লড়াই – গুলশন ঘোষ

লড়াই – গুলশন ঘোষ

লড়াই            (ছোটোগল্প)

গুলশন ঘোষ

বিয়ের ১১ মাস পর পিউ যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এলো তখন সে ১০ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
কয়েক সপ্তাহ পর এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল পিউ।
সে যখন ক্লাস সিক্স-এ – তখন তার বিয়ে হয়ে যায়। বয়স ১৩। বন্ধ হয়ে যায় লেখাপড়া।

পিউ তখন ছোট। অজানা এক জ্বরে কিছু দিন ভুগে মারা গিয়েছিল তার বাবা জগন্নাথ ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন নবাসনের যজমান। সংসার তাঁর একার হলেও সদস্য নেহাত কম নয় — স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে পাঁচজন। সবার দু-বেলা পেট চালানো ও ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো বেশ কষ্টকর। কোন জমি জায়গা ছিল না জগন্নাথ ভট্টাচার্যের। পূজার্চনা করেই কোনক্রমে দিন চালাতে হত তাঁকে।
তিনি মারা যাওয়ার পর বড় ছেলে নবাসন গ্রামের যজমান হল। এর কয়েক বছর পরেই চন্দননগরের এক অবস্থা সম্পন্ন ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে সম্বন্ধ এলো পিউ-এর জন্য। জগন্নাথবাবুর বন্ধুরা তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলেকে বোঝালেন পিউ-এর বিয়ে দিয়ে দেওয়া জন্য। রাজি হয়ে গেল তার মা ও দাদা।
কিন্তু, বিয়েটা সুখের হল না। বিয়ের কয়েক মাস পর থেকেই পিউ লক্ষ করে যে তার বর কয়েক দিন বাড়িতে থেকেই তারপর কোনও কাজ আছে বলে বেরিয়ে যায়। কখন ফেরে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। বাড়ি ফিরেও নতুন বউ-এর সঙ্গে ঠিকঠাক ভাবে কথা পর্যন্ত বলে না তন্ময়। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
সকালে উঠেই তন্ময় আবার কোথায় বেরিয়ে যায় তার কিছুই জানতে পারে না পিউ। তার স্বামী বেরিয়ে গেলে পিউ বিষণ্ন কৌতূহলে সেই পথের দিকেই তাকিয়ে থাকে। একবারও নতুন বউয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না তন্ময়। পিউ দোতলার ঘরের জানালা দিয়ে আম বাগানের মধ্যে অবস্থিত ইটভাটার চিমনির দিকে একমনে তাকিয়ে ভাবতে থাকে — কে জানে আবার কবে ফিরবে সে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার। চিমনির ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে বাগান ছেড়ে ভাসতে ভাসতে দূর এগিয়ে গিয়ে বাতাসে মিশে যায়।
পিউয়ের বড় জা এসে দাঁড়ায় পিউ-এর ঘরের দরজার সামনে। সঙ্গে চার বছরের মেয়ে তুলি নাচের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে।
— তুই তুলিকে নাচের ক্লাসে নিয়ে যা, রান্নার দিদি চলে আসবে এক্ষুনি। পিউকে ওর জা বলল।
বাড়ি থেকে মাত্র ১ মিনিট হাঁটা পথ তুলির নাচের ক্লাস।এর আগেও কয়েকবার পিউ ওর জা-এর সঙ্গে তুলির নাচের ক্লাসে গিয়েছিল। আজ সে একা। সঙ্গে তুলি।
নাচের হল রুমে তুলিকে দিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায় পিউ। বারান্দার জানালা থেকে পিউ তাকিয়ে দেখে তুলিকে। সে একবার নাচের দিদিমণির দিকে দেখছে, আবার হাত ও আঙুলগুলো ধীরে ধীরে বাঁকাতে বাঁকাতে চোখ পাল্টে ফিরে তাকাচ্ছে পিউয়ের দিকে। পিউ একভাবে তুলির দিকে তাকিয়ে আছে। আনমনে হাসছে পিউ।
ছোটবেলায় পিউ-এর মা যখন তাকে নাচের ক্লাসে দিয়ে এসে জানালা দিয়ে ওর দিকে তাকাত তখন ঠিক এমন ভাবেই পিউ ওর মা’র দিকে হাসিভরা চোখে তাকিয়ে থাকত।
পিউ চার বছর নাচ শিখেছিল। তার মায়ের অসুখ হল। তাকে নাচের ক্লাসে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ ছিল না। বন্ধ হয়ে গেল তার নাচ শেখা।
আজ আবার তুলিকে দেখে তার শৈশবের স্মৃতি ভিড় করে এলো। তার পা যেন গানের তালে তালে নেচে উঠছে। ‘ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে বহে কিবা মৃদু বায়’ গানটার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুনগুন করছে পিউ আর পা দোলাচ্ছে। তুলি একটু গাবলুগুবলু। হাত আর কোমর খুব স্লো মোশানে দুলছে। কিন্তু পিউয়ের হাত কোমর ভালভাবে মুভ করত। ছোট থেকেই সে খুব স্লিম। চটপটে। আজ আবার সেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন ভিড় করে আসায় মনে মনে তার আবার নাচ শেখার ইচ্ছা প্রকট হয়ে উঠল।
ঊষা নৃত্যাঙ্গানে পাশাপাশি দু’টি ব্যাচে নাচের ক্লাস চলে। একটি ছোটদের জন্য। অন্যটিতে বড়দের।
আর দেরি না করে সে পরের দিনই সে এসে ভর্তি হয়ে গেল নাচের স্কুলে।
কিন্তু, বেশি দিন তার নাচ শেখা হল না। নাচ শেখা তার বন্ধ হয়ে গেল। সে অন্তঃসত্ত্বা।
পিউ-এর শ্বশুর বিশ্বনাথবাবু এই খবর পাওয়া মাত্রই ছোটছেলে তন্ময়কে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু, তিনি জানতে পারলেন যে ছোটছেলে বাড়িতে নেই। সেই কবে বেরিয়েছে এখনও বাড়ি ফেরেনি।
কিন্তু তন্ময় কোথায় গেছে তা ছোট বউমার কাছে জানতে চেয়েও কোনও সদুত্তর পায়নি বিশ্বনাথবাবু।
বিয়ের পর থেকেই তন্ময় নিজের ইচ্ছামতো বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। কখন কোথায় যাচ্ছে কাউকে বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
তন্ময় জেলেদের একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় বিশ্বনাথবাবু বড় ছেলেকে সম্পত্তি দিলেও ছোটছেলে তন্ময়কে অনেকদিন সম্পত্তির ছিটেফোঁটাও লিখে দেননি। বিশ্বনাথবাবু বলেছিলেন যে, ছেলে যদি অন্য ব্রাহ্মণ মেয়েকে বিয়ে করে তার সঙ্গে সংসার করে তবেই তার প্রাপ্য সব সম্পত্তি তাকে লিখে দেবেন।
তন্ময় যেদিন ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে করেছিল তার কয়েকমাস পরেই তিনি ছোটছেলের প্রাপ্য অংশটুকু লিখে দিয়েছিলেন ছোট ছেলের নামে।
যেদিন সম্পত্তির ভাগ পেয়ে গেলো তারপর থেকেই তন্ময় প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যে ফিরত সেটাও প্রায় বন্ধ করে দিল। পিউ বরের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় একা একা বসে বসে দিন গুনত। কখনও এমন হয়েছে একমাস পর বাড়ি ফিরে কোনভাবে রাতটুকু কাটিয়ে আবার সকালেই বেরিয়ে গেছে তন্ময়।
পিউ নাচের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল নিজের একাকীত্ব কাটাতে। যেখানেই অনেকটা সময় তার কেটে যেত। কিন্তু সেটাও বন্ধ হয়ে গেল অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায়।
পিউ নাচ শিখত লাবণি দিদির কাছে। পিউ নাচের ক্লাসে আসছে না দেখে লাবণি একদিন চলে আসে পিউ এর বাড়ি। খুব খুশি হয় পিউ। নাচের দিদিকে নিয়ে গিয়ে বসায় তার শোয়ার ঘরে। এমনিতেই বাড়ির লোক সংখ্যা খুব কম। সারাদিন তাকে প্রায় একা একাই উপরের ঘরে বন্দি থাকতে হয়। কাজ বলতে রান্নার সময় একটু আধটু বড় জা’কে সবজি কেটে সাহায্য করা। তাছাড়া তেমন কোনও কাজ করতেই হয় না তাকে। একা একা যেন সময় কাটতে চায় না পিউ-এর।
লাবণিদি’কে বসতে বলে নীচে চা আনতে গেল সে। নিষেধ সত্ত্বেও শুনল না।
একটু পরে একটা চা আর বিস্কুট নিয়ে হাজির।
টি টেবিলে চায়ের কাপ সহ প্লেটটি এগিয়ে দিল পিউ। কাপটি মুখ নিয়ে চুমুক দিতে গিয়ে সামনে টিভির টেবিলে রাখা একটা ফটো ফ্রেমের দিকে চোখ পড়ে লাবণির।
ধীরে ধীরে সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল কাপ হাতে নিয়ে। সে অপলক দৃষ্টিতে ফটোফ্রেমের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
বিস্ময়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ পর লাবণি তাকে জিজ্ঞাসা করে — এই ছবিটা কার!
— আমার বরের।
— মানে! তোর বর? কী করে সে? মাথার ভিতর একটা মুখ খুব দ্রুত ঘুরতে থাকে লাবণির। কিছুতেই সেই মুখ স্থির ছবি হচ্ছে না। অজানা এক আতঙ্কের কালো ছায়া ক্রমশ তার চোখেমুখে ফুটে উঠতে লাগল।
পিউ ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ছবিটা দেখার পর লাবণিদি’র ঠিক কী হল! কিন্তু সে আর নিজে ধৈর্য ধরতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে — ছবিটা দেখে তুমি কেমন অন্যমনা হয়ে গেলে কেন?
লাবণি ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিল না। তাই সে বলে, না তেমন কিছু না। তা তুই বল, কেন ক্লাসে আসছিস না? এদিকে একটা বিশেষ দরকারে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম তোর সঙ্গে একটু দেখা করে যাই।
— না না ভালোই করেছো। আসলে আমি এখন আর যেতে পারব না নাচ শিখতে। ক’দিন খুব মাথাটা ঘোরাচ্ছিল। বড় দিদিকে বলতে সেদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। জানলাম আমি প্রেগন্যান্ট।
— বা! ভালো খবর তো। খুশির কথা। এক কথা মুখে বললেও লাবণি কিন্তু ভিতরে ভিতরে আরও অস্থির হয়ে পড়ল। তার কী করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারছে না। অথচ এদিকে তার কৌতূহল ক্রমশ তাকে অস্থির করে তুলছে।
সে ছবিটার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পিউকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা বোন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো তোকে? কিছু যেন মনে করিস না! আমার ভুলও হতে পারে।
— না দিদি তুমি নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো। তোমার কী জিজ্ঞাসা আছে?
— আচ্ছা তোর স্বামী কোথায় থাকে? কী করে?
— কী করে ঠিক আমি বলতে পারবো না দিদি, তবে বাড়িতে খুব কম থাকে। মাঝে মাঝে আসে আর চলে যায়। অনেক দিন পর বাড়ি ফেরে। তাও ফেরার কোন ঠিক থাকে না।
লাবণির ভাবনা যেন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে……..।
— আচ্ছা দিদি কেন বলতো? তুমি কী তাকে চেনো? ছবিটা দেখার পরই তুমি যেন অন্যমনা হয়ে কী একটা ভাবছো। তুমি দ্বিধা না করে আমায় বলতে পারো, আমি তোমাকে নিজের দিদির মতোই ভাবি।
— না তেমন কিছু না। আবার নিজের চোখকেও অবিশ্বাস করতে পারছি না! একথা বলে লাবণি সেদিন যা দেখেছিল সব পিউকে জানাল।
লাবণিদি’র মুখে সব কথার শোনার পর তার পায়ের তলার এতদিনের অশান্ত মাটিটাও আজ যেন হঠাৎ ঝড়ে বালির মতো নিমেষে উড়ে যেতে লাগল। তন্ময়ের বাড়ি না ফেরার কারণটা পিউ-এর মনে স্পষ্ট ধারণার জন্ম দিল। ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে লাগল পিউ। বুকের ভিতরটা চিনচিন কর জ্বলছে। না আর পারল না নিজেকে আটকে রাখতে। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
লাবণির ঠিক কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারল না। তবে সান্ত্বনা দিয়ে যে কোন লাভ হবে না, সেটা লাবণি একটু হলেও অনুভব করতে পেরেছে পিউ-এর আছাড়া কাছাড় করা দেখে। একটা মেয়ে হয়ে বরং তাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করাই ভালো।
চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে লাবণি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। মনকে শক্ত করার নির্দেশ দেয়। হেরে যাওয়াই জীবন নয়। এসব উপদেশ দিলেও কোন কাজ হয় না। সে ক্রমশই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
সময়। যত সময় গেলো সে ক্লান্ত হয়ে স্থির হয়ে পড়ে। নিজেই নিজের মনকে বোঝাতে থাকে, না যদি লাবণিদি’র দেখা ভুল হয়ে থাকে। এতে মন একটু স্থির হলেও পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে, না লাবণিদি যাকে দেখেছে সেই তার বর। অন্য কেউ হতে পারে না।
কিন্তু, তার মনে পড়ে গত বুধবারই তন্ময়ের একটা ফোন এসে ছিল। খুব ভোরেই না খেয়ে বেরিয়ে গেলো। লাবণিদি বলছিল বুধবারই মানকুণ্ডুর স্কুল মাঠে তার স্কুলের মেয়েদের নিয়ে নাচের প্রতিযোগিতায় গিয়েছিল। সেখানেই তন্ময়ের ছবির মতো হুবহু এক যুবকের সঙ্গে লাবণির দেখা। মানুষকে কী অন্য মানুষের মতো দেখতে হতে পারে না। হতেই পারে। একটু জ্বালা কমল। কিন্তু, তারপর যখন মনে পড়ে তার সঙ্গে একটা বউ ও ৪ বছরের বাচ্ছা ছিল। তখনই ক্রোধ চরমে ওঠে পিউ-এর। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সেই ছবি। লাবণিদি’র দেখা বা স্মৃতি ভুলও তো হতে পারে। ঠাকু্‌র, যেন ভুল হয় লাবণিদি’র দেখা। পরক্ষণে মনে হল, না – এতটা ভুল তার হবে না। কেন না লাবণিদি বলছিল যে, কোথায় ফর্ম ফিলাপ করা হচ্ছে, তা লাবণিকে জিজ্ঞাসা করতে এসেছিল সেই যুবক। তাই ভালোভাবে তাকে মনে আছে। কিন্তু নাম? নাম কী কোন ভাবে জানতে পেরেছে লাবণিদি?
এই সব ভাবতে ভাবতে পিউ লাবণিদি’কে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা ওর নাম কী? আর ওই মেয়েটা যে ওর-ই তা কী তুমি নিশ্চিত?
নাম জানি না। তবে হ্যাঁ মেয়েটা ওর-ই। কেননা শুনিছি মেয়েটাকে বাবা বলে ডাকতে।
আর ভুল হওয়ার কিছুই বাকি নেই। একমাত্র নাম। যদি নামটা জানা যেত – তাহলে এখনই নিশ্চিত হয়ে যেত পারতো পিউ। কিন্তু, কীভাবে তা জানা যাবে!
অনেক পর পিউ-র কান্নায় একটু ভাটা পড়তে লাবণিদি তাকে আবারও ভেঙে না পড়তে নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
পিউ বড় জা-কে গিয়ে সব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানালো। সব শুনে পিউকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে শ্বশুরের আছে গিয়ে জানালো বড় জা।
বিশ্বনাথবাবু খুব একটা অবিশ্বাস করলেন না। কিন্তু, ছেলে যে এতটা বিশ্বাসঘাতকতা করবে সম্পত্তির জন্য সেটাও কল্পনা করতে পারলেন না।
খোঁজ নেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি লোক পাঠালেন বিশ্বনাথবাবু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো লাবণি যা বলেছে তা একদম ঠিক। সেই ব্যক্তিই তন্ময়। তার অন্য একটা সংসার রয়েছে। আগে যাকে ভালবাসত তাকে নিয়েই মানকুন্ডুতে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। তার একটা ৪ বছরের মেয়েও আছে।
বিশ্বনাথবাবু তাদের প্রেম মেনে নেননি। অনেক দিন পর তন্ময় বিয়েতে রাজি হয়েছিল ভেবে বিশ্বনাথবাবু নিজে দেখাশোনা করে ব্রাহ্মণের মেয়ের সঙ্গে ছোট ছেলের বিয়ে দিয়ে ছিলেন। কিন্তু, ছেলে যে এমন করতে পারে সে কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। মুখে তার চুনকালি লেপে দিল ছোটছেলে। রাগে ভিতরে ভিতরে আগুন হয়ে উঠলেও এখন আর তার কিছুই করার নেই। হাতের আঙুল যে কেটে দিয়েছেন সম্পত্তি লিখে দিয়ে।
শ্বশুরের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে পিউ। কেন! কেন আমার জীবনটা নষ্ট করলেন? জেনে বুঝে কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করল আপনার ছেলে?
মেয়েটির কী হবে! কী বা জবাব দেবে ছোট বউমাকে? মাথা পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতে লাগল বিশ্বনাথবাবুর। কোন কথার উত্তর দিতে না পেরে শেষে একান্তে বড় বউমাকে ডেকে বলে যে, এই তো ক’মাস হয়েছে, ওকে অ্যাবরশন করিয়ে নিতে বলো! যা টাকা লাগে আমি দেবো।
শ্বশুর মশায়ের কথা শুনে বিনা মেঘে যেন বজ্রাঘাত পড়ল বড় বউমার, কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। একরাশ কষ্ট বুকে চাপা রেখে বলে, ছি! বাবা ছিঃ। থাক্‌ আপনাকে আর কিছু করতে হবে না।
পিউ কারও কোন পরামর্শ না শুনেই পরের দিন চলে আসে শিমুলতলায় মা-দাদাদের কাছে।

(দুই)
শীতকাল। ছোট বেলা। কোল আলো করে তার সন্তান বাড়তে লাগল। দিন যত পার হয় চিন্তা বাড়ে তত। ছেলেকে কীভাবে মানুষ করবে পিউ। কতদিনই বা দাদাদের রোজগারের টাকায় বসে বসে সে ও তার ছেলে খাবে। তাছাড়া দাদারা বড় হয়েছে। তেমন কোন রোজকারও করে না তারা। এবার বিয়ে করে তাদেরও সংসারী হতে হবে। এত খরচ জোগাবে কোথা থেকে! নিজেকে একটা কিছু করতেই হবে — এটাই সে রাতদিন ভাবতে থাকে।

ছেলেকে নিয়ে দুর্গা দালানে বসে থাকে বিকেলের দিকে। পাড়ার অনেকেই আসে। ভিড় জমে। নানান লোক বিভিন্ন পরামর্শ দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত সব সমাধানের পথ মেশে আদালতের চত্বরে। তাকে অর্থের জন্য আদালতে কেস করতে বলে। কিন্তু পিউ সব শুনে যায় – তার মতামত কিছুই জানায় না।

আরও একটি শীত এসে গেলো। পিউ-এর ডাক পড়ল তার বাবার বন্ধুর বাড়িতে। বাবার বন্ধুর নাতনীকে নাচ শেখাতে হবে।
প্রথম পাঁচমাস একাই নাচ শিখত তিথি।
প্রথম ৫ মাস যাওয়ার পর তার আরও একজন ছাত্রী ভর্তি হল নাচ শেখার জন্য। এইভাবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ১০ জন ছাত্রী হয়ে গেলো তার নাচের ক্লাসে।
কিন্তু, লোকের বাড়িতে তো আর এক সঙ্গে অত সবাইকে নাচ শেখানো সম্ভব নয়। কিন্তু এমন সামর্থও নেই যে কোথাও ঘর ভাড়া নিয়ে নাচ শেখাবে। কাজেই অল্প ছাত্রী নিয়েই তার বাবার বন্ধুর বাড়িতে নাচের ক্লাস চালাতে লাগল।
এর মধ্যেই একদিন পিউ ক্লাস নিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছে ড্রেস চেঞ্জ করছে। তখন ফোনে অচেনা নম্বর থেকে একটা ফোন এলো। প্রথমে ধরেনি। পরে আবার কল ঢুকছে দেখে — তখন সে ফোনটা রিসিভ করে।
ফোন ধরার পর পিউ জানতে পারে যে তার-ই ছাত্রী মৌরী’র মাসির ছেলে তাকে ফোন করেছে। পিউ তাকে চিনতো। কেননা মৌরী’কে নিয়ে ছেলেটি তার নাচের ক্লাসে আসত। এবং নাচ শেষ হলে বাইকে করে বাড়ি নিয়ে যেত তাকে। তবে কোনদিন সেভাবে কথা হয় নি তার সঙ্গে।
পিউ এতদিন তার নামও জানতো না। আজ জানল – তার নাম অবকাশ। বেশ মিষ্টি আর নিষ্পাপ দেখতে তাকে। গলার স্বরও খুব শান্ত আর শীতের দুপুরে নরম রোদের মতো।
কেন অবকাশ তাকে ফোন করেছে পিউ জানতে চাইলে সে জানায় যে তাদের গ্রামের একটি ক্লাব আছে। যেখানে যদি পিউ গিয়ে নাচ শেখায় তাহলে অনেক শিক্ষার্থী পেয়ে যাবে। পিউ একটুও না ভেবেই খুশি হয়ে সম্মতি জানিয়ে দিল।
ছেলে তিন বছরে পড়েছে। এবার লেখাপড়ার খরচ বাড়বে। কাজেই বেশি ভাবলে চলবে না। যত কষ্টই হোক তার রোজকার বাড়ানো দরকার। সে মনে মনে ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালো। ঠাকুর মুখ তুলে চাইলে সব ঠিক চলে যাবে।

