
সময় (ছোটোগল্প)
প্রসেনজিৎ রায়
ধর্মপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ …. অনেক বছর পর প্রিয়া ফোন করেছে দেখা করার জন্য। প্রায় ২৮ বছরের বিরতি। জীবনের প্রথম প্রেম প্রিয়া। কলেজ জীবনে যৌবন পূর্ণতা প্রাপ্তি লাভ করেছিল সবুজের এই প্রিয়ার ভালোবাসাতেই। বাড়িতে জানাজানি হয়েছিল; কেউ অমত করেনি। সব মোটামুটি ঠিকই ছিল, সবুজ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর বিয়ে হবে তাদের। কিন্তু শেষ অবধি সেই সময়টুকু পায়নি সবুজ। কলেজ পাশ করতে না করতেই হঠাৎ করে প্রিয়া একদিন জানালো তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে …. সবুজ যাতে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে। সবুজের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল সেদিন। তারপরই প্রিয়ার মোবাইলে যতবার চেষ্টা করেছে সুইচ অফ। তবু এত বছর পরেও আজও ভুলতে পারেনি প্রিয়াকে, নিজের ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছে প্রিয়াকে হারানোর যন্ত্রণাকে। কোনোদিনও ঘৃণা করেনি প্রিয়াকে। তার স্থির বিশ্বাস, হয়তো পরিস্থিতির চাপেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রিয়া। শুধু খানিকটা চাপা অভিমান ছিল প্রিয়ার উপর। কিন্তু গতকাল প্রিয়া যখন এত বছর পর ফোন করে কথা বলল, কথা বলতে বলতে বারবার প্রিয়ার গলা জড়িয়ে আসছিল। বুঝতে পেরেছিল সবুজ, মনের যে অমোঘ টান তার কিছুই কমেনি এতবছরে। চেপে রাখা অভিমানগুলো এক নিমেষে চুরমার হয়ে গেছিল।
২.
জানালার পাশের সিটে বসে আছে সবুজ। রাস্তার ধারের দিঘি, গাছপালা, মানুষজন সব পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে সবুজ কুমারনগরের দিকে, বার বার ভাবনা উঁকি দিচ্ছে প্রিয়ার। মনে পড়ছিল সেই ফেলে আসা দিনগুলির কথা। ফোনে গলা শুনে লেগেছে খানিকটা বয়স বেড়েছে প্রিয়ার। প্রিয়া কি আগের মতই মেকআপ করে নিজেকে সুন্দর রাখতে ব্যস্ত থাকে এখনও নাকি বয়সের ভারে খানিকটা নুইয়ে পড়েছে….? এখনও কি কথায় কথায় কান্না পায় ওর…? রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চাট, ফুচকা খেতে ভালোবাসে ….? সব কি আগের মতই নাকি ২৮ বছর সময়ের ব্যবধানটা যথেষ্ট কারো সম্পর্ক, আচরণ, অভ্যাস সব পাল্টে দেবার জন্য ? এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ রাস্তায় চোখে পড়ল দুই লাভ বার্ড। সবুজ আনমনেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো — “হঠাৎ দেখা” কবিতাটার লাইনগুলো কথা খুব মনে পড়ছিল তখন তার।
৩.
সবুজ কুমারনগরে পৌঁছে দাঁড়িয়ে আছে বাসস্ট্যান্ডে প্রিয়ার অপেক্ষায়। দেখা করতে আসার সময় দেরি করার অভ্যেস আজও প্রিয়া তাহলে ছাড়তে পারেনি। কলেজে থাকতে সবুজ ধর্মপুর থেকে কুমারনগরে বন্ধের দিন যখন প্রিয়ার সাথে দেখা করতে যেত তখনও আসতে এমন দেরি করত প্রিয়া। সবুজ এসব স্মৃতি রোমন্থন করে বেখেয়ালেই মুচকি মুচকি হাসছে। হঠাৎ পেছন থেকে এক অপরিচিত নারীকন্ঠ — সবুজ। এক প্রবল চোরাবালির স্রোত খেলে গেল সবুজের বুকের বাঁ পাশ ভেদ করে। পিছনে ঘুরে তাকালো সবুজ। এক নিমেষের জন্য শক্তিমান সময়ও যেন দাঁড়িয়ে পড়েছিল, বুকভরে স্বস্তি পাবার জন্যে এতদিন পর| একটি গোলাপী রংয়ের শিফন শাড়ি, কপালে লাল টিপ, ক্লিপ বাঁধা চুলে সুসজ্জিতা প্রিয়াকে ২৮ বছর আগের মতোই লাগছিল প্রায়। দুজন দুজনকে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করল এতবছর পর দেখে। এক-দু’টা সাদা চুল আর গালের চামড়া একটু কুঁচকে যাওয়া ছাড়া প্রিয়া আগের মতই সুন্দরী আছে।
খানিক সময়ের অঘোষিত নীরবতা ভেঙে সবুজ বলল — তোমার বয়স বেশি বাড়েনি, আগের মতোই আছো।
প্রিয়া — কিন্তু তোমার একি অবস্থা !
সবুজ — ছাড়ো, চলো পাশের রেস্টুরেন্টটাতে যাই, ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খাই। আর বসে কথাও বলা যাবে। প্রিয়া প্রস্তাবে নিঃশর্ত সায় দিল।
কথায় কথায় বারবার জল আনাগোনা করছিল দুজনের চোখের কোণায়।
প্রিয়া — বিশ্বাস কর সবুজ, তোমাকে ঠকাতে চাইনি, বাবার হঠাৎ করে ক্যান্সার ধরা পড়ল আর তোমার তখনও কিছু হয়নি…।
সবুজ মাঝপথেই থামিয়ে বলল, থাক, অতীত যখন বিরহের তখন ঘাঁটাঘাঁটি নাই বা করলাম।
প্রিয়া নীরব হয়ে রইল।
৪.
কথায় কথায় প্রিয়ার সংসারের গল্প শুনল সবুজ। কীভাবে স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে গোছগাছ সংসার গড়েছে প্রিয়া — শুনে মনে মনে আক্ষেপ হল সবুজের।
প্রিয়া — আজ তোমাকে আসতে বলেছি বিশেষ কারণে, আমার একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে।
সবুজ — কি, বলো।
প্রিয়া — তোমার ছেলে আকাশ যে একটি মেয়েকে ভালবাসে নিশ্চয়ই জানো।
সবুজ — হ্যাঁ মৌ-আকাশ সব শেয়ার করে আমাকে। কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে?
প্রিয়া — মৌ আমার মেয়ে।
সবুজ থমকে গেলো কিছুক্ষণ উদ্ভূত পরিস্থিতির আকস্মিক পট পরিবর্তনে।
প্রিয়া — মৌ এর কাছে আকাশের পরিচয় শুনে বুঝতে পেরেছি তোমার ছেলে সে। আমার উপর অভিমান করে তুমি যদি বিয়েটা ভেঙে দাও এই ভয়ে তোমাকে আমি সবার অজান্তে অনুরোধ করতে এসেছি। খুব ভালোবাসে দুজন দুজনকে।
সবুজ হেসে বলল — নিজের দুর্ভাগ্যের দায় তোমাকে দিয়ে দুটি প্রেমকে গলা টিপে হত্যা করব এমন নির্দয় নই আমি। তুমি চিন্তা করোনা। কিন্তু তোমাকেও একটা কথা বলার আছে।
প্রিয়া — কি কথা ?
সবুজ — আকাশ আমার ছেলে নয়, আমার দাদার ছেলে, ওর যখন ২ মাস বয়স এক দুর্ঘটনায় দাদা-বৌদি মারা যায়। তখন থেকেই আকাশ জানে সে আমার ছেলে, তার বাবা-মা মৃত — এই সত্যিটা যাতে সে কোনোদিন না জানে তাই কমলনগর ছেড়ে চলে এসেছি ধর্মপুর যেখানে কেউ আমাদের চেনে না।
প্রিয়া চোখে জল নিয়ে বলল — মানে তুমি বিয়ে…।
সবুজ থামিয়ে বলল — কি হবে বিয়ে করে ? আকাশকে নিয়ে সত্যি খুশি আছি।
প্রিয়া — তোমার জীবনটা সত্যি নষ্ট করেছি আমি।
সবুজ হাসে — আরে, সত্যি আমার আক্ষেপ নেই। আর এখন মৌ মা এসে আমার দেখাশুনা করবে, আর বৃদ্ধ বয়সে কি চাই ? হয়তো এই বড় প্রাপ্তির জন্যই সেদিন তোমাকে হারাতে হয়েছিল। সময় কি নেবে কি দেবে কেউ বলতে পারে না। তুমি অযথা চিন্তা না করে মৌ মাকে তাড়াতাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করো। হাত পুড়িয়ে আর কত রান্না করবো?
প্রিয়া — যাক আমি নিশ্চিন্ত।
হঠাৎ প্রিয়ার মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোন রিসিভ করে বলল — আসতে একটু দেরি হবে, একটু মার্কেটিং এ বেরিয়েছিলাম। তুমি মৌকে নিয়ে খেয়ে নাও।
সবুজের বুঝতে অসুবিধা হল না ফোনটা কার ছিল। দেরি না করে উঠে দাঁড়াল সবুজ — এবার যেতে হবে।
প্রিয়া — আরও একটু বসে গেলে হয় না ?
সবুজ — ভিত্তিহীন মায়া বাড়িয়ে কি লাভ ?
এই প্রশ্নের উত্তর প্রিয়ার কাছে নেই, আর কোনোদিন হয়তো পাবেও না।
প্রিয়াকে বিদায় জানিয়ে বাসে উঠল সবুজ। জানালা দিয়ে দেখল প্রিয়া অশ্রুসিক্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। যার প্রতিটি চোখের পলকে ফুটে উঠছিল কোনো এক না পাওয়ার যন্ত্রণা। আর সবুজ ? সে তো নিজের যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখতে সিদ্ধহস্ত অনেক আগে থেকেই …. হয়তো এটাই তার অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিতব্য।