটকের বাইরে থাকে—
বিরক্ত করে না। ঝরা পাতার তলায় ঢাকা এই বাড়ি, এই ম্লান জীবনেরও
একরকম সুখ আছে, একরকম আস্বাদন আছে — আমি বেশ আছি।

শৈশব কাটে অভিবক্ত বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। স্কুলের শিক্ষা প্রাপ্ত হন আসামের শিলচর এবং কলকাতায়। শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর তিনি ভারতীয় সেনায় যোগদান করেন এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে বেশ কিছুকাল কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে মেশিন ডিজাইনের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।
তিনি একালের একজন বিশিষ্ট কবি। অনেকের মতে স্বাধীন উত্তর বাংলায় তিনি সর্বাধিক প্রভাবশালী কবিদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর দীর্ঘ রচনার সম্ভারের মধ্যে রয়েছে “চাঁদের ওপিঠ”, “অক্ষয় মালবেরী” প্রভৃতি। ২০১০ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী দ্বারা ভূষিত হন, এ রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান “রবীন্দ্র পুরষ্কার”-এ তার “টুংটাং শব্দ নিঃশব্দ”-(২০০৫) এর জন্য।

তিনি কবিতাকে অর্থউন্নতির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেননি। বইয়ের জানলায় আলোর অধিক পথ দেখতেন। নগর ঋষির কাছে যেন কাক কথা বলত। সমুদ্রের হিম চলে আসত পাহাড়ের গাঢ়তায়। কবির প্রয়াণে আমাদের গভীর প্রণতি।

(তথ্য সংগৃহীত।)