পিউ-এর ছেলে এবছর ক্লাস এইট-এ উঠল। অনেক দিন থেকেই পিউ দু’জায়গায় নাচের স্কুল চালায়। ছেলের পড়ানো খরচ নিয়ে তার আগের মতো অতটা চিন্তা হয় না। কিন্তু চিন্তা হয় ছেলেকে একা রেখে নতুন করে ঘর বাঁধার।

(তিন)
অবকাশ পিউকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায়। কিন্তু, পিউ-এর অবকাশকে ভালো লাগলেও বিয়ে করতে রাজি নয়। বন্ধু হয়েই কাটাতে চায়। তাকে সাপোর্ট করার জন্য সে সব সময় আভূমি কৃতজ্ঞ অবকাশের কাছে। আত্মত্যাগের মহিমায় প্রাপ্তিতে সে অবকাশে জন্য ভালো জীবন সঙ্গী খোঁজ করে। কিন্তু, মাহাত্ম্যের গৌরব লোভে বিয়েতে অসম্মতি জানিয়ে পিউ তার ইচ্ছার অপমৃত্যু ঘটাতে চাইলেই কি তা সব সময় ঘটা সম্ভব!
তবুও প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পিউ। কিছুতেই যে পরাস্ত হবে না অবকাশের কাছে। অবকাশের সব যুক্তিকে থামিয়ে দেয় ছেলের অজুহাতে। কিন্তু এই অদৃশ্য বৃহত্তর তৃতীয় হাতটিও যুক্তির বর্ম হিসাবে অস্তিত্ব সংকটে ভোগে — অবকাশ যখন পিউ-এর সন্তানসহ পিউকে নিয়ে ঘর বাঁধার কথা বলে।
পিউ’এর চোখে জল চলে আসে। এত সুখ! না কি স্বপ্ন! পরক্ষণেই ভয় হয়। যুদ্ধ চলে। প্রতিরোধ গড়ে তোলে অবকাশের কথার বাষ্পে।
পিউ-এর থেকে অবকাশ বয়সে তিন বছরের ছোট। পিউ তাকে বাধা দেয়। সে তাকে বোঝায় যে পিউ-এর চেয়ে ভালো মেয়ে পাওয়ার যোগ্য সে। কিন্তু আবেগ তার সুনামি। কোন বাঁধ তাকে আটকাবে।

অবকাশ বাড়িতে মা-কে সব বলে। তার মা রাজি হয়ে যায়। একদিন জোর করে পিউকে বলে তার ছেলেকে তাদের বাড়ি নিয়ে চলে যায়। সেদিন ছিল তার ছেলের জন্মদিন। তাকে বরণ করে ঘরে তোলে অবকাশের মা।

সব কিছুই স্বপ্নের মত লাগে পিউ এর কাছে। দিন ঠিক হয়ে যায় বিয়ের। ১৮ই ফাল্গুন।
কিন্তু, পিউ-এর বুক কাঁপতে থাকে এক অনিশ্চিত আশঙ্কায়! এখনও সে আইনত তন্ময়ের বউ। ডিভোর্স চেয়ে নোটিস পাঠানো হয়েছে তন্মেয়কে। সম্পত্তির জন্য তন্ময় যদি ডিভোর্স দিতে বেঁকে বসে তা হলে কী হবে — এই সব ভেবে অস্থির হয়ে ছেলেকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে পিউ